জ্বলদর্চি

খপ্পর-৮ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস : খপ্পর 
পর্ব: আট 
লেখক: অনিন্দ্য পাল 

চিত্র- জাহ্নবী সেন


 মুদ্রা তাকে চিনতে পেরেছিল। কোথাও একটা ওয়েভ লেন্থের মিল ছিল দুজনের মধ্যে। প্রথমে ভালো বন্ধু হল মুদ্রা, এই বন্ধুত্বটা খুব দরকার ছিল মৈমির। শরীরে মনে একেবারে একা হয়ে গেছিল তখন। মুদ্রা তাকে খানিকটা অক্সিজেন দেয়। কিন্তু মৈমি একটা ব্যাপারে মুদ্রাকে খানিকটা হিংসা করতো। মুদ্রার লাক্সারিয়াস জীবন যাপন। মুদ্রার গাড়ি, পস এরিয়ায় ফ্ল্যাট, প্রচুর গয়না, এসব মৈমির কাছে তখনও স্বপ্ন ছিল। 
মাস ছয়েক পর, এক রবিবার, দুজনে গেছিল বড়বাজারে, শাড়ি কিনতে। ওরা কেনাকাটা করছে, তখনই মুদ্রার একটা ফোন আসে, ফোনে কোন পুরুষ কন্ঠ খুব রাগারাগি করছিল। ফোনটা কেটে মুদ্রা খুব মনমরা হয়ে যায়। শাড়ি কিনে ফেরার পথে ওরা একটা রেস্টুরেন্টে খেতে ঢোকে। সেখানে বসে মৈমি জানতে চায়, 
--সমস্যাটা কি? যদি বলতে চাস, বলতে পারিস। না হলে থাক। 
-- এ সব তোর না শোনাই ভালো। তুই বরং খাবারের অর্ডার দে। 
সেদিন ওরা চুপচাপ দু'টো হাক্কা চাউ খেয়ে চলে আসে। 
মৈমি ভুলেই গেছিল ব্যাপারটা। বাড়ি ফিরে রান্না করে সোম আর সৌমেনকে খাইয়ে নিজে সবে খেতে বসেছে, তখনি মুদ্রা তাকে ফোনটা করে। বেশ উদ্বিগ্ন আর আবেগ মেশানো গলায় বলে, 
-- মৈ, তুই কখনো ভেবেছিস আমার এত কিছু কোথা থেকে আসে? 
অবাক মৈমি বলে, 
-- এত কিছু মানে? 
-- মানে, এই চল্লিশ লাখের ফ্ল্যাট, সাত লাখের গাড়ি, গয়না এই সব আর কি, তোর কি মনে হয় এগুলো সব আমার চাকরির পয়সায় করা? আমার বরতো জানিস, মাস গেলে দশ হাজার! তাহলে? 
এ প্রশ্ন মৈমির মনে থাকলেও সে খোলসা করে নি। কিন্তু মুদ্রা ভেঙেছিল। 
-- দেখ, আমি বরাবর হাইলি অ্যাম্বিসাস। তুই এখন যেমন ভাড়া বাড়ি থাকিস, আমারও দশ বছর কেটেছে, এক কামরার ঘরে। তোর তো তবু নিজের পায়খানা বাথরুম আছে আমার সেটাও ছিলনা। আমি ভোর পাঁচটায় উঠে লাইন দিতাম কমন পায়খানায়, বালতি করে জল তুলে চান করতাম পলিথিন ঘেরা বারান্দায়। মেয়েটাকে ভর্তি করেছিলাম কর্পোরেশন স্কুলে। কিন্তু কখনো ওই লাইফটাকে মেনে নিতে পারি নি। সব সময় মনের মধ্যে একটা রাক্ষসী আমাকে চিরে ফালাফালা করতো। হঠাৎ একদিন সুযোগ এল। সেদিন নার্সিং হোম থেকে ফিরছি, নটা বাজে রাত। একটা ফোন এল। এক পেশেন্ট এর। বাড়ি তে ডিউটি করতে হবে, নাইট। ভালো টাকা দেবে। বেহালার সেই ছোট নার্সিংহোমের চেয়ে অনেক বেশি। ছেড়ে দিলাম নার্সিংহোম। সেদিন ছেড়ে না দিলে আজ আমার বড়জোড় তোরমত একটা দুকামরার অ্যাটাচবাথ ভাড়ার ঘর কপালে লেখা থাকতো। 
--- মানে? বুঝলাম না। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মৈমি  আরো গভীরে যেতে চাইছিল, দূর থেকে একটা আগুনের হল্কা তার গায়ে লাগছিল। 
-- ওই ডিউটিটা ছিল এক বয়স্ক মহিলার। প্রায় কোমা পেশেন্ট বলা যায়। রাতে ঘুমোনো ছাড়া অন্য কাজ তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু দিন তিনেক পর থেকে পাল্টে গেল সব। সেই রাতে শুয়ে আছি। কি-প্যাড মোবাইলটা নিয়ে ঘাঁটছি, হঠাৎ আমার ভাগ্যদেবতা এলেন। বাবুদা। ওই বুড়ির ছেলে। আমি প্রথমে বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু স্বপ্ন দেখালো। আর ভাবতে হয় নি। একের পর এক যোগাযোগ। ফোন। টাকা। সব, সব হলো, এখনও আমি সেই জাহাজেই আছি। 
মৈমি, একটু তীব্র গলায় বললো, 
-- এসকর্ট? 
-- বেশ্যাও বলতে পারিস! কিন্তু যাই বলিস, আমার, তোর মত ঘর থেকে এইটুকু উপরে ওঠার জন্য আর কোন রাস্তা খোলা আছে কি? থাকলে জানাবি আমাকে। 
মৈমি কিছু বলতে পারে নি। মুদ্রা আবার শুরু করেছিল, 
-- আমার আজকের সমস্যাটা একটু অন্য। একটা আন্তর্জাতিক ফিনান্স কোম্পানির দুই অফিসার আগামীকাল কলকাতায় আসছে। আমি আছি, কিন্তু আর একজন নতুন কাউকে চাইছে। এটাই সমস্যা। আমি নতুন কাউকে পাচ্ছি না, আজ রাতের মধ্যে কনফার্ম না করলে, হাতছাড়া হয়ে যাবে। তিন লাখ। 
তখন ওটা নিয়েই চিন্তায় ছিলাম। এখনও আছি। 
আরো কিছু কথার পর ফোনটা রেখে দিয়েছিল মৈমি। কম দামি স্মার্ট ফোন, প্রায়শই হ্যাং করে। 
রাত তখন বারোটা। সোম আর সৌমেন পৃথিবীর সব শান্তি বুকে চেপে ঘুমিয়ে আছে। শুধু মৈমির চোখে ঘুম ছিল না। ঘেন্না হচ্ছিল মুদ্রাকে। নিজেকেও। মৈমি সেদিন ঘেন্নার জঞ্জাল খুঁড়েছে বহুক্ষণ। মাটি পায়নি এতটুকু। যা কিছু তার হাতে উঠে এসেছে,  সেই সব জঞ্জালের মধ্যে মুদ্রার সঙ্গে মিলে যায়, এমন একটাই জিনিস ছিল, সেটা অ্যাম্বিশন। একটু ভালো থাকা, একটু স্বচ্ছলতা, একটু সুখ। এই সুখ সে আজও পেয়েছে কিনা বুঝতে পারে না, কিন্তু সেই রাতের ঘেন্নাটা আজও তাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পরদিন পার্কস্ট্রিটের ফাইভ স্টার হোটেলে কেটেছিল রাতটা। আবার একটা পুরোনো খিদে চনমন করে উঠেছিল অনেকদিন পর। খুব আদর করেছিল মুদ্রাকে। একে অন্যকে জড়িয়ে কেঁদেছিল। মুদ্রার বাড়িতে কাটিয়েছিল সেই রাতটা। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে একে অপরের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে মৈমির মনে হয়েছিল, আসলে শরীরটা নয়, সে সব সময় একটু ভালোবাসার জন্যই হন্যে হয়ে বেড়িয়েছে। পেনিট্রেশন নয়, সে চেয়েছে অন্য একটা মানুষের সমস্ত অনুভূতি আর অস্তিত্ব কে নিজের মধ্যে অনুভব করতে। কিন্তু সেটা কোন পুরুষ তাকে দিতে পারেনি, দিয়েছে মুদ্রা। 
আজো তারা যখন এক হয়, নিজেদের সমস্ত স্বেদ, ক্লেদ, অপূর্ণতা ধুয়ে ফেলে চরম লেহনে, নিজেদের ভিতরে জমে থাকা সমস্ত কঠিন বাস্তবকে চরম নিষ্পেষণে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে, তখন মনে হয়, তারা এই একটা কারণেই পৃথিবীতে এসেছে। বাকি সব মিথ্যে। 
ক্যাঁচ করে থেমে গেল অটোটা। তার আর সেই মহিলার মাঝে বসে থাকা বয়স্ক মানুষটা নেমে গেল। সেই মহিলা সরে এল খানিকটা। ডানদিক থেকে সেই ছেলেটা উঠে এল ধারে। অটো যেই আবার চলতে শুরু করল ঠিক তখনই হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ রিংটোন বেজে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড পর বোঝা গেল সেটা ওই মহিলার। বুকের ভিতর থেকে মোবাইলটা বের করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তীব্র চিৎকার। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল মৈমি। তীব্র গালাগাল আর বকুনি চলতে লাগলো। সম্ভবত দেরি করে ফিরছে আর রান্না করা নেই তাই! মৈমি এবার মনে মনে হেসে ফেললো। শাঁখা, সিঁদুর এর কি জোর! একটা শিকলের ও বোধহয় এত ক্ষমতা নেই। নাহ, নিজেকে তার ভাগ্যবান মনে হয়। বহুদিন হয়েছে, সে ওসব বালাই তুলে দিয়েছে। একটা সোনার বালা ছাড়া আর কিছুই নেই হাতে। চোখে একটা ছবি ভেসে ওঠে মৈমির। এই মেয়েটা বাড়ি ফিরে রান্না করবে। সবাইকে  খাওয়াবে। তারপর শুতে যাবে। সেখানে নিজে খাদ্য হবে, ওই জানোয়ারটার, যে হয়ত সারাদিন কোথাও বসে তাস পিটিয়েছে, সন্ধ্যায় চোলাই মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে। কি করে এই মেয়ে গুলো দিনের পর দিন এই ভাবে বেঁচে থাকে, ভাবতেই শিউরে ওঠে মৈমি। 
-- দিদি, আপনার স্টপেজ এসে গেছে। 
অটোচালকের কথায় সচেতন হয়ে ওঠে মৈমি। নামতে হবে। দশটা পাঁচ। ঠিক আছে, থাক একটু অপেক্ষায়, সব কিছু এত সুলভ নয়! 

#নয়
"নে শুরু কর" -- সোমের দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো তপু। এক প্লেট হাক্কা চাউ নিয়ে দুজনে খাবে। পার্কস্ট্রিট এলেই এই হোটেলটায় ঢোকে ওরা। মাঝারি হোটেল, বসার জায়গাও বেশ ভালো। সবচেয়ে ভালো এখানকার ওয়াশ রুমটা। তপু প্রতিবার এসে আগে ওয়াশ রুম থেকে ঘুরে আসে, এবারো তাই করেছে। কিন্তু তপুর একটা ব্যাপার একটু অদ্ভুত মনে হল আজ। টয়লেট সেরে বেরোবার সময় তপুর হঠাৎ খেয়াল হল, আয়নার উপরে সিলিং-এ একটা ফ্যান্সি হোল্ডারে একটা এলিডি বাল্ব জ্বলছে। হোল্ডারটাকে একটু অদ্ভুত মনে হল তার। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে ছিল সেদিকে, কিন্তু চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় আর দেখতে পারেনি। তবে ওইটুকু সময়ে মনে হয়েছিল বাল্বটাকে নিয়ে হোল্ডারটা আস্তে আস্তে ঘুরছে। তপুর খটকাটা ওই জন্যই। টেবিলে বসেও সেটাই ভাবছিল। শপিংমল, সুলভ শৌচালয়ে সিসি ক্যামেরা অনেকের চোখে পড়েছে, এখানেও ওই হোল্ডারে কোন ক্যামেরা বসানো আছে কি না কে জানে? একটা বিশ্রী গা রিনরিনে ভাব তপুর শরীরটা একটু যেন কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। মানুষের যে আরও কিসে আনন্দ কে জানে? 
-- আজ আমি যেতে পারবো না বুঝলি! মা ফিরবে না, বাবাও থাকবে না, বাড়ি যেতে হবে। অন্য একদিন চল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments