জ্বলদর্চি

সুতোয় বাঁধা পুতুল-১(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/সুমন মল্লিক

সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক


পর্ব – ১


প্রথম অধ্যায়

সকাল থেকে একটাই লাইন লিখে বসে আছে বিহান : জানতেও পারলে না তুমি কী করে গেছ৷ তারপর আর কিছু লিখতে পারছে না৷ কথারা ভিড় করে আসছে, অথচ লিখতে পারছে না কিছুই৷ মাঝে মাঝেই বিহানের এরকম হয়৷ একটা লাইন বিদ্যুতের মতো আছড়ে পড়ে৷ কিন্তু তারপরের লাইনটির জন্য বসে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা৷ তবে আজ একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল৷ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে থেকেও এলো না সেই দ্বিতীয় লাইন৷ অথচ কথারা মাথার ভেতর ঢেউ তুলছে৷ বুকের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে স্মৃতির সাম্পান৷ এরকমও হয়? এরকমটা কেন যে হয়! জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে, মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবে বিহান৷

     বিহান সরকার এই সময়ের একজন সুপরিচিত কবি৷ মধ্যবয়সেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে৷ দু’টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে৷ পাঠকপ্রীতিও ভালোই পেয়েছে বলা যায় অল্প সময়ে৷ যদিও বাড়ির কেউই ওর এই কবিতা লেখার বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি৷ বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় চাকরি করবে৷ কিন্তু তাদের ইচ্ছে বিহান পূরণ করতে পারেনি৷ বিয়ের প্রথম দু’বছর স্কুলের চাকরিটা করতে করতেই অন্য চাকরির বেশ কিছু পরীক্ষা দিয়েছিল বিহান৷ সফল হয়নি৷ মনপ্রাণ দিয়েই চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু হয়নি৷ তারপর চেষ্টা করাটা ছেড়ে দেয় বিহান৷ বাংলা কবিতার স্নিগ্ধ সরোবরে না জানি কোন্ মন্ত্রবলে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে৷ আর ওর ভেতর ভেসে উঠতে থাকে নতুন নতুন সব কবিতা৷ 

     বিহানের স্ত্রী রূপাঞ্জনা একটি বেসরকারী হাসপাতালে রিসেপশনের কাজ করে৷ সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত এক শিফ্টের ডিউটি৷ রূপাঞ্জনার এই কাজে বিহান প্রথম প্রথম আপত্তি করতো৷ কিন্তু বছর দু’য়েক পর থেকে, যখন থেকে কবিতায় পুরোপুরি ধ্যানমগ্ন হয়, বিহান আর কিছু বলে না৷ সকালের দিকে টানা দু’ঘন্টা লেখার সময় পেয়ে যায়৷ ছুটির দিনে পাঁচ-ছয় ঘন্টা৷ মা বাবা নিজেদের মতোই থাকে, একেবারেই বিরক্ত করে না বিহানকে৷ 
     ছুটির দিন৷ রূপাঞ্জনা নার্সিংহোমে৷ বিহান ভেবেছিল তৃতীয় কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপিটাকে গুছিয়ে নেওয়া যাবে অনেকটা৷ সেইসঙ্গে কথারাও কবিতার শরীর পেয়ে যাবে বেশ কিছু৷ কিন্তু কিছুই হল না৷ সকাল থেকে দুপুর মাত্র একটি লাইন৷ একটু পরেই রূপাঞ্জনা চলে আসবে৷ তারপর আর টেবিলে বসে থাকা অসম্ভব৷ কারণ যেসব কাজের কথা বিহানকে করতে বলে গিয়েছিল রূপাঞ্জনা তার একটিও সে করেনি৷ ভুলে বসে আছে সব৷ লিখতে বসলে বিহান বাকি সবকিছু ভুলে যায়৷ এখন যেটুকু অন্তত মনে করে করে করা সম্ভব দ্রুত করে ফেলতে হবে৷ নাহলে অশান্তি হবে ভীষণ৷ যদিও বিহানের লেখালেখির বিষয়ে আর কোন মাথা ঘামায় না রূপাঞ্জনা৷ কিন্তু কাজ থেকে ফিরে ঘর লণ্ডভণ্ড দেখলে ভীষণ রাগারাগি করবে৷ ঘরে-বাইরে তো খেটেই চলেছে রূপাঞ্জনা৷ একজন কাজের মাসিও রাখেনি৷ বেতনের পুরোটাই সংসারে চলে যায়৷ বিহানের অল্প উপার্জন থেকে মান্থলি রেকারিং করা – জমি কিনতে হবে, বাড়ি করতে হবে৷ কতদিন আর ভাড়াবাড়িতে থাকা যায়৷ 

     বিহান বিছানা তুলে ঘরগুলো দ্রুত গুছিয়ে ফেললো যতটা সম্ভব৷  তারপর বাজার থেকে ঘুরে এলো চট্ করে৷ স্নান সেরে বেরোতেই দ্যাখে রূপাঞ্জনা এসে গেছে৷ চুড়িদার খুলে নাইটি পড়ছে৷ বিহান জানে রূপাঞ্জনা এখন ক্লান্ত৷ কথা না বলে পড়ার ঘরে ঢুকে গেল৷ টেবিলে বসতেই অবাক হয়ে গেল বিহান এবং খানিকটা লজ্জাও পেল৷ টেবিলের ওপর একটা কার্ড এবং তার ওপর একগুচ্ছ লাল গোলাপ৷ বিহান কার্ডটা খুললো৷ কার্ডে বাংলায় লেখা – আজ আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী৷ আমার ভালোবাসা নিয়ো৷ আমরা যেন এভাবেই থাকি আজীবন৷ অনেক অনেক আদর৷” বিবাহবার্ষিকীর কথা একদম ভুলে বসে আছে বিহান৷

     স্নান করে বেরিয়ে এসেছে রূপাঞ্জনা৷ শাড়ি পড়ছে৷ বিহান চুপিচুপি রূপাঞ্জনার পেছনে এসে দাঁড়ালো৷ তারপর একেবারেই বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো ওকে৷ আঁচল খসে পড়লো৷ রূপাঞ্জনা আস্তে আস্তে বিহানের দিকে ঘুরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলো৷

শীতল বাতাস সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ বাইরের কোন আওয়াজ আসছে না ভেতরে৷ জানালা দিয়ে নীচে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় ছুটে চলেছে বাইক ও গাড়ি৷ বিশেষ বিশেষ দিনে বিহান ও রূপাঞ্জনা এই রেস্তোরাঁতেই খেতে আসে রাতে৷ ছিমছাম, নিরিবিলি, সুসজ্জিত এবং খাবারের দামটাও একেবারে ঠিকঠাক৷ মালিক নন-বেঙ্গলি, ম্যানেজার বাঙালি৷ ম্যানেজার ওদের দু’জনকেই ভালো করে চেনে৷
     প্রতিবারের মতো এবারও মেনু কার্ড হাতেই আধঘন্টা সময় কেটে গেল৷ রূপাঞ্জনা বাইরে ভেজটাই প্রেফার করে৷ বিহান ননভেজ৷ কাজেই দেরি হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ শেষ পর্যন্ত খাবার অর্ডার করে ওরা টেবিলে পাশাপাশি বসে আছে৷ বিহান যথারীতি জিন্স ও পাঞ্জাবী পড়েছে৷ অনেকদিন বাদে মন দিয়ে সেজেছে রূপাঞ্জনা – পার্লারে না গেলেও নিজেই যতটা পেরেছে করেছে – চোখে মাসকারা, মেরুন টিপ, নেলপলিশ ও লিপস্টিক, চুল বেঁধেছে পরিপাটি করে, বেগুনি শিফনের চুড়িদারে ওকে মানিয়েছে দারুণ৷ বিকেলে ঝট্ করে বেরিয়ে চুড়িদারটা পছন্দ করে কিনে এনেছিল বিহান৷ এমনিতেই রূপাঞ্জনা যথেষ্ট সুন্দরী৷ কিন্তু আজ বোধহয় ওকে একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে৷ বিহান চোখ ফেরাতে পারছে না৷       
     খেতে খেতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় কেটে গেল৷ খেতে খেতেই চললো নানান গল্প৷ এরপর বৃষ্টি থামতেই বাইকে বেরিয়ে পড়লো দু’জন৷ কাল স্কুল আছে বিহানের৷ খানিকক্ষণ আগে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে৷ রাস্তা ফাঁকা কিন্তু পুরোপুরি ভেজা৷ রাত হয়ে যাওয়াতে বিহান বাইকটা একটু জোরেই চালাচ্ছিল৷ একটা টার্নিঙে হঠাৎ করে একটি লোক দুলতে দুলতে বাইকের সামনে চলে এলো৷ একেই ভেজা রাস্তা, তার ওপর বাইকের স্পিড৷ অনেক চেষ্টা করেও পারলো না বিহান৷ লোকটিকে বেশ জোরেই আঘাত করলো৷ রূপাঞ্জনা ও বিহান বাইক থেকে পড়ে গেলেও, চোট লাগলো সামান্যই৷ আশপাশে লোক তেমন ছিল না৷ শুধু পানদোকানের লোকটি ছুটে এলো৷ আহত লোকটি উঠে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টা করছে না৷ শুধু কী যেন বিড়বিড় করছে৷ বোঝা যাচ্ছে না৷ সম্ভবত কাউকে গালিগালাজ করছে৷ বিহান লোকটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো, চেষ্টা করলো পানদোকানের লোকটিও৷ কিন্তু ওঠানো গেল না৷ বিহান ততক্ষণে লোকটির মুখে মদের গন্ধ পেয়ে গেছে৷ হঠাৎ রূপাঞ্জনা দেখলো লোকটির মাথার পেছন থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে৷ দেরি না করে রূপাঞ্জনা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করলো ওর নার্সিংহোমে৷ লোকটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে বিহান৷ লোকটি ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে৷

আজকাল বেসরকারী হাসপাতালে এলে বোঝাই যায় না, সেটা হাসপাতাল নাকি কোন ফাইভস্টার হোটেল৷ রূপাঞ্জনার নার্সিংহোমে বিহান খুব বেশি আসেনি৷ তবে যতবারই এসেছে অবাক হয়েছে৷ এ যেন মানুষকে সর্বশান্ত করার এক সুসজ্জিত জায়গা৷ মেঝেতে দামী টাইলস৷ সর্বত্র এল ই ডি লাইট৷ সমস্ত কাজ কম্পিটারে হচ্ছে৷ রিসেপশন ও কাউন্টারে বসে থাকা মহিলারাই যেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী৷ শহরের বড় বড় নামকরা ডাক্তারদের এখানে পাওয়া যায়৷ নানাদিকে লিফ্টের ছড়াছড়ি৷ বাথরুমে কমোড, আয়না, বেসিন, ওডোনিল, সবই থাকে৷ কেবিনগুলিতে ঢুকলে মনে হয় কিছুদিন অসুস্থ হয়ে এখানে পড়ে থাকলে মন্দ কী! অবশ্যই যদি পকেটে জোর থাকে৷

     সেরকমই একটি কেবিনে গতকাল রাতে ভর্তি করা হয়েছে বিহানের বাইকের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া লোকটিকে৷ রূপাঞ্জনার নার্সিংহোমের বেশ সুনাম রয়েছে শহরে৷ রাতে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল বিহান ও রূপাঞ্জনা৷ আজ সকাল সকাল রূপাঞ্জনার সঙ্গেই বিহান চলে এসেছে লোকটিকে দেখতে৷ লোকটির বয়স পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে৷ মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে৷ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে৷ বিহান ও রূপাঞ্জনা কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় এবং গতরাতের ঘটনার কথা বলতেই ভদ্রলোক খুবই লজ্জিত বোধ করলেন এবং দুঃখ প্রকাশ করলেন৷ কাজ থাকায় রূপাঞ্জনা বেরিয়ে গেল৷ বিহানের স্কুল যেতে অনেকটা সময় থাকায় ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করতে লাগলো৷ ভদ্রলোকের নাম সুকমল মিশ্র৷ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ম্যানেজার৷ মাস দু’য়েক হলো ট্রান্সফার হয়ে এই শহরের ব্রাঞ্চে এসেছেন৷ বিবাহিত৷ গতকাল গাড়ি নিয়ে বেরোননি ড্রাইভার না আসায়৷ ব্যাংকে কাজের চাপ থাকায় একটু বেশিই ড্রিংক করে ফেলেছিলেন কাল৷ বার থেকে বাড়ি ফেরার সময়ই বিহানের সঙ্গে মুখোমুখি৷
     সুকমলকে বেশ মিশুকে, সহজ মনের একজন আড্ডাবাজ মানুষ বলেই মনে হলো বিহানের৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে নিজের প্রায় সমস্ত কথাই বিহানকে বলে ফেললো নিঃসঙ্কোচে৷ ডাক্তারবাবু ও নার্স এসে হাজির হওয়াতে গল্পে ব্যাঘাত ঘটলো৷ সবকিছু পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু জানালেন, মোটোমুটি ঠিকই আছে সব, শুধু মাথায় দুটো সেলাই পড়েছে এবং বেশ কিছু জায়গা ছুলে গেছে৷ বিকেলে সুকমলকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে৷
     ডাক্তার চলে যাবার পর সুকমল আবার খোশমেজাজে গল্প করতে শুরু করলো৷ বিহান সুকমলের স্ত্রী কোথায় জানতে চাইল৷ সুকমল বললো, সে খবর পেয়ে রাতে এসেছিল৷ সারারাতই ছিল৷ সকালে নার্স বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছে৷ দুপুরে আসবে৷ ইতিমধ্যে কেবিনে এসে হাজির হয়েছে সুকমলের ব্যাংকের কয়েকজন সহকর্মী৷ বিহানের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলো সুকমল৷ বিহান এবার উঠে পড়লো, স্কুলে যেতে হবে৷ সুকমল বিহানের মোবাইল নম্বর নিয়ে এবং আবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, কথা হবে৷ 
     রিসেপশনে রূপাঞ্জনার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এলো বিহান৷ রূপাঞ্জনা কাজে ব্যস্ত, গতরাতের চিন্তার ছায়া উবে গেছে ওর মুখ থেকে৷ বিহানও এখন অনেকটা হাল্কা বোধ করছে৷ রাত থেকে যে দুশ্চিন্তা একটা বড় পাথরের মতো চেপে বসে ছিল বুকে, তা সুকমলের সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে৷ বাইক স্টার্ট দিয়ে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে পড়লো বিহান৷ ওর হাল্কা হয়ে আসা মাথায় আবার এসে বসলো গতকাল সকালে লেখা সেই একমাত্র লাইনটি৷ একা একটি লাইন৷ পেছনে কেন আর কোন লাইন আসছে না! ভাবতে ভাবতে স্কুলের দিকে এগিয়ে চললো বিহান৷

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments