জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-১৪/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি::১৪
-------------------------------------- 
তৃতীয় ধারার মানুষ
------------------------------
এগারাে বছর বয়স নাগাদ স্নেহময় নিজে বুঝতে পারল যে সে ঠিক আর পাঁচটা মানুষের মতাে নয়। অনেকখানি আলাদা তাদের থেকে। বােঝার পর থেকেই তার মনের মধ্যে শুরু হল ধুকপুকানি। কি হবে এবার? বাবা-মা কি ভাববে? বন্ধু বান্ধবেরা  কি ভাববে? কি ভাবে জীবন চলবে তার?

যদি জন্মগত বাহ্যিক খুঁত না থাকে তাহলে একইরকম বৈশিষ্ট নিয়ে জন্মায় সকলে। তার পর বড় হয়। শৈশব শেষ হয়ে কৈশাের তার পর যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব এবং বার্ধক্য। কিছু মানুষের  শরীরের গঠন একই রকম বৈশিষ্ট মেনে হয়না। তাদের  গঠনগত বৈচিত্র থাকে। শরীরে পুরুষ ও মহিলা এ দুই উপাদান মিলে মিশে থাকে। একটু বড় হলে তা বুঝতে পারা যায়।  যেমন, স্নেহময় বুঝতে পেরেছিল এগারাে বছর বয়সে। যখন  সে হঠাৎ আবিস্কার করল (আবিস্কার না বলে অনুভব বলাই ভালাে) যে সে বাইরের থেকে ছেলে হলেও কিন্তু ভিতর থেকে মেয়ে। সে এক  অন্যরকম গল্প। এর আগে আর একটু ছােটবেলায় সে খেয়াল করেছিল মা তাকে আদর করলে তার অনুভূতিটা কেমন যেন ঘিনঘিনে হয়, কিন্তু বাবা আদর করলে খুব ভালাে লাগে। অথচ মা তাকে খুবই ভালােবাসেন। এ ব্যাপারটা যদিও মায়ের কাছে কখনাে প্রকাশ করেনি সে। তবু মনে মনে নিজের খুব অবাক হয়েছিল এরকম ঘটাতে। ওই বয়সে  অনেক ছেলেমেয়ে প্রতিবেশী, এমনকি নিকট বা দূর  আত্মীয় বড়দের হাতে গােপনে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাকেও তার বাংলার প্রাইভেট টিউটর বুঝিয়ে সুঝিয়ে অ্যাবিউস করেছিল এই সময়টাতে। আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল এটাই যে ব্যাপারটা সে বেশ এনজয় করেছিল তখন। ব্যায়াম করা পুরুষালি স্বাস্থ্যের বাংলা টিউটরের স্পর্শ তীব্র আনন্দ দিয়েছিল তাকে। টিউটর এতটা আশা করেনি। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল পাওয়াতে তাদের সম্পর্ক বহুদিন টিকেছিল। পড়া ছাড়তে হয়েছিল টিউটর অন্যত্র চলে যাওয়াতে। সে সময় একমাস ঘুমােতে পারেনি স্নেহময়। বহুদিন পর্যন্ত কষ্ট পেয়েছিল সে।

এ ঘটনার আগে পর্যন্ত স্নেহময়ের শরীরে গঠনে না ছিল পুরুষত্ব, না ছিল নারীত্বের ছাপ। তারপর দেখা গেল যে  বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ভাবে তার একটুও পুরুষত্বের উন্মেষ হলো না । গালে বা শরীরের অন্য কোনো স্থানে  সামান্যতম  কেশোদ্গম হলো না, উল্টে শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে  নারীসুলভ চর্বির আধিক্য   শুরু হলো, সঙ্গে শুরু হল স্তনের বৃদ্ধি। সঙ্গে পুরুষের প্রতি আকর্ষণের অনুভূতি। প্রথমে পাড়ার ক্লাবের সিনিয়র দাদা বাদল  পরে পুলিশ সার্জেন্ট দূর সম্পর্কের এক কাকা বিহারীলাল এবং কুড়ি বাইশ বছর বয়সে তার শেষ সম্পর্কটা তৈরি হল সহপাঠী অবােধের সঙ্গে। অবােধ জেলার হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। শরীর স্বাস্থ্যের কথা বললাম না নতুন করে।

বিষয়টা নিয়ে সমস্যা হল বিবিধ। অন্য স্বাভাবিক মানুষ হলে এ সমস্যা নিয়ে তার লজ্জা বা যন্ত্রণার সীমা থাকত না। কিন্তু প্রথমদিকে এমন কিছু ঘটলে স্নেহময়ের যে রকম ধুকপুকানি শুরু হতো, বিস্ময়কর ভাবে পরের দিকে তেমন কিছু না হয়ে বরং ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ঠেকত তার কাছে। ভাবখানা এমন, যেন এরকমই হওয়া উচিত। দুবিধা ছিল অন্য বিষয়ে। সে ভাবতে শুরু করেছিল—ভাগ্যিস জন্মেছিল এভাবে, যদি পুরুষ মানুষ হিসেবে জন্মাত তাহলে জীবন কিভাবে কাটত নারী সন্নিধ্যে কে জানে!  এমনিতেই স্নেহময় একটু চুপচাপ লাজুক প্রকৃতির মানুষ, এবং ভীষণ আনমনা। কারণে অকারণে টুকটাক বিষয়ে ভুল হয়ে যায়। যেমন, হয়তো বাইরে যাচ্ছে কোনাে কারণে, দরজার বাইরে গিয়ে দেখল জুতােটা পরা হয়নি। মায়ের কথায় হুঁশ এল। খাওয়ার পর মুখ না ধােয়া তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তারপর চশমা পরে স্নানে চলে যাওয়া। গামছা পরে গামছা খোঁজা, এই আর কি।  তার আড়ালে তাকে নিয়ে যে বিস্তর ঠাট্টাতামাশা চলে একটা বুঝত স্নেহময়। তবে যথারীতি আমল দিত না। তার বাবা-মায়ের যে অসুবিধে হতো এ ব্যাপারটা সে   ঠিকঠাক বুঝত কিনা সেটাও অবশ্য একটা ধোঁয়াশা।  জীব হিসেবে মানুষ যেমন ভালাে, তেমন সে খারাপও। এই যে, খ্যাতিমান মানুষ দেখলেই সাধারণ মানুষের তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ার প্রবণতা, তার সঙ্গে অনাবশ্যক ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করা অথবা যে মানুষটা অক্ষমতার কারণে সমাজে কোণঠাসা, তাকে আরও কোণঠাসা করার নিরন্তর প্রয়াস,  এসব  হলো মানুষের কদৰ্য্য স্বভাবের এপিঠ আর ওপিঠ। এগুলি তাকে যেমন সুবিধা দিয়েছে, সেরকম বিপদেও ফেলেছে বার বার।

স্নেহময়ের বাবা-মা তাে স্বাভাবিক শরীর ও মনের মানুষ! সুতরাং স্নেহময়কে নিয়ে তাঁদের সমস্যা দিনকে দিন বাড়তে শুরু করল। তাঁরা রাস্তাঘাটে চলতে পারতেন না, পরিচিত অপরিচিতরা তাদের দিকে তাকিয়ে টিটকারি মারত অথবা এমন কৌতুকের দৃষ্টিতে  তাকিয়ে থাকত যেন তাঁরা দুজন ভিনগ্রহের মানুষ। হঠাৎ করে পৃথিবীতে চলে এসে কী যেন একটা অন্যায় করে ফেলেছেন। কেউ আবার কিছুই না বলে পাশ দিয়ে মুচকি হেসে দ্রুত হেঁটে চলে যেত।

বিষয়গুলাে নিয়ে তাঁরা প্রথমে সুহৃদ বন্ধুদের সঙ্গে আলােচনা করে দেখেছিলেন। এবং বুঝেছিলেন এ ব্যাপারে বন্ধুরা তাঁদের এড়িয়ে যাওয়ারই পক্ষপাতী। সমাজে একঘরে হয়ে থাকতে কেউই চায় না। আর একঘরেদের সঙ্গে সংসর্গ করলে তাদেরও যে একঘরে হওয়ার সম্ভাবনা তা মানুষ বিলক্ষণ বােঝে।  এরপর বিষয়টা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিগােচরে এনেছিলেন তাঁরা। তাতে বিশেষ কোনাে লাভ হয়নি। প্রশাসনের কোনাে কাজ না করতে পারলেই ভালাে হয়, কেবল মানুষকে বিপদে ফেলার কাজ ছাড়া।  মাইনেটা নিয়েই বেশিরভাগ কাজ শেষ  করেন তাঁরা। বাকি সময়টা ছেলের পড়া, মেয়ের বিয়ে, বউয়ের কেনাকাটি, বন্ধুবাজি, গুলতানি করে কাটাতেই বেশি ভালােবাসেন।

স্থানীয় এম.এল.এ হরিচরণ বাবুর কাছেও তাঁরা গেছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে। তিনি আবার আর এক কাঠি সরেস। প্রথমে তাে অ্যাপয়েন্টমেন্টই দিতে চাননি,  এরপর যখন তা পাওয়া গেল, তখন সব শুনে তিনি বললেন যে, তিনি তাে জনপ্রতিনিধি। কোনাে একের বা গোষ্ঠীর  তাে নন! সুতরাং মেজারিটি যে দিকে, তাঁকে সে দিকেই থাকতে হবে। আর তাছাড়া এ ব্যাপারটা তিনি খেয়াল করে দেখেছেন যে এ নিয়ে বিরােধী নেতা গুরুচরণবাবু অকারণে জল ঘােলা করে নোংরা রাজনীতি করছেন, যাতে স্নেহময়ের হয়ে কিছু বললে তাঁর নামে জনমানসে যাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় । ব্যাপারটা তিনি এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারেন না! এর শেষ দেখে ছাড়বেন ।

এ কথা শুনে তাঁরা বুঝলেন, সামাজিক সমস্যার যে জগদ্দল পাথর তাঁদের বুকে জেঁকে বসেছে তার থেকে আপাতত তাদের মুক্তির কোনাে উপায় নেই। গড়পড়তা পােড় খাওয়া মানুষেরা যে কী বস্তু দিয়ে তৈরি সে কথা ভেবে সময় নষ্ট না করে তাঁরা বরং অন্যভাবে সমস্যা সমাধানের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলেন।
পুলিশের ব্যাপারটা আরও মজার। তারা হয় বলে এ এরিয়াটা আমার নয় অথবা এ বিষয়টা আমার এক্তিয়ারে নয়। 

সমাজ এরকম একটা আঘােষিত নিয়ম সমস্যা জর্জর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষদের জন্য করে রেখেছে যে, তাদের যন্ত্রণা, তাদের সমস্যা সব তাদের দায়, কিন্তু তাদের সাফল্য,  আনন্দ এগুলাে সমাজের কৃতিত্বে!  অসামাজিকতার ট্র্যাডিশন চলতে থাকলে কুম্ভকর্ণরূপী সমাজকর্তারা জেগে উঠবেন কবে? সম্ভাবনা আছে কি তার?  নাকি তাঁদের চারপাশে জেগে থাকা পদাতিক সেনারা সদাকুষ্ঠিত হয় অহরহ, যাতে  তাদের ঘুম ভেঙে শরীর খারাপ  না হয়ে যায় !

এদিকে স্নেহময়ের বয়স বাড়ছিল। পুরুষ মানুষের প্রতি তার আকর্ষণ তীব্রতর হচ্ছিল সে তা বেশ বুঝতে পারত, আর সঙ্গে এও অনুভব করত যে সমাজে এখনাে তাদের এ অনুভূতির কোনো মানবিক স্বীকৃতি নেই। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকারও নেই। এ লড়াই অসম, এবং তা লড়তে গেলে সমগােত্রীয় ও সমমনস্ক মানুষদের প্ল্যাটফর্মকে সঙ্গে নিয়ে লড়তে হবে।

ততদিনে একটু একটু করে এই তৃতীয়ধারার মানুষগুলির সংগঠন তৈরি হতে শুরু করেছে । চারিদিকে এদের হয়েও কথা বলতে শুরু করেছে কিছু সমাজসেবী সংগঠন। এরকম একটা সময়ে স্থানীয় জেলাভিত্তিক সংগঠন ‘মুক্তিকামী’-র সঙ্গে তার যােগাযােগ হল। বাসে কলেজ থেকে ফেরার পথে সংগঠনের একজন সভ্য সুমিত্রর সঙ্গে আলাপ তার। এরপর কিছুদিন তার সঙ্গে কথা চালাতে চালাতে একসময় সেও তাদের সদস্য হয়ে গেল। সংগঠনে এসে যেন অদ্ভুত অন্য এক পৃথিবী, এক মুক্ত বাতাসের সন্ধান পেল স্নেহময়। এতদিনে অন্তত তার সমভাবনার শরিক মানুষজনের সন্ধান পেল সে যারা একসঙ্গে পৃথিবীকে তাদের বাসযােগ্য করার কথা ভাবে। সে জন্য কাজ করে প্রতিনিয়ত।  এবার স্নেহময়ের বাবা-মা পড়ল ফ্যাসাদে। এতদিন তাঁরা তাদের মানসিক যন্ত্রণা গােপন রেখেছিলেন ছেলের কাছে। তার বিষয়ে একাধিক সুহৃদ বন্ধুর সঙ্গে আলােচনা করেছিলেন সমাধানের আশায় কিন্তু কেউ-ই কোনাে দিশা দিতে পারেননি। তারা এটাই ভেবে অবাক হয়েছেন , কি ভাবে একটি ছেলে শারীরিক ভাবে আর একটি ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কেনই বা মেয়েদের প্রতি এত তার এত অনাগ্রহ বিতৃষ্ণা ? স্নেহময় ভাবলো, হয়তাে খােলাখুলি আলােচনায় বসলে এর একটা সহজ সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যতবার তারা পরস্পর টেবিলের উল্টো পাশে বসেছে ততবার নিট ফল হয়েছে শূন্য । এর পরে অনেক ভেবেচিন্তে বাবা-মা ঠিক করলেন যে এক গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন, তাতে যদি তার মতি ফেরে। দেশে গরিব এবং সুন্দরী মেয়ে খুঁজলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।  গরিব মানুষের ক্ষেত্রে  সুবিধেটা হলো,বেশির ভাগ  ক্ষেত্রেই তাদের বিশেষ কোনাে চাহিদা থাকে না শ্বশুরবাড়ি থেকে এবং যেটা পাওয়া যায় পুরােটাই উপরি। মেয়ের খোঁজ তাে পাওয়া গেল! বারাসতে বাড়ি। বাবা স্কুল মাস্টার ছিলেন,  তিনি হঠাৎ রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর  তাঁর গুণধর ছেলে সে চাকরি পেয়ে পছন্দের মেয়ে বিয়ে করে, মা ও বােনকে ফেলে পালিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। এদিক পানে ভুলেও মাড়ায় না। আর্থিক সাহায্য করা তাে দূরস্থান। আজকাল সমাজ এরকমই। মায়ের কোলপোঁছা আদরে বাঁদর ছেলেরা বড় আর যােগ্য হয়ে কেটে পড়ে বাড়ি থেকে।  তাদের বিন্দুমাত্র অনুশােচনা নেই এ বিষয়ে!

বােন তাে এতদিন টিউশানি করে তার আর মায়ের সংসার চালাত। ওর সম্পর্কে পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে খবর নিয়েছিলেন স্নেহময়ের মা । তাদের কেউ খারাপ কিছু বলেননি। এমন মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ আসাতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তাঁরা ! স্নেহময়ের সম্পর্কে কিচ্ছুটি না জানিয়ে তাে  তাঁরা তার সঙ্গে বিয়ে দিলেন ছেলের ।  বিয়ের আগে  তার ব্রেস্ট অপারেশন করে ছােট করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ছেলে ছেলেই লাগছিল স্নেহময়কে! কিন্তু হলে কী হয় ! সে তাে আর সে কারণে ছেলে হয়ে যায়নি! ফলে যা হওয়ার তাই হল। অত্যন্ত ভালাে এবং গরির ঘরের মেয়ে বলে ছমাস সে ছিল স্নেহময়ের সঙ্গে। তারপর সব বুঝে শুনে এক ভােররাতে সেই যে  শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে  গেল, আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। বাবা-মায়ের শেষ অস্ত্রটাও ভোঁতা হয়ে গেল এভাবে। এর কিছুদিন বাদে, যখন স্নেহময়ের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর তখন তিনদিনের জ্বরে ভুগে স্নেহময়ের বাবা হঠাৎ মারা যান ।  তার আগে  বিশ্বনাথ বলে এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে স্নেহময়ের এবং সে তার সঙ্গী বিশ্বনাথের  করছিল স্নেহময়!  তাদের সংগঠনটি তখনো করে সে। অফিসের সেক্রেটারির দায়িত্বটাও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে । মায়ের বড় চিন্তা তাকে নিয়ে। বাড়ির একমাত্র সন্তান সে! উত্তরপুরুষ যে আসবে এমন কোনাে সম্ভাবনা দেখছেন  না তিনি। বরং প্রতিদিন প্রতিমুহুর্ত তাঁদের পরিবার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কথা ভেবে হতাশ হয়ে যান তিনি। স্নেহময়ের কোনাে অনুশােচনা দুঃখবােধ ছিল না । অপ্রাপ্তির কারণে তাে নয়-ই। কেবল  মানুষের তাঁর মতো তৃতীয় ধারার মানুষদের সমাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার অক্ষমতাতে  মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মন খারাপ হয়ে যায় তার। তৃতীয়ধারায় মানুষদের সম্পর্কে প্রচুর পড়াশােনা করেছিল স্নেহময়। নতুন নতুন তথ্যগুলাে লিখে রাখত ডায়েরির পাতায়। এই তাে সেদিন আমেরিকার এক মেডিকেল জার্নালে কোনো এক ব্রিটিশ চিকিৎসক তাদের সম্বন্ধে যা কিছু লিখেছিলেন, পড়েছে সে। তাতে তার গােটা শরীরে যে কী খুশির আলােড়ন বয়ে গেছিল বােঝাতে পারবেনা স্নেহময়। আহা! সত্যি যদি তাদের সুখেরও দিন আসে কখনো!
প্রতিটি মানুষ নিজের সাচ্ছন্দ্য আর সুখের কথা ভাবে। কেউ কেউ উদারতার মুখােশ পরে ভাবে তা। তাদের কাছে উদারতা এক তৃপ্তির বিষয় এবং তাতেও নিজের স্বার্থ চরিতার্থ হয়। স্নেহময় ভাবে, সে না হয় শরীর ও মনের দিক থেকে ব্যতিক্রমী হয়েছে জিন ও গঠনতত্ত্বের গলদের কারণে কিন্তু তার স্বাভাবিক বৃদ্ধিবৃত্তি তাে আছে! মানসিক বৈকল্য নেই! তাহলে তার অধিকার বােধে সমাজের এত অমর্যাদা কেন? একদিন তাদেরও দিন আসবে নিশ্চয়, তখন পৃথিবীর পথঘাট তাদেরও আপনজন হবে!

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়  তার মাঝে মাঝে মনখারাপ আর তীব্র ভীতির চোরাস্রোতে। সঙ্গীকে জড়িয়ে ধরে   তখন কাঁদে সে। ভােরবেলায় অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কখনো। সকাল থেকে আবার একদিনের লড়াইয়ের শুরু যে! যে লড়াই শুরু হয়েছে, সে লড়াই কঠিন তা সে জানে, কিন্তু পিছিয়ে আসা মানেই তাে হার। সমষ্টির অধিকার অর্জনের এ লড়াই সে হারবে কোন আক্কেলে ?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments