জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (কোরিয়া) /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (কোরিয়া) 

চিন্ময় দাশ 


ন্যায্য বিচার 

অনেক পুরানো দিনের কথা। পাহাড়ের গা ঘেঁষা একটা গ্রাম। গরিব চাষাভুষো মানুষজনের বাস সেখানে। খেতে-খামারে চাষবাসের কাজকর্ম করে জীবন কাটে তাদের। 

একবার ভারী সমস্যায় পড়ে গেল মানুষগুলো। ক'দিন হোল, একটা বাঘ খুব উৎপাত শুরু করেছে। প্রায়ই যাতায়াত করছে গ্রামের দিকে। আজ এর গরু-বাছুর, তো কাল ওর ছাগল-ভেড়া তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। বাঘের ভয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরুনোটাও দায় হয়ে উঠেছে। সেদিন একজন বেরিয়েছিল, তার তো একটা পা-ই কেটে নিয়েছে।

এভাবে ঘরবন্দি হয়ে থাকলে তো জীবন চলে না। মোড়লের কথায়, গাঁয়ের সবাই জড়ো হল, একটা উপায় বার করবার জন্য। নইলে, বাঁচা যাবে কী করে?
মোড়ল বলল-- একটা কাজ করো সবাই মিলে। বাঘ তো আসে রাতের বেলা। ছোট বড় যতগুলো রাস্তা আছে গাঁয়ে ঢোকার, সবগুলোর মুখে একটা করে গর্ত খুঁড়ে রাখো। তাতে ধরা পড়ে যাবে বাঘ ব্যাটা।

সবার মনে ধরল কথাটা। সবাই কাজে লেগে গেল। সবে বড় হয়েছে যে ছেলেমেয়েরা, তারাও এসে হাত লাগাল। অনেকগুলো গর্ত তৈরী হয়ে গেল দিন ফুরোবার আগেই। 
পরদিন সকালে একটি যুবক ছেলে আসছিল এই গ্রামে। তার কাকার সাথে দেখা করতে। গ্রামে ঢোকার মুখেই, একটা ভারী গর্জন কানে এল তার।
কীসের আওয়াজ? সুবিধার মনে হচ্ছে না যেন। ব্যাপাটা দেখা দরকার। এই ভেবে, শব্দটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল ছেলেটা।

খুঁজতে খুঁজতে একটা গর্তের কাছে হাজির। অবাক হয়ে দ্যাখে, গভীর করে খোঁড়া একটা গর্ত। তার ভিতরে জলজ্যান্ত একটা বাঘ। একেবারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভিতরে। উঠে আসবার চেষ্টা করছে। যত না পারছে, তত গর্জন করছে বেচারা। যতবার লাফ দেয়, ততবারই ধপাস করে আছাড়  খেয়ে পড়ে মাটিতে। তখনই আবার তার গর্জন। 

ভারী মজা লাগল ছেলেটার। মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল-- এই যে বাঘবাবাজি, পড়লে কেমন করে? 
বাঘ বলল-- সেটাই তো বুঝতে পারছি না. রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম, যেমন যাই. হঠাৎই পড়ে গেলাম গর্তটায়। আগের দিন ছিল না গর্তটা।

ছেলেটা চুকচুক শব্দ করে বলল-- আহারে, বনের রাজার কী দুর্দশা! 
বাঘ করুণ গলায় বলল-- একটু দয়া কর। তুলে দাও আমাকে। বউ-বাচ্চারা আছে ঘরে। খুব ভাবনায় পড়ে যাবে তারা। দোহাই তোমার, একটু উপকার করো। সারা জীবন মনে রাখব তোমাকে।

মনে দয়া হল যুবকটির। আগু-পিছু না ভেবে, বন থেকে মোটা দেখে একটা গাছের দল জোগাড় করে এনে, নীচে নামিয়ে দিল। অমনি সেটা বেয়ে তরতর করে উঠে এল বাঘ-- আহ, বাঁচালে আমাকে। 
এতক্ষণে হুঁশ হল ছেলেটার। তার সামনে দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত একটা বাঘ। কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল-- চলি তাহলে। কাজ আছে আমার। বিদায়।

এক গাল হাসি বাঘের মুখে-- এত তাড়া কিসের? যাবে তো আমার পেটে। ব্যস্ত কেন হে? 
ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল যুবকটি-- সে কী? আমি তোমার এতবড় উপকার করলাম, আর তুমি কি না--
-- রাখো তোমার উপকার। সারারাত না খেয়ে পেট চুঁইচুঁই করছে। ঘরেও বউ-বাচ্চারা বসে আছে পথ চেয়ে। তোমাকে দিয়ে আজকের দিনটা দিব্বি চলে যাবে সবার।
ছেলেটার মাথা ঝিমঝিম করছে। কোন রকমে বলল-- এটা অন্যায়। বিচারটা কি ঠিক হল? উপকারীরই অপকার করবে তুমি?

বিচারের কথা বলছো? বাঘ হেসে বলল-- ঠিক আছে, চলো-- যার কাছে তোমার তোমার মন চায়, বিচার চাইবে। এও বলছি, মাত্র একজন নয়, তিন- তিনজনের কাছে বিচার চাইবে তুমি। একজনও যদি বলে আমার ভুল হচ্ছে, ছেড়ে দেব তোমাকে।

একটু আশা জাগল যুবকটির মনে। গ্রামের দিকে গেলে, হইচই বেধে যাবে। বনের কিনারা ধরে এগোল সে। 
এক জায়গায় দেখল, এক পাল গরু চরছে মাঠে। তাদের সাথেই প্রথম দেখা। বুড়োমতন একটি বলদকে সামনে পেয়ে, সব কথা খুলে বলল তাকে। জানতে চাইল-- এটা কি বাঘের ঠিক বিচার হচ্ছে? 
গরুটা হেসে উঠে বলল-- হচ্ছে না-ই বা কেন? মানুষের সাথে যেমনটা হওয়া উচিত, একেবারে তেমনটাই হচ্ছে। 
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল-- এ কী বলছো তুমি? 
বলদ রগের গলায় বলল-- বলবো না-ই বা কেন? আমাদের কথাই ধরো তাহলে। সারা জীবন মানুষের সেবা করি আমার। লাঙল টানি, দুধের যোগান দিই। কিন্তু দ্যাখো, যেই বয়স হল, অমনি কসাই ডেকে বেচে দেয়। একমুঠো খড়-ভূষিও দেয় না। ঠিক বিচারই তো করেছে বাঘ। ভুল কী হয়েছে?
বাঘের মুখে হাসি। বলল-- চলো, আরও দুজনকে বলতে পারবে এখনও। 
খানিক দূর গিয়ে সামনে পড়ল একটা বটগাছ। তাকে সব কথা বলার পর, বট বলল-- ভুল কী হয়েছে? এটাই মানুষের পাওনা।

-- সে কী? একথা বলছো কেন? ছেলেটা বলল-- আমি তো এর উপকারই করেছি বাঘের।
বটগাছ বলল-- আমরাও তো উপকারই করি মানুষের। ছায়া দিই। কাঠ-পাতা দিই। মেঘ ডেকে আনি-- তবেই না বৃষ্টি হয়, চাষবাস হয়। ফসল ফলে খেত-খামারে। তবুও মানুষই ডালপালা কাটে। আস্ত গাছও কেটে সাফ করে দ্যায়। তোমরা অন্তত সুবিচার চেয়ো না।

বাঘের মুখে এখন বেশ চওড়া হাসি। বলল-- চলো গো, ছেলে। আরও একজন হাতে আছে তোমার।
পাশেই তো বন। একটা শেয়াল বেরিয়েছিল পথে। একেবারে সামনে পড়ে গেল সে। যেই বাঘকে দেখেছে, কিছু বলবার আগেই, পেন্নাম হই, রাজামশাই, বলেই সাঁৎ করে সরে পড়ল সেখান থেকে।

কপাল ভালো, এবার একটা খরগোশ দেখা গেল। শেয়ালের চেয়েও বুদ্ধি বেশি তার, বনের সবাই মানে কথাটা। শেয়ালের মত ধূর্ত নয় সে। সুবিচার করবার জন্য সুনাম আছে খরগোশের।

কুটকুট করে বুনো আলু তুলে খাচ্ছিল সে। বাঘই তাকে দাঁড় করল বিচার করে দেবার জন্য। আসলে, বাঘের তখন নাড়িভুঁড়ি জ্বলছে খিদেয়। দেরি সইছে না আর।
যুবকটির মুখে সব শুনল খরগোশ। বেশ মন দিয়ে শুনল। বুঝতে কিছুই বাকি রইল না তার। কিন্তু কাঠবেড়ালিকে বাদ দিলে, সে-ই হল বনের সবচেয়ে পুঁচকে জীব। বাঘের এক ধমকেই প্রাণ চলে যাবে তার। কী করে ন্যায্য কথা বলে এখন?

ছোট্ট মাথায় বড় বুদ্ধি খরগোশের। সে বলল-- সবই তো শুনলাম। কিন্তু মুখের কথায় বিচার করতে নাই কখনো। আমি অন্তত করি না। ঠিকঠাক কী ঘটেছিল, নিজের চোখে যদি দেখাতে পারো আমাকে, বিচার করতে সময় নেব না।

বাঘের আর দেরি সইছে না। ছেলেটার ঘর মটকাতে পারলে, সে ঘরে ফিরে যায়। সাত-পাঁচ না ভেবে, বাঘ বলল-- এ আর এমন কী কথা। গর্তটার কাছে গেলেই হয়। সব গোল মিটে যায়।
গর্তটার কাছে এসে হাজির হল তিনজনে। খরগোশ বলল-- কে কোথায় ছিলে, দেখাও আমাকে। 
বাঘ এক লাফে গর্তে নেমে গেল। বলল-- আমি এখানে ছিলাম। 

খরগোশ বলল-- গাছের ডালটা কি গর্তেই নামানো ছিল? 
সাথে সাথে বাঘের এক ধমক-- আচ্ছা বেকুব তো তুই। ডাল নামানো থাকলে কি আর আমি সারা রাত এখানে পড়ে থাকি?

খরগোশ কোন জবাব দিল না। বলল--তাহলে ডালটা ছিল কোথায়, সেটা দেখাও। 

যুবকটি এগিয়ে এসে, টেনে তুলল ডালটাকে। খরগোশ বলল-- এখানে নয়, যেখানে ছিল, রেখে এস সেখানে। তারপর পা চালিয়ে কাকার বাড়ি চলে যাও। আর, গ্রামের লোকজনকে বলে দিও, তারা এসে যেন বিহিত করে বাঘের। সঠিক বিচার তখনই হবে।

এবার বিপদটা মাথায় ঢুকল বাঘের। নিজের বোকামিতে আবার ফাঁদে পড়ে গেছে সে। নীচ থেকে সজোরে গর্জন করে উঠল-- তবে রে হতভাগা!  সারা এলাকা যেন কেঁপে কেঁপে উঠল সেই হুঙ্কারে।  

একটুও ঘাবড়ালো না খরগোশ। গ্রাহ্যই করল না বাঘকে। ছেলেটাকে বলল-- একটা কথা তোমাকে বলি বাছা। আগুপিছু না ভেবে কোন কাজ কোর না। তাছাড়া, শয়তানের উপকার করতে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধির কাজ নয়।

ছেলেটার তো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সে অনেক ধন্যবাদ দিল খরগোশকে। খরগোশ বলল-- ঠিক আছে, এবার কাকার বাড়ি যাও। খবরটা দিও গ্রামের লোকেদের। আমি চলি, আলুগুলো ফেলে এসেছি। 
খরগোশ চলল তার আলুর জন্য। যুবকটি চলল কাকার বাড়ি। কেবল বাঘের বুক ধড়ফড়। কখন গ্রামের লোকেরা এসে হাজির হয়ে যাবে লাঠি-সোটা-বল্লম নিয়ে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments