সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক
পর্ব – ৫
ষষ্ঠ অধ্যায়
১৬
কফিশপে বসে আছে বিহান ও রূপক৷ এস এস সি-তে চাকরি হয়েছে দু’জনেরই৷ আজই স্কুলে জয়েন করেছে ওরা৷ আলাদা আলাদা স্কুল৷ দুটো স্কুলই শহর লাগোয়া৷ আগে থেকেই ঠিক ছিল সন্ধ্যায় ওরা এই কফিশপেই বসবে৷ পড়াশুনোর চাপ, টেনশন আজ আর সেসব কিছুই নেই৷ আনন্দ আছে বুকভরা৷
“স্কুলে কোন সুন্দরী দিদিমণি আছে নাকি তোর বয়সী?” রূপকের মুখে দুষ্টুমির হাসি৷
“না৷ সবাই সিনিয়র৷ তোর স্কুলে?”
“আছে একজন৷ ভীষণ হাই-ফাই৷ আমার সাধারণ মেয়ে চাই৷”
“সেটাই ভালো রে৷ হাজার হোক আমরা তো মধ্যবিত্ত৷”
“তবে একটা বাইক কিনতেই হবে এবার৷ নাহলে বেশ কিছু টাকা মাসে মাসে অটোভাড়া আর রিক্সাভাড়াতেই চলে যাবে৷ সাইকেল নিয়ে কি স্কুলে যাওয়া যায় বল?”
“আমিও সেকথাই ভাবছি৷ আর সাইকেল নয়৷ কয়েকটা মাস যাক৷ একটু টাকা পয়সা জমুক৷ তারপর একদিন শোরুমে যাওয়া যাবে৷ কি বলিস?”
“হ্যাঁ, একটু টাকা পয়সা জমুক, তারপর৷ বোনের জন্য ছেলে দেখছে৷ আমরা তো যজম৷ বিয়ের বয়স হয়েছে বোনের৷ বাবা আর দেরি করতে চাইছে না৷ কাজেই যেকোন দিন বিয়ের সানাই বেজে যাবে বাড়িতে৷ আমাকেও তো কিছু খরচ করতে হবে৷ বোনকেও দিতে হবে কিছু৷”
“ওহ্, তাহলে ভাই তুই বাজে খরচ একদমই করিস না৷ টাকা জমা৷ বাইক না হয় কিছুদিন পরেই কিনলি৷”
“হ্যাঁ রে৷”
“আমারও তো টাকা জমাতেই হবে৷ মায়ের শরীর ভালো থাকে না, জানিসই তো৷ দু’মাস আগেই ভর্তি করতে হয়েছিল হাসপাতালে৷ বাবা তো পুলিশের সামান্য চাকরিতেই অনেক করলো৷ এবার আমাকেই দেখতে হবে সবটা৷”
জীবনের সবথেকে আনন্দের দিনেও বিহান ও রূপক বর্তমান আর ভবিষ্যতের চিন্তাভাবনা নিয়ে কথা বলছে৷ বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবন তো এরকমই৷ সেখানে চাকরি পাবার আনন্দে বন্ধুদের নিয়ে পার্টি হয় না, মদের ফোয়ারা ওঠে না, সারারাত বান্ধবীর সঙ্গে কাটানো যায় না৷
১৭
অবশেষে হলো রিইউনিয়নটা৷ অনেকদিন ধরেই প্ল্যানিং চলছিল৷ সমস্ত ক্রেডিট শতরূপার৷ ও-ই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ কলেজে বিহান, তৃষা, রূপক, তুহিন আর শতরূপা – এই পাঁচজন একসঙ্গে থাকতো৷ কলেজ শেষ হবার পর সবার সঙ্গে সবার কম-বেশি যোগাযোগ থাকলেও, তৃষার সঙ্গে শুধু শতরূপারই যোগাযোগ ছিল৷
তুহিন আর শতরূপা কলেজ থেকেই প্রেম করছে৷ তুহিনের বাবা হার্ডওয়্যারের বড় ব্যবসায়ী৷ কলেজ শেষ করেই তুহিন বাবার ব্যবসায় যোগ দেয়৷ এম এ করেছে ডিসটেনসে কিন্তু চারকির চেষ্টা করেনি, বলা ভালো সেকথা ভাবেইনি৷ তুহিন ও শতরূপার বিয়ের আর দু’মাস বাকি৷ তার আগে এই রিইউনিয়ন৷
বিহান আরেকবার মুখোমুখি হলো বদলে যাওয়া তৃষার৷ একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে বসেছে ওরা সবাই৷ তুহিন ও শতরূপা ওদের বিয়ের কার্ড তুলে দিয়েছে সবার হাতে৷ খাওয়া দাওয়া চলছে দেদার৷ সেসঙ্গে পানও৷ কলেজের স্মৃতি ভেসে উঠছে সবারই কথায়৷
সবার অলক্ষ্যেই বিহানের চোখের সঙ্গে তৃষার চোখের ঘর্ষণ হচ্ছে৷ আগুন জ্বলছে তবে দেখা যাচ্ছে না৷ বিয়ের পর তৃষা যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে৷ বিহানের চোখ ওর নিজের কথা শুনছে না, ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃষার শরীরে৷ হঠাৎ বিহানের মোবাইল বেজে উঠল৷ বিহানের বাবার ফোন৷ বিহান বাড়িতে সব বলেই এসেছে৷ এত তাড়াতাড়ি ফোন আসার কথা নয়৷
১৮
এবার আর মা-কে সরকারি হাসপাতালে নয়, একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে বিহান৷ পাঁচ দিন হলো৷ স্কুলের সময়টুকু বাদে বাকি সময় এখানেই থাকে বিহান৷ রাতে বাড়ি যায় শুধু৷ বিকেলের দিকে রূপক আসে রোজ৷ মায়ের শরীর এবার একটু বেশিই বিগড়ে যায়৷ তবে এখন অনেকটাই ভালো আগের থেকে৷
দুপুরে নার্সিংহোমের পাশেই একটা হোটেলে খেতে খেতে বিহানের বাবা বিহানকে বললো, “পাঁচ দিন তো হয়ে গেল৷ কাল শুনেছিলাম বিল চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে৷ মা-কে হাসপাতালে ভর্তি করলেই পারতি৷ যাই হোক, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দেখ কবে ছুটি দেবে৷ কথা বলে আজ কালের মধ্যে ছুটি করিয়ে নে৷ এখন তো তোর মা অনেকটাই ভালো আছে৷ বাকিটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখা যাবে৷”
“হ্যাঁ, দেখি, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আজ কথা বলবো৷”
“হুম৷ কী কথা হয় জানাস৷”
“ঠিক আছে৷ তুমি বাড়ি চলে যাও৷ আমি দেখি ডাক্তারবাবু আছেন কিনা৷”
বাবাকে অটোতে তুলে দিয়ে বিহান নার্সিংহোমে ফিরে এলো৷ ওষুধের দোকান থেকে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিলো৷ তারপর এগিয়ে গেল রিসেপশনের দিকে৷ একটি মেয়ে বসে আছে৷ নীল-কমলা চুড়িদার৷ চোখে কাজল৷ কপালে ছোট্ট টিপ৷ চুলে ক্লিপ, সুন্দর করে বাঁধা৷ ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক্৷ বিহান জিজ্ঞেস করলো, “এক্সকিউজমি, ড. সরকার কি চলে গেছেন?”
সপ্তম অধ্যায়
১৯
ভাইজাকের সমুদ্রসৈকতের ওপর ছড়িয়ে আছে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোক৷ আকাশ একেবারে পরিষ্কার৷ ওপরে আকাশে তারারা টিমটিম করছে আর নীচে সমুদ্রে টিমটিম করছে বহুদূরে ভাসমান নৌকো ও জাহাজের আলো৷ একটা পাথরের ওপর বিহানের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে রূপাঞ্জনা৷ কাছেই একটা হোটেলে উঠেছে ওরা৷ রূপাঞ্জনার খুব ইচ্ছে ছিল ভাইজাক ঘুরবে৷ তাই হানিমুনের প্ল্যানিংটা এখানেই করেছে বিহান৷ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রূপাঞ্জনা বলে, “দ্যাখো চাঁদটা মনে হচ্ছে সমুদ্রে নেমে স্নান করবে একটু পরেই৷”
“ওই চাঁদ কী করবে জানি না৷ তবে এই চাঁদের যদি ইচ্ছে থাকে আমি সাহায্য করতে পারি৷” মুচকি হেসে বললো বিহান৷
“তাই? আমার সব ইচ্ছে তুমি পূরণ করবে?”
“ইচ্ছে তো করে তোমার সব ইচ্ছেকে আমার ইচ্ছের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে পূরণ করতে৷ কিন্তু আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু, ততটুকুই পারবো৷”
“কে বলেছে তোমার সাধ্যের বাইরে আমি কিছু চাইবো?”
“তবু... মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে, বিশেষ করে...”
“চুপ চুপ চুপ৷” বিহানের ঠোঁটে আঙুল রেখে বিহানকে থামিয়ে দেয় রূপাঞ্জনা৷ “তোমাকে সারা জীবনের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি৷ এটাই আমার স্বপ্ন পূরণ৷ আর কিচ্ছু চাই না আমার৷”
“আমারও তাই৷ তুমি আমার সঙ্গে আছো৷ ব্যাস, আমারও আর কিছু চাই না৷”
সমুদ্রের জল এসে লাগছিল ওদের পায়ে৷ এমন একটি রাতের জন্যই তো কতদিন অপেক্ষা করে ছিল ওরা৷ আজ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই ঢেউ উঠবে ওদের মনে৷ আজ সেই রাত, চাঁদের আলোর নীচে সমুদ্রের মতো সেই রাত, যে রাত ফুলসজ্জার মতোই জীবনে একবার আসে৷
২০
ডিনার করে হোটেলরুমে ফিরে এসেছে বিহান ও রূপাঞ্জনা৷ রূপাঞ্জনা ফ্রেশ হতে ঢুকেছে বাথরুমে৷ বিহান সেই ফাঁকে ব্যালকনিতে বসে সিগারেট ধরিয়েছে৷ বাড়িতে ফোনও করে নিয়েছে৷ বিহান এর আগে বাংলার বাইরে কোথাও যায়নি৷ বাবার স্বল্প আয়ে সেই শৌখিনতা সম্ভবও ছিল না৷ আগাগোড়াই হিসেব করে চলতে হয়েছে বিহানকে৷
চাকরি পাবার পর থেকে, বিশেষ করে রূপাঞ্জনা জীবনে আসার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাও নতুন রূপে ফিরে আসে বিহানের মধ্যে৷ বেশ কিছু ভালো পত্রিকায় বিহানের কবিতা প্রকাশিতও হয়েছে৷ একটা পাণ্ডুলিপিও তৈরি করে ফেলেছে৷ জীবনের প্রথম কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি৷ নাম ‘স্বপ্নের পুনর্জন্ম’৷ হ্যাঁ, বিহানের স্বপ্ন পুনর্জন্ম নিয়েছে৷ রূপাঞ্জনার মধ্যে দিয়ে নিয়েছে৷
বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে বিহান ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢোকে৷ সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছে রূপাঞ্জনা৷ জিরো ওয়াট আলোয় রূপাঞ্জনাকে এক চাঁদপরির মতো লাগছে৷ বিহান জড়িয়ে ধরে রূপাঞ্জনাকে৷ তোয়ালে মেঝেতে পড়ে যায়৷ শ্বাস আর রক্তে প্রবল গতি৷ তারপর গোটা রুমটাই যেন এক অলৌকিক সমুদ্র হয়ে ওঠে৷ তাতে দু’টি মাত্র ঢেউয়ের তীব্র উথালপাথাল৷
২১
শপিং করে রুমে ফিরে এসেছে রূপাঞ্জনা ও বিহান৷ দু’জনই ক্লান্ত৷ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলো দু’জনই৷ দুপুরের খাবার খেতে এখনও অনেকটা সময় বাকি৷ রূপাঞ্জনা বললো, “কত টাকার কেনাকাটা হলো আজ?”
“যা হয়েছে, হয়েছে৷ হানিমুন একবারই হয়৷ যা খরচা হচ্ছে হোক৷ তাছাড়া বাইরে ঘুরতে এসে সবার জন্য কিছু না কিনে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা বাজে দেখায়৷”
“সেটা অবশ্য ঠিক৷ তবে আমি বোধহয় একটু বেশিই খরচা করিয়ে ফেললাম তোমাকে৷”
“হানিমুনে এসে তোমার জন্য এটুকু না করতে পরলে আমার কি ভালো লাগতো?”
“আচ্ছা আজকে সমুদ্রের ধারে একটু আগে আগেই যাবো, কেমন? একটু বেশিক্ষণ থাকবো৷ কাল তো দুপুরের আগেই স্টেশনে পৌঁছে যেতে হবে৷”
“হ্যাঁ, বিকেলেই যাবো৷ ফিরে আসবো আগে আগেই৷ রাতে খাবারের পর একদম ইচ্ছে করবে না গোছগাছ করতে৷ খেতে যাবার আগেই সবকিছু গুছিয়ে নেবো৷”
“আচ্ছা৷”
“কাল দশটার মধ্যেই স্টেশনে চলে যাবো৷ দুপুরের খাবারটা ওখানেই সেরে নেওয়া যাবে৷ ভিড় হবে ভালোই৷ আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে একটা বড় ঘূর্ণিঝড়ের আছড়ে পড়ার কথা অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে৷ অনেকেই রিজার্ভেশন থাকা সত্ত্বেও তৎকালের চেষ্টা করছে৷ স্লিপার আর জেনারেলে তো ভয়ংকর ভিড় হচ্ছে রোজ৷”
“ভাগ্যিস আমরা কাল ফিরে যাচ্ছি৷ টিকিটটাও এসি-থ্রি-তে হওয়াতে খুব ভালো হলো৷”
“হ্যাঁ৷ টিকিটের পেছন একটু বেশি টাকা গেলেও, এই ভিড়ের মধ্যে শান্তিতে ফেরা যাবে৷ আমাদের ওদিকেও ঝড়ের প্রভাব পড়বে বলছে৷ তিন দিন সময় আছে৷ বাড়ি পৌঁছে যেতে পারলে শান্তি৷”
সমুদ্র উত্তাল না হলেও আকাশে মেঘের ঘটঘটা৷ চাঁদের দেখা নেই আছ৷ মাইকে সতর্কতামূলক প্রচার শুরু হয়ে গেছে৷ ভাষা বোঝা যায় না৷ বেশি রাত করলো না বিহান৷ রূপাঞ্জনাকে নিয়ে উঠে পরলো সমুদ্রের পার থেকে৷ আজ ওদের হানিমুনের শেষ দিন৷ দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে যেন কেটে গেল৷ অনেক ভালো ভালো জায়গা ঘুরেছে ওরা৷ কাল দুপুরে ফেরার ট্রেন৷
২২
ট্রেন ঢুকছে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে৷ স্টেশনে মারাত্মক ভিড়৷ ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই সব ট্যুরিস্ট ঘরে ফিরছে৷ একে তো গুমোট গরম, তার ওপর লাগেজ টেনে একেবারে ঘামস্নান হয়ে গেছে বিহানের৷ রূপাঞ্জনারও একই অবস্থা৷
“ওফ্, বাঁচা গেল৷” রূপাঞ্জনা ঘাম মুছে নিচ্ছে৷
“হ্যাঁ, এবার শান্তি৷ বাইরে যা গরম৷ পুরো তন্দুর হয়ে আছে৷ এ সি-তে টিকিটটা করে কী যে ভালো করেছিলাম৷”
“হ্যাঁ, নাহলে পুরো সেদ্ধ হয়ে যেতে হতো৷”
ওপর থেকে এ সি-র ঠান্ডা হওয়া নেমে আসছে৷ ভেতরে সমস্ত প্যাসেঞ্জারের মুখেই স্বস্তি৷ লোয়ার আর মিডল বার্থ পেয়েছে বিহান ও রূপাঞ্জনা৷ এক পাঞ্জাবী বয়স্ক দম্পতি এসে বসলো৷ আধ ঘন্টার স্টপেজ৷ এখানে ট্রেনের সব পরিষ্কার-টরিষ্কার করা হয়৷ ইঞ্জিনও পাল্টানো হয়৷ অনেকটা সময় থাকায় কোন তাড়াহুড়ো নেই৷ সবাই ধীরে সুস্থেই উঠছে৷
বিহান নীচে নেমে হাতমুখটা ধুয়ে নিলো ভালো করে৷ কোল্ড ড্রিংস আর কিছু চিপস কিনে নিল৷ দুটো দুই লিটারের জলের বোতলও৷ ট্রেন সিগন্যাল পেয়ে গেছে৷ দূরে হলুদ আলো টিমটিম করে জ্বলছে৷ ইঞ্জিন থেকে ক্রমাগত হর্ন বাজতে লাগলো৷ এবার একটু তাড়াহুড়ো চোখে পড়ছে৷ একটা হ্যাচকা টান৷ ট্রেন চলতে শুরু করলো৷ শোনা না গেলেও দেখা যাচ্ছে, হাত নেড়ে নেড়ে বিহানকে ডাকছে রূপাঞ্জনা৷ বিহান দৌড়ে উঠে পড়লো ট্রেনে৷
সিটে এসে বসতেই পাথর হয়ে গেল বিহান৷ বাকরুদ্ধ৷ চক্ষুস্থির৷ উল্টোদিকে বসে আছে তৃষা৷ বিহানের বুকের ভেতর অন্য এক ঘূর্ণিঝড় তখন তছনছ করে চলেছে ওকে৷ বিহান কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না৷ মনেও প্রবল আশঙ্কা৷ আজ কি রূপাঞ্জনা জেনে যাবে বিহানের কবিতার জন্মকথা? ওর প্রথম স্বপ্নের কথা? তৃষার দিকে অবাক হয়ে অপলক তাকিয়ে আছে বিহান৷ নীরবতা ভেঙে দিলো তৃষাই – “আরে, বিহান! তুই এখানে?”
“আপনি চেনেন ওকে?” প্রশ্ন করে রূপাঞ্জনা৷
“আমরা কলেজ ফ্রেন্ড৷ সেম ইয়ার, সেম ডিপার্টমেন্ট৷ আপনি?”
“আমি বিহানের ওয়াইফ৷”
“ওহ্, আচ্ছা৷ তার মানে আপনারা ঘুরতে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ, এখানেই৷ হানিমুন৷”
“ও আচ্ছা আচ্ছা৷ এই বিহান, লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে নিলি৷ ইনভাইটও করলি না?” বিহানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তৃষা৷
“না আসলে তুই তো এখন অন্য শহরের বাসিন্দা, তাই মাথায় আসেনি৷ যাই হোক, আছিস কেমন বল? সঙ্গে কে উনি? আর এই দুষ্টুটা যেভাবে তোকে চিপকে আছে, নিশ্চয়ই ও তোর ছেলে?”
“হ্যাঁ৷ আর ইনি আমার জা৷ আমার হাসবেন্টের ভাইজাকে ট্রান্সফার হয়েছে একবছর মতো হলো৷ দাদার ট্রান্সফার হয়েছে আমাদের ওখানেই৷ দাদা দিদি এসেছিলেন আমাদের এখানে৷ দাদার হঠাৎ জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে যান৷ দিদিকে যেতে দিইনি তখন৷ আমার হাসবেন্ট তো সময়ই পায় না একেবারে৷ অগত্যা আমাদের দু’জনকেই যেতে হচ্ছে৷”
বিহান ও রূপাঞ্জনাকে নিজের জা-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় তৃষা৷ বিহানের বুকের ঝড় আস্তে আস্তে থেমে আসে৷ তিন মহিলার গল্প জমে উঠেছে৷ বিহান উঠে পড়ে৷ বাথরুমে ঢোকে৷ সিগারেট ধরায়৷ তৃষাকে তো বহু কষ্টে ভুলিয়ে দিয়েছে বিহান৷ তবু কেন বারবার ও সামনে চলে আসছে? কেন বিহানের বুকের নীচে এক কবরে চাপা দেওয়া অজস্র ছবিকে খুঁড়ে বার করতে চাইছে ওর ভাগ্য? নিজেকেই প্রশ্ন করে বিহান৷ ট্রেন ছুটছে৷ কিন্তু বিহান যেন থেমে আছে৷ শুধু থেমেই নেই, ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ৷ ডুবে যাচ্ছে পুরোনো স্মৃতির চোরাবালিতে৷
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments