জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-৩/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার
শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল





পর্ব : ৩ 

ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেল। নরম রোদের আভা মাখতে মাখতে হেঁটে হেঁটে এলাম আকাশদের বাড়ি। আকাশ আমার প্রিয় বন্ধু। বুজুম ফ্রেন্ড। একসঙ্গেই পড়ি আমরা। আকাশের যমজ বোন অনুশীলাও আমাদের সঙ্গেই চন্দ্রপুর হাইস্কুলে পড়ে। টেস্ট পরীক্ষার পর আমি প্রায় প্রতিদিনই বিকেলের দিকে আকাশের বাড়ি যাই। কিছুক্ষণ হাল্কা আড্ডা হয়। আমি আকাশ আর অনু থাকি। তারপর একসঙ্গে টেক্সট বই, সাজেশন বই থেকে অনুশীলন। এটাই এখন প্রাত্যহিক রুটিন। শান্তি আশ্রমের দিকে এখন একদম যাওয়া বারণ। এবার যা হবে পরীক্ষার পর হবে। ইচ্ছে আছে একটা নাটকের দল করার। মলয়ের উৎসাহ এতে সবচেয়ে বেশি। সব ঠিকঠাক থাকলে এবছর আমরা নাটকের দল তৈরি করবই।
স্বরূপানন্দজিও এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেন। এতেই আগ্রহ আরও বেড়েছে আমাদের। 

আকাশের বাড়িতে যাওয়াটা আমার কাছে বড্ড ভালোলাগার।পড়াশুনা করে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। আড্ডা দিয়ে মেজাজ হালকা করাও যায়। দুটোই হয়। আকাশের বাবা আমাদের কুসুমপুর এলাকার সবচেয়ে বড় জমিদার। অনেক জমিজমা।বাগান। দিঘি। চাকর বাকর, লোকবল, অর্থবল বেশ বেশি।সেখানে তো আমরা কোন চুনোপুঁটি! বাবা আমার ভালো ইংরেজি জানেন এটাই আমার একটা অহংকার। চাকরি পাননি ঠিকই কিন্তু মেধা ও মননে যথেষ্ট সমকালীন। বরং আগামীর কথাও ভাবেন। আকাশের বাবা শিবনারায়ণবাবু আর আমার বাবা আদতে ক্লাসমেট। ভালো বন্ধুও। সেই সূত্রেই আমাদের এত অন্তরঙ্গতা। 

আকাশের অনেক গুলো টিউশন। গৃহশিক্ষিক। আমার কোনও প্রাইভেট টিউটর নেই। নিজে পড়ি। বাবার কাছে পড়ি।স্কুলের মাস্টারমশাইরা কখনো কখনো ক্লাসের সময় বাদ দিয়ে প্রয়োজন মতো আমাকে বাড়তি সময় দেখিয়ে দেন।বাবা ইংরেজি দেখান। সবমিলিয়ে তেমন কোনও অসুবিধা  হয় না। আকাশও তার বিভিন্ন বিষয়ের মহার্ঘ নোটস আমাকে দেয়। আকাশ অনু দুজনই বাবার কাছে ইংরেজি পড়তে আসে। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা পড়ার রুটিন তৈরি হয়ে আছে আমাদের। আর তো কটা দিন। ফাইনাল পরীক্ষা এই এল বলে!


পরীক্ষা শেষ হল। ফলাফলও হল। প্রত্যাশা মতো আমিই স্কুলের প্রথম। আকাশ দ্বিতীয়। অনুও পাস করল প্রথম বিভাগে। আকাশ দ্বিতীয় হওয়ায়, প্রথমে একটু মনখারাপ করেছিল ওর। পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেল। আমাদের বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। আগের মতোই শক্ত আছে বাঁধন। 

এর পরই এল যত দ্বিধা। আমি জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসিনি।কোনও অজ্ঞাত কারণে অনুও বসেনি। আকাশ মেডিক্যালে র‍্যাঙ্ক করল। পড়তে চলে গেল কলকাতায়। আমি আর অনু ভর্তি হলাম আমাদের শহরের কলেজে।


#
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে অভ্যাসমতো ব্যাগটা বিছানার একপাশে নামিয়ে রেখে দিয়েছি। রাত্রে পড়তে গিয়ে যখন বই খুলেছি,বেশ অবাক হলাম। বইয়ের ভেতরে ভাঁজ করে একটা কাগজ রাখা আছে। ভাঁজ খুলতেই আরও অনেক বিস্ময় অপেক্ষায় ছিল। একটা ছোট চিঠি। সুন্দর হাতের লেখায় লেখা। 

"বেশ কয়েকদিন ধরেই কিছু কথা বলব ভাবছি। সুযোগ পাচ্ছি না। কাল একবার কাঁসাই এর পাড়ে, বড় বটগাছের তলায় এলে কথা বলতে পারি। বিকেলে, অপেক্ষা করব।" 

লেখার প্রতিটি অক্ষর আমার চেনা। তাই নাম লেখা না থাকলেও অব্যর্থ বুঝলাম, কার চিঠি। খুব দ্রুততায় কিন্তু মনের তীব্র আকুতি নিয়ে যত্নে লেখা। পড়লেই বোঝা যায়। একটা অস্থিরতা চাপা দেওয়া আছে। রাত্রে ঘুমোতে গিয়ে অনেক দুর্ভাবনা চেপে ধরল আমাকে। খারাপ কিছু কি ঘটতে চলেছে? প্রশ্ন করি নিজেকেই। 

কলেজ যাইনি আজ। মনখারাপ আর চঞ্চলতা ঘিরে রেখেছে আমাকে। দুপুর গড়াতেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।কাঁসাই। নদীতে হাঁটু জল। সারা বছরই এমন থাকে। শুধু বর্ষা এলে বোঝা যায় নদীর আসল রূপ। চোখের সামনে চিকচিকে বালি। পাড়ে তেমন বড় কিছু গাছ নেই। দু'একটা অনেক পুরনো বট গাছ আছে। চারিদিকের ধুসরতার মধ্যে গাছের ছায়া আর সবুজ দেখে মন জুড়ায়। রাখালের দল ফিরছে।দূরের হাট থেকে ফিরে আসছে গ্রাম্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। 

সাইকেলটাকে গাছের নিচে একপাশে স্ট্যান্ড করে অপেক্ষা করছি। বিকেল হয়ে আসছে। জানি এবার ও আসবে। গ্রামীণ পরিবেশে ছেলেমেয়েদের একান্ত মেলামেশা খুব সহজ ভাবে নেয় না এই সমাজ। অনেক কথা শুনতে হয়। সেই কলঙ্কের কোনও দাগ যাতে কোথাও ওকে বা আমাকে স্পর্শ করতে না পারে সে বিষয়ে আমি সতর্ক আছি। 

আমার বুকের স্পন্দন বাড়ছে। কী এমন বলতে চাইছে! আমি ভাবতে ভাবতে দেখি, দূর থেকে হেঁটে আসছে নীল শাড়ির মিষ্টি মেয়ে। দ্রুত পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল। ঝড়ের মতো। খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে। কপালে গালে এসে পড়ছে।অজান্তেই তার হাত সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছে। বিকেলের রোদের আভা তার সারা গায়ে। রাঙা রোদে দীপ্যমান এই চঞ্চলমনা আমাকে আরও অস্থির করে তুলল। আমি শুনতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। ও কিছু বলার আগেই আমি বলি, 'কী , কী বলবি? বল আমাকে। আমি অধৈর্য। তাড়াতাড়ি বল।'
একটু নীরবতা। তারপর বলল, 'চল বসে কথা বলি।'
গাছের ছায়াবৃত্তের একপাশে বসলাম। মুখোমুখি। দুজনের মাঝখান দিয়ে সুদূরে সূর্য অবস্থান করছে। রোদের নরম আলো আমাদের গায়ে। কিছু বলতে গিয়ে যেন থেমে যেতে চাইল। আমি আবার বলি, 'প্লিজ। বল।'
একটু থেমে বলল, 'আমি চলে যাব।'
'কোথায়?'
'জানি না।'
আমার এই অস্থিরতার মধ্যেও হাসি এল। হালকা লাগল নিজেকে। বললাম, 'তাহলে কোথাও যেতে পারবি না তুই।আমি তো ভাবছিলাম কী না কী বলবি। কত টেনশনে আছি কাল থেকে।'
'সত্যি বলছি। আমার সামনের পথ অন্ধকার।' মুখ শুকনো হয়ে আসছে অনুর। ওর চুল আজ খোলা। ও আজ নীল শাড়ি। আমি অবাক, ও কী করে জানল, আমি খোলা চুল পছন্দ করি, নীল রং পছন্দ করি? ও কি জানে, ওর এই সাজ আমাকে আনন্দ দেবে, ওর এই সাজ আমারই ইচ্ছে মতো ? জানি না আমি। ভালোলাগার রসায়ন হয়তো এমনই।
'কিছু বুঝতে পারছি না আমি।'
'বাবাকে তো চিনিস। দাদার ব্যাপারে যত যত্নশীল আমার ব্যাপারে ততটাই নির্লিপ্ত। উদাসীন। যেন কোনও ভাবে আমাকে রাখলেই হল। দাদা ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার পর ভেবেছিলাম বাবা আমাকে বেশি আপন করবে। করল না!সেই একই অবহেলা। আমি আর মানতে পারছি না।'
'আমি যে এত যত্ন করি। এত খেয়াল রাখি?'
'বাবার স্নেহের কোনও পরিপূরক হয় না কেশব। সবই মোটামুটি ঠিক ছিল এতদিন। ক'দিন হলো বাবার মাথায় ভুত চেপেছে। মল্লভূমের জমিদারবাড়ির ছোট ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে। ওদের বাড়ি থেকে লোকজন এসে দেখেও গেছে। ওরা মত দিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে এই বৈশাখেই সানাই বাজবে।'
আমার মাথার ঠিক নেই। আমি নিতে পারছি না আর। অনুর মুখে হাত রাখি। 'নাহ্। এটা হয় না। তুই ভালো করে বোঝা বাড়িতে। এখনও তোর পড়া শেষ হয়নি। অনেক স্বপ্ন তোর চোখে। আমার চোখে। কী হবে সেগুলোর?'
'কাকে বোঝাবো। বাবাকে কিছু বলতে পারব না। দাদাকে বলে কিছু লাভ হবে বলে মনে হয় না। দাদা তো সেদিন আমার বিয়ের ব্যাপারে সবই শুনেছে। কোনও বারণ তো করেনি! অবশ্য বাবা কারোর কথাই শুনবে না। আমার নিয়তি স্থির হয়ে গেছে।' 

অনুর চোখের জলে চিকচিক করছে অস্ত সূর্যের আলো। গৈরিক রঙের আভা। যেন এক ত্যাগের, এক ছেড়ে যাওয়ার বার্তা লেখা আছে এই অশ্রুতে। আমি পড়তে চেষ্টা করি। 

আমি অনুকে আমার জীবনে চাই, এমন কথা আজ অব্দি বলিনি। তেমন পরিস্থিতি কখনও তৈরিই হয়নি। অথচ আজ ঘটনার পরম্পরায় দুজনেই বুঝে নিলাম একে অন্যের জন্য বাঁচি। বাঁচব আগামীতে। অজান্তের দুর্নিবার এই টানই কি প্রেম? কখনও খোঁজ করে দেখিনি। অনুও কি জানে এই গোপন অনুরাগই প্রেম? জানি না। ভালোবাসা কি এমনই, ভালোলাগায় ভরিয়ে দিয়ে, নিভৃতে বিভাজনের প্রান্তে এনে দাঁড় করায় জীবনকে? ছোটবেলার পুতুল খেলার ঘর থেকে আমাদের জানাশোনা। কেউ কাউকে কখনও এমন করে , আলাদা করে চেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। অথচ দুজনেরই চাহিদা একই রয়েছে মনে মনে। 

আমি হাত দিয়ে অনুর চোখের জল মুছতে যাই। ও আমার হাত দুটো ধরে। সযত্নে নিজের কোলের কাছে রাখে। বলে, 'এই জলকে গড়াতে দে। এই অশ্রু ভালোবাসার।ভালোলাগার। ভালোবাসতে গিয়ে পাওয়া কষ্টের ইতিহাস আছে এই জলধারায়। আমি পৃথিবীতে অন্যের হয়ে বাঁচতে পারব না। জীবন তো ফুলেরই মতো। একবার দেবতার পায়ে নিবেদন করলে, সেই ফুল অন্য দেবতাকে নিবেদন করা যায় না। আমি তো কেশবে নিবেদিত!'
আমি যত কষ্ট পাচ্ছি, আনন্দ পাচ্ছি তার অনেক বেশি। এই অনুরাগ, এই উৎসর্গ এতকাল চেপে রেখেছিল অনুশীলা। ওর এই অনুভবের উচ্চারণ তো আসলে আমার জীবনের সেরা সঞ্চয়। জীবনের পথে কোনও বাধাই আর থাকল না। এ আমার আশ্চর্য অহংকার।
আমি মুগ্ধতায় দেখছি অনুশীলাকে। এমন করে আগে কখনও দেখিনি। যেন হঠাৎ করে আমার অধিকার বেড়ে গেছে ওর উপর। জমিদারবাড়ির ছোট ছেলে কেন, অন্য কারোর পাশে ওকে আমি দেখতে পারব না। তরোয়াল হয়ে হত্যা করব তাদের। অনু আমার একার!
'কেশব।'
'বল।'
'আমি হয়তো পৃথিবীতে থাকব না। সেদিন আমাকে মনে থাকবে তোর?'

বেসামাল হয়ে যাই আমি। বুনো আবেগ পেয়ে বসে আমাকে।কাছে টেনে নিই অনুশীলাকে। আলিঙ্গনের উষ্ণতায় যেন সরে যাচ্ছে সমূহ অন্ধকার। বিপদ। অনিশ্চয়তা।
ওর চোখের জল মুছে যায় আমার ঠোঁটের উষ্ণতায়। সূর্য ঢলে গেছে দিগন্তে। দুরগামী পাখিদের উড়ানের রেখায় ফুটছে আমাদের স্বপ্নের সম্ভার। আমি জোর করে বলি, 'এত আপন করে কেউ যে ভালোবাসে না আমাকে। তুই শুধুই আমার। আমি শুধু তোরই। এটাই আমাদের জীবন সমীকরণ। দেখিস আমরা একে অন্যের থাকব আমৃত্যু।' 

সন্ধ্যা নেমে আসছে। গৈরিক ক্যানভাসে দূর দিগন্তে পাখিরা উড়তে উড়তে বিন্দুর মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। দিন শেষ হওয়ার মতো আমাদেরও সমস্ত কিছু যেন সমাপ্তপ্রবণ। আর এখানে থাকা যাবে না। এক অসম্পূর্ণতা নিয়ে, অনিশ্চয়তা নিয়ে বাড়ির পথে পা রাখি দুজনেই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments