গুচ্ছ কবিতা
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
অপলক
তোমার ভিতরে একটা শহর আছে।
সে শহরে ঘিঞ্জি বস্তি আর ঠাসঠেসে বাড়ির পাশে নর্দমা,
চোরা গলি। সে শহরে সন্ধ্যা হলে আলো জ্বলে নিয়ন সবুজ।
ঝিলমিল চাকচিক্য দমিয়ে রাখে আতরগন্ধী মনবাগান।
বরবাদ হয়ে যাওয়া চিল আর শকুনের দল ঘুরে বেড়ায়
মৃত বাতিস্তম্ভকে বেষ্টন করে।
জায়গায় জায়গায় ঘুণ আর তেলাপোকা ছুঁয়ে থাকে
দরিদ্র জৈব আসবাব। এসবই আমার মত জানে
আরো কয়জন লোক। তোমার দোস্ত আর দোস্তানার দল।
…
তবুও গোধূলি হলে ভরা বিকেলের মায়া ভুলে
তারামাখা বাগানেতে আমাকেই দেখি ডাক তুমি।
যে তারার মরা দীপ থেকে সুবাসের নম্র সুর জ্বেলে
এখনো দাঁড়িয়ে আছে আশ্চর্য নবীন ভৈরবী।
সেই বাগানেতে জেন’ ভুলে কেউ ঢোকে না কখনো।
দূর থেকে দেখে যায় আলো আর ছায়াদের খেলা
আমার ভাগ্যে শুধু লিখেছিলে সে মাধুরী কেন?
নিছক মজার ছলে? নিয়ত আবিল অবহেলা?
বাইরে ক্ষয়াটে রোগ, আর পোড়া দেওয়াল-আড়ালে
জোনাকি জ্বলেছে, জানা? শুধু এটুকুই কি প্রগতি?
দাম আর দানের পাথারে, একমুঠো মানবিক ক্ষতি?
এক-তারা
কাকে বলে সুর?
গহীনে ভাঁটার টানে, যার স্বর, কলরব…
মেদহীন, সুপ্রাচীন ও আমূল।
সে কালোছেলের চামড়া খুলে নিই।
পরক্ষণে ওকে দিই উত্তরীয়, উজ্জ্বল হলুদ।
যেমন বিজনে অন্যমন, খোলা পাতা,
প্রভু ও প্রতারক!
যেমন জলের নিচে রঙিন মাছ,
সূর্যাস্তের সন্ধ্যায়, আভা ছড়ায়।
সুর? সে ত মেঘ, আকাশের সামিয়ানা…
আমার একলা দেশের রাজা,
আমার আজন্মের নতজানু-বেদী।
মেজাইয়ের বেশে তাকে দিই মুক্ত, সুগন্ধি, ফুল।
সে যদি সমুদ্রযাত্রা, একচক্ষু জলদস্যু আমি।
সে যদি সূর্যডোবা বনে, গাছ থেকে গাছে ছেয়ে
পাতা ঝরানো পথ, আমি…
একলা ছোটা মেয়ে।
জাতক
নাভিত্বরণের শব্দই টের পাও, বসন্ত আগমে?
কেউ নয়, কারোর গভীর ছায়া নয়,
এখানে বিছিয়ে থাকে অলীক স্বপ্ন-তন্ডুল।
হিরণ্যগর্ভ নামক প্রাচীন কিশোর দেখো, ভাত রাঁধে নিয়ন আলোতে।
দূরে হাটে সেলাইয়ের দোকান তার। পোড়া ঘায়ে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে,
লাইনের ওপার থেকে ভেসে আসা “কু-ঝিকঝিক” টের পায় তার আপাত নিঃসাড় শ্রবণেন্দ্র।
হাতের কাছেই রাখা, খরিদ্দারী ফরমায়েশ, বৈবাহিক লালশালূ।
ছুঁচের আমূল ডগা লকলকে আগুণের তাতে ওঠে-নামে,
গাঙ্গেয় বটের নিচে, ফেন-উপচায়। এ গোপন অধ্যাবসায় জেনো আবশ্যিক।
সন্ধ্যা হলে মানুষ নয়, নদীতীরে পাখি এসে বসে, কাঁধে গায়ে মাথায়।
জলের ফণার মত ভেসে আ্সে অদম্য সংকীর্তণ।
রাতের চাঁদের আলো শববস্ত্র হয়ে ঘিরে ফেলে দুয়ারের নিরিবিলি কড়া।
একক নূপুর হেন, অথবা আদিম কোন কেকা!
আয়ুরই অক্ষরবৃত্তে বাঁধা থাকে একাক্ষর জীবন দোতারা।
উগ্র বারোয়ারী বিষণ্ণ ফর্দের ওই আকণ্ঠ অরণ্যে এখনো
এক বহুপন্থচারী ফেরে মাত্র অভিযোজনেরই খোঁজে।
বালকজন্মকাল পুনঃ সমাগত, হিরণ্যগর্ভ ক্রমশ বোঝে।।
কে ও?
কেউ নয়, শুধুই সময়।
যোগ
গোধূলির বটগাছ জানে, মর্মবাণ, আর কিছু ঋণ।
তবু উত্তমর্ণ, তার কাছে আমি খুশি হতে পারি না।
...এ জানালায় কেবল তোমার অধিকার।
তুমি দেখ এই গাছ, এই ফল।
পাখিরা আমার!
চোখ খোলা বা বন্ধে, নির্বন্ধে।
ওই গাছে জল আর ফল,
ছদ্মবেশ জানি আমি,
রূপেলা মেঘের সারি
পেরিয়েই না দেখেছি
তোমার গেরুয়া দুর্গ, অন্নবস্ত্র আমার।
...এ রুদ্রাক্ষের দানাগুলি ধীরে ছড়িয়ে গেলেই,
পাখি জানে ফল।
তোমার কাঁধেতে তার মেলা।
বুকেতে, মুখেও।
সেই দানা তুলে রাখি তলে তলে,
আবার মালাটি হয়, সুনিশ্চয়।
সুতো খুলে গেলে ফের,
গোপন আঁতাত, আমাদের।
পোস্টমর্টেম
কারও সাথে ঝগড়া কি ছিল?
আশেপাশে দেখেনি ত কেউ?
কদিন আগের কথা, জান?
বিনিময় শুধু, নেই ঢেউ?
স্বামীর নামটা জানা আছে?
পরিবারে কে ছিল, এসব?
একা একা ছিল একেবারে?
ছিল না কি কোন কলরব?
এভাবে প্রশ্নগুলি আসে
যখন ফুরিয়ে যায় দিন
একাকীই, গোধূলি বাসাতে
রক্তের ধারা ক্রমে ক্ষীণ।
কেউ কি বলেনি তাকে ‘ভাব’?
সবাই কি দিয়েছিল আড়ি?
কারো কথা আসেনি কি মনে?
যেদিন চেয়েছে যেতে বাড়ি?
বাড়ি মানে আসলে মানুষই
মনের ভিতরে যেই মান!
গহন কুঞ্জে লেখা আছে
মৃত্যুবোধ্য অভিধান।
আরও পড়ুন
3 Comments
পরিণত! গভীর! আমূলস্পর্শী!
ReplyDeletemon vore jay
ReplyDeleteকবি, লেখা মুগ্ধতা এনে দিল।
ReplyDelete