সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক
পর্ব – ১০
উনিশ বছর পর
একটি কথোপকথন
“চলে যাবার সময় বলেছিলে – আসি৷
আমি সেই শব্দটুকুর ভেতরে
জেগে বসে থাকি সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত৷
ঘুম নেই, ঘুম নেই, নেই একফোঁটা ঘুম৷
আমার সারা শরীরে ফুটে আছে বিরহকুসম৷
কী অসাধারণ কবিতা৷ সোজা বুকের ভেতরে গিয়ে ধাক্কা দেয়৷ সব বই-ই আছে বাড়িতে৷ সবক’টাই পড়া হয়ে গেছে আমার৷ তবু সময় পেলেই আবার নিয়ে বসি৷ আমার কবিতা লেখার ইন্সপিরেশন উনিই৷”
“আমিও পড়ি সময় পেলেই৷ তুমি কতদিন হলো কবিতা লিখছো?’
“খুব বেশি না৷ ওই কলেজ থেকে৷”
“প্রকাশিত হয়েছে কিছু?”
“হ্যাঁ৷ চারটে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এখনও অবধি৷ খুব বেশি তো লিখিনি৷ ওই পড়ার ফাঁকে একটু একটু৷”
“কবিতা প্রকাশিত হয়ে চলেছে, তার মানে তো তুমি ভালো লেখো৷ তোমার লেখা শোনাও৷”
“আমি তো লেখার ডায়রি নিয়ে আসিনি৷ মুখস্ত বলতে পারি না৷”
“আর ক’টা দিন থেকে গেলে পারতে৷”
“ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই৷ সামনেই এম এ ফাইনাল৷ পড়ার ভীষণ চাপ৷ মা বলে রেখেছে বি এ অনার্সের মতোই এম এ-তেও ভালো পার্সেন্টেজ পেতে হবে৷”
“এখানে থেকেও তো পড়াশুনো করা যেত৷ এমন কী হতো আর চার-পাঁচটা দিন থেকে গেলে৷”
“দু’দিন তো থাকলাম৷ গল্পে গল্পেই কেটে গেল৷ পড়াশুনো হতো বলে তো মনে হয় না৷”
“আচ্ছা৷ তার মানে আমার জন্য তোমার পড়াশুনোর ক্ষতি হয়৷ ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি৷”
“এই রিয়া, শোনো৷ শুধু শুধু রাগ করে না৷ আমি তো মজা করছিলাম৷ তোমার সঙ্গে কথা না বলে কি আমি থাকতে পারি?”
“তাহলে ওরকম বললে কেন?
“আরে আমি তো মজা করলাম৷ আমি এখানে আসবো বলে আগে থেকেই অ্যাডভান্স পড়ে এসেছি, যাতে দুটো দিন পুরোপুরি তোমার সঙ্গে থাকতে পারি৷ মায়ের কিছু জিনিস আর যারা ভাড়া আছে তাদের কাছ থেকে টাকা নিতে এসেছি৷ সে তো বড়জোর ঘন্টাখানেকের কাজ৷ তবুও দু’দিন থাকলাম৷”
“আমিও তো দু’দিন কলেজ গেলাম না৷ আচ্ছা আন্টি কেমন আছে?”
“এমনি ভালোই আছে৷ কিন্তু জেলের কষ্টের দিনগুলো ভুলতে পারেনি৷ লুকিয়ে কাঁদে৷ আমি বুঝতে পারি৷”
“হ্যাঁ, কী ঝড়টাই না বয়ে গেছে! তিনটে জীবন ভাগ্যচক্রে কীভাবে ছারখার হয়ে গেল!”
“তোমার মা-বাবার কথা ভাবলে ভীষণ খারাপ লাগে৷ আমার ওই শয়তান...”
“থাক রাতুল৷ ওসব নিয়ে আর কথা বলারই দরকার নেই৷ তুমি আন্টির খেয়াল রাখো আর পড়াশুনো করো মন দিয়ে৷ আমি তো তোমার চাকরি পাবার অপেক্ষায় বসে আছি৷ কবিতাটাও পাশাপাশি লিখে যাও৷”
“হ্যাঁ, মাকে তো দেখে রাখতেই হবে৷ একজন অন্য ডাক্তারকে দেখাচ্ছি এখন৷ বেশ নামডাক আছে৷ ওষুধে কাজ হচ্ছে মনে হয়৷ ইদানিং রাতে ঘুমোচ্ছে ঠিকঠাক৷ আঙ্কল কেমন আছে?”
“ওই আগেরই মতো৷ কোন ইমপ্রুভমেন্ট নেই৷ সারাদিন টেবিলের সামনে বসে থাকে৷ কাউকে চিনতে পারে না৷ ডাক্তার বলেছে ওষুধ খায়িয়ে যেতে৷ এই ধরণের পেশেন্টদের সুস্থতার তো কোন ঠিক নেই৷ উনিশ বছর তো হয়ে গেল৷”
“মা-কে তো নিয়ে আসতে চাই৷ রাজি হয় না৷ বলে এই অবস্থায় তোমার বাবাকে দেখতে পারবে না৷ আচ্ছা, তোমরা কি এখন তোমার মায়ের ফ্ল্যাটে থাকো?”
“হ্যাঁ, ঠাকুমা-ঠাকুরদা আর দাদু-দিদা চলে যাবার পর থেকে ওখানেই থাকছি৷ মাসি বলেছে ফ্ল্যাটটা পরে আমার নামে করে দেবে৷”
“বাহ, খুবই ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমার মাসি৷”
“জানো, বাবার বেশ কিছু অপ্রকাশিত কবিতা রয়েছে একটি ডায়রিতে৷ বহু আগের লেখা সবই৷ কী করা যায় বলো তো?”
“তুমি যদি বলো তাহলে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি এই ব্যাপারে৷ মা শুনলে আগ্রহ দেখাবে আমি জানি৷ শেষের দিকের বইগুলির প্রকাশক তো শুনেছি মায়ের ক্লাসমেট৷”
“হ্যাঁ, জয় আঙ্কল৷ বাবা, আন্টি আর জয় আঙ্কল ক্লাসমেট ছিল৷ আন্টিকে বলে দ্যাখো তাহলে৷ বাবা তো আর লেখে না এখন৷ একদিন ঘর গোছাতে গিয়ে ডায়রিটা পেয়েছি৷ কবিতাগুলো বই আকারে প্রকাশিত হলে খুবই ভালো হয়৷”
“বেশ৷ আমি দেখছি কী করা যায়৷ বই হলে এখানেই একটা অনুষ্ঠান করা হবে৷ কবি বিহানের নামটা আরেকবার মনে করানোর সময় এসেছে পাঠককে৷ মা-কে নিয়ে আসবোই ওই অনুষ্ঠানে৷”
“তাহলে তো খুবই ভালো হয়৷ কতদিন ওরা একে অপরের মুখোমুখি হয়নি৷ দু’জনের দেখা হওয়াটা খুব দরকার৷ এটা আমার বারেবারেই মনে হয়৷”
“হ্যাঁ, আমিও ভেবেছি এটা৷ মায়ের সঙ্গে দেখা হলে কে বলতে পারে, তোমার বাবা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল৷ অ্যাটলিস্ট চেষ্টাটা তো আমাদের করে দেখতেই হবে৷ দেখা যাক৷ বইটার কথা আগে বলি মা-কে৷”
“আন্টি কী বলে জানিও৷ আমি তাহলে কম্পোজ শুরু করছি৷”
“একদম৷ ওই যে ট্রেন ঢুকছে৷”
“এতোদিন পর পর আসো৷ ভালো লাগে না৷ আচ্ছা, সাবধানে যেয়ো৷ ভালো থেকো৷ পৌঁছে ফোন কোরো৷ আর এরপর সময় নিয়ে আসবে৷ কবিতাও নিয়ে আসবে৷”
“আচ্ছা৷ কবিতা ফোনেই শোনাবো তোমাকে৷ তুমিও ভালো থেকো৷ আঙ্কলের খেয়াল রেখো আর পড়াশুনোটা মন দিয়ে করো৷ আশা করি সামনে ভালো দিন আসবে৷ কথা হবে ফোনে৷ চলি৷”
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments