জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-৯/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 
ছায়া ছায়া অন্ধকার 

শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল 

পর্ব :৯ 

প্রতিদিনের মতো আজও মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন সন্ন্যাসিনী। সঙ্গে আরও দু'জন। স্বরূপানন্দজির মতোই দৈনন্দিন আনন্দমেলা যাওয়া তাঁর অভ্যেস। এতে শরীরচর্চা হতো। দুটো আশ্রম দেখভাল করাও হতো। মানুষজনের সঙ্গে দেখা এবং কথা হতো। 

ফেরার সময় খুব জলতেষ্টা লাগছিল তাঁর। হাত দেখিয়ে সঙ্গী দু'জনকে থামতে বললেন তিনি। লক্ষ্মী ঝর্ণার কাছে এসে একটুক্ষণ বসলেন। জিরিয়ে নিলেন। দুহাত ভাল করে ধুয়ে, আঁজলা ভরে জল তুলে তুলে খেলেন। এমন অবসন্ন সন্ন্যাসিনীকে সাধারণত কেউ কখনও দেখেনি। বাইরে থেকে দেখেও কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। সঙ্গে থাকা একজন বললেন, 'মা। আপনার কী শরীর খারাপ করছে? তাহলে, এখানেই একটু বিশ্রাম নিন। আশ্রমে ফিরে গিয়ে সাইকেল বা মোটরগাড়ি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি।'
মাথা নাড়ালেন সন্ন্যাসিনী। বোঝাতে চাইলেন তার আর দরকার নেই। তিনি হেঁটে হেঁটে নিজেই যেতে পারবেন। মুখে বললেন, 'না না। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু করতে হবে না । চল আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই।' 

শরতের সকালে মিষ্টি রোদ উঠেছে। মাঠ ভর্তি সবুজ ধানের খেত। পাহাড়ের গা বেয়ে থাকা গাছগাছালি সব বর্ষার জল পেয়ে সবুজ, ঘন সবুজ হয়ে পর্দা বিছিয়ে রেখেছে যেন। ঘাসের উপর চলতে চলতে পায়ের পাতায় শিশিরের আর্দ্রতা অনুভূত হয়। অসীম শূন্য নীল আকাশের গায়ে ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোর মতো মেঘ। এত মনোরম আবহে এক ভয়ানক মনখারাপ নিয়ে চলেছেন সন্ন্যাসিনী। তাঁর সঙ্গীরা যতবারই জিজ্ঞেস করেছে, প্রতিবারই এড়িয়ে গেছেন তিনি। কয়েকদিন আগের ওই রাত্রির ভয়ানক ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না সন্ন্যাসিনী। ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন তারপর থেকে। 

অনেক রাত্রি তখন। চারপাশ নিস্তব্ধ। কীভাবে সন্ন্যাসিনীর শয়নকক্ষে এসে ঢুকে পড়েছিল , দীর্ঘদেহী কদাকার এক মানুষ! কালো গায়ের রং। কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। মোটা গোঁফ। লাল রঙের ফেটি মাথায়। কানে দুল। হাতে ধারালো ভোজালি। হ্যারিকেনের অল্প আলোর আভায় চকচক করছিল। প্রায় সংজ্ঞাহীন হওয়ার জোগাড়। ভয়ে তাকাতে পারছিলেন না সন্ন্যাসিনী। 

'এই আশ্রমের ইতিহাস জানো তো ? তোমার আগে স্বরূপানন্দজি ছিলেন। আমার সঙ্গে কথার মিল হয়নি। আমি যা চেয়েছিলাম দেননি। কী করেছিলাম জানো তো ? এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম।'
গলায় এক তীব্র আক্রোশ। আবারও বলে যাচ্ছে ওই বিকট চেহারার লোকটা। 'আমি এই জঙ্গলের রাজা। ডাকাতদের সর্দার। পুলিশ আমার নাম শুনে কাঁপে। আমি পরোয়া করি না কাউকেই।'
সন্ন্যাসিনী কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। কাঁপছিলেন ভয়ে। লোকটি তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। সে একাই বলে যাচ্ছিল, 'আমি সব জানি। আমি জানি স্বরূপানন্দজির আসল পরিচয়। তাঁর প্রকৃত নাম। কী ভাবে তিনি এসেছিলেন এখানে, কেন এসেছিলেন, আমি সব জানি। নেপাল বর্ডার থেকে গাদা গাদা টাকা আসত।'
সন্ন্যাসিনী ধরা পড়ে যাবার ভয়ে হাত জোড় করে বসেছিলেন।
লোকটা তখনও শান্ত হয়নি। 'স্বরূপানন্দজির সঙ্গে টাকার ভাগে গন্ডগোল হয়েছিল। ব্যস। সরিয়ে দিলাম। ধান্দা কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ঠিকই। তারপরও তো চলছে। ডিকে শর্মা তো নিশ্চয়ই সব বলেছে।'
এবার সাহস করে সন্ন্যাসিনী বললেন। খুব নিচু গলায়। কাঁপা কাঁপা আওয়াজে।
'আমার কাছে কী চান আপনি?'
'তোমার পরিচয়? কেন এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছো!' 
'পিন্টু কিছু বলেনি আপনাকে?'
'পিন্টু নয়। পিন্টু নয়। ডি কে শর্মা বলো। আমি কিন্তু শর্মা বলেই ডাকি ওকে। ওইটুকু বেঁটে লোকটার ক্ষমতা দেখেছো! এতবড় কাজকারবার দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে! ও যা বলেছে, তা কি সত্যি?'
'কী বলেছে?'
'তোমার ব্যাপারে সব কথাই বলেছে। সব। আমি তোমার কাছ থেকে, তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। তাই এসেছি।'
সন্ন্যাসিনী বুঝতে পারেন আর পালাবার পথ নেই। বাধ্য হয়ে এবার বলতে শুরু করেন।
'হ্যাঁ। বিজয় মহাপাত্র আমার বাবা। মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। আমিও আর শিলিগুড়ির আশ্রমে থাকতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে এখানকার ডাক্তারবাবু, আকাশের সঙ্গে ভাগ্যক্রমে আলাপ হয়। তাঁর কাছেই জানতে পারি এই আশ্রমের কথা। চলে আসি। এসে বুঝতে পারি বাবা এখানেই ছিলেন। আমার তো বাবা মা আর কেউ রইল না।'
গলা বুজে আসছিল সন্ন্যাসিনীর। একটা ধমক দিয়ে উঠল লোকটা। 'চুপ করো। ওইসব ন্যাকা কান্না কাঁদবে না। ধান্দার কথা বলো। শর্মা বলল তুমি নাকি আমাকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে চাইছো। সিকি ভাগও দিতে চাইছো না। সিক্সটি ফরটিতে একদমই রাজি নও। তুমি তো খুব ছোটলোক আছ! টাকা দেখেই পুরোটাই নিতে চাইছ। এটা তো আমি হতে দেব না। আমার এলাকায় কারখানা চলছে। শর্মাকে এতদিন ধরে রক্ষা করে আসছি। আমার সিক্সটি ফরটি ভাগ এতদিন পেয়ে আসছি। আমি ছাড়ব কী করে? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, যদি কোনও রকমের চালাকি করো, আমার ভাগে ভাগ বসাও, তোমাকেও আমি তোমার বাবার পথ ধরিয়ে দেব। এটাই শেষ কথা। দুদিন ভাবো। শর্মাকে বলবে আমার ভাগ যেন ঠিকঠাক রেখে দেয়। চলি !' 

এই কথা বলেই পালিয়ে গেল লোকটা। গর্জন করে লাফিয়ে যেন এইমাত্র একটা সিংহ চলে গেল। এক বিভীষিকাময় রাত্রির, এক ভয়ানক রাত্রির ভয়াল স্মৃতি যেন কিছুতেই পিছু ছাড়তে চাইল না সন্ন্যাসিনীর। 


ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়। এটা শুনেছি। প্রত্যক্ষ করলাম। কিন্তু এমন পুনরাবৃত্তি দেখার কোনও আশা স্বপ্নেও ছিল না। এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। কিন্তু এই ঘটনা অনেককিছুর ইঙ্গিত করছে।  অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অনেক 'কিন্তু', 'যদি' নিয়ে আসছে মনের ভেতর। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি। উত্তর পাই না। 

চারিদিকে বিরাট হৈ চৈ পড়ে গেল। এটা অসম্ভব। কেউ মানতেই পারছে না। আমি আকাশের মনের অবস্থা ভাবছি। ভাবছি নয়না এবং শিবনারায়ণবাবুর কথাও। 

পুলিশ এসেছে আশ্রমে। পঞ্চায়েত প্ৰধান বিমান, পার্টির নেতা মলয় থেকে শুরু করে অনেক লোকজন এসে হাজির। আমি আর আকাশ সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছি। 

আজ থেকে অনেক বছর আগের সেই দিন, দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে। স্বরূপানন্দজির তীরবিদ্ধ শায়িত নিথর দেহ। মা কালীর মন্দিরের সামনে রাখা। আর আজ ঠিক একই ভাবে, সন্ন্যাসিনী অঞ্জলীর নশ্বর নিথর তীরবিদ্ধ দেহখানি ঠিক মা কালীর মূর্তির সামনেই শায়িত।

Post a Comment

0 Comments