জ্বলদর্চি

খপ্পর-১২ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস: খপ্পর 
লেখক: অনিন্দ্য পাল 
পর্ব : বারো  

============= 
ব্যানা চোখ দুটো খুলতে চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু পারছে না। বড় বড় দু'টো ধারালো পাথর যেন তার চোখের উপর কেউ চাপিয়ে দিয়েছে। কতক্ষণ যে এভাবে শুয়ে আছে তা জানে না ব্যানা। হাত-পা খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা, ফলে নড়াচড়াও করতে পারছে না। ঠোঁট দুটো আঠালো টেপ দিয়ে শক্ত করে আটকানো, চেঁচামেচি তো দূরের কথা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে মাঝে মাঝে। প্রচন্ড তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে ব্যানার, জিভটা মুখের মধ্যে থেকেও অসম্ভব শুকনো হয়ে উঠেছে। 
এই কদিনে, কতদিন সেটা জানে না ব্যানা, এভাবে আটকে থাকতে থাকতে তার দিন, রাত, মাস, বছর সব হিসেব গুলিয়ে গেছে। তবে এত খারাপের মধ্যেও একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তৈরি হয়েছে তার। ব্যানার ভিতর থেকে কেউ যেন তাকে আগাম জানিয়ে দেয়, "এবার তোমার শরীরটা নিয়ে কতগুলো পশু ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে।" ব্যানা মনে মনে তৈরি হয়ে যায়, নিজেকে একটা রক্ত-মাংসের যন্ত্রের মত সঁপে দেয় কয়েকজন চরম শরীরভুক নারী-পুরুষের পৈশাচিক উৎসবে। 
      এই এখন তেমনটাই অনুভব করছে ব্যানা। মর্গের লাশের মত পড়ে থাকতে থাকতেও বুঝতে পারছে কয়েক জন মানুষের উপস্থিতি, তারা তার খাট থেকে মাত্র কয়েক পা দূরেই ঘোরা ফেরা করছে। ব্যানা যতটা বুঝেছে, তাকে একটা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। সেই ঘরটার বাইরে রয়েছে বাকি লোকজন। হয়ত তারা আজকের নতুন কোন যন্ত্রণাদায়ক ভোগের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করছে, তৈরি হচ্ছে আগামী কয়েক ঘন্টা ধরে তাকে চরম যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। 
        আঘাতের উপর আঘাত লাগতে লাগতে যেমন ব্যাথার অনুভূতিটাও কমে যায় ঠিক তেমনি অবস্থা এখন ব্যানার। ব্যানার অনুভূতি তাকে বলে দিচ্ছে, তার শরীরে কোন কাপড় নেই। প্রতিটা লজ্জাস্থানে চাপ-চাপ ব্যাথা। পায়ুর মুখটা মাঝে মাঝেই দপদপ করে উঠছে। 
     ভগবান কে সেটা জানে না ব্যানা। রাসুকে দেখতো একটা কাঠের তাকে কয়েকটা ছবিতে ফুল দিতে। ব্যানা দেয়নি কখনো। কিন্তু এখন ব্যানা ভাবে, ভগবানের সঙ্গে দেখা হলে, জানতে চাইবে তার মাকে কেন তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। মা থাকলে তাকে রাসুর কাছে আসতে হত না, আর রাসুর কাছে না আসলে জৈসার খপ্পরেও পড়তে হত না। রাসুই যে তাকে এই নরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, সেকথা এখন ব্যানার কাছে স্পষ্ট। 
   একটা শক্ত, কড়া পড়া হাতের স্পর্শে চমকে ওঠে ব্যানা। সেই দৈত্যের মত লোকটা। আজও তাকে এর খাবার হতে হবে ভেবেই বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো ব্যানার। ভয়ানক যন্ত্রনাটা কি ভাবে সহ্য করবে সেটাই ভেবে পায় না ব্যানা। আগে তাকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হত, আস্তে আস্তে কখন জ্ঞান চলে যেত সে বুঝতেই পারতো না। এখন আর দেওয়া হয় না ইঞ্জেকশন, ব্যানার ছটফটানি, গোঙানি, কান্না সবটাই যেন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে শয়তানগুলো। 
      ব্যানার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। এবার তাকে উপুড় করে শোয়ানো হবে। মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকে ব্যানা। 
     হঠাৎ একটু তর্ক-বিতর্কের চাপা কিন্তু তীব্র আওয়াজ কানে আসে ব্যানার। জৈসার সঙ্গে এক পুরুষের বাগবিতন্ডা চলছে। সেই লোকটা জৈসাকে বলছে, 
-- হামনে ইতনা মানি ইনভেস্ট কিয়া আপকি ইস প্রোজেক্টপর, পর আভিতক কুছ রিটার্ন নেহি মিলা। এয়সে নহি চলনেওয়ালা। ইস লন্ডেকো তো আজ ফিনিশ করনা হ্যায়। জাদা দিন ইঁহাপর রুক নহি সকতে হো আপলোগ। 
রাগী গলায় জৈসা বললো, 
-- এ বাত তো ঠিক হ্যায়, আপনে ইনভেস্ট কিয়া, পর হামনে ভি আপনা সিস্টেম ওর আদমীওকো নহি ইনভেস্ট কিয়া হোতা তো এ কাম হোতা ক্যা? আজতক ইস প্রোজেক্টকো অঞ্জাম কিসনে দিয়া? অর রহি বাত রিটার্ন কি, ও আপকো জরুর মিলেগা, কামতো খতম হোনে দিজিয়ে! 
ঠিক তখনই দরজায় আলতো একটা শব্দ হল। জৈসা চুপ করে গেল। সেই পুরুষকণ্ঠও আর কোন কথা বললো না। 
*        *          *         *          *          *             *   
রাজেনের ইশারা পেয়ে এগিয়ে গেল দীপু। বিজয়ার পাশের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে দুবার আলতো করে টোকা দিল। কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে যখন কোন শব্দ পাওয়া গেল না, কেউ এসে দরজাটা খুলেও দিল না, তখন দরজার পাশের কলিংবেলটা টিপলো। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর যখন দীপু আবার দরজায় জোরে নক করতে যাবে, ঠিক তখনই খুলে গেল দরজাটা। 
একজন বেশ পেশীবহুল চেহারার লোক দরজা খুলে দীপুকে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলো। 
-- কাকে চাই? 
দীপু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো, লোকটার পরনে একটা জংলি প্রিন্টের কার্গো প্যান্ট, গায়ে একটা নীল টি শার্ট। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। দেখে মিলিটারি মনে হয়। দীপু প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিয়ে বললো, 
-- আমি এই পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। একটু আলাপ করতে এলাম। আচ্ছা, কিছুক্ষণ আগে একটা গোঙানির মত আওয়াজ পেলাম মনে হল। তাই ভাবলাম কোন সমস্যা হয়ে থাকতে পারে, যদি কোন সাহায্য করতে পারি ... 
দীপুর কথা শেষ করতে না দিয়ে লোকটা যেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, 
-- না, কোন সাহায্যের দরকার নেই। আপ যাইয়ে। 
কথাটা বলেই লোকটা দাম করে মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনি সেখানে এসে দাঁড়ালো রাজেন। 
-- কিন্তু আমরা যে সাহায্য করবো বলেই এসেছি। আপনার লাগুক বা না লাগুক সাহায্য আমরা করবোই। এবার দরজাটা ছেড়ে দাঁড়ান তো-- আমাদেরকে ভিতরে ঢুকতে দিন। কথা বলতে বলতেই রাজেনের হাতে উঠে এসেছে সার্ভিস রিভলভার। পিছনে জনা দশেক সশস্ত্র সঙ্গী। 
    দরজায় দাঁড়ানো ষণ্ডা গোছের লোকটা প্রথমে একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেও পরক্ষণেই দরজাটা সর্বশক্তি দিয়ে বন্ধ করতে গেল, কিন্তু রাজেনের বুট পায়ের একটা জোরালো লাথিতে দরজাটা দড়াম শব্দ করে হাট হয়ে খুলে গেল। ততক্ষণে লোকটা বিদ্যুৎ গতিতে ভিতরে ঢুকে গেছে। তার পিছন পিছন হুড়মুড় করে রাজেন আর তার সঙ্গীরা ঢুকে পড়লো ঘরে। দীপু আর তপু বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরের ভিতর থেকে ভয়ানক একটা ধস্তাধস্তির শব্দ এল, আর তারপরেই একটা গুলির শব্দ। রাতের শহুরে নিস্তব্ধতা চৌচির হয়ে গেল ফায়ারিং এর শব্দে। দীপু আর থাকতে পারলো না, প্রচন্ড উদ্বেগ নিয়ে ভিতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। রাজেন আর তার দুই সঙ্গীর রিভলবার তাক করা রয়েছে দুই মহিলার দিকে। রাজেনের বাকি সঙ্গীরা সেই ষণ্ডা গোছের লোকটাকে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে মেঝেতে ঠেসে ধরে আছে। 
দীপু দেখলো দুই মহিলার এক জনের শরীরে পোষাক প্রায় নেই বললেই চলে। অন্য জনের শরীরের উর্ধাঙ্গে কোন পোষাক নেই। সে একটা ওড়না জাতীয় কিছু দিয়ে প্রাণপনে নিজের নগ্নতাকে ঢাকার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে সেই মহিলা একটা স্টিল আলমারির পাশে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো। 
   দীপুর হঠাৎ করে খেয়াল হল, গত কয়েক দিন ধরে বিজু পিসি, তপু আর সোম যে গোঙানি আর কান্নার শব্দ শুনেছে, ওদের যতদূর মনে হয়েছে সেগুলো কোন টিনেজ ছেলের। তাহলে? সেই ছেলেটা বা যেই হোক না কেন সে কোথায়? দীপুর তখনি মনে হল বিজু পিসির ফ্ল্যাটের মতই এটাও একই নক্সার হলে বিজু পিসির বেডরুমের মত এখানেও একটা বেডরুম থাকার কথা। সেখানেই হয়ত আটকে রাখা হয়েছে কাউকে, যার গোঙানি শুনেই গত কয়েকদিন ধরে বিজু পিসি, তপু আর সোম বার বার ফ্লাটের দরজা ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু কেউ যখন সাড়া দেয় নি তখন ওদের সন্দেহ হয়। রাজেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিজু পিসি। খোঁজ খবর করতে জানা যায় প্রতি বুধ আর শনিবার রাতে এই ফ্ল্যাটে কয়েক জন পুরুষ আর  মহিলা আসে। ফ্ল্যাটটা যার নামে কেনা সে থাকে সিঙ্গাপুর, তার কোন এক আত্মীয় রাজ সিং দেখা শোনা করে। রাজেন এই রাজ সিং কেই টার্গেট করে আজকের অপারেশনটা প্ল্যান করেছে। যাতে টার্গেট আর তার দলবল এই ব্যাপারটা টের না পায় তাই এই বিয়ের অনুষ্ঠানের নাটকটা করা। 
     দীপু রাজেনের পিছন দিয়ে ড্রয়িং রুমটাকে আড়াআড়ি পেরিয়ে যেতেই দেখতে পেল দরজাটা। ভিতর থেকে বন্ধ। লকটা কয়েকবার ঘোরাতেই খুলে গেল দরজাটা। দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢুকতে গিয়ে একটা শক্ত অথচ নমনীয় কিছুতে বাধা পেয়ে থমকে গেল দীপু। একটু ভালো করে পরখ করার পর বুঝতে পারলো, ওটা একটা সাউন্ডপ্রুফ ডিভাইডার। দু-একবার একটু এদিক ওদিক ঠেলা দিতেই ডিভাইডারটা খুলে পড়ে গেল। সেটার ওপাশে চোখ পড়তেই দীপুর সমস্ত শরীর ঘেন্নায় রি রি করে উঠলো। বিছানার উপর একটা তেরো চোদ্দ বছরের সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছেলের শরীরের উপর চেপে আছে একজন মানুষ। সেই মানুষটাও একেবারে উলঙ্গ। বন্য পশুর মত সেই মানুষটা ছেলেটার শরীরটাকে একটা মাংসপিণ্ডের মত ছিঁড়ছে। এরকম পাশবিক যৌন আনন্দ কোন মানুষ যে ভোগ করতে পারে সেটা দীপুর জানা ছিল না। রাগে তার কান-মাথা একেবারে গরম হয়ে গেল। ঠিক তখনই দীপুর চোখে পড়লো, ঘরের একটা কোণে ট্রাইপডের উপর রাখা একটা অত্যন্ত উন্নত মানের ক্যামেরা, সেটাতে বিছানার উপর ঘটতে থাকা সব কিছু রেকর্ডিং হয়ে চলেছে। 
       দীপু এক-পা দু-পা করে একটু এগোচ্ছিল বিছানার দিকে, কিন্তু ওকে থেমে যেতে হল, ওর উপর একটা কিছু ঝাঁপিয়ে পড়ে দীপুকে মেঝেতে আছড়ে ফেললো। দীপু মেঝেতে পড়ে থেকেই দেখতে পেল, তপু একটা লোককে তার উপর থেকে তুলে ক্যারাটের কয়েকটা মারে ঘায়েল করে দিল। দীপু এবার উঠে লোকটার মাথায় একটা জোরালো রদ্দা বসিয়ে দিতেই লোকটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। 
   ঘরের মধ্যে যখন এই সব ধস্তাধস্তি চলছে, তখন বিছানা থেকে ব্যানাকে ছেড়ে দিয়ে সেই পশুর মত লোকটা নেমে পালাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু ততক্ষণে রাজেনের বাহিনী ঢুকে পড়েছে ঘরে। তারা লোকদুটোকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে চলে গেল। 
     এসবের মধ্যেই তপু ব্যানাকে বাঁধন মুক্ত করে বিছানার উপর তুলে বসিয়েছে। কিন্তু ব্যানা বসতে পারলো না। ধপ করে বিছানার উপর পড়ে গেল। শরীরে কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই তার। 
     তপুকে ব্যানার কাছে রেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল দীপু। ড্রয়িং-এ তখন বেশ কয়েকজন মহিলা কনস্টেবল পৌঁছে গেছে। তারা প্রায় উলঙ্গ মহিলাকে একটা নাইটি পরিয়েছে। কিন্তু আলমারির পাশে লুকিয়ে দাঁড়ানো মহিলার মুখ তখনও ওড়নায় ঢাকা। রাজেন সোম কে সমস্ত ঘটনার ভিডিও এবং ছবি তোলার দায়িত্ব দিয়েছে। সোম চারদিকে ঘুরে ভিডিও করছে, এখন সে আলমারির পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। 
     কয়েকজন মহিলা কনস্টেবল আলমারির পাশে লুকোনো মহিলার ওড়নাটা ধরে টানাটানি করতে লাগলো, কিন্তু সেই মহিলা কিছুতেই মুখের উপর থেকে ওড়নাটা সরাতে দিচ্ছে না। কয়েকবার এরকম টানাটানি করার পর একজন মহিলা কনস্টেবল সেই মহিলার গালে একটা প্রচন্ড চড় কষিয়ে দিতেই মহিলার হাতের মুঠো আলগা হয়ে ওড়নাটা খসে পড়ে গেল মুখ থেকে। 
আর ঠিক তখনই সবাইকে হতবাক করে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে উঠলো সোম, 
-- মা-আ-আ! 
সোমের চিৎকারে তপুও ব্যানার কাছ থেকে ছুটে এসে সেই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল। এ কাকে দেখছে সে? সোমের মা এদের সঙ্গে? খোঁজ-খবরে যতটা তথ্য উঠে এসেছিল তাতে দু'জন মহিলার নাম জানা গেছিল, একজন জৈসা অন্য জন ভিমি। এই ভিমিই কি তবে সোমের মা? মাথা কাজ করছে না তপুর। সে সোমের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সোম নিজের মুখটা দু-হাতে ঢেকে মেঝেতে বসে পড়েছে। তীব্র একটা কষ্টের চাপা কান্না ভেসে আসছিল সোমের কাছ থেকে। তপুর বাহ্যজ্ঞান যেন লোপ পেয়েছে একেবারে।  কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। ঠিক তখনই বিজয়া এগিয়ে এসে সোমের হাত ধরে তুলে দাঁড় করালেন। সোমকে দু-হাতে চেপে ধরে বললেন, 
--কোথায় তোর মা? কি যাতা কথা বলছিস? 
কিন্তু সোম বিজয়ার কথার কোন উত্তর দিল না। তপুও ততক্ষণে সোমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সোম একবার তপুর দিকে তাকিয়ে বিজয়ার হাত ছাড়িয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে গেল ফ্ল্যাটের জানালার দিকে। তারপর কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই গ্রিল হীন জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়লো নীচের পাথুরে মেঝেতে। চারতলার এই অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা সব মানুষের কানে শুধু একটা ধপ করে শব্দ এসে পৌঁছালো। 
এই ঘটনার এক মাস পর: 
বিজয়া আজ যাবেন ছেলের কাছে। রাত আটটায় ফ্লাইট। ফ্ল্যাটের চাবিটা তপুকে দিয়েছেন। এই একমাসে মেয়েটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। সেই উচ্ছৃঙ্খল, ডাকাবুকো, সব রকম নিয়ম ভাঙা মেয়েটা কেমন শান্ত, নির্বিকার হয়ে গেছে। সোম হাসপাতালে দিন তিনেক লড়াই করে যে দিন চলে গেল, তপু সেই দিন সেই সময় থেকে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। অদ্ভুত একটা কঠিন মোড়ক দিয়ে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। আগের মত যখন তখন বেরিয়ে পড়ে না, এখন কাজ ছাড়া আর বাইরে বেরোয় না তপু। 
বিজয়া তপুকে এই ফ্লাটের দায়িত্ব যেমন দিয়েছেন, রাজেনকে বলে দীপুরও একটা কাজের ব্যবস্থা করেছেন। এরমধ্যে বিজয়া একদিন উমার কাছেও গেছিলেন। কিন্তু তপুর সম্পর্কে উমাকে কিছু বোঝাতে পারেন নি। খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে সবাই সব জেনেছে, উমাও জেনেছেন। তপুকে এই সম্পর্কে একটাও প্রশ্ন করেন নি উমা, কিন্তু তার পর থেকে তপুর সঙ্গে বাক্যালাপ করেন নি এখনও। বিজয়া বুঝেছেন উমা আদরের মেয়ের মানসিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইছেন না। 
তপুকে এখানেই একটা ফিজিওথেরাপির কিওর সেন্টার করে দিয়েছেন বিজয়া। তার ফ্ল্যাট যে কমপ্লেক্সে সেখানেই একটা ছোট ঘরে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তপু আগামী কয়েকদিনে সেখানেই কাজ শুরু করবে। 
সাতটা বাজে। ওলা এসে গেছে। এখান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে খুব বেশী হলে আধ ঘন্টা লাগার কথা, তবু একটু আগেই বেরোবেন ঠিক করে রেখেছেন বিজয়া। অপেক্ষা করছেন একজন বিশেষ মানুষের জন্য। তার হাতে আপতত তপুকে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারবেন। 
তপু একটা কাপে কফি ঢেলে বিজয়ার জন্য নিয়ে এল। নিজেও নিল একটু। বিজয়া কফিতে চুমুক দিতে দিতে একবার তাকালেন তপুর দিকে। এতটা কাঠিন্য আগে কখনও দেখেননি তপুর মুখ-চোখে। সমস্ত আঘাত সহ্য করার জন্য নিজেকে একটা পাথরের মূর্তির মত করে নিচ্ছে মেয়েটা। বিজয়ার বুক চিরে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। 
ঠিক তখনই বেজে উঠলো কলিংবেলটা। তপু উঠতে যাচ্ছিল, বিজয়া বারণ করলেন। তিনি উদগ্রীব হয়ে ছিলেন যার জন্য, তার আসার কথা তপু জানে না, বিজয়া ইচ্ছা করেই জানান নি। 
বিজয়া দরজাটা খুলে দিলেন। তপু সোফা থেকে উঠে একটু পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে তপুর মুখ থেকে একটা অদ্ভুত বিপন্নতা মেশানো শব্দ বেরিয়ে এল, 
-- মা! 

বিজয়া উমাকে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে এলেন। এই টুকু করতে যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কি চরম মানসিক টানাপোড়েন গেছে তা শুধু জানেন বিজয়া আর উমা। আজো বিজয়া নিশ্চিত ছিলেন না, যে উমা আসবেন। বৌদিকে যতটা দেখেছেন বিজয়া, মানুষটার অসম্ভব আত্মসম্মান বোধ আর জেদ ভেঙে তাকে দিয়ে কোন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো প্রায় অসম্ভব। যখন উমাকে বলেছিলেন, তপুকে তিনি নিজের ফ্ল্যাটটা দিয়ে যেতে চান, ভবিষ্যতে তপু ওখানেই সেটল হোক এটাই তিনি চান, উমা একেবারেই রাজি ছিলেন না। 
   উমাকে ভিতরে সোফায় বসিয়ে বিজয়া ঘড়ি দেখলেন, সাতটা পাঁচ। ব্যাগপত্তর আগেই নামিয়ে দিয়ে এসেছে তপু। এবার তাকে বেরোতে হবে। তপুকে একটা চুমু খেয়ে দরজাটা খুলে বেরিয়ে পড়লেন বিজয়া। অনেক দূরের পথ যেতে হবে তাকে। বৈদুর্য তার অপেক্ষায় আছে। 
      (সমাপ্ত) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments