জ্বলদর্চি

খপ্পর-৪ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস : খপ্পর 
পর্ব: চার 
অনিন্দ্য পাল 

চিত্র- জাহ্নবী সেন

====== 
#পাঁচ
নুডলস গুলো কেমন জোলো লাগছে দেখে সরিয়ে রেখে উঠে পড়লো সোম। মা আজ আসেনি। বাবা যেমন তেমন করে নুডলস গুলো রান্না করেছে, রান্না না বলে সিদ্ধ করে রেখেছে বললেই ঠিক বলা হয়। এ সব খাওয়া যায়? মনে মনে গালমন্দ করতে করতে বিছানায় ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো। আগামী কাল ক্লাস আছে, প্রবলেম গুলো সেট করতে হবে। চৌধুরী ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে। পার্মানেন্ট না হতে পারলে ছ'মাসের খাটুনি একেবারে জলে যাবে। টাকাটা ভালো দেয় এরা তাই জান দিয়ে লেগেপড়ে আছে সোম। সদ্য মাস্টার্স শেষ করেই এই সর্বভারতীয় কোচিং সংস্থায় ঢুকেছে। মৈমি ম্যানেজ করেছে। নেট দিয়েছে একবার, প্রস্তুতি তেমন ছিলনা। কলেজটাই মূল টার্গেট, যদিও মৈমি, চায় সে রিসার্চ করুক, সেটা বাংলায় হোক, ভারতে হোক বা অন্য কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোক। সোম ও তেমনটাই চেষ্টা করছিল। মাঝখানে হঠাৎ করে এই তপু সব ওলট পালট করে দিল। তার পড়াশুনা, খেলাধুলো, সামান্য লেখালিখি সবই যেন হঠাৎ করে একটা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। না সে তপুকে পুরোপুরি গিলতে পারছে না পারছে ওর মুঠো থেকে বের হয়ে আসতে। ভালোখবর কাগজে বিজ্ঞানের কয়েকটা নিবন্ধ লিখে তপুর নজরে আসে সোম। তপু আর ওর কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ফেসবুক গ্রুপ চালায়। সেখানে সোমের লেখাগুলো পোষ্ট করে শান্তনু, সোমের স্কুলের ক্লাসমেট, সেও ওই গ্রুপের সদস্য। সেটাই কাল হল সোমের জন্য। গ্রুপের ওয়াল থেকে মেসেঞ্জার, মেসেঞ্জার থেকে হোয়াটসঅ্যাপ।
তারপর জড়িয়ে পড়া, মাকড়সার জালের মত। যতদিন যাচ্ছে তপু যেন একটা বিরাট পাইথন হয়ে উঠছে। গিলছে, কিন্তু সোম কোনরকম নড়াচড়া করতে পারছে না এমনকি চিৎকার করে মৈমিকে ও ডাকতে পারছে না। তবে ডেকেও যে খুব একটা লাভ হবে না সেটা সোম খুব ভালো করেই জানে। মৈমি তাকে অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছে, নিজের সমস্ত রকম সমস্যার সমাধান তাকে নিজেই করতে হয় । শুধু পার্সের দায়িত্ব নিয়েছে মৈমি, সেটাও একবছরের জন্য, এর মধ্যে নিজের পকেটমানি তাকে জোগাড় করতেই হবে, বাকি পড়াশুনার খরচ অবশ্যই মৈমির। 
মৈমিকে এখনও তপুর কথা বলে নি সোম। কি বা বলতো? তপুর সম্পর্কে সে নিজেই কনফিউজড। তার অনেক অপছন্দের কাজ, তপুর রোজকার অভ্যাস। সে বাধ্য না হলে স্মোক করে না, কিন্তু বাইরে বেরোলে তপু চেন স্মোকার। তার প্রথম অ্যালকোহল আজকেই, তপুর জন্য। তপু উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই চেখে দেখতে অভ্যস্ত। 
আরও অনেক ... মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। চিন্তাটা কোথাও একটা ঘাপটি মেরে থাকলো। রিসিভ করলো সোম, 
-- হ্যাঁ মা, বলো 
-- কি করছিস বাবু? ওপাশ থেকে মৈমি ফিসফিস শব্দে ছেলেকে ছুঁতে চায়। এভাবেই কথা বলে সে। অন্তত রাত্রে যখন ফোন করে, মৈমির শব্দ তখন একদম মাপা আর রহস্যময়। যেন একটু জোরে কথা বললেই কার ও ঘুম ভেঙে যাবে। 
-- ওই বাড়ি ফিরে খেলাম, এখন বিছানায়। তোমার আজ নাইট বলো নি তো? আমি ভাবলাম বাড়ি এসে চিকেন খাবো। 
-- কেন বাবা রান্না করে নি? কি খেলি? 
-- ওই নুডলস! জঘন্য! বাবা যে কেন ...
মৈমি এবার তেতে ওঠে। ফিসফিস স্বরে ধারালো হয়ে ওঠে তার শব্দ। 
-- একেবারে ওয়র্থলেশ! বার বার বলে এলাম, সব কিছু ঠিকঠাক করা আছে শুধু মাংসটা একটু কষিয়ে নিলেই হয়ে যেত। কিছুই পারে না। আসলে পারে সব ই, করবে না ইচ্ছা করে। আমার জীবনটাই একেবারে ম্যাসাকার করে দিল হারামজাদা শয়তান। না ফিনান্স, না হাউসহোল্ড! এতটা ইরেসপন্সিবল কি করে হয় একটা মানুষ? ছিঃ! 
দু'টো মোবাইলের দুদিকে খানিকটা ধোঁয়াটে নিস্তব্ধতা। 
কয়েক সেকেন্ড পরে সোম একটু সামলে উঠলো, কিন্তু তার মাথা কাজ করলো না, ফলে মোবাইলে সময়ের পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু হল না। 
-- বাবু তুই খেয়েছিস তো? না হলে ফ্রিজে ...কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো মৈমি, থেমে গেল। 
-- আচ্ছা রাখছি এখন, পরে কথা বলছি। 
আরও একটু চাপা স্বরে এবং অত্যন্ত দ্রুত শব্দ গুলো উচ্চারণ করলো মৈমি। মোবাইলে তখন 'কল এন্ডেড'।
 সোম থমকে থাকে অনেকটা সময়। 
মৈমি যখন এভাবে কথা বলে, তখন সোম চিনতে পারে না, চেনা মা'কে। গত কয়েক বছর ধরে মৈমির সঙ্গে সৌমেনের সম্পর্ক একরকমই। সোমের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার কয়েক দিন পরেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সৌমেনের কোম্পানি। ইন্দো-ব্রিটিশ কোম্পানিতে প্রথমে স্টেনো হয়ে ঢুকলেও পরে কম্পিউটার অপারেটর এ প্রমোশন পায়। কিন্তু রাজ্যে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই এই কোম্পানি সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল। ফলে তারা পাততাড়ি গোটায়। এককালীন লাখ খানেক টাকা ছাড়া আর কিছুই পায় নি সৌমেন। তাদের দাবী ছিল পেনশন দিক কর্তৃপক্ষ, কিন্তু কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, ফলে হঠাৎ পাওয়া বেকারত্ব ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় নি। আটচল্লিশ বছর বয়সে অন্য কোন চাকরি ও পাওয়া সম্ভব ছিল না, অন্তত সৌমেনের জন্য তো বটেই। ওই স্টেনোগ্রাফির বিদ্যেটা ছাড়া আর তেমন কিছু তার শেখা ছিল না, যেটা তাকে এই বয়সে খেতে দিতে পারে। পাওয়া টাকার খানিকটা নিয়ে ব্যবসা করতে চেষ্টা করেছিল। কয়েক বন্ধু মিলে পারফিউম, জামা প্যান্টের পিস, সালোয়ারের পিস নিয়ে বিভিন্ন অফিসে, স্কুলে কলেজে গিয়ে ক্যানভাসিং করে বিক্রি করা, কিন্তু দাঁড়ায় নি ব্যবসাটা। বছর খানেক সম্পূর্ণ বেকার হয়ে যখন অবসাদ পাশবালিশ হয়ে উঠেছে তখন থেকেই খেয়াল করলো সৌমেন, তার শুধু চাকরি যায় নি, পৌরুষও গেছে। সংসারটা চলছিল মৈমির টাকায়। মৈমি নার্স। সাহস দিচ্ছিল সৌমেন কে। তার মনের ধ্বস আটকাতে চেষ্টা করছিলো তখন, আদরে, ভালোবাসায়। নাইট ডিউটি নিত না মৈমি, ম্যানেজ মাস্টার ও চিরকাল। সোম কলেজে। তারা দিনের স্বচ্ছতায় নিজেদের আবিষ্কার করতে চাইতো। কিন্তু হতাশা সৌমেনকে খুঁড়তে কার্পণ্য করছিল না। আগে একা থাকলেই আসতো, আছড়ে ফেলতো একটা অন্ধকার কুয়োয়। সেই কুয়োটা অনেকটা তাদের গ্রামের বিষকুয়োর মত। লোকে বলতো ওই কুয়োটাতে যে কেউ পড়ে গেলে, যদি উঠেও আসতে পারে কোনোভাবে, তাও তাকে বাঁচানো যায় না। ওর নাকি জলে, মাটিতে বিষ। সেই বিষকুয়োয় ডুবে যাচ্ছিল রোজ। এমনকি যখন মৈমি তার সব কিছু দিয়ে ধুয়ে দিতে চাইছে সেই বিষ, তখনও। আস্তে আস্তে কি যে হল, সৌমেনের সব কিছু বিষের ছোবলে মরে যেতে থাকলো। তার ইচ্ছা, শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর সব ক্ষমতা হারিয়ে যেতে থাকলো। অনেক চেষ্টা করেছে সৌমেন, কিন্তু প্রতিবারই ভেঙে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে। যতই সে ভেঙে পড়তে লাগলো, যতই সে ডুবে যেতে থাকলো বিষকুয়োয়, ততই মৈমি সরে যেতে থাকলো, কখন যে সৌমেন বিষকুয়োর একেবারে নিচে নেমে এসেছে বুঝতে পারে নি, মৈমি বুঝেছিল। সে ডোবে নি সৌমেনের সঙ্গে। সাত বছরের ছোট মৈমি, সৌমেনের চেয়ে। তার জন্য জীবনটা এত সেপিয়া হয়ে যাবে এত তাড়াতাড়ি, সেটা মৈমি মেনে নিতে পারে নি। ডুবতে দিয়েছিল সৌমেনকে। 
  সৌমেন এখন ঘরেরবর। পরিবার সামলায়। কাজের লোক বলতে তোলাকাজের মাসিটা ছাড়া কেউ নেই। সৌমেন আছে। রান্না, বাজার, ঘরদোর গোছানো এরকম সবকিছু এখন তার রুটিন। মৈমি বলেছে, উপার্জন না থাক, ক্ষমতা না থাক এতে অন্তত সংসারের কাজ হবে, খানিকটা খরচ ও বাঁচবে। তা অবশ্য হয়েছে। মৈমি দিনের পর দিন হয়ে উঠেছে গৃহস্বামী। ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছে রহস্যময়ী। পাল্টে গেছে  
খোলস। একেবারে আধুনিক প্যাকেজে মুড়ে ফেলেছে শরীর , মন, কথাবার্তা চালচলন সব। সোম ও তেমনি রঙিন হয়ে উঠছে, মায়ের মত, আচারে ব্যবহারে অভ্যাসে, স্বাদে, গন্ধে। সৌমেন মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় এই মা ছেলের মধ্যে। আরও ডুবে যেতে থাকে বিষকুয়োয়। 

মাঝে মাঝে সোম ও চিনতে পারে না। সৌমেন কেও, মৈমি কেও। ছোটবেলার ভাড়া বাড়ির বাবা মা আর এখন এই চকচকে দক্ষিণ খোলা তৃতীয়তলের ফ্লাটের বাবা যেন এক নয়, অন্য কোন পরিবারে সে যেন দত্তক সন্তান। 
অভাব কখনও সে দেখেনি, বোঝেও না। তবুও কখনও সোমের ভিতরে একটা ম্যাগমা হোল জেগে ওঠে। বাবাকে এভাবে কাদায় মিশে যেতে দেখে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করে সব কিছু, নিজেকেও। 
চুপচাপ বসে থাকে সোম। ল্যাপটপটা অপেক্ষা করতে করতে স্লিপ মোডে চলে যায়। রাত নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments