জ্বলদর্চি

এই যে আলোর আকুলতা-৮(উৎসব ১৪২৮)আবীর ভট্টাচার্য

এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য 
 (অষ্টম অধ‍্যায়)


ঘন সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে অ্যসফল্টের কালো রাস্তা যেন সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে। দ্রূতগামী গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, গহন বনমধ‍্যে ইতস্ততঃ বাড়ি ফেরা খটাস বা বুনো খরগোশ, কখনও বা বনভূমি হালকা হয়ে দৃষ্টিপথে আদিগন্ত ধানজমি; সন্ধ‍্যে হয়ে এলো, পাখিরাও ফিরছে বাড়ি, কখনোও বা, পথপাশের খালে, পদ্ম বা শালুকের পুকুরে অরুণছায়া অস্ত-রবি-রাগ। গাড়ির মধ্যেও চলছে সারাদিনের ঘটনাবলীর গল্পগাছা। বেশী কথা বলছিলেন,অরূপ ও অরূন্ধতী। বোঝা গেল, এখানে আসার আগে রীতিমতো পড়াশোনা করেছেন দুজনেই, যদিও নিজের বিষয় নয়, তবু হয়তো ভালোবেসেই ছুঁতে এসেছেন নগরপারের এই মাটির ইতিহাস। 

ওনাদের আলোচনা থেকেই জানা গেল, বাংলা-ঝাড়খন্ডের সীমান্তবর্তী এই স্হানে, সুবর্নরেখা নদী উড়িষ্যা অতিক্রম করে অর্ধচন্দ্রাকৃতি গতিমুখে পাথুরিয়া জমি আলিঙ্গন করেছে, কথিত এই যে, আদিম কোলরাজার হাতিশালা ছিলো এটি, হয়তো ভিনরাজ‍্যের হাতিদের বিশ্রামস্হলও ছিলো। যাহোক, এখন সে রামও নেই, সে রাজত্বও নেই, কিন্তু আছে বনদপ্তরের সুদৃশ‍্য বাংলো, আরও দূরে, রোমাঞ্চপ্রিয় ভ্রমণার্থীদের জন্য নদীপারে বিলাসবহুল তাঁবু।
             
গাড়ি এসে পৌছলো সেখানেই। জায়গাটির নাম হাতিবাড়ি। আগে থেকেই ব‍্যবস্হাপনা ছিলো, কেয়ারটেকারের সাদর অভ‍্যর্থনা, খানিক্ষণের মধ্যেই সুগন্ধী চায়ের আতিথেয়তা সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষেই উড়িয়ে দিলো। ইচ্ছে ছিলো, নদীর সুস্বাদু মাছ খাওয়ার, সে সখও মিটলো। রাতে চিংড়ি, পাবদা দুই পদই থাকবে, কথা হো'ল। মেয়েরা বললেন, একেবার দেশীয় ধরনের রান্নার আয়োজন করতে, সেকথা শুনে খুশি হয়ে কেয়ারটেকার সঙ্গে খাওয়াতে চাইলেন, 'আলুপওড়া'-অর্থাৎ দেশীয় ধরনে  'গ্রিল্ড পটাটো'।
               
রান্না-বান্নার ব‍্যবস্হা দেখে, সবাই চললেন নদীপারে, ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে, নদীবাঁকের ছোট্ট ছোট্ট স্বর্নালী উর্মিমালার সঙ্গে তার  সঙ্গমপূর্ব অভিসারও শুরু হয়ে গেছে; কি যেন এক অপার্থিব মায়াজগৎ সামনে…'সমাজ সংসার মিছে সব'; আসার আগে কেয়ারটেকার সাবধান করে দিয়েছিলেন, বেশীদূরে না যেতে, বর্ষাশেষের সাপখোপের ভয়, জলের মধ্যে লুকানো 'দ'-এর বিপদ; ইত‍্যাদি,ইত‍্যাদি। কিন্তু এমন মায়াবী অনুসঙ্গ পার্থিব সব তুচ্ছতাকে ভুলিয়ে দেয়, ওনারা আরও একটু এগিয়ে নদীজলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন; ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা পাথরখন্ডে কেউ কেউ বসলেন, কেউ বা দাঁড়িয়ে; সবার মনে মনে তখন গাইছেন এক এবং একমাত্র রবিঠাকুর, 'আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…', কেমন যেন এক অপুর্ব কস্তূরীগন্ধে বিমোহিত নদীতীর, সে গন্ধখানি যেন খানিক পরে  উঠে এলো  একটু দূরে একলা বসে থাকা অরূন্ধতী-কন্ঠে।
                 
প্রতিটি গানেরই আলাদা আলাদা আবেদন থাকে, মানুষ,পরিবেশ, ক্ষেত্র বিশেষে; বিশেষ নারী অথবা বিশেষ ফুলের মতো বিশেষ বিশেষ সময়ে  তা ভরিয়ে তোলে মনের আঙন; 'কোন স্বর্গের মোহিনী মরীচিকা, শরৎ-নীলাম্বরে তড়িৎলতা…'-সম সেদিনের সেই চন্দ্রালোকিত রাত্রে, অরূন্ধতী-কন্ঠের সেই গানের হাহাকার ,'আমারে যে জাগতে হবে…' কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।

 অপরা জোৎস্নায় শালগাছের পাতায় পাতায় খেলে যাওয়া বিরহী বাতাসের অনুরননে জন্মপারের যে  অন্তর্লীন বিরহব‍্যথা উথলে উঠেছিলো; তা হয়তো উপস্থিত সকলেরই আজীবন বেদন-সঞ্চয় হয়ে রইলো।

         খানিক পর, ফিরে এলেন সবাই নিজের জগতে, ফিরতে যে হয়ই। কিন্তু অভ‍্যস্ত জীবনের বাইরে এই যে সমান্ত‍রালে বয়ে চলা অনিত‍্য জীবনপ্রবাহ; কখনো কখনো তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের একান্ত একাকী আমিকে ছুঁয়ে থাকার অবসর নিত‍্যদিনের একঘেয়েমির মাঝে পাওয়া হয় কি? এজন্য লাগে এমন অবসর; তা নইলে,'আমার ভূবণ রবে কি কেবলই আধা রে'!…...

          রাতের উৎকৃষ্ট খাওয়াদাওয়ার পরে, সবাই যে যার ঘরে বিশ্রামে গেলেন, অন্ধকার বারান্দায় তখন আলোছায়ার ঝিলিমিলি। বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিলো না অরণির, সুখতন্দ্রাবেশে ভাসছিলো সন্ধ্যার ছবি…'; লৌকিক জীবনে তাঁর বন্ধুপত্নী অথবা বান্ধবী কোন নারী তিনি নন, সে মুহূর্তে অরূন্ধতীকে তাঁর মনে হয়েছিলো যেন কোন  শাপভ্রষ্টা গান্ধর্বী; পিয়া-মিলন-পিয়াসে  একমনা যার অর্চনা সুরের বন্দিসে,
'কোন গহন অরণ‍্যে তার এলেম হারায়ে
কোন দূরজনমের কোন্ স্মৃতি-বিস্মৃতিছায়ে'।…..এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে দুচোখে আসন পেতেছে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসীর দল, মনে নেই তাঁর, সকালবেলা ঘুম ভাঙলো হাজার পাখির কচিরমিচিরের সাথে নিজেদের বাচ্চাদের কিচিরমিচিরে; ঘনঘুমঘোর আচমকাই ভেঙে গিয়ে খানিক বিরক্তিতে বলে উঠলেন,

-হচ্ছে টা কি সকাল সকাল!বর্গী এলো নাকি!

রূপা কাছেই ছিলেন,মুচকি হেসে বললেন,

-আজ শুনলাম, বর্গীদেশে যাবো! তাই বুঝি ছেলেরা জুড়েছে বর্গী হামলা আর ছেলের বাবার মুখেও বর্গীদের কথা!

-সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, আজ তাঁদের বেড়াতে যাওয়ার কথা রামেশ্বর মন্দির। ছোটবেলায় দু-একবার মায়ের সঙ্গে গিয়েছেন, এই এলাকার বিখ্যাত শিবমন্দির, শিবরাত্রির সময়ে বিশাল মেলা বসে। তবে মনে মনে ভেবেই রেখেছেন, উনি কিছু বলবেন না, এই অঞ্চলটির কথা অরূপ আর অরূন্ধতীর মুখেই শুনবেন, কত্তো পড়াশোনা ওঁদের….এইসব ভাবনার ছায়া হয়তো  মুখে ফুটে উঠেছিলো, পাশে বসে থাকা রূপা তাঁর শঙ্খ-ফেননিভ ফেসিয়াল-চর্চিত কনকাঙ্গুলি বুকে ছুঁইয়ে বললেন,

-কাল অরূ যা গানটা গাইলো না! খুব আফশোষ হয় যদি নাচ না শিখে গান শিখতাম গো!

-কেন! এককালে তো তোমার নাচে সবাই পাগল ছিলো! আমার তো সবসময়েই ভয় করতো যদি হারিয়ে ফেলি! অবশ্য সে ভয় এখনও আছে,যা রূপ তোমার!

-যাঃ! সবসময়েই ফ্লাটারি! আমি বলছি  একটা সিরিয়াস কথা!!

-ব‍্যাপারটা কি ম‍্যাডাম! এই বনজঙ্গলে এসে সবাই কি অচেনা হয়ে যাচ্ছি নাকি!....হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন,কপালের আলগা চুলগুলি সরিয়ে দিলেন, এই একটু আদরেই যেন গলে গেলেন রূপা, যেমন সেই প্রথম প্রথম…

-তুমি না!.....আল্হাদী গলায় একখানি ছোট্ট ঘুসি মেরে পালিয়ে গেলেন আদুরী বেড়ালনীর মতো, তৃপ্তসুখে সংসারী পুরুষটি  বিছানা ছাড়লেন; গতকাল রাতের অশান্তি আর মনে নেই; সত‍্যিই, বিশেষ বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ মানুষের সঙ্গ জীবনযাপনে খুব জরুরী। এদিকে, লকলকে আগুনশিখায় ইয়াব্বড়ো লোহার কড়াইতে সাদা-সাদা লুচি ভাজা হচ্ছে, গন্ধে চারিদিক ম-ম করছে, দুষ্টুগুলো নিশ্চই ওখানে; তাঁরাও আর দেরী না করে তৈরী হয়ে পৌঁছে গেলেন খাওয়ায় ঘরে।

তাঁকে দেখেই অরূন্ধতীর মুখে ছড়িয়ে পড়লো সপ্রশংস হাসি,দোলা তো বলেই উঠলো,

-যা দেখাচ্ছে আজ তোমায়,ফাটাফাটি!!

তিনি পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক,যথারীতি কৃতিত্ব দিলেন স্ত্রীকে; রূপার খুশি খুশি হাসি অনেক দিন পরে খুশি করলো তাঁকেও।
বেশ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হলো,সবাই মিলে চেপে বসলেন গাড়িতে,গন্তব‍্য রামেশ্বর মন্দির।
           
মন্দিরটি উড়িষ্যার নিজস্ব শৈলীতে প্রস্তুত; জনবিরল, বিরাট এক  উঁচু টিলার ওপরে এর অবস্থান; মন্দিরের চাতালে দাঁড়ালে বহুদূর পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়; দেখা যায়, মন্দিরের উল্টোপারে সাঁকরাইলের ভৈরবথানও।  বইতেই আছে, রামেশ্বর শিব দ্বাদশলিঙ্গ, গৌরীপট্টে প্রোথিত। সুবর্ণরেখা তীরে, মাকড়াপাথর নির্মিত পূর্বমুখী অপুর্ব সুন্দর এই মন্দির যার পেছনের দিকে ১০৮খানা সিঁড়ি নেমে গেছে এক কুন্ডে, নাটমন্দিরে আছে এক প্রচণ্ড ভারী কালোপাথরের ষাঁড়। কে যে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, তা নিয়ে অসংখ্য জনশ্রুতি: কেউ বলেন,বিশ্বকর্মার একরাতেই সৃষ্টি  এই মন্দির; কেউ বলেন মারাঠা বর্গীদের সৃষ্ট এই দেবদেউল, যা তাঁরা 'ওয়াচ টাওয়ার' হিসেবে ব‍্যবহার করতেন। আবার,কেউ বলেন, বনবাসকালে রামপূজিত এই মহাদেব শিব, পরবর্তীকালে সীতাও নির্বাসিত হয়ে এখানেই জন্ম দেন লবকুশের। এর থেকে আরও একটু দূরেই বাল্মিকি-তপোবন। অপুর্ব সুন্দর এক পরিবেশ,শান্ত, স্নিগ্ধ বন,ঝোরা,হরিণচরা ছোট্ট মন্দির, ছোট্ট সমাধি। তারপাশে সীতাধুনি, যার আগুন কখনও নেভেনা। আছে সীতানালা, সীতার স্নানের হলুদজলবাহী ঈষৎ হলুদ রঙের জল বয়ে যাচ্ছে অবিরল।

          এইসব দেখতে দেখতে, মন যেন অতীতচারী হয়ে পড়ে, কল্পচক্ষে ভেসে ওঠে, সেই দূর্বিনীত মারাঠা দস্যুদল যেন 'হর হর মহাদেও' ধ্বনি তুলে, তেজীয়ান অশ্বক্ষুরে পাথুরিয়া মাটিতেও ধুলা সৃষ্টি করে এগিয়ে আসছে, লুন্ঠিত শস‍্য ও ধন-বন্টন, পরবর্তী পরিকল্পনা, দেবার্চনা, বিশ্রাম, হয়তো বা দেশে ফেলে আসা সংসারের জন্য মনকেমন ; সবকিছুই হয়তো ঘটতো এখানেই; তারা কি কখনও ভেবেছিলো, অনেক, অনেক বছর পরে, অন্য কোন একদল মানুষ এসে এখানে দাঁড়িয়েই তাদের কথা ভাববে; সময়ের একমুখী স্রোত অস্বীকার করে তাদের সুখ-দুঃখ-আশার সঙ্গী হবে!
কালচক্র ঘুরে চলে, আকাঙ্ক্ষা বাসনাবন্হি যে নেভেনা, যুগে-যুগে,কালে-কালে তা প্রবহমান। ''হে চিরসারথী,তব রথচক্রে….''

চিত্র- লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. উফ্! দারুণ!❤️❤️❤️

    ReplyDelete
  2. বিমোহিত হয়ে যাচ্ছি। কি ভাষার মাধুর্য।

    ReplyDelete