জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-৪/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার
শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল

পর্ব : ০৪ 

শূন্যতা জীবনকে কী ভাবে গ্রাস করে আস্তে আস্তে টের পেতে শুরু করলাম। কালবৈশাখী আসার আগে মেঘলা আকাশে, দূর দিগন্তে লাল ধুলো ওড়ে। নেমে আসে ছায়া। অন্ধকার। বোঝা যায় ঝড় আসছে। একটা প্রস্তুতি থাকে মনে। নিরাপদে সরে যাওয়া যায়। কিন্তু এমন হঠাৎ ঝড়ের তেমন কোনও আগাম পূর্বাভাস আমার কাছে ছিল না। এই তো মাত্র ক'দিন আগেই জানলাম, অনুশীলা আমার একার। আমি আর অনু ছাড়া তো কেউ জানেই না সে কথা। এই অনিবার্য ভালোলাগার, সন্তুষ্টির অনুভবটুকু উপভোগ করার সময়ই পেলাম না। আমার জীবনে নেমে এল অন্ধকার। আমি কবে যে স্বাভাবিক হব জানি না। এত বড় একটা দুর্ঘটনা, এত বড় একটা প্রলয় , আমি তো বিশ্বাস করতেই পারিনি। আজও পারি না। আকাশের মুখ থেকেই প্রথম জানতে পারি, অনু আর নেই। 

আমি কলেজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সকাল বেলা। হঠাৎ দেখি আকাশ আমার বাড়িতে। আমি অবাক। ওর তো এই সময় কলকাতায় থাকার কথা। তাহলে কি হঠাৎ করেই ও বাড়ি ফিরেছে ? ওকে দেখেই সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগল। অবিন্যস্ত চুল। পোশাক। সম্পূর্ণ চেহারায় এক বিপর্যয়ের ছাপ ! 

আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করি, ' কী ব্যাপার আকাশ ? এখন এখানে? হঠাৎ ? কলকাতা থেকে কবে এলি ? এই তো আগের সপ্তাহেই গিয়েছিলি কলকাতায়?' এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করায় ও বোধহয় সব কটার উত্তর গুছিয়ে দিতে পারল না আমাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, 'ওসব পরে বলব। তুই এক্ষুণি চল আমার সঙ্গে। এক্ষুণি। আমার সব শেষ হয়ে গেল কেশব। সব। আমি একা হয়ে গেলাম, এই পৃথিবীতে!'
হাউমাউ করে কাঁদছে আকাশ। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
আমি স্তম্ভিত। নির্বাক। কী হয়েছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তবে বড় কিছু ক্ষতি হয়েছে বুঝতে পারছি। জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না। আমার মন কু ডাক দেয়। নদীর পাড়ে বসে যে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছিল অনু, সেরকম কিছু করে বসেনি তো! আমার ভয় করতে লাগল। পায়ের তলার মাটি যেন সরে সরে যাচ্ছে। আমার উপর ভর করে কাঁদছে আকাশ।
কোনোরকমে বললাম, 'কী হয়েছে আকাশ? আমাকে বল।'
আকাশের কান্নার ভেতর থেকে আওয়াজ এল। 
'চল।চল আমার সঙ্গে। আমি কিছু বলতে পারছি না এখন। একথা বলা যায় না।' 

একজন মানুষের জেদ, সামাজিক সম্মান রক্ষার তাগিদ, বাবা মেয়ের মায়াকেও অতিক্রম করতে পারে। কতটা নিষ্ঠুর হলে একজন বাবা তার মেয়ের জীবনের অকাল সমাপ্তি ডেকে আনতে পারে! কোনো ঘৃণা, অবজ্ঞা বা অবহেলাই যে এমন পাপীর জন্য উপযুক্ত নয়। শিবনারায়ণবাবু কি পাষাণ! 

জীবনে কখনও দেখিনি কোনও প্রিজজনের নিথর দেহ। ছাদের কড়ি বর্গায় ফাঁস লাগিয়ে নশ্বর শরীর ত্যাগ করেছে অনু। আমার চোখের সামনে এখন শায়িত। যেন এক পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। জীবনের অন্যান্য সমস্ত বিষয়কে দূরে সরিয়ে রেখে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে, ভালোবাসাই বেঁচে থাকার একমাত্র এবং শেষতম শর্ত। ভালোবাসার চেয়ে মহার্ঘ এ বিশ্বে আর কিছুই নেই। তার ধারণা আবেগের উপরে প্রতিষ্ঠিত, তার বিশ্বাস অপরিণত বয়সের প্রমাণ রাখে, এমন কেউ বলতেই পারে, কিন্তু তার ত্যাগের, উৎসর্গের যে দুর্নিবার নেশা, তাকে তো কোনো মাপকাঠিতেই একবিন্দু লঘু করা যায় না। এই বিশাল বৈভব তো আমার। এই অহংকারও আমার। আমি যেন আমৃত্যু এর সম্মান রাখতে পারি। আমি মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণাম করি। 

সমস্ত নিয়মকানুন শেষে, সব কিছু কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলাম। গতকাল অনুর বিয়ের দিন ধার্য করার জন্যই দু'বাড়ি বসেছিল আলাপ আলোচনায়। আকাশ এসেছিল সে জন্যই। তাহলে কি শেষ উপায় না দেখে, অনু আকাশকে বলেছিল আমার কথা। আকাশ মানেনি। নাকি অনু দুঃসাহস দেখিয়েছিল ওর বাবাকে বলার। এটা তো আমি কোনোদিনই জানতে পারব না। যদি সেরকমই কিছু হয়ে থাকে এবং আকাশ যদি নিজে এসে আমাকে বলে একমাত্র তবেই জানতে পারব। এই এক দোলাচল আমাকে কষ্ট দেবে আজীবন। 

#
শূন্যতারও একটা অদ্ভুত অনুভব আছে। এই অনুভব উদাসীনতার। নির্লিপ্তির। আত্মবিলয়ের। মনে হয় এই জীবনের কোনও অর্থ নেই। বেঁচে থাকার অধিকার বা প্রয়োজন শেষ। আমি এখন কী করব? অনু যে দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে, তার একমাত্র এবং সমস্ত দায়ই তো আমার। এ আমি কী করলাম! এই পাপ থেকে আমি কীভাবে মুক্তি পাব? আমার আজকাল আর ঘুম আসে না। আমার মাটির ঘর। খড়ের চাল। দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে দেখি শেষ রাতের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ। যে আলো দিতে দিতে ক্লান্ত। আমিও কি চাঁদের মতো ক্ষয়িষ্ণু? আমি কবিতা লিখি না। অথচ ক'দিন ধরেই এক নাম না জানা কবির মৃত্যুগন্ধ মাখা কবিতার লাইন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই কবিরও কি মনের অবস্থা আমারই মতো? জীবন মরণের ঘ্রাণ ও অনুভব মিশিয়ে লেখা এই কবিতা আমাকে ভীষণ ভাবে স্পর্শ করছে। কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে শূন্যতার ছাপ। মৃত্যুর আহ্বান দিয়ে জীবনের জয়গান লেখা। জীবনের সম্যক ধারণা ভালোবাসাকে ঘিরেই। এই কবিতাই আমাকে এখনও অক্সিজেন জোগাচ্ছে। আমি জানি জীবনের গতি যেদিকেই যাক আগামীতে, আমার পথচলায়, আমার ভাবনায় , আমার কর্মে, মর্মে অনুশীলাই হয়ে উঠবে আমার অন্তরালের আদর্শ। শূন্যের আবহে, চেতন অবচেতন যেন কখনও কখনও একাকার হয়ে যায়। কবিতার লাইন ধরে ডুবে যেতে থাকি ক্রমশ....। 

"আমার নিঃসঙ্গ কৈশোর মহাশূন্যতা আর অথৈ স্তব্ধতাকে ভেঙে দিল-  তোমার রক্ত স্বেদ শ্বাস স্নায়ু হৃদস্পন্দন।
স্পষ্টতা রহস্য মিলেমিশে একাকার!
পৃথিবীর ভেতর পৃথিবী লেখার ভেতর লেখা 
তোমার ভেতর আরেকটা তুমি আরেকটা তুমি আরেকটা তুমি-- আরও আরও--
আমার সুস্থ অস্তিত্ব আমার রূপকথা আমার যাচ্ছেতাই।
উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়ালাম আহ্নিক গতি পাশে;
দেখা হল সর্বনাশের সঙ্গে, 
বলল-আমি মিলন, আমিই বিচ্ছেদ
ফিরে এলাম তোমার কাছে সত্যের সন্ধানে।
গদ্যকে বিপন্ন করা ধূর্ত কবিতার মতো, তোমার আলিঙ্গন
আত্মপ্রপাতের সুস্পষ্ট আভাস দিল
তোমার রহস্যময় খোলা চুলে পেলাম
মৃত্যুগন্ধ মাখা ভুলে ভর্তি একটা জীবন্ত অতীত।
তোমার আবেগী চুম্বনে আর্দ্র হল 
আমার ঠোঁট চোখের পাতা কপাল
বুঝলাম আমার কবিতা উপন্যাসরা ঝরাল তাদের আয়ুষ্কাল
প্রতিটি সূর্যাস্ত অনুসরণে।
তোমার অত্যাশ্চর্য চোখের অতলে গিয়ে দেখলাম
বসে আছে আত্মধ্বংস অনিবার্য নীল মৃত্যু।
তোমার হাতেই আমার হৃদয়
উপলব্ধি করো দুই হৃদয়ের সমছন্দ সমস্পন্দন।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments