জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-৪/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি::৪
--------------------------
এক দম্পতির গল্প
--------------------------
রাধা সর্বাধিকারি যখন তার বর নিকুঞ্জকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসে তখন  রাধার  বয়স আঠেরাে আর নিকুঞ্জের বত্রিশ। বয়সে এত ফারাক হওয়ার কারণ হলো, রাধা তখন উঠতি বয়সের বেলেল্লাপনায়  আর পাড়ার বখাটে ছেলেদের সহায়তায় বয়ে যাচ্ছিল। পড়াশােনা হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই দেখে রাধার বাবা  প্রহ্লাদ অনােন্যপায় হয়ে প্রায় তার ছােটকাকার বয়সি এক কোনো এক নিকুঞ্জের গলায় রাধাকে ঝুলিয়ে তাদের সীমান্ত পার করে দিয়ে  হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। নিকুঞ্জের বহুদিন থেকেই নজর ছিল রাধা'র দিকে। যখন রাধার এক বছর বয়স আর তার পনেরাে, তখন থেকেই নিকুঞ্জের একটু মেয়ে মেয়ে বাতিক, তবে পছন্দ করত বয়সে বড়দের। তারপর সে সব মেয়েরা বড় থেকে বুড়ো হওয়াতে,  বুড়াে নিকুঞ্জের শখের বয়স না বাড়াতে , আর রাধা ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠাতে, এক সময়  নিকুঞ্জ ও রাধার মধ্যে বিয়েটা হয়েই গেল। বাংলাদেশের খাঁটি  জল-হাওয়া আর খাবারের গুনে অনেক বড় মানুষই দেরিতে বুড়াে হয় বোধহয়। শরীরের দিকে বিশেষ নজর না রাখলেও নিকুঞ্জের ক্ষেত্রে  কি সেটাই ঘটেছিল হয়তো বা।

যে সময়ের কথা বলছি সেটা উনিশশো উনআশি কী আশি সাল।  সুভাষনগর তখন  এখনকার মতাে জমজমাট হয়নি।

এমন কি রেললাইনের এ পার, গোরাবাজারও না।  মহল্লার বুক চিড়ে আর.এন গুহ রােড গােরুহাটার মােড় থেকে কখনো সােজা, কখনও বাঁকা পথে শেষমেশ একনম্বর এয়ারপাের্ট গেট দিয়ে যশাের রােডে উঠেছে। রাস্তার নাম যত বড় তত দেখনদারিত্ব নেই তার, বরং অসংখ্য খানাখন্দে ভরতি। বর্ষায় নৌকো চালানাের অবস্থা, আর অন্য সময় গাড়ি ঘােড়া নাচতে নাচতে যাওয়ায় রসিক লােকে সে রাস্তাকে বলত ‘উদয়শঙ্কর সরনী'। সে রাস্তার সি.পি.এম পার্টি অফিসের উল্টো দিকে যে হনুমান মন্দির  তার পিছন দিকে একটা ছােট বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে উঠল দুজনে। বাংলাদেশ থেকে শ্বশুরের দেওয়া ছাড়াও নিজেরও কিছু পৈতৃক টাকাকড়ি নিয়ে এসেছিল নিকুঞ্জ। সুতরাং আয়ের থেকে  ব্যয়ের  দিকে তার বেশি  নজর হলেও সব মিলে বেশ চলছিল। কিন্তু টপাটপ দুটো বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ যেন ভাঁড়ারে টান পড়ল। এরকম কিছু মানুষ থাকে, যারা সঞ্চয়ে বিশ্বাসী নয়। যা আছে তা ফুর্তিফার্তায় উড়িয়ে দেওয়ার পর যখন অভাব টের পায় তখন নির্লজ্জের মতাে মানুষের কাছে হাত পাতে অথবা অসৎ উপায়ে অর্থাগমের দিকে নজর দেয় । নিকুঞ্জ যে এরকম যে করবে  এমন  মুরোদও ছিল না তার।  দেওয়ালে পিঠ ঠেকার পর , কি করা দরকার এ কথা ভেবে আরো মাস ছয়েক সময় অনায়াসে কাটিয়ে দিল সে। পকেটে মালকড়ি নেই অথচ হাবভাব, সখ সৌখিনতা দেখে মনে হয় জমিদার। সব সময় ফিটফাট, ক্লিন সেভড। গরম ও শীতকালে পােশাক পরিচ্ছদে নিখুঁত।

  তারা এদেশে আসার পর, মেয়েকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে, মা ,বাবা এবং বড় ভাইও যথারিতী তাদের পিছন পিছন এসে হাজির।  রাধাদের অবশ্য একটা সুবিধা ছিল এ ব্যাপারে ! তার মাসি বহু আগে থেকেই বিবাহসূত্রে এ দেশের নাগরিক। তাঁর বর অঞ্চলের  দাপুটে ও প্রতিপত্তিশালী মানুষ! সুতরাং তাদের এখানে থিতু হতে কোনাে  বাধা হয়নি । রাধারা দাবি করত ওরা ওদেশের মুসলিমদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে বাধ্য হয়ে পালিয়ে এসেছে এদেশে। কিন্তু রাধার বাবার ব্যাপারটা একটু আলাদা। ওদেশে ওদের প্রতিপত্তি যথেষ্টই ছিল, এখনো আছে। কিন্তু পিছুটান বড় বালাই। তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে প্রায় আক্ষেপ করতেন যে নিকুঞ্জের সঙ্গে রাধার বিয়ে দেওয়াটা তার জীবনের একটা বড় ভুল, এবং তার মাসুল গুনতেই তাদের পিছু পিছু তাঁকেও এদেশে চলে আসতে হয়েছে। আসার পর রাধার বাচ্চা তাে হয়ে গেল দুখানা, কিন্তু তা স্থানীয় মানুষজন, যারা রাধা নিকুঞ্জকে চেনে, তারা এই দুটি বাচ্চাকে নিকুঞ্জের বাসনার বাই-প্রােডাক্ট হিসাবেই ধরল, কারণ তাদের  মধ্যে প্রথম থেকেই কিছুমাত্র মানসিক নৈকট্য ছিলনা । রাস্তায় পাশাপাশি দুজনকে হাঁটতে দেখা যায়নি কোনােদিন । পড়াশোনার ব্যাপারে নিকুঞ্জের কখনো কোনো আগ্রহ ছিল না। শেষপর্যন্ত ঠ্যালাগুঁতো করে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে সে খ্যান্তি দেয় পড়াশােনায়। মানুষ সাধারণত পাল্টায় না। ছােটবেলা থেকে তার মূল প্রকৃতি একই রকম থাকে। বিজ্ঞানের এ গূঢ় তত্ত্ব তার পক্ষে জানা সম্ভব না হলেও, পড়াশােনা না করে যে বেশ ফুরফুরে দায়ীত্বজ্ঞান হীন থাকা যায় তা অনেক ছােটবেলা থেকেই বুঝেছিল নিকুঞ্জ। তার শ্বশুরমশাই বিচক্ষণ বৈষয়িক মানুষ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যদিও অঢেল টাকা যৌতুক দিয়েছিলেন বিয়েতে তবুও বসে খেতে খেতে নিকুঞ্জের সে টাকাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কারণ রক্ষা করতে না পারলে যখের ধনও একদিন না একদিন শেষ হয়ে যায়। তখন  পরিবার নিয়ে নিকুঞ্জ সটান তাঁর বাড়িতে এসে উঠবে। সে ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শ্বশুরমশাই নিকুঞ্জকে  দমদমের দেবীনিবাসে একটা ওষুধের দোকান করে দিলেন। নাম রাখা হলো, সেবা ফার্মাসি। উনি ভেবেছিলেন কিছুদিন ঢাকায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়তাে নিকুঞ্জকে এ ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করবে। অঞ্চলের খ্যাতিমান মানুষ ধীরেন ভট্টাচার্য এসে দোকানের ফিতে কাটলেন, ধূমধাম করে লোক খাওয়ানাে হলো। তার পর অবশ্য নিকুঞ্জকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। অতি সহজেই তার দোকান লাটে উঠে গেল। না ওঠার কোনাে কারণ নেই । প্রথম কারণ হলো,  নিকুঞ্জ মিনমিনে স্বভাবের হলেও তার ব্যবহার অতি খারাপ। দুই, দোকানে সব অপ্রয়ােজনীয় ওষুধ। তিন, নিজের মর্জিমতাে দোকান খােলে বন্ধ করে সে। চার, অচেনা মানুষকেও ধারে ওষুধ দেয়। পাঁচ, স্থানীয় অন্যান্য দোকানদারদের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করা এবং ছয়, কর্মচারীর হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানাে যাতে  চুরি করে  দোকান ফাঁক করতে তার কোনােরকম অসুবিধে না হয়।
গণেশ উল্টালো যদিও,  তবু বােলচাল গেল না নিকুঞ্জের। বেশ কিছু বদ, নেশাখাের বন্ধুবান্ধব জুটেছিল তার। তাদের সঙ্গে ফুর্তি, পার্টি, সিনেমা, পিকনিক ইত্যাদি করে বাকি যেটুকু ছিল সে পয়সারও শ্রাদ্ধ করতে শুরু করল নিকুঞ্জ। মদ, মেয়েমানুষের দোষ ছিল না। থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল যদিও। হয়তাে সুযােগ ছিলনা, অথবা সাহস। 

  এর কিছুদিন বাদে ওই সেবা ফার্মাসির নিকুঞ্জ তার কিছু তথাকথিত সুহৃদের পরামর্শে মুদির দোকান দেয়। সে দোকান কোনােদিনই চলেনি। কেন এমন হলো জিজ্ঞাসা করাতে সে বলেছিল,শার্ট প্যান্ট পরে নুন তেল বিক্রি করতে সে পারবে না!

(এ-ও এক ধরনের মানুষ, আবার ‘ভজা’-ও এক ধরনের। যে শহর ঘুরে ঘুরে ঝুড়িতে করে আলুর চপ বিক্রি করে বেড়াত প্রথম জীবনে। জীবনের শেষে ব্যবসায় এত সাফল্য পেয়েছিল সে যে মৃত্যুকালে একটা তিনতলা বাড়ি, দুই উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী ছেলে এবং তাদের যােগ্য দুই শিক্ষিতা স্ত্রী দেখে যেতে পেরেছিল)।
তারপর কিছুদিন ছাত্র পড়ানাের চেষ্টা। তাতেও ব্যর্থ। ছাত্ররা আরও ব্যর্থ পাস ফেলের নিরিখে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই, 'ওই নিকুঞ্জ মাস্টার আসছে?' বলে তাকে আওয়াজ দিয়ে দৌড় লাগাত  চ্যাংড়া ছোঁড়ার দল। দেশ থেকে যখন এসেছিল এদেশে, তখন ওজন ছিল আশি কেজি, পাঁচ বছরের মধ্যেই তা কমে দাঁড়াল বাষট্টিতে। কিছুটা অভাবে কিছুটা উশৃঙ্খলতায়। অপদার্থ মানুষদের বন্ধু থাকে না বেশিদিন। পরিবার ও সমাজে নিঃসঙ্গতার কারণে দ্রুত শরীর ও মনের দিক থেকে নিঃস্ব হতে শুরু করল সে।     রাধার গল্পটা অন্য। দুটো বাচ্চা হওয়ার পর সে যখন খানিকটা পরিণত হলো তখন  প্রেমহীন সে তার পৃথিবী ও  পুরুষের প্রতি আকর্ষণটা নতুন করে অনুভব করতে শুরু করল। দেখতে ভালাে না হলেও ভরা বসন্ত রাধার শরীরে। সুতরাং বিভিন্ন বয়সের রসিক  জোটাতে তার কোনাে অসুবিধা হলো না। পয়সা তখনও রয়েছে কিছুটা। বর ফ্যা ফ্যা করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় গােটা দিন, রাতে বাড়ি ফিরে শারীরিক দাম্পত্য সেরে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। দিনের বেলায় বরের অনুপস্থিতিতে অন্য একাধিক পুরুষ তার বাড়িতে আসে। ছেলে দুটো পাশের বাড়ির সদ্য বিবাহিত ইঞ্জিনিয়ার দম্পতির বাড়িতে মানুষ হতে থাকে।  ইঞ্জিনিয়ারের  স্ত্রীর সঙ্গে ভালাে দহরম মহরম ছিল রাধার। ইঞ্জিনিয়ার তখন পেশাগত সংগ্রামে উপরে উঠতে ব্যস্ত। তাঁর স্ত্রীর   রাধার সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করে বেশ সময় কাটে।  বন্ধুত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকায় খুঁটিনাটি অনেক ব্যক্তিগত কথা হতো তাদের মধ্যে। রাধার কাছে থেকে এভাবেই একদিন ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী  জানতে পারল যে সে বাড়ি ছেড়ে, সংসার ছেড়ে পালানাের পরিকল্পনা করছে। একজন উপযুক্ত পুরুষ সঙ্গী দরকার কেবল। অনেকেই লাইনে আছে, কিন্তু কাউকেই বিশেষ মনে ধরছে না, ভরসা হচ্ছে না যার কাঁধে চড়ে বাকি জীবনটা অনায়াসে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দেওয়া যায়।  

  সঙ্গী জুটল অবশ্য শেষপর্যন্ত! বিমল! বিবাহিত, সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এক ছেলের বাবা। বয়স তিরিশ। বিমলের স্টিলের ফার্নিচারের কারবার। রাধার পাড়াতেই ছােট কারখানা টুকটাক চলে। ছেলে ভালাে। নেশা ভাং নেই । মন দিয়ে কাজ করে। সময়ে বাড়ি যায়, কিন্তু মনে হতাশা। স্ত্রী তার মনের মতাে নয়, নিমাই ঝিমাই স্বভাব। শরীর খিটখিটে রােগা। বিমলের প্রতি তার শারীরিক বা মানসিক আকর্ষণ নেই কোনাে। এক সঙ্গে থাকে এই পর্যন্ত। কথায় কথায় ঝগড়া করে তার সঙ্গে আর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে বলে। এরকমই চলছিল বছরের পর বছর। তারপর এরকম পরিস্থিতিতে একদিন সে রাধার সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে গেল। বাড়তে থাকল তার গভীরতা।

  ব্যাপারটা ঘটেছিল অদ্ভুতভাবে। বিমল ব্যাবসার কারণে কাকে একটা ফোন করতে গিয়ে রং নাম্বার হয়ে সােজা রাধার কাছে চলে যায় তা। তার থেকে মাঝে মাঝেই ফোনাফুনি। রাধার সংস্পর্শে এসে নতুন মানুষ হয়ে উঠল যেন  বিমল। পাতলা শরীরে মাংস লাগল। নাকের নীচে পুরু গোঁফ, চালচলনে গাম্ভীর্য।  যেহেতু এ সম্পর্কের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই তাই ভালো মানুষ বিমলের আস্তে আস্তে জীবনে হতাশা আসতে শুরু করল এবং তা ভুলতে মদে আসক্তি হলো তার। বন্ধুদের সঙ্গে মন কষাকষি শুরু হলো। অন্য আরো সব গুণপনা প্রকাশ পেতে শুরু করল ধীরে ধীরে।
এরকম চলতে চলতে বিমল একদিন ঠিক করল  স্ত্রীকে ডির্ভোস দিতে হবে। রাধাকে পেতেই হবে স্ত্রী হিসাবে। তারপর পরিকল্পনা মাফিক স্ত্রীকে ব্যাপক মারধরাে করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সােজা রাধার কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাড়ল সে।

  বিয়েতে অসুবিধে ছিল অবশ্য। কারণ পরিমল, বা রাধা কেউই ডিভাের্স পায়নি তখনও। সুতরাং আইন ও সমাজ তাদের বিয়ের অনুমতি দেয় কীভাবে ? তাতে অবশ্য থােরাই কেয়ার। অবৈধতা কে আটকায়? দিনের পর দিন তাদের ঘনিষ্টতা ও নির্লজ্জ অবৈধ  যৌথজীবনের কেচ্ছা বেড়েই চলল ।  এর মধ্যে রাধার ছেলে দুটো বড় হয়েছে। বড় ছেলে ক্লাস ফোর থেকেই পরিণত বেশ। ছােট ভাইয়ের খেয়াল রাখা, মায়ের রান্নাবান্নায় সাহায্য, রাধা-পরিমলের  ঘনিষ্ঠতার সময় বাইরের দরজায় বসে পাহারা দেওয়া এবং বাবা আসলে মাকে সময় মতাে সতর্ক করে দেওয়া এসব ব্যাপারে সে বেশ কাজের ছিল। এটা অবশ্য রাধার সাফল্য যে ছেলে দুটোকে সে নিজের করে নিতে পেরেছিল। ছেলেরা তার অকৃত্রিম ভালােবাসা অনুভব করত।  ভালােবাসার বিষয়ে ভান ছিল না তার।

  অবৈধ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনের কারণে তিনবার গর্ভপাত করানাের পর রাধা পরিমলের পিতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে তার কন্যাসন্তানের মা হল তেইশ বছর বয়সে। ততদিনে আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। নিকুঞ্জ টের পেয়েছে সব।  তারপর বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছে সে সম্পর্ক ভেঙে নিজেদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার। প্রথমে শ্বশুর-শাশুড়ির শরণাপন্ন হওয়া, তারপর পাড়ার লােকেদের নিয়ে বিমলকে শাসানাে, শেষে রাধার হাতে ধরে অনুনয় বিনয় কোনাে কিছুতেই বরফ না গলায় শেষ পর্যন্ত এক রাতে সংসার ছেড়ে লিলুয়ার তার গুরুর আশ্রমে চলে গিয়ে সন্ন্যাসজীবন যাপন করতে শুরু করল সে। মাঝে মধ্যে আসত ছেলেদুটির সঙ্গে দেখা করতে, আবার চলে যেত।

  রাধা বিমলের বাড়িতে গিয়ে উঠল এর পর। তাদের যৌথ সংসার। অন্য ভাইয়ের বউয়েরা সমাদর করে তাকে ঘরে তুললেও তার দ্বিতীয় সংসারজীবন সুখের হয়নি। বিমল ক্রমে আরও টাকা ও প্রতিপত্তির নেশায় মদ্যপ, অসৎ ও অসাধু ব্যবসায়ী হয়ে উঠল। প্রতিরাতে বাড়ি ফিরে আকণ্ঠ মদ, মাংস খেয়ে সন্দেহের বশে তাকে গােটা রাত ধরে   মারধোর করে ভােরবেলা ঘুমিয়ে পড়ত সে এবং সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার খেয়ে দোকানে বেরিয়ে যেত সােজা। ক্রমে অন্য এক বিধবা মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্টতা হল তার। রাধা পড়ল আরও গভীর পাঁকে।  ছেলে দুটোর মধ্যে বড় জন পড়াশােনায় ভালাে। মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই টিউশানি করে নিজেরটা চালিয়ে নিত। এই করে ক্রমে ক্রমে  সে গ্র্যাজুয়েট হলো। এম.কম করল, এম.বি.এ করল। ভাই পড়াশােনায় ভালাে নয় তত। প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করার পর মতিগতি বিগড়ে গেছিল তার। শেষ পর্যন্ত দাদার যােগসাজশে সেক্টর ফাইভের এক আইটি অফিসে হাজার দশেক টাকা মাইনের একটা চাকরিতে ঢুকে যায় সে। বিমলের অত্যাচারে দুই ভাই  বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আলাদা ভাড়া বাড়ি নিয়ে থাকতে শুরু করেছে। প্রথমে তারা মেসে খেত , শেষ পর্যন্ত তাদের মা'ও তার মেয়েকে নিয়ে সেখানে উঠে এসে এক সঙ্গে বসবাস শুরু করল।  রাধার বাবা গত হয়েছেন এর মধ্যে। ওদিক থেকে সাহায্য বন্ধ। দাদার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ সম্পর্ক। বিমলের ব্যবসার বারােটা, পুলিশ এসে তার কারখানা সিল করে দিয়ে গেছে ব্যাংক লােনের টাকা না মেটাতে পারার কারণে । ফ্যাটি লিভার আর জন্ডিসে আক্রান্ত তাকে দেখে চেনা যায় না। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই শুরু হয়েছে তার। ছেলেদের কাছে হাত পাতবে না বলে রাধা এ সময় একটা সেলাই, রিপু, ফলস পিকোর দোকান দিল পুরনাে পাড়ায়। সকালে মেয়েকে নিয়ে সেখানে চলে যায়, রাতে ফেরে। ছেলেরা চাইলেও তাকে কাজ ছাড়াতে পারেনি। নিকুঞ্জের প্রথম জীবনের বারফট্টাই, পরবর্তি জীবনে সৎ ভাবে বেঁচে থাকার আকুতি কোনােটাই বিশেষ কাজে দেয়নি। রাধার জীবনটা ঘৃণা আর ভালােবাসার অদ্ভুত এক মিশেল। শরীর সর্বস্ব জীবন যাপন নিয়ে বাঁচতে চেয়ে সে গরম কড়াই থেকে আগুনে পড়ল ভাগ্যের ফেরে। নিঃস্বতর হয়ে এখন জীবনে সে কী চায় তা নিজেও জানে না। বিমল অতি ভালাে থেকে অতি খারাপ মানুষে পরিণত হয়েছে শিক্ষার অভাবে । এখন নখদন্তহীন হয়ে আঙুল চোষে। ছেলেগুলাে বেশ আছে।

অথচ এ গল্পটা অন্যরকম ভাবেও লেখা হতে পারত। সুখী নিস্তরঙ্গ জীবন হতে পারত সবার।  বিশেষ কিছু দরকার কি ছিল জীবন দাৰ্শনিক হওয়া ছাড়া? আমি যে, আমি যে রকম আছি, আমার যে রকম পরিমণ্ডল, আমার যে রকম সঙ্গীসাথী সেই তুলনায় আমি ভালাে থাকব না খারাপ থাকব ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে কার আর হাত আছে? যে মানুষটাকে আমি খুব ভালাে ভাবছি এমনও তাে হতে পারে তার ভিতরটা আমি বুঝতে পারিনি! পাহাড়টা দেখেছি মুগ্ধ হয়ে, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিটা চোখে পড়েনি। আরও সুখী আর ধনী হতে গিয়ে গভীর খাদে পড়ার উদাহরণ  বাস্তবে আর ইতিহাসে তাে ভূরি ভূরি আছে!

  ভাগ্যের চাকা আজ উপরে তাে কাল নীচে। কে যেন তাকে নাগাড়ে ঘুরিয়ে চলেছে নিজের খেয়াল মতাে। সুখ তাে একটা মানসিকতা! তাকে পেতে হলে সুখি হওয়ার অভ্যাস তৈরি হওয়া দরকার। প্রাচুর্য বা বৈভবের প্রয়ােজন নেই।

  মানুষ বুঝেও বোঝেনা কেন?


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments