জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-৮/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত


মাকে একা ছাড়তে চাইল না বুল্টি। প্রভা রাস্তায় বেরোতেই তাই আবার ফোন করল মেয়ে।"তুমি একটু অপেক্ষা কর মা। আমিও যাব তোমার সাথে। চয়নদাকে শেষ দেখাটা দেখার জন্য মনটা বড় ছটপট করছে। বাবার জন্য ও যা করেছে,কোনওদিন তা ভুলব না। নিজের ছেলেও অমন করেনা। চয়নদার মতো ভালমানুষ আজকের দিনে পাওয়া যায়না। ছেলে মেয়ের সুখের দিনটাই দেখে যেতে পারল না ও।" মনখারাপের নির্যাস মেশানো কথাগুলো বলে বুল্টি একটা শ্বাস ছেড়ে ফোন কেটে দেয়।
      বুল্টির ছেলেদুটো স্কুলে গিয়েছিল। ওদের মনিং স্কুল। পাশের বাড়ির মনোজকাকুকে বাচ্চাদুটোকে ছুটির পর নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়ে একটা অটো ধরে সে খানিকক্ষণেের মধ্যে চলে এল মায়ের কাছে। আজ শ্যামলও বাড়িতে নেই। কী একটা কাজে ভোর ভোর বেরিয়ে গেছে শ্রীরামপুর। তখন পাঁচটাও বাজেনি। ওর ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। 
     একটা অটো ধরে বুল্টি চলে এল মায়ের কাছে। প্রভা তখন একা বসে বসে কাঁদছেন। চয়নের মুখটা বড় মনে পড়ছে আজ। ওর বলা কথাগুলো কানে বাজছে। "সুরেশকাকার কেউ নেই,এটা তুমি ভাবলে কেমন করে? এই চয়ন যতক্ষণ আছে,তুমি নিশ্চিন্তে থাক কাকিমা। সব হবে। একটু ধৈর্য ধরো।" ধৈর্যই তো ধরেছিলেন প্রভা। সুরেশের মৃত্যুর পর পনেরো দিনের ধৈর্য। কোনও সুরাহা হয়নি। দেশের বাড়ি থেকে একজনও কেউ এসে পাশে দাঁড়ায়নি প্রভার। অথচ ছোটভাই বীরেশ রয়েছে ওখানে। বীরেশের তিরিশ বছরের ছেলে পলাশ রয়েছে। জেঠুর প্রতি ওর কোনও দায়িত্ব ছিল না। সম্পর্ক কেটে দিল। সুতোর মতো ছিঁড়ে দিল নাড়ীর টান। অগ্রাহ্য করল রক্তের সম্পর্ক। সেদিন চয়নই সব সামলেছে। নিজে হাতে একাই সুরেশের পারলৌকিক কাজ করেছে। মাথা ন্যাড়া হয়েছে।চয়নের এই আত্মত্যাগের কথা প্রভা ভুলে যান কেমন করে? নাকি বুল্টিই ভুলতে পারে? তখন সেই ক'মাস হল বিয়ে হয়েছে বুল্টির। মেয়ে হিসেবে বাবার যেটুকু কাজ করার সে তো করেইছে। ব্রাহ্মণ কঠোর নিয়মের কথা শুনিয়ে বলেছিলেন,"পুত্রের হাতে পিন্ডদানে পিতার আত্মা সন্তুষ্ট হয়। নিজপুত্র না থাকলে ভ্রাতুষ্পুত্র হলেও হবে।" সেদিন ব্রাহ্মণের ঐ নীতিকথার তীব্র প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়েছিল চয়নের। এখন যুগ কত এগিয়ে গেছে। এসব বস্তাপচা লৌকিকতার কোনও  যুক্তি আছে? ছেলে পারলে মেয়ে পারবে না কেন? কীসের দোষ? কিন্তু কিছু বলতে পারেনি চয়ন। বংশের দীর্ঘদিনের নিয়মের কথা মনে করে মুখে আটকে যায়। পুরোহিতের বিধান খারাপ লাগলেও বুল্টিও সেদিন চুপ করেছিল। শেষ মূহুর্তেও বীরেশের ছেলে ছোটন না আসায় সুরেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চয়ন করে। দেশের মানুষের রাগটা কোথায়,প্রভা জানেন। সুরেশের মৃতদেহ ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দাহ করা হয়নি গাঁয়ের শিমুলতলা শ্মশানে বাপ কাকাদের পাশে। সুরেশ শহরে থাকে। থাকতেই পারে। কাজের সূত্রে কলকাতায় থাকতেই পারে তিরিশ চল্লিশ বছর। তাবলে শেষদিনও নিজের জন্মভূমিতে ফিরবে না? মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাই বীরেশ,বীরেশের ছেলে সবাই এসেছিল সেদিন। বুল্টি রাজি হয়নি। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বাবার তৈরি করা বাড়িতে হোক,বুল্টি এটাই চেয়েছিল। শুধু বুল্টি একা কেন,প্রভা নিজেও চাননি দীর্ঘ এতগুলো বছর পরে শুধুমাত্র জন্মভূমির স্বাদ নিতে মানুষটার যাপনভূমিকে অগ্রাহ্য করতে। সুরেশের শ্রাদ্ধটা ওখানে গিয়ে কোথায় করবেন তাঁরা? জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়টা যেখানে কাটল,সেটা কি সহজে মুছে ফেলা যায়? তাছাড়া দেশের বাড়িতে যাওয়া মানে তো জন্মভূমির নাম করে পরগাছার মতো আশ্রয়। প্রভার শ্বশুরের ভিটে কোথায় আছে আর ওখানে? যে বাড়িতে সুরেশের দেহ নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল ওরা,সে বাড়ি তো বীরেশের! ওখানে সুরেশের সম্মান কোথায়? তাই নিয়েই রাগ। সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। আপন ভাই বীরেশ প্রভাকে তো ছাড়লই,সেদিন থেকে খুড়তুতো কাকা সুরেশের পরিবারের প্রতিও চরম উদাসীন দেখালেন অয়ন। দেখাল রাজীব,রাকেশ। চয়নের আত্মত্যাগটাকে ভালভাবে মেনে নেয়নি ওরা। চয়নের অতো মহান সাজবার কী আছে? সুরেশকাকার শ্রাদ্ধ নাহয় না হত! যা পারতেন করতেন প্রভা! সেদিন কারও কথায় কান নি দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখে চয়ন তাই সুরেশকাকার সমস্ত কাজ করে নিজে হাতে। গ্রামে এখবর যায়। সবাই চয়নকে ধন্য ধন্য করে। আজকের দিনে এরকম মানুষ কোথায়? সুমিত্রা,পাপিয়া আর কাঞ্চনার গাত্রজ্বালা হয়। নিজেকে কী ভেবেছে চয়ন? কলকাতায় থেকে দুটো পয়সার মুখ দেখেছে বলে কি যা ইচ্ছে তাই করে বেরোবে? অয়ন একবার ধমক দিয়েছিলেন ভাইকে। "তুই কিন্তু  এটা ঠিক করলি না। এটা বাড়াবাড়ি।"
"আমি তো করতে চাইনি। আমি তো বীরেশকাকার ছেলের জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। সুরেশকাকার নিজের ছেলে না থাক,ভাইপোও তো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটা করতে পারত। ভাইয়ের ছেলে মানেই তো নিজের ছেলের মতোন। করল না যখন,আমাকেই করতে হল। কলকাতায় আমিও আছি,দীর্ঘদিন ধরে কাকাও আছে,সব দেখেশুনে বিবেকে আমার খুব লেগেছিল দাদা।"
সরসীবালার মৃত্যুতে সেই শোধটাই যেন তুলল ওরা সবাই। কলকাতায় বসে পনেরোদিন অশৌচ পালন করলেন প্রভা। ঘাটকাজের দিন গ্রামে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। অয়ন চয়নের মা,পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা সরসীবালা বংশের বটগাছের মতো। তাঁর পারোলৌকিক কাজে প্রভা গিয়ে ঘাটে উঠবেন না,তা কি হয়? কিন্তু  যেতে দেওয়া হলনা প্রভাকে। প্রভার ওপর তখনও রাগটা একইরকম রাজীব রাকেশের। চয়নকে দিয়েই ফোন করালো ওরা।অয়নকে যেন মৃদু ধমক দিয়ে রাজীব বলল,"কলকাতা থেকে ঐ কাকিমা এলে আমরা ঘাট মানবো না। এখন দেখ কী করবে। যদি আমাদের সবাইকে নিয়ে চলতে চাও,তাহলে সুরেশকাকার বউকে আসতে বারণ কর। যখন আসার,তখন ও আসেনি কেন? এখন একা লাগছে?"

অগত্যা চয়নকে তাই বলতেই হল,"প্রভা কাকিমা,তুমি এখন এসো না। নখ'টা ওখানেই কেটৈ নাও। তুমি এলে ঝামেলা হবে।" এখনও মনে আছে প্রভার,চয়নের ফোনটা পাওয়ার পর সেদিন মাঝরাস্তা থেকে আবার ফিরে যেতে হয়েছিল বাড়িতে। দরজার তালা খুলতে গিয়ে চাবি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল অশ্রুতে।

     আহিরীটোলার বাস পেতে আজ একটু সময় লাগল। যদিও বা পাওয়া গেল,যানজটে আটকে পড়ল দু'বার। মা মেয়ে পাশাপাশি একই সীটে বসল। যেতে যেতে প্রভা মেয়েকে বললেন,"ওরা এসে আবার কোনও ঝামেলা করবে না তো রে,মা? আমি যে ঘরপোড়া গরু! ঋষভ কী বলবে,কে জানে। ঐটুকুনি ছেলে। কী আর বোঝে এসবের?"

"কিচ্ছু হবে না মা। তুমি শান্ত হয়ে বোসো তো। চয়নদার কি কেউ নেই? বউদি আছে,ছেলেমেয়ে দুটো আছে। সিদ্ধান্ত তো ওরা নেবে।" বুল্টি বোঝালো মাকে।

 বোঝাতে গিয়ে আড়চোখে লক্ষ করল, প্রভা কাঁদছেন।
 কাঁদুক। কেঁদে যদি একটু হালকা লাগে নিজেকে।

 সুরেশের শ্রাদ্ধশান্তি করেছিল চয়ন। ছেলের মতো কাজ করেছিল। আজ ছেলের মৃত্যুতে মা তো কাঁদবেই।
     কান্নাটা গিলে বুল্টি শক্ত হতে চাইছিল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments