জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-৮/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার 

শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল



পর্ব : ৮ 

সূর্যের পশ্চিমে ওঠার মতোই এই ঘটনা। শিবনারায়ণবাবু নিজে আজ এসেছেন আমাদের বাড়িতে! অনুশীলা চলে যাওয়ার পর কোনোদিন আমি শিবনারায়ণবাবুর মুখ দেখি না। দেখা অবশ্য এমনিতেই হয় না। রাস্তায় দেখা হলেও আমি চোখ তুলে দেখি না। কিন্তু আজ তো নিজে এসেছেন। সঙ্গে এসেছে তাঁর বৌমা। আকাশের স্ত্রী। নয়না। একটা একগুঁয়ে মানুষ, যে কখনও নিজেকে বাঁকাতে শেখেনি, যাঁর অবিমৃষ‍্যকারীতায় আমার জীবনপথ বদলে গেছে, তাঁকে আমি ঘৃণার চোখেই দেখি। বাবার বন্ধু। বয়স্ক মানুষ। সেটুকুর জন্যই বাইরের সম্মান রাখা। শিবনারায়ণবাবুর সেই ধোপদুরস্ত পোশাক, চেহারা সব এখন ম্লান। ওঁরা আমার সঙ্গেই কথা বলতে চান এখন। 

আমি কিছু কথা বলিনি। শিবনারায়ণবাবু হাত জোড় করার ভঙ্গিতে আমার দিকে চাইলেন। যেন ক্ষমাপ্রার্থী দাঁড়িয়ে আছেন ক্ষমা ভিক্ষার জন্য। নিজের অন্যায়ের জন্য বোধহয় তিনি নিজে অনুতপ্ত। নয়না চেয়ে আছে অপলক। কিছু বলবে।বা বুঝতে চেষ্টা করছে।
আমি নিস্পৃহ গলায় বলি,' কাকু। বলুন। কী বলতে চান?এভাবে বাড়িতে না এসে আমাকে ডাকতে পারতেন। আমি নিজেই যেতাম। আকাশ তো কালই এখানে এসেছিল।'
'সেই ডাকার অধিকার কই? সেই সম্মান তো আমি রাখিনি কেশব। অনেক অন্যায় হয়ে গেছে যে জীবনে।' বলতে বলতে থামেন। আবার বলেন, 'আকাশকে বাঁচাতে হবে। আমি সে জন্যই এসেছি।'
'আকাশ! কেন ? কী হয়েছে আকাশের?'
নয়নার মুখ চান শিবনারায়ণ। নয়না শিবনারায়ণের। আমি বুঝতে চেষ্টা করি।
'আসলে, কথাটা খুব লজ্জার। বলতেও আমার লজ্জা করছে। তুমিও আমার পুত্রসম। তবে আমি জানি একমাত্র তুমিই পারো এই সাংঘাতিক সমস্যা থেকে আকাশকে মুক্ত করতে। ওকে বিপথ থেকে সঠিক পথে আনতে। ও তো তোমার কথাই শোনে। তোমার পরামর্শ মানে।'
আমি আন্দাজ করলাম কী বলতে চাইছেন। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, 'আরও খুলে বলুন। আমি হয়তো কিছু বুঝতে ভুল করছি। বা বুঝতেই পারছি না।'
নয়না শুকনো মুখে আমার দিকে চেয়ে বলল, 'কেশবদা, একজন নারীর কাছে একথা বলা লজ্জার। তার চেয়েও বেশি কষ্টের। তুমি তো তোমার বন্ধুকে সবচেয়ে বেশি চেনো। আমি তো ওর জীবনে মাত্র এই কিছুদিন। কিন্তু তুমি তো ছোটবেলা থেকেই ওকে চেনো। তুমি যদি ওকে, আশ্রমের ওই মহিলার কাছ থেকে দূরে রাখতে না পারো তাহলে আমাদের সংসারে এক বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। আমি হয়তো আর থাকবোই না। সংসারে না। এই পৃথিবীতেও না।' 

নয়না কাঁদছে। অনুর মুখ মনে পড়ে আমার। কেন জানি না। সেও এক অজ্ঞাত ভয় থেকে, সামাজিক লজ্জা থেকে,  ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয় থেকে এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে। একটা ভুল পদক্ষেপ জীবন বদলে দেয়। আমার জীবন বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে আরও অনেকের জীবন। 

সবকিছুই এখন আমার কাছে জলের মতো পরিস্কার। আমি ওদেরকে বললাম, 'আমার উপরে যখন এত বড় দায়িত্ব দিলেন, আমি নিশ্চয়ই পালন করব।' 

বাবা বাড়িতেই ছিলেন। শিবনারায়ণবাবুকে পেয়ে বেশ আনন্দের সঙ্গে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বাবাও আকাশের ব্যাপারে কানাঘুষো শুনেছেন। গ্রামের পরিবেশটাই তো এমন। নদীর এপারে ঢেউ উঠলে অন্যপাড়ে শোনা যায়। সবাই সবকিছু জেনে যায়। নয়না আমাকে এবার আরও একটু স্পষ্ট করে বলল, 'দাদা। তুমিই পারবে আকাশকে বোঝাতে। ও যে প্রচন্ড পাগলামি শুরু করেছে। আমার বাচ্চার কী হবে ? এরকম চলতে থাকলে, আমি ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব সবদিনের জন্য। আর কোনোদিন ওর মুখ দেখব না। ছিঃ। একজন স্ত্রীর পক্ষে এ অসভ্যতা সহ্য করা কত অপমানের!'
নয়নার কথায় ভয়। সেখান থেকে দুঃখ। তাকে অতিক্রম করে ক্ষোভ। নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনিবার্য অঙ্গীকার।
সত্যিই তো। এভাবে তো চলতে পারে না। আমি কারোর কথা বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না। 

সন্ন্যাসিনী স্বরূপানন্দজির পথই যেন অনুসরণ করছেন। তাঁরও বেশ কিছু ভক্ত তৈরি হয়েছে। বাইরের লোকের আনাগোনা বেড়েছে। দু'তিন জন সঙ্গী করে প্রতিদিন অনন্দমেলায় মর্নিং ওয়াকে যান। আশ্রমের কালী মায়ের মন্দিরে পুজোপাঠ শুরু হয়েছে। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, ইতিহাস বোধহয় ফিরে এসেছে। ভয়ও হয়। তাই সতর্কও থাকি। 

কিছুদিন আগে সন্ধেবেলা  আশ্রমে গিয়েছি। একা। লাইব্রেরিতে একটু পড়াশুনো করে বাড়ি ফেরার প্ল্যান আছে।আরতি করে সন্ন্যাসিনী নিশ্চয়ই ভেতরে বিশ্রাম করছেন বা ধ্যানে বসেছেন। এমনই তাঁর অভ্যাস। আমার কেমন একটা কৌতূহল হল। লাইব্রেরিতে ঢোকার আগে আশ্রমের মূল প্রাসাদে গেলাম। এখন সন্ন্যাসিনী অনেকগুলো ঘর আস্তে আস্তে দখল করেছেন। যেহেতু এলাকায় আগের মতোই কাজ হচ্ছে তাই পার্টি থেকে বা আমাদের কারোর পক্ষ থেকে তেমন আপত্তি জানানো হয়নি। প্রত্যেকের অবাধ যাতায়াত এখন। 

গিয়ে দেখলাম সন্ন্যাসিনী নেই। নিশ্চয় ধ্যানে বসেছেন। আমি লাইব্রেরিতে ফিরে এলাম। রাত্রের হ্যারিকেনের আলোয় লাইব্রেরিতে পড়াশুনো চলে। লাইব্রেরিতে ঢুকতে গিয়ে আটকে গেলাম। ভেতরে ফিসফিস আওয়াজ আসছে। একটু থমকে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার কান খাড়া। চোখের দৃষ্টিও সামনে। আতশকাঁচের মতো কিছু খুঁজছে। আর সত্যিই, আমাকে অবাক করে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। তার মানে, লোকজন যা বলে, তা সত্যি! সন্ন্যাসিনী আসলে কিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। আকাশই তাঁর শিকার। নাকি আকাশই তাঁকে নিজের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করেছে। কে, কে এই সন্ন্যাসিনীর বেশধারী মহিলা? কী তাঁর উদ্দেশ্য? আমার মনে প্রশ্ন জাগে। 

আলিঙ্গন শেষ করে ওরা একে অপরের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানোর পর আমি ইচ্ছে করেই আওয়াজ দিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ওরা বিন্দুমাত্র চঞ্চল হয়নি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, একটুক্ষণ আগে এমন ঘটনা ঘটেছে। আকাশকেও কত সহজ লাগছে। সন্ন্যাসিনীর আচরণেও কোনও অসঙ্গতি নেই। দুজনেই পড়ার টেবিলের দুপাশে দুটো বই নিয়ে বসেছে। 

আমি যেন অপ্রাসঙ্গিক এখানে বা আমার উপস্থিতি এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত। ওরা কি রাগ করল? কিন্ত আমি তো লাইব্রেরির প্রাত্যহিক সদস্য। বরং ওরা নয়। ওরা কখনো কখনো আসে। আমিই প্রথম কথা বললাম। আকাশকে লক্ষ্য করে।
'আজ হঠাৎ লাইব্রেরিতে ? তোর তো পরে নাটকের রিহার্সালে আসার কথা!'
আকাশের হাসিমুখ। 'চলে এলাম। সারাদিন রোগী দেখতে দেখতে ক্লান্ত। কিছু ছোটগল্প পড়ে মন ভালো করার জন্য এসেছি। ভালোই হল। তুইও এসে গেছিস। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্পও করা যাবে।'  সন্ন্যাসিনী শুনছিলেন আমাদের কথা। তাঁর শুভ্র পোশাক। খোলা চুল। কপালে চন্দনের তিলক। হ্যারিকেনের তামাটে আলোয় ওঁর ফর্সা চেহারায় এক অদ্ভুত আভা বেরিয়ে আসছে। ওঁকে লক্ষ্য করে বলি, 'আপনি তো সেদিন আকাশকে খুঁজছিলেন। আমি ওকে বলেছিলাম সে কথা। মনে হয় আকাশ আমাকে না জানিয়েই তাই আপনার কাছে একা একা এসেছে। ওর আজকাল আধ্যাত্মিক জগতের দিকে টান বেড়েছে!'
আকাশ শব্দ করে হাসল। সন্ন্যাসিনীর মনে হয় সেটা পছন্দ হল না। একবার আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশের হাসি থামল। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'আপনার বুঝি আধ্যাত্মিক জগতে টান নেই। আপনি নাস্তিক?'
আমি বললাম, 'আমি নাস্তিক কি না বলতে পারব না। তবে আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীতে সর্ব শক্তিমান কেউ আছেন। যিনি অদৃশ্য থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন।'
এবার হাসলেন সন্ন্যাসিনী। 'তার মানে, আপনি নাস্তিক নন। প্রমাণিত হল।' 

লাইব্রেরিতে আমাদের পড়া আর কিছু হল না। আমি পড়তে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ আগের দৃশ্যটা বারবার চোখে ভেসে উঠতে লাগল। নাটকের রিহার্সাল করে একসাথে আমি আর আকাশ বাড়ি ফিরলাম।


নয়না কাঁদছে। ওর কান্নার শব্দে আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমার কষ্ট হল খুব। নয়না বলল, 'জানো কেশবদা, আকাশ যখন শিলিগুড়িতে ছিল, ও বলেছিল এমনই এক মহিলার কথা। তখন ভেবেছিলাম ডাক্তারের কাছে এমন রোগী তো কতই এসে থাকে। পরে বুঝেছি, আকাশের জন্যই, আকাশের মদতেই ওই মহিলা এখানে এসে উপস্থিত। আকাশ সব শেষ করে দিল!' 


ঠিকই তো। আকাশ আমাকে চিঠিতে লিখেছিল এমনই একজনের কথা। ঘটনার পরম্পরা বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মহিলাই অঞ্জলি। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। কী হবে এবার ! কী করে আকাশকে ফেরাব? 

আমি নয়নাকে বলি, 'কেঁদো না। আকাশ ভুল বুঝতে পারবে।অনুশোচনা করবে। অনুতপ্ত হবে। ফিরে আসবে তোমার কাছে। আমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। কথা দিলাম।' 

আজকের মতো নয়না চলে গেল শিবনারায়ণবাবুকে নিয়ে। আমি তো কথা দিয়ে ফেললাম। আমার কাজ বেড়ে গেল। 

আমার জেদ বেড়ে যায়। আমি চাই সব কিছু ঠিক হয়ে যাক। আমি ঠিক করবই। আকাশকে বাঁচাতে হবে। নয়নাকে বাঁচাতে হবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments