জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /(উৎসব ১৪২৮)/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

গুচ্ছ কবিতা 
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া


বাতিঘর 

কুলকুলোতী পাঁচ এয়োতি গুয়াপান হাতে
গোল হয়ে ফুঁ দিই লালপাড় আলতার ছাপে
আর পিদিমের নীচে পাঁচ কুনকে আন্ধার
কড়ি খেলে গোপন পয়ারে
আমি কি ব্রতকথা লিখি চৌকাঠ?
বরজে ঢুকতে মানা
আমি কী ব্রতকথা গড়ি পানপাতা?
পারনের রাতে শুধু এই খড়িআঁকা
আলপনা হাত সাতটি তারার গায়ে
উদাসীন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে রাখে
জলের ওপর দিয়ে, স্থির জলের ওপর দিয়ে দিয়ে
সাঁকো পেরিয়ে যায় নিশুত চাঁদ
হাওয়ায় হাওয়ায় তুমি প্রবণতা লেখো
বাতাসের দোরে ভারি পায়চারি শুনি
ক্ষমা নেই ক্ষমা নেই ডাকতে ডাকতে
রাতপাখির মতো উড়তে চেয়েছি যত,
পুড়ে গেছে রসাতল আমার
দ‍্যাখো এই ছাইমাখা ঠোঁট
পদ্মবীজে তবু বসেছি ভ্রমর
প্রদীপে প্রদীপে ভাসে অন্ধকার
রূপময় দরিয়া অগাধ, তুমি তার বাতিঘর
ডাঁয়ে বাঁয়ে আলো-অভিমুখ
শ্লোকে অন্ধ চোখ তবু শোনো,
উদাসীন আলোর ঝলক
ব্রতর দুব্বো হাতে ফিরে গেছি বহুবার
ঘূর্ণ‍্যমান আলোয় আলোয়
জলের অন্ধকারে জল হবো ফের
নক্ষত্রের ইশারাও শুনবো না আর...


  ব্রহ্ম কমল   

জেগে থাকে এই গ্ৰাম
কামিনী ধানের ঝাঁপি খুলে
কড়ি খেলে যুবতি মেয়েরা
উলু দেয় প্রহরের রাতে
শুনে শুনে ঘুম নেই তারও
নির্জন হাওয়ার বেদিতে
কালো পাথরের লিঙ্গ জেগে থাকে একা
জোয়ারের কালে
নিরম্বু উপবাসে এয়োতিরা দুধ ঢেলে দিলে
গ্ৰামীন দেবতার পাশে কাঁসরঘন্টার চাঁদ বেজে ওঠে
গোলা সিঁদুর ও নীল দুধে যোনি ভিজে যায়
মুর্ছিত এয়োদের শাদা বুকে ধুলো জ্বর উঠে উঠে আসে
ভরা কলসে রক্তমুখী ফুল পড়লেই
ঘোর উন্মাদিনী ধুধু নাচে চিরে দেয় ঘাসের আকাশ
ঝলকেই বিদ্যুৎ! মূর্ছনা হয়
কোমল বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে ব্রম্ভান্ড
মন্ত্রমুগ্ধ ও ঈশ্বর আবডাল খোলো পাথরের
করুণ ধূপের সাথে উঠে এসো
গোঙা ও অন্ধ যত উন্মাদ শরীরে আজ
ভাসাও ভাসাও ওই অশ্রু বীজের শাদা স্রোত
তবু পরমাদজনিত রাত পাথরের থান থেকে ওঠো
চিতাকাঠ থেকে উঠে এসো পোড়া আংরা যত
অরণ্য স্মৃতি নিয়ে ফিরে এসো
দ‍্যাখো জাতিস্মর এই গ্ৰামে
লাল পাড় যুবতিরা ব্রহ্মকমল হয়ে ফোটে
পাথরের ঘুমজল টলমল শালুক ডাঁটায়...


 আম্রপালি 

পাখিদের কান্না থেকে গড়িয়ে আসা আনম্র এই রাত
জেগে থাকা ডালপালা মেলে ধরে জোছনার হাত
ত্রিযামা প্রহর হাতে ভিক্ষুর নিথর ভ্রমণ
হাওয়া তবু হাওয়া আসে জেতবন পেরিয়ে শ্রমণ
পারমিতা অক্ষর ডানা মেলে মানসভূমির বহুদূর
পুথির আকাশে জল, ভিজে যাচ্ছে রেণু-স্বপ্ন-উজ্জয়িনীপুর
পরমা রাত্রি জেনে নাগরিক গিহগুলি ঘিরে
গোরোচোনা হাত রেখে অধমুখ গহপতি গেছে গিহে ফিরে
ধ‍্যানের ও মুখ থেকে আয়ুস্মান, নর্তকীর কাছে
শুনে যান,প্রকৃতির আরও কিছু দেয়া নেয়া আছে
জনপদনারীটির চোখে যে বিজুরি চমকায়
ময়ূরী মুদ্রায় বিষাদের উল্টোমুখে যে নৃত্যের রথ,
আমি তার সারথি!ভাসমান শূন্যে তবু
আমারও রয়েছে কিছু নিজস্ব পথ
আমি যদি বহুকল্প মর্ম জুড়ে নির্বাসিত প্রাণ
নিকায় ও সূত্রের আপনিও প্রহরী তবে
নিজেকে প্রশ্ন করুন আজ মহাজ্ঞান
শাদাডানা শিখা জুড়ে রেখে যাই
প্রদীপে এই রৌদ্রভরাচোখ
সংঘের শরণে যাবো তথাগত মন্ত্র ছুঁয়ে
পৌঁছোবো ভিক্ষুণী,ভস্মমাখা পুথির শোলোক
দীপগাছা জ্বেলে দিই,নিজেরই নিজেরই
এ উন্মাদ তীক্ষ্ণ আলোক
আশরীর ঘৃণা-দুঃখ তবু ভিক্ষু,আগুনকোরক
নাচনীর বাঁকা ঠামে স্ফুলিঙ্গ উত্থিত হই...
আমিই সে! জেনে প্রভু দেখে নিন,
পৃথিবীও লোকাতীত আনন্দলোক….
                                            
                                     
সর্পমস্তা 

চাঁদের কলস মাথায়
কাঠের স্তম্ভ থেকে নেমে দাঁড়ালেন দেবী
আদিবাসী গ্ৰামের পদ্ম দীঘিতে
জোছনার ভর হয় হাওয়ার বেদীতে
পদ্মের ডাঁটি বেয়ে নেমে যান পাতালছায়ায়
প্রাচীন বাতাসের ঈশ্বরী তিনি
বায়ু নিয়ন্ত্রণই তার শক্তি
উথাল পাথাল ঢেউয়ে রক্ষা করেন মন পবনের নাও
দিক রচনায় তিনিই ধ্রুবা
নিখোঁজ নাবিকের কম্পাসে নক্ষত্র আঁকেন যখন
আলোর গন্ধে গুনগুন করে তার ঠোঁট
রাতের ফাটলে ফুঁসে ওঠে চিরল জিভ
তিনি অভয় করেন
এক হাতে সান্ত্বনা দেন অন্ধকার নদী
ধারালো চিতা উশকে দেন আর হাতে
রক্তাভ আঙুলে তারাদের আকন্দ ফুল ফোটে
নৌকোর গাঢ় শ্বাস,দাঁড়ের আঘাত
বোঝার আগেই ঘন কৃষ্ণ ফনা ধরে রাত
কামিনী ঝোঁপের নীচে প্রত‍্যেকবার
ছোবলের আগের মুহুর্তে তার
ছেঁড়া মেঘে নির্জন খোঁপা খসে যায়
সুবাতাসের দেবী তিনি
হেসে ওঠেন সৌরভের হাওয়ায়
শিরায় শিরায় বহে যাওয়া নীল বিষ
ভরে ওঠে দুধজোছনায় ...


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
                 



  

                    

Post a Comment

0 Comments