সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক
পর্ব – ২
দ্বিতীয় অধ্যায়
৪
‘But if the while I think on thee, dear friend,
All losses are restored and sorrows end.’
শেকসপিয়ারের তিরিশ নম্বর সনেটের এই শেষ দু’টি লাইনের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আলোচনার মধ্যে দিয়েই প্রথম কথা শুরু হয় বিহান ও তৃষার৷ ইংরাজি অনার্স নিয়ে দু’জনই কলেজে ভর্তি হয়েছে৷ প্রথম প্রথম বিহান শুধু দেখেই গেছে তৃষাকে৷ ভালো লেগেছে প্রথম দিনই৷ কিন্তু কথা হলো বেশ কিছুদিন পর অফ পিরিয়ডের আলোচনায়৷ মনে মনে বিহান শেকসপিয়ারকে কত যে ধন্যবাদ জানিয়েছে কে জানে৷
এরপর দু’জনের কথা আর বন্ধ হয়নি৷ বরং বেঞ্চের দূরত্ব উবে একবেঞ্চে পাশাপাশি বসতে শুরু করে ওরা৷ পড়াশুনোয় একে অপরকে সাহায্য করার পাশাপাশি ক্রমশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে৷ মনের দিক থেকেও দু’জন খুব কাছাকাছি চলে আসে দু’জনের৷ অফ পিরিয়ডের আড্ডায় আর দেখা যায় না ওদের৷ মাঝে মাঝে ক্লাস থেকে উধাও হয়ে যায়৷
কলেজের একেবারে শুরুর দিন থেকেই বিহানের কবিতা লেখাও শুরু হয়ে যায়৷ কলেজের পড়ার বাইরেও সময় পেলেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, ভাস্কর চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ার এক অদ্ভুত নেশা ছিল বিহানের৷ তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ তো ছিলই৷ বিহানের কবিতা লেখার প্রবণতাটা আরও বেড়ে যায় তৃষার সঙ্গে ওর আলাপ হবার পর থেকে৷ বিহানের হাত থেকে বেরিয়ে আসে এধরণের সব লাইন–
দেহের প্রচন্ড কাঁপন থেকে হঠাৎ
সামনে এসে দাঁড়াবে নয়নাভিরাম
সমস্ত মায়া আচমকা এসে বসবে
বুকের খাঁচায়
কিংবা
শীতঘুমের শেষে হাপিত্যেশ করেছি একটি দর্শনের জন্য
একটি দর্শনে সহস্র দমক ভরা থাকে, থাকে আরোগ্য৷
দুপুরের পরে তুমি বৃষ্টি হয়ে নেমে আসো পাতায় পাতায়
আমি ভিজতে চাই না, তবু ভিজি, কি করে হবো যোগ্য...
কিংবা
বহুকাল আমি জীবনের রংবাহার ছুঁয়ে দেখিনি৷
একবার কি অন্তত ঝাঁপ দেবো প্রিয় সর্বনাশে?
সহপাঠিরা দিন দিন বিহানের এবং বিহানের কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠে৷ কলেজ ম্যাগাজিনে মনোনীত ও প্রকাশিত হয় ওর কবিতা৷ দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে করতেই কবি হিসেবে বিহানের প্রাথমিক একটা পরিচিতি তৈরি হয়ে যায় গোটা কলেজেই৷ কিন্তু পরীক্ষার ফল ভালো আসে না৷ তৃষারও একই৷ দু’জনই টেনেটুনে চল্লিশ শতাংশ৷ বসন্তের মনোরম পরিবেশে হঠাৎ ঘোর কালো মেঘের ছায়ার মতো বিহান ও তৃষার সোনালি দিনের ওপরও এক অদৃশ্য কালো ছায়া ঘুরতে থাকে৷ ওরা কিছুই বুঝতে পারে না৷
৫
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষটা দেখতে দেখতে কেটে গেল৷ যেন একখন্ড মেঘ আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভেসে ভেসে একসময় মিলিয়ে গেল৷ বিহান ও তৃষার মধ্যে ঠিক দূরত্ব নয়, তবে স্বাভাবিকতার অভাব ঘটেছে৷ কারণ, প্রথমত পরীক্ষায় দু’জনেরই ভীষণ খারাপ পার্সেন্টেজ এবং দ্বিতীয়ত তৃষাকে লেখা বিহানের কিছু চিঠি তৃষার মায়ের হাতে পড়ে যাওয়া৷
বিহান ও তৃষা, দু’জনই বুঝতে পারছিলো ওদের সম্পর্কের সমীরকণ নড়বড়ে সাঁকোর মতো ঝুলে আছে – একটা প্লাবনে ভেঙে যাবে৷ কিন্তু সবকিছু তো মানুষের হাতে থাকে না৷ তৃষা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়৷ তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন ভালো পার্সেন্টেজ৷ তাছাড়া বিহানকে নিয়ে ওর বাড়িতে দীর্ঘ অশান্তি চলেছে৷ বিহান অবশ্য কোনভাবেই তৃষাকে জোর করে আকড়ে ধরতে চায়নি৷ স্পেস দিয়েছে৷ কিন্তু সেই স্পেস নদীগর্ভে একটি চরের মতো ক্রমবর্ধমান – যে কোন দিন নদীটাকেই খেয়ে নিতে পারে৷
বিহান পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ কিন্তু যতটা করতে চায় ততটা পারেনা৷ বারবার না বলতে পারা কথারা ঘিরে ধরে – কথারা কবিতার লাইন হতে চায় – লাইনগুলি পূর্ণাঙ্গ শরীর দাবী করে৷ একটি শরীর এরকম হয়ে ওঠে –
নদীর মতো ছিল সে
ছিল বৃষ্টির মতো
ঋতু বদলে যেতেই দ্যাখো
বুকে হাজারো ক্ষত
কী করা যায় এখন, এখন কী করার...
আর কি মনে আলো জ্বলে উঠবে তার
সেই আলোর দেখা পাবার জন্যই অপেক্ষা করে বিহান৷ তৃষার সঙ্গে কথা হয় মুখোমুখি হলে – কথা হয় এক দুটোই মাত্র৷ প্রথম বর্ষের একেকটা দিন মেঘভাঙা বৃষ্টির মতো নেমে আসে বিহানের ওপর৷ বিহান শুধু কলম হাতে বসে থাকে তার নীচে৷
৬
বসন্তের ঝরা পাতার মতো বিহানের স্বপ্নগুলিও একে একে ঝরে পড়ছে৷ তৃষা এখন আরও দূরে, অনেক দূরে৷ তৃষা এখন যেন দিগন্তে এক আলেয়া৷ শুধু দেখা যায়, মুগ্ধ হওয়া যায়, ছুঁয়ে দেখা যায় না৷ বিহান তবু স্পর্শ পায় তৃষার, একেকটা উষ্ণ শ্বাস বিহানের শরীরে আজও খেলা করে৷ বিহান নোট মুখস্থ করার মাঝেই পাথর হয়ে যায় যখন তখন৷ তৃষার চুল থেকে কবিতার লাইন পাহাড়ি ঝরনার মতো নেমে আসে বিহানের হাতে৷ বিহান লেখে৷ বিহান কবিতা লেখে৷ কবিতার ভেতর লুকোনো এক সিন্দুকে রেখে দেয় ওর সমস্ত অভিমান, অক্ষমতা আর টুটাফুটা অনুরাগ৷
বিহানের বাবা থানার কন্সটেবল৷ রিটায়ারমেন্টের আর বছরখানেক বাকি৷ মা রক্তালপতার রুগি৷ বাবার শেষ ট্রান্সফারের পর ভাড়াবাড়িতেই দিন কাটছে৷ কাজেই কলেজ শেষ হলে পরবর্তী পড়াশুনোর পাশাপাশি বিহানকে চাকরির পড়াটাও চালু করে দিতে হবে৷
ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পাঁচ মাস আগে তৃষার বাবা হঠাৎ মারা গেল৷ সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক৷ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও পাওয়া যায়নি৷ স্কুল ছুটি থাকায় তৃষার মা বাড়িতেই ছিল৷ তৃষা পড়ছিলো৷ দুপুরবেলার ঘটনা৷ খবর পেয়ে তৃষাদের আত্মীয়স্বজন, মায়ের স্কুলের কলিগরা এসেছিল৷ তৃষার বন্ধুরাও এসেছিল৷ বিহানও গিয়েছিল৷ কিন্তু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ তৃষার সঙ্গে কথা বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে৷
এরপর থেকে তৃষা কলেজে আসা কমিয়ে দিলো৷ যথারীতি বিহানও৷ কমন ফ্রেন্ড রিতিকার বাড়ি তৃষার বাড়ির কাছেই ছিল৷ রিতিকার কাছেই নিয়মিত তৃষার খবর নিতো বিহান৷ বিহানের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর মা ও মেয়ের মধ্যে কিছুটা চির ধরেছে৷ বাবাকে খুব ভালোবাসতো তৃষা৷ বাবার এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি তৃষা৷ ফলে একটা চাপা যন্ত্রণা বুকের ভেতর তছনছ করতে থাকে তৃষাকে৷
বিহান একটা সময় বুঝতে পারে তৃষা ভালো নেই একেবারেই৷ ফোন করে তৃষাকে৷ তৃষা ধরে না৷ আবার করে৷ পর পর বেশকিছুদিন করে৷ তৃষা ধরে না৷ বাবা নেই কিন্তু যে কথা তৃষা বাবাকে দিয়েছিল, সেটা আছে৷ সেটা মেনে চলবে তৃষা৷
বিহানের বাষট্টি শতাংশ নম্বর এলো ফাইনাল ইয়ারে৷ খেটেছিল কিন্তু এতোটাও আশা করেনি৷ তৃষার উনপঞ্চাশ শতাংশ৷ সেকেন্ড ইয়ার থেকেও কমে গেল৷ কলেজের বাইরে নম্বরের চার্ট দেখতে সবাই এলো৷ শুধু তৃষা এলো না৷ বিহান সাইকেলস্ট্যান্ডে অনেকক্ষণ বসে থাকলো৷ তৃষা এলো না৷
অবশেষে এলো সেই দিন৷ মার্কশিট বিলি হচ্ছে৷ যার যা রেজাল্ট হওয়ার হয়ে গেছে৷ সবার মুখেই হাসি৷ সবাই বেশ সেজেগুজে এসেছে৷ শেষ দিন কলেজের৷ এদিক সেদিক ছোট বড় জটলা৷ গল্পে মেতে উঠেছে সবাই৷ মোবাইল নম্বর দেয়া-নেয়া চলছে৷ আর কবে দেখা হবে কে জানে৷ অনেকে অনেককে জড়িয়েও ধরছে৷ অনেকের চোখে জল৷ বিহান খুঁজে চলেছে তৃষাকে৷ বেশ খানিকক্ষণ পর খুঁজে পেল৷ এগিয়ে গেল তৃষার দিকে৷ বিহানকে দেখে মৃদু হাসলো তৃষা৷ ব্যাস্, ওটুকুই৷ কিছুই বলার সুযোগ পেল না বিহান৷ বিহান দেখলো, গোধূলির রাঙা আলোর দিকে তৃষা চলে যাচ্ছে৷ চলে যাচ্ছে তৃষা৷
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments