জ্বলদর্চি

দুটি অণুগল্প /(উৎসব ১৪২৮)/স্বপন শর্মা

দুটি অণুগল্প 

স্বপন শর্মা

গরিবিয়ানা
 

অটো-ড্রাইভারের পাশে বসে রোজ বিকেলে চাকদহ থেকে মালোপাড়ায় নামি। ড্রাইভার আমাকে দেখেই বলে, আসেন খোকনকাকা, আপনার জন্য জায়গা রেখে দিয়েছি। ধন্যবাদ ভাইপো , বলে  আমি আগে ভাড়াটা দিয়ে দিই যাতে ওকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে না হয় ।
প্রতিদিনের  মতো এমনি এক বিকেলে দশটাকা  ভাড়া মিটিয়ে  সবে বসেছি, এমন সময় এক মধ্যবয়সিনি অটো ড্রাইভারকে জিগ্যেস করেন , কখন ছাড়বা ? কথায় স্থানীয় ভাষার টান।
--এখনি, ওঠে বসুন ।
-- বলছি বটতলা নাপব । ভাড়া কত ?
-আটটাকা ।
--একটু কম হবে না ?
--আরে মাসি বটতলার ভাড়াই আটটাকা। ট্রেনে যান, কমে হয়ে যাবে।
--বলছি, পাঁচটাকা নিয়ো ।
--কলতলা অব্দি ভাড়াই তো পাঁচটাকা ।
--ঠিক আছে , কলতলাতেই নামিয়ে দেবা ।
 অটো ছাড়ার পর দুটো স্টপেজ পরে এক ভদ্রলোক ওঠেন। ওঠেই মধ্যবয়সিনিকে দেখে
বলে ,  আরে বউদি , কোথায় গেছিলা ?
--একটু চাকদায় গেছিলাম । তুই ভালো আছিস , ভোলা? অনেকদিন পরে দেখা ।
--ইতিমধ্যে নানা কথায় কলতলা পেরিয়ে যায় । অটো-ড্রাইভার জিগ্যেস করে ,
এখানে নামলেন না দিদি ?
--নাহ, বটতলাতেই নাপব।

বটতলা এলে ছ’টাকা দিয়ে নেমে যায়। চেহারায় দারিদ্রের ছাপ নেই। পরনে অবশ্য খুবই কম দামি শাড়ি। এলোমেলো চুল। মহিলা বলেন, তুই কলতলায় নামিয়ে দিলি না কেন ? তাহলে তো পাঁচটাকায় হয়ে যেত ।
---আর  দু-টাকা দিন । আপনি তো বললেন বটতলাতেই নামবেন ।
---ঠিক আছে এই নে । শেষে মহিলা দু-টাকা দিয়ে দেয় ।
মহিলা নেমে যাওয়ার পর অটো-ড্রাইভার মহিলার পরিচিত সেই ভোলাকে জিগ্যেস করে, দাদা এই মহিলা কি খুবই গরিব ?
--আরে না । এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী পরিবার। কোটিপতি । নিজে পঞ্চায়েতে চাকরি করেন । ওঁর স্বামী ইট-সিমেন্ট-বালির বিরাট বড়  ব্যবসায়ী । মেয়ে চাকরি করে।  তিনতলা বাড়ি। প্রচুর জায়গা-জমি ।
--অটো-ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলেন তো খোকন-কাকা , যার এত পয়সা,  ভাড়া নিয়ে কি বারগেনিংটা করল ! আমি তো ভাবছিলাম ভিক্ষুক। কি
অবস্থা ! যার যত বেশি টাকা, সে দেখছি তত বেশি গরিব। 



প্রিয় পাঠিকার পাঠ

অজয় যখনই কোন গল্প লেখেন , তাঁর প্রিয় পাঠিকা পিংকিকে দিয়ে একবার পড়িয়ে নেন। পিংকি লেখাটি বাড়ি নিয়ে যায় এবং পরের দিন ফেরত দেয়।  একই
অফিসে কাজ করায় অজয়ের সুবিধে অনেক । পিংকির সাহিত্যপ্রীতি অজয়কে মুগ্ধ করে ।  রূপচর্চায় যত্নবান এই সুন্দরী সহকর্মীর সান্নিধ্য পেতে অজয়ের মত
অনেকেই  উৎসাহী । অজয় বিষয়টাকে স্বাভাবিকই ভাবেন ।
           অজয় একদিন জিগ্যেস করেন , কিগো পিংকি, তুমি আমার লেখা পড়, অথচ কোন মতামত দাও না  কেন ?
---কি যে বলেন , অজয় সেনের লেখায় আমি মতামত দেব? আপনার সব লেখাই আমার ভালো লাগে । এই বলে রূপসি  পিংকি স্নিগ্ধ হাসি উপহার দেয় ।
---জানো,  একটা প্রবন্ধ আজই শেষ করলাম । তোমার কাজের চাপ তো আজ কিছুটা কম, একটু পড়ে যদি মতামত দাও, খুশি হব।
---- ঠিক আছে , দিন । পিংকি লেখাটি নেয় । অজয় নিজের চেয়ারে বসে নিজের কাজের ফাঁকে লক্ষ্য করেন পিংকি লেখাটি পড়ছে কি না ।

পিংকি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছে দেখে অজয় প্রথমে খুশি হন । কিছুক্ষণ পর অজয় কৌতূহলবশত চেয়ার থেকে  উঠে  দরজার আড়ালে গিয়ে দেখেন প্রথম পৃষ্ঠাটির ওপর মোবাইল রেখে মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে নানা ছবি দেখছে  পিংকি। বিবাহিতা এই ত্রিশোর্ধার পাশে অফিসের বড়বাবু  অতনু বিশ্বাস ফিস ফিস কথা বলে চলেন ।

মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কখনো চুল ঠিক করে , কখনো ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক গাঢ করে আবার কখনও রুমাল দিয়ে সুন্দর মুখের ঘাম মোছে সে। মাঝেমাঝে অতনুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ।

      অতনু চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ অজয় লক্ষ্য করেন একইরকম ভাবে লেখাটির ওপর পিংকি মোবাইল রেখে নানারকম ভাবে  নিজেকে দেখে চলে। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে নানা ছবি ও ম্য্যাসেজ দেখতে থাকে । এরই মধ্যে  অফিসের কাজে আসা বহিরাগতদের সঙ্গে কথা বলা ।

  দু-মাস ধরে খেটে লেখা প্রবন্ধটির প্রতি পিংকির এরকম অবজ্ঞা দেখে আগুনভজ্বলে  মধ্যবয়সি অজয়ের ভেতরে। তাঁর টয়লেট পেয়ে যায়।  প্রাকৃতিক  কাজ সেরে বেসিনে হাত ধুয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখেন, পিংকি হাসছে। ক্ষিপ্ত অজয় জোরে থুতু ফেলেন। বাইরে বেরিয়ে পিংকির  কাছে গিয়ে অজয় জিগ্যেস করেন,  লেখাটি পড়েছ , পিংকি ? পিংকি বলে, হ্যাঁ,  দারুণ লিখেছেন অজয়দা । অজয় লেখাটি চেয়ে নেন এবং কোন কথা না বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ মাথা নীচু  করে বসে থাকেন ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments