জ্বলদর্চি

কাশ্মীর গ্রেট লেক ট্র্যেক/(উৎসব ১৪২৮)/নরেন হালদার


কাশ্মীর গ্রেট লেক ট্র্যেক
নরেন হালদার

বাঙালি ভ্রমণপিপাসু হলেও ট্রেকিংয়ে তেমন আগ্রহী নয়। পরিশ্রম করে পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করা তাদের হয়তো রক্তে নেই। তাই ট্রেকিংয়ে বাঙ্গালিদের খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যেও ব্যতিক্রম থাকে। যেমন আমার মত আরো দু’ চারজন পরিশ্রম বিলাসী বাঙালি। যারা হয়তো প্রচুর টাকা খরচ করে বিলাসবহুল গাড়িতে চেপে জানালার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মন ভোলাতে পারে না। যতটা সম্ভব পুরো প্রকৃতির মাঝে ডুবে গিয়ে সমগ্রকে আত্তীকরণ করতে চায়। তাতে না থাকে জানালার ফাঁক, না থাকে জনগণের কোলাহলপূর্ণ দৃশ্য দূষণ না থাকে প্রকৃতি দূষণ।

“Haven in Earth” বলা হয়ে থাকে কাশ্মীরকে। স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ছিল সেই স্বর্গে কিছুদিন বেঁচে আসা। এবং সেটা ট্র্যেকিংয়ের মাধ্যমে করব এ দৃঢ়তা ছিল‌ই। গেলামও তাই।

   বেসক্যাম্প সোনমার্গ - হোটেল সোনমার্গ প্যালেস। Flite-এ কলকাতা থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে শ্রীনগর। সেখান থেকে Privet Car-এ করে সোনমার্গ। রাত সাড়ে আটটায় গিয়ে পৌঁছলাম বেসক্যাম্পে। সোনমার্গ পৌঁছানোর পথে প্রথম আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে ৮ পি.এম.-কে রাত বলবো না সন্ধ্যা বলবো! কারণ আটটার সময়েও চারিদিকে গোধূলির আলো ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের চূড়ায় একখণ্ড সূর্যের আলোও খেলে বেড়াচ্ছে। পরে অবশ্য ভৌগোলিক বুদ্ধি মাথায় খেলে যেতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। আমি এসেছি দেশের পূর্ব প্রান্ত থেকে এবং সোনমার্গের উচ্চতা ২৭৪০ মিটার। 
   রাতে ট্র্যেক-কোডিনেটর, ক্যাম্প-লিডার এবং গ্রুপ-সদস্যদের সাথে পরিচয় হল। বেশিরভাগ সদস্য গুজরাট থেকে আগত। তারপর মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক। বেঙ্গল থেকে কেবল আমরা দুজন বাঙালি, আমি ও আমার স্ত্রী।

   পরদিন সকালে Group Exercise, দুপুরে Acclimatization Walk। সমতলের তিন থেকে চার হাজার মিটার উপরে পাহাড়ে চড়াই-উতরাই করতে হবে - শরীরকে তো তার উপযুক্ত করতেই হবে। বেসক্যাম্প সোনমার্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রথমেই আমাকে মুগ্ধ করে তুলেছিল। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে উঁচু-নিচু টিলা (স্থানীয় ভাষায় টেবিল টপ) সবুজের গালিচা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। দূষণমুক্ত পরিবেশ তাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছিল। আর তার উপর অসংখ্য মিউলের বিচরণ। দূরে Thajiwas Glaicier থেকে বরফ গলা জলের ধারা নেমে এসেছে। তবে এটি সোন্দর্যের আবাসভূমি হলেও ভয়ের যথেষ্ট কারণও আছে। তিনদিন আগে পাহাড়ি জঙ্গল থেকে দুটি ভাল্লুক বেরিয়ে এসে তিনজন ট্র্যেকারকে নাকি যখম করেছিল।

   তৃতীয় দিন আমাদের ট্র্যেক শুরু। গন্তব্য নিচনাই ক্যাম্প। উচ্চতা ১১৯৪৮ ফুট বা ৩৬৪২ মিটার। দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি। বেসক্যাম্প সোনমার্গ থেকে বেরিয়েই আমরা উঠতে শুরু করলাম টেবিল টপের দিকে। সবুজ গালিচার উপর হেঁটে চলা সারিবদ্ধ লাইন যেন প্রকৃতির নিয়মই বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া। সবুজ গালিচা যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে নিজের কোলে ডেকে নিচ্ছে। টেবিল টপের উপরে একটা স্থানীয় দোকান। এখানে ট্র্যেকাররা ইচ্ছে মত ম্যাগি বা চকোলেট বা আরো কিছু খেয়ে নিতে পারে। আমরা অনেকেই সেখানে বয়ে আনা Pack-Lunch সেরে নিলাম। তারপর আবার হাঁটা। বনের ভেতর দিয়ে। ম্যাপল, পাইন, ভোজ ইত্যাদি নানা গাছ যুগ-যুগান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছে এ পথের আশেপাশে। তাদের এখানেই সৃষ্টি, এখানেই ক্ষয়, এখানেই মাটির সাথে মিশে যাওয়া। নগর সভ্যতার দুষ্টুলোকের হাত এ গাছের উপর কোনদিন পড়েনি, আর পড়বেও না বলে আমার ধারণা। একটু এগিয়েই দেখা পেলাম বরফ গলা জল ধরার। তার পাশদিয়ে এগিয়ে চললাম উৎসের দিকে। উৎস আমাদের পৌঁছে দিল নিচনাই ক্যাম্পে। 

   চতুর্থ দিনের গন্তব্য বিষ্ণুসার ক্যাম্প। উচ্চতা ১২১৫২ ফুট বা ৩৭০৪ মিটার। দূরত্ব প্রায় পনেরো কিলোমিটার। পরের দিন সকালে নিচনাই ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বরফ গলা জলের ধারাটি অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম। জলধারার ওপর বরফ জমাট বেঁধে আছে, নিচ দিয়ে ফুল্গু ধারার মতো ঠান্ডা জল বয়ে চলেছে। খুব সাবধান। জমাটবাঁধা বরফের নরম জায়গায় পা পড়লে বা একবার পা স্লিপ হলে সোজা গিয়ে পড়তে হবে নদীতে। নদী পার হয়ে আবার চড়াই। লম্বা Trail ধরে এগিয়ে চলা। চড়াই এসে শেষ হলো নিচনাই পাশ-এ।

   আমাদের এই Trek-এ তিনটি ‘Pass’ অতিক্রম করতে হবে। নিচনাই পাশ (১৩৪৫৮ফুট), গডসার পাশ (১৩৭৬৩ ফুট) এবং জ্যাক পাশ (১৩৪২৬ফুট)। তিনটি পাশের উচ্চতা কমবেশি কাছাকাছি। পাশ বলতে খুব সহজভাবে লম্বা একটি পাহাড়ের চূড়া, যেখান থেকে বৃষ্টি বা বরফ গলা জল দুদিকে নেমে যায়। অর্থাৎ একটি ভ্যালি থেকে অন্য একটি ভ্যালিতে যাওয়ার মধ্যবিন্দু।
   নিচনাই পাশ-এর উপর দাঁড়িয়ে মনে হল এ এক আজব সুন্দর জায়গা। মাথার উপর দিগন্ত বিস্তৃত খোলা নীল আকাশ। ৩৬০ ডিগ্রী জুড়ে বিস্তৃত বরফ শুভ্র পাহাড়চূড়া দেখে নিজেকে বিজয়ী বলে মনে হল। পর্বতের গায়ে গায়ে ছেঁড়া সাদা তুলোর মতো জমে থাকা বরফখণ্ড, পরিস্কার নীল আকাশ আর বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পাহাড়চূড়া যেন সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

 এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত অজেয় পর্বত আমার পায়ের কাছে এসে নিজেদের অস্তিত্বকে জানিয়ে যাচ্ছে। সকলের সমান উচ্চতায় আমি দাঁড়িয়ে আছি।
   এখান থেকে আবার নিচের দিকে Trail ধরে নেমে আসা বিষ্ণুসার লেকের দিকে, যেখানে আমাদের ক্যাম্প পাতা হয়েছএ। ডানদিকে অসংখ্য বনফুলে সমৃদ্ধ তৃণভূমি, অন্যদিকে পাহাড়। সামনে এগিয়ে বরফঢাকা পর্বতের কোলে দুটি স্বচ্ছ জলের হ্রদ বিষ্ণুসার এবং কৃষ্ণসার আমাদের গন্তব্য পথে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। মন কোন এক অচেনা আনন্দে বারবার নেচে উঠছিল এ দৃশ্য দেখএ। ক্যাম্পে এসে Welcome drinks সঙ্গে Hot soup শরীরকে ক্লান্তিমুক্ত করে দিয়েছিল এক নিমেষে। 

   বিষ্ণুসার লেক থেকে বয়ে আসা জলের স্রোতে মাছেরা খেলা করে ইচ্ছেমত। স্রোতের পাশে বসে মাছের এই খেলা অনায়াসেই লক্ষ্য করা যায়। কিছু লোক রাতে ছিপ ফেলে সেই মাছ শিকার করে। আপনি পাঁচশ টাকা খরচ করলেই দুটি মাছ ফ্রাই করে আপনার কাছে দিয়ে যাবে।

   পঞ্চম দিনের গন্তব্য গডসার ক্যাম্প। উচ্চতা ১০৭৭৭ ফুট বা ৩২৪৫ মিটার। ট্র্যেকিংপথ প্রায় ২১ কিলোমিটার। পরেরদিন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে Trail ধরে গডসার পাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। ‘পাশ’ থেকে সৃষ্টিকর্তার সৌন্দর্য দেখা এক আলাদা অনুভূতি। সেখান থেকে ৮০ ডিগ্রী কোণ করে আবার নিচে নেমে আসা। গডসারের আলপাইন তৃণভূমির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সৌভাগ্যে নিজেকে এবং সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে থাকা যায় না। একে জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলে মনে হয়। এ পথে চলতে চলতে আরো কিছু ছোট ছোট হ্রদের দেখা পাওয়া যাবে। সেগুলোও যেন সৃষ্টিকর্তা সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে ট্র্যেকারদের জন্য। মনোরম গডসার লেক-এর আরেক নাম Velly of Flowers। নাম না জানা কত বন্যফুল চলার পথের দুপাশে ফুটে আছে যেন আমাদের স্বাগত জানানোর জন্যই। নগর জীবনে যেমন কোনো অনুষ্ঠানে সুন্দর দৃষ্ট মানবী কিছু পরিচিত ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য, এখানে প্রকৃতি সেই মানবী। যুগ যুগ ধরে এ অভ্যর্থনা পাওয়ার পিপাসি হয়ে উঠেছিলাম। সমস্ত নগর-জীবনকে উপেক্ষা করে এই নাম-না-জানা ফুলের রাজ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম। তারাও যেন কোন এক বন্ধনহীন মায়ায় আমাকে বাঁধতে চেয়েছিল। হেঁটে চললাম তার উপর দিয়ে।

 কিছুক্ষণ বাদে এরকমই এক সজ্জিত ফুলের তৃণভূমির উপর Lunch Point স্থির করা হলো। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি জলধারা। বড় বড় পাথরের ফোকলগলে জলধারা বয়ে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। Lunch করতে বসে মনে পড়ে গেল নগর জীবনে অভ্যস্ত Lunch Table-এর কথা। সেখানে টেবিল সাজানো থাকে কিছু কৃত্রিম ফুল দিয়ে, কিন্তু এ Lunch Table তো ভগবানের সৃষ্টি। ভগবান নিজের হাতে বিভিন্ন রকমের বন্য ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে আমাদের এই টেবিলকে। মৃদু হাওয়ায় যখন ফুলগুলি দোল খায় তখন হৃদয়ের প্রতিটি কোষ আনন্দে মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার সমগ্র ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে নাচতে থাকে।

   এরপর এগিয়ে চললাম গডসার ক্যাম্পের দিকে, ফুলের ভ্যালিকে অতিক্রম করে। কিছুদুর যাওয়ার পর বাঁদিকে পাহাড়ের কোলে গডসার লেক। পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা সাদা বরফের প্রতিবিম্ব এসে পড়েছে জলের উপর। প্রতিবিম্বের ছবি দেখে তাকে লেক বলে ভ্রম হয়। যেন ওইরকম আরেকটা পাহাড় ঠিক ওই পাহাড়টির নিচেই উল্টে রয়েছে। এখান থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে আমাদের ক্যাম্প।

   ষষ্ঠ দিনের গন্তব্য সতসার ক্যাম্প। উচ্চতা ১১৮৬০ ফুট বা ৩৬১৫ মিটার। দূরত্ব প্রায় ১৪ কিমি। পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায় Breakfast করে Pack-lunch নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। ক্যাম্পের পাশেই ২৫ মিটার লম্বা মোটা একটি বরফের আস্তরণ। অনেক বছর ধরে এ বরফের কোন ক্ষয় নেই। তার উপর দিয়েই আমাদের রাস্তা। যেতে হবে সাবধানে। বরফের উপর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবেনা। একটানা হেঁটে জমাট বাঁধা বরফের রাস্তাটুকু পেরোতে হবে। পেরিয়ে গেলাম। আবার আমাদের চড়াই পাহাড়ের উপরে। চড়াই সম্পন্ন করে আবার পাহাড়ের গা বেয়ে সরু রাস্তা। একদিকে পাহাড় চূড়া অপরদিকে খাদ। খাড়াই নয়, অনেকটা হেলানো। কিন্তু দুদিকেই বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে তৃণভূমি, আর তার মধ্যে ফুটে রয়েছে হাজারো রকমের নাম-না-জানা ফুল। গাইডের সহযোগিতা নিয়ে একটি ফুলের পরিচয় জানতে পারলাম, সেটি স্ট্রবেরি ফুল। স্ট্রবেরি নামটার সাথে কেমন যেন আমার একটা আবেগমিশ্রিত কৌতুহল ছিল। এর আগে কোনদিন স্ট্রবেরি ফুল বা গাছ দেখিনি। ফলে কৌতূহলটা অমূলক নয়। আমরা এগিয়ে চললাম। রাস্তা এবার প্রায় সমতল। হাঁটতে কোন কষ্টই হচ্ছিল না।

   সাতসার কথার অর্থ সাতটি সার বা লেক। ছোট-বড় সাতটি লেকের সৌন্দর্য এই Treking পথটিকে সাজিয়ে রেখেছে। সাতসার ক্যাম্প পর্যন্ত আমরা পাঁচটি ছোট ছোট লেক দেখতে পেলাম, যেগুলি প্রায় একরকম ভাবে অবস্থান করছে পরপর। ছ’ নম্বর লেকে যেতে হলে একটু পাহাড়ের উপর দিকে উঠতে হবে। ক্যাম্প থেকে বাঁদিকে। ক্যাম্পে ব্যাগপত্র রেখে যেতে হবে। গাইড আমাদের নির্দেশ দিল যে যে যেতে ইচ্ছুক তারা যেতে পারে। গ্রুপের ২৩ জন সদস্যের মধ্যে আমরা ছ’জন রাজি হলাম। আমার একটাই বক্তব্য, পরিশ্রম বা কষ্ট কোন কিছুকে আত্তীকরণ করা থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। বাকিদের না-যাওয়ার একটাই কারণ বলে মনে হল - অতিরিক্ত পরিশ্রম। গাইডকে অনুসরণ করে আমরা এগিয়ে গেলাম। অনেকটাই চড়াই। বড় বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে, তার উপর দিয়েই যেতে হবে। চললাম। 

   এ লেকের জল আরো স্বচ্ছ। লেকটা অনেকটা কানাউঁচু গামলার অর্ধেকটা জল ভরলে যেমন দেখায়, ঠিক তেমন। তিন দিকের পাহাড় খাঁড়াভাবে নেমে গেছে লেকের ভিতর। জলের ভেতরে পড়ে থাকা পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আলাদাভাবে এই লেকের নাম রাখা হয়েছে সাতসার। উপরের দিকে আরো একটি লেক রয়েছে। কিন্তু গাইডের বারণে আমার ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলো। ফিরে এলাম ক্যাম্পে।

   সপ্তম দিনের গন্তব্য গঙ্গাবল লেক। উচ্চতা ১১৪৮২ ফুট বা ৩৫০০ মিটার। দূরত্ব প্রায় ১০ কিমি। মাঝে অতিক্রম করতে হবে Trek-এর তৃতীয় Pass জ্যাকপাশ (Zach Pass)। উচ্চতা ১৩৪২৮ ফুট বা ৪০৯৩ মিটার। সাতসার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ছোট একটা জলাধারাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলাম। কিছুদুর যাবার পরেই রাস্তা এসে পড়ল বড় বড় পাথরের উপর। প্রায় ৭০০ মিটার চড়াই এই রকম পাথরের উপর দিয়ে, এগিয়ে গেলাম। এ দিনের আবহাওয়া আমাদের সম্পূর্ণরূপে সঙ্গ দেয়নি। পুরো আকাশ জুড়ে কুয়াশা ও মেঘের ঘনঘটা। চলার পথে অনবরত তারা আমাদের নাকে-মুখে ঢুকে ব্যতিবস্ত করে তুলেছিল। দূরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের চোখ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছিল।

 পনেরো-কুড়ি ফুট দূরের কোন কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবু এগিয়ে চললাম। কিছুদূর যাবার পর বড় বড় পাথর গুলো আমাদের পথ ছেড়ে দিল। আমরা মসৃণ রাস্তা ধরে উপরে উঠতে লাগলাম। আরো কিছুদুর যাবার পর গাইডের কথামতো বিশ্রাম। আরো অন্য গ্রুপের সদস্যরা এখানে বিশ্রামে বসেছে। আমিও বসলাম। দু’পাঁচ মিনিট পরেই কানে এল একটি সুন্দর গান – Afree Afree…। গায়ক কে, বুঝতে অসুবিধা হলো না - রাহাত ফতে আলী খান। কোন এক Treker সজ্ঞে করে Bluetooth Speker নিয়ে এসেছে, তাতেই গান বাজছে। Treking-এর সময় কানের কাছে এরকম নাগরিক গান বাজুক, এটা আমার পছন্দ নয়। কারণ যাত্রাপথের সৌন্দর্য উপভোগে ও বড় ব্যাঘাত ঘটায়, সম্পূর্ণ মনকে সমর্পণ করতে বাধা দেয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এই জগতে। কিন্তু বিশ্রামের সময় এটুকু নাগরিক ছন্দের স্পন্দন ভালই লাগলো। গান শুরু হওয়ার এক-দু সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ চলে গেল এক তরুণী তন্বীর দিকে। গানের ছন্দে সে দাঁড়িয়ে পড়ে কোমর দোলাতে শুরু করেছে। ক্রমান্বয়ে তা একটি Western Dance-এ পরিণত হল। আমি এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে দুবার ভাবিনি। এরকম একটি উচ্চতায় এরকম একটি বিনোদন, সমগ্র ট্র্যেকিংটাকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল।


   তারপর আবার এগিয়ে চললাম Zach Pass-এর উচ্চতার দিকে। খুব দূর নয়, আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম Trek-এর তৃতীয় Pass Zach Pass-এ। পুরো Pass জুড়ে বরফের এক লম্বা রাস্তা। এখান থেকে পর্বতশ্রেণীর শৃঙ্গের একটা Panoramic View দেখতে পেলাম। আর দূরে বরফাবৃত ‘হরমুখ’ পর্বত শৃঙ্গ। Kashmir Region-এর অন্যতম উচ্চতম শৃঙ্গ এটি। উচ্চতা ১৬৮৭০ ফুট বা ৫১৪৩ মিটার। শৃঙ্গটি দেখতে অনেকটা কৈলাস পর্বতের মত। তাই হয়তো এর নাম রাখা হয়েছে হরমুখ। কিন্তু মেঘের সাথে শৃঙ্গের লুকোচুরি খেলা আমাদের নিরাশ করে দিয়েছিল তার প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে। নিচে হরমুখের কোল ঘেঁষে দুটি হ্রদ - নন্দকোল ও গঙ্গাবল অবস্থিত। Zach Pass-এর চূড়া থেকে দেখা এদুটি লেকের ছবি মনের আয়নায় চিরকালের জন্য বাঁধানো হয়ে থাকবে। কাশ্মীরের অন্যতম বৃহত্তম এই গঙ্গাবল লেক। এছাড়া এই দুই লেকে প্রচুর মাছ আছে। নিকটবর্তী নারানাগ গ্রাম থেকে অনেকেই ছিপ নিয়ে চলে আসে এখানে মাছ ধরতে।
 Zach Pass থেকে গঙ্গাবল লেক পুরোটাই উতরাই এবং পুরোটাই খাড়াই। আমরা নেমে এলাম। নন্দকোল লেকের কাছে আমাদের ক্যাম্প, গঙ্গাবল থেকে কিছুটা দূরে। ক্যাম্পে যাওয়ার পথে একটু ঘুরে গঙ্গাবল লেকের জলের স্পর্শ নিয়ে উপস্থিত হলাম ক্যাম্পে।

   অষ্টম দিনের গন্তব্য নারানাগ গ্রাম, সেখান থেকে গাড়িতে করে বেসক্যাম্প। Treking দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি। পরের দিন ক্যাম্পের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী পার হলাম এক এক করে। জলে প্রচন্ড স্রোত। দুপ্রান্তে পাথর চাঁই করে তার উপর একটা লম্বা গুরিকে মোটা করে চেরাই করে ফেলে রাখা হয়েছে। এই গুঁড়ির ওপর দিয়ে কেবল মাত্র একজনই খুব সাবধানে পার হতে পারবে। পা একটু অসাবধান হলেই সঙ্গে সঙ্গে জলে। আর জলে পড়লে স্রোত আপনাকে বড় বড় পাথরের উপর আছাড়ি-পিছাড়ি করে জান বের করে নেবে। অতএব সাবধান। 

   আমরা গাইডের সহযোগিতায় এক এক করে নদী পেরিয়ে গেলাম। তৃণ আবৃত ছোট টেবিল টপ-এর গা-ঘেঁষে, হরমুখকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে চললাম। তারপর হাজির হলাম ইন্ডিয়ান আর্মির চেকপোষ্টে। এখানে অন্যান্য গ্রুপের সদস্যের সাথে সাথে আমাদের সকল সদস্যেরও পরিচয়পর্ব সমাপন করে এগিয়ে চললাম। সামনে ঘনবন দেবদারু গাছের, সঙ্গে উতরাই। এ বনেও নাকি ভল্লুকের বসবাস। একাকী কোন Treker বা পথচারীকে পেলে তারা আক্রমণ করে। অতএব গাইডের নির্দেশ, সকলকে দলবেঁধে চলতে হবে। দলবেঁধে চললাম। কিন্তু পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসার উত্তেজনা আর দেবদারু বনের সৌন্দর্য কিছুতেই আমাকে ভল্লুকের ভয়কে পাত্তা দিতে দিল না। সারিবদ্ধ দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে রহস্যময় সৌন্দর্যের আনাগোনায় আমি যেন বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বারবার নিজেকে হারিয়ে দিচ্ছিলাম। এভাবেই আমরা নেমে এলাম নারানাগ গ্রামে।

   আমাদের Treking যখন শেষ হলো তখন বিকেল তিনটে। সেখানে অপেক্ষমান গাড়ি ধরে সোজা সোনমার্গ এবং সেখান থেকে মেদিনীপুর। কি অসম্ভব ভালোলাগা নিয়ে যে ফিরলাম তার হয়তো কিছুটা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে পারলাম। কিন্তু তার বেশির ভাগটাই স্থায়ী হয়ে রয়ে গেছে আমার মনের মনিকোঠায়।

ছবি - লেখক
___________

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments