জ্বলদর্চি

কবি-চিত্রকর শ্যামলবরণ সাহার সঙ্গে একদিন/সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্রাবণী গুপ্ত

দক্ষিণের বারান্দায় কবি-চিত্রকর শ্যামলবরণ সাহার সঙ্গে একদিন... ‌
 
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্রাবণী গুপ্ত


"যত বাঁশগাছ আঁকি
দেখে মনে হয় আমার মুখের ছবি

কাটারির ঘায়ে নিবংশ
আবার গজিয়েছি আমি
এমন গোয়ার্তুমি শিখেছি তোমার কাছে"



১. আপনি বাঁশগাছ যেমন আঁকেন, তেমন লেখেনও বাঁশগাছ। রঙ-তুলি না খাতা-পেন কোনটি আপনার বেশি প্রিয়?

উঃ- তুমি জানতে চেয়েছ, যেহেতু আমি একই মানুষ একসঙ্গে কবিতাও লিখি আবার ছবিও আঁকি তাই রঙ-তুলি না খাতা-পেন কোনটা আমার বেশি প্রিয়। তখন ছবি আঁকি, এক্সিবিশন টেক্সিবিশনের জন্য বাগুইআটিতেই থাকতাম। একবার হয়েছে কি, কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য-এর বাড়িতে গেছি কবিতা নেব বলে,  উনি কবিতা দিলেন আর কথা প্রসঙ্গে এও বললেন যে আমার নামে হুবহু নাকি একজন কবি আছেন। আমি তখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, "আমিই সেই ব্যক্তি"। উনি বললেন, "তুমি বলছিলে তুমি ছবি আঁকো, বাগুইআটিতে থাকো, তোমার বহু লেখা আমি পড়েছি"। আসলে অনেক ঘুরেছি, অনেকেই আমার উভয় সত্তার সাথে পরিচিত আবার অনেকেই সবটা জানেন না। কিন্তু আমার কাছে এ দুটোই আমার ভালোলাগার জায়গা। একটা কবিতা যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই আমার ছবি আঁকা শুরু আবার যেখানে একটা ছবি আঁকা শেষ হয় সেখান থেকেই আমার কবিতার শুরু। তাই তুলি ধরতে না দিলে আমি কলম দিয়েই ছবি আঁকব। 

২. আপনার ছবির জগতে আসার ভাবনা কখন এবং কিভাবে?

উঃ- অনেক ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতাম, দেয়ালে, কখনও খাতায়। এক্ষেত্রে আমার প্রথম ভাস্কর আমার মা আর প্রথম ছবি আঁকার হাতেখড়ি বাবার হাত ধরেই। মা যখন রুটি করতেন আমি মায়ের কাছ থেকে আটার গোলা নিয়ে তা দিয়ে সাপ বানাতাম, মা করতেন কি সেই সাপের মুখটা একটু চেপে দিয়ে ফণা মতো করে দিতেন, সেই দেখে আমার সে কী ভয়। এই যে ভয়মিশ্রিত আনন্দ, এটা আমার মায়ের কাছ থেকেই শেখা।তাই মা-ই আমার দেখা প্রথম ভাস্কর। আমিতো বরাবরই ঘরকুনো, বাজার যেতে চাইতাম না একদম। সে পুজোর বাজার হোক আর যাই হোক। আমি মায়ের সঙ্গে ঘরেই থাকতাম। বাবা জুতো কিনতে যেতেন, একটা কাগজে আমার পায়ের ছাপ খুব সুন্দর করে তুলে নিতেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেটা দেখে আমার সে কী আনন্দ। এই আমার প্রথম দেখা ছবি। এভাবেই আমার বাবা তাঁর অজ্ঞাতেই আমার দেখা প্রথম চিত্রকর হয়ে উঠেছিলেন। আর একটা কথা না বললেই নয়। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি বর্ধমান টাউন স্কুলে, একদিন অঙ্কের ক্লাসে সবাই মন দিয়ে অঙ্ক করছে, আমি কিন্তু লাস্ট বেঞ্চে বসে বসে স্যারের ছবি আঁকছি। স্যার মানে আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষারকান্তি বন্দোপাধ্যায়। ছবি আঁকছি। স্যারের হাতে যথারীতি ধরাও পড়লাম কিন্তু উনি আমাকে ভৎসনা না করে উৎসাহ দিলেন এবং স্কুলের অনুষ্ঠানে প্রর্দশনীর জন্য একঘর ছবিও আঁকতে বললেন। এটাই ছিল আমার ছবি আঁকার জগতে প্রথম প্রবেশ। বলতে গেলে এটাই আমার প্রথম প্রর্দশনী।

৩. আপনি বাঁশগাছকেই আত্মপ্রতিকৃতি বলে বেছে নিলেন- এই রহস্যের মুখ থেকে যদি একটু ঘোমটা সরান।

উঃ আমি কখনও চাইনি শিল্পী শ্যামলবরণ সাহা কখনও কারো অনুকরণ করছেন একথা কেউ বলুন। তাই মনে মনে নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করব এমন চেষ্টাই ছিল। আর বাঁশগাছ! সে তো হুবহু আমিই। ঐ যে লিখেছি, " এমন গোয়ার্তুমি শিখেছি তোমার কাছে ", আসলে বাঁশগাছ যেমন গোঁয়ার, বারবার কেটে দিলেও আবার বেড়ে ওঠে। আমিও তেমন। কতবার কতজন আমার মতো মফস্বলের ছেলেকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছে তবুও আমি একরোখা, হেরে যাইনি। কেউ একফোঁটা জল দেয়নি বাঁশগাছের গোড়ায়, তবু বাঁশগাছ বেড়ে ওঠে। বহুবার ভেবেছি, দেখেছি অনেক অনেক মিল রয়েছে আমার বাঁশগাছের সাথে, তাই বাঁশগাছেই নিজেকে দেখতে পাই, বারবার বারংবার। বাঁশগাছ তো মানুষের নাড়িকাটা থেকে অন্তিম যাত্রার মাচা তৈরি, সবটাতেই কাজে লাগে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সাথে সাথে থাকে। আমিও তেমনি মানুষের সঙ্গে আজীবন থাকতে চেয়েছি, চলতে চেয়েছি মানুষের পাশে পাশে। 

৪. কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আপনার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু-একটির কথা বলুন। 

উঃ- প্রথম একক এক্সিবিশন হয় কলকাতায় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ। সেটা ছিল ২০০৪ সাল।  তার আগে বহুবার ডুয়েট এবং গ্রুপ এক্সিবিশন হয়েছে অবশ্য। এ যাবৎ মোট ছ'বার একক এক্সিবিশন হয়েছে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ। এছাড়া দিল্লীতে ডুয়েট এক্সিবিশন করেছি। মুম্বাইতেও। চেন্নাইতে গ্রুপ এক্সিবিশন। তখন অবশ্য শহরগুলোর নাম অন্য ছিল, বোম্বে, মাদ্রাজ এইসব। কলকাতার তাজবেঙ্গল-এ ২০১৬ সালে আমার লাস্ট এক্সিবিশনটি হয়েছে। প্রথমটির উদ্বোধন করেছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও চিত্রকর রবীন মন্ডল আর ২০১৬ সালে অ্যাকাডেমিতে যে শেষ প্রর্দশনীটি হয় সেটির উদ্বোধন করেছিলেন সাহিত্যিক দেবেশ রায় ও অরুণ সেন। এছাড়া আলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত, হিরণ মিত্র, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সুভাষ ভট্টাচার্য, কালীকৃষ্ণ গুহ-র মতো বিদগ্ধ মানুষজন উপস্থিত থেকেছেন আমার বিভিন্ন এক্সিবিশনে। 

৫. ইতিমধ্যে আপনার কাব্যগ্রন্থ এগারোটি, ছড়ার বই চারটি, প্রথম কাব্যগ্রন্থ  "বেহুলা বিস্ময়" যখন প্রকাশ পেল সেই উত্তেজনার কথা কিছু বলুন।

উঃ- "বেহুলা বিস্ময়" প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে, ৪৮ পাতার একটা কবিতার বই। আনন্দবাজারে খুব ভালো একটা রিভিউ বেরিয়েছিল। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পড়ে বলেছিলেন, "এগুলো কি লিখেছ, এগুলো কবিতা!" কবি প্রনবেন্দু দাসগুপ্তকে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম," আমার একটি বই বেরিয়েছে, আমি আপনার কাছে পৌঁছে দিতে চাই, কি ভাবে তা সম্ভব যদি জানান?" উনি উত্তরে লিখেছিলেন "যে কোন শনিবার বাড়িতে আসতে পারেন, আমি বাড়িতেই থাকি "। আমি যথারীতি উপস্থিত হলাম, গিয়ে দেখি উনি পায়চারি করছেন, আমাকে দেখে সস্নেহে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। সেই প্রথম সিঁড়িতে উঠতে উঠতে ওনার বাড়িতে আমি অরিজিনাল কিছু ছবি দেখি, বিখ্যাত সব ছবি, সুনীল দাসের ছবিও প্রথম ওনার বাড়িতেই দেখি। ওনাকে বইটি দিয়ে ফিরে আসি। তারপর উনি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, "তোমার সব কবিতাই খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু তুমি একটা চরিত্রে আসার চেষ্টা করো"। এই "চরিত্র" শব্দটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। কেননা আমার কোন কবিতা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো, কোনটা পরেশ মন্ডলের মতো কোনটা আবার প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত-এর মতো। কবি আলোক সরকারের মতো কখনও লেখার চেষ্টা করিনি। যদিও কবি আলোক সরকার আমার "বেহুলা বিস্ময়" পড়ে ওনার ভালোলাগার কথাই জানিয়েছিলেন। ওনার কবিতা পড়তাম, হয়তো সবটা বুঝতাম না, এখনও যে বুঝি তা বলব না, আমার মনে হয় কবি আলোক সরকারের কবিতা সম্পূর্ণ বোঝা যায় না, ওটা অনুভবের ব্যাপার। সমগ্র মানুষটাকে ভালোবাসতাম, ওনার সান্নিধ্যটাকে ভালোবাসতাম। তা যাইহোক, কবি প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত-এর ঐ চিঠিটা আমার খুব কাজে লেগেছিল। লেখার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা চরিত্র হয়তো তৈরি করতে সাহায্য করেছিল ওনার কথাগুলো, একটা স্বকীয়তা, যা দেখলে সহজেই অন্যের থেকে আলাদা করা যায়, এই আর কি। 

৬. প্রকাশক শ্যামল বরণ আর শিল্পী বরণ, এটা সামলান কি ভাবে?

উঃ- আসলে কবিতা তো শুধু একার জন্য নয়, কবিতা মানে সকলকে নিয়ে থাকা। তাই আমি চাই একটা পরিমন্ডল তৈরি হোক, নতুন নতুন মুখ উঠে আসুক কবিতার হাত ধরে, নতুন প্রতিভারা পরিচিতি লাভ করুক। আমার বরাবরের আক্ষেপ জানো, আমাদের দেশে যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা বেশিরভাগই ছবি সম্পর্কে বিশেষ খোঁজখবর রাখেন না আবার যাঁরা ছবি আঁকেন তাঁরা অনেকেই কবিতাচর্চা করেন না। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছবি আর কবিতা হাত ধরাধরি করে চলুক। আর এগুলি আমার মন ভালো রাখার বিষয়। আমি অনেক আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, মনের জন্য পাঁচদিন আর পেটের জন্য দুদিন। তাই মনের টানে সব সামলে ফেলি, অসুবিধে হয় না।

৭. "বাল্মীকি" নামে একটি কালজয়ী পত্রিকার সম্পাদনা করছেন বহুদিন, এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ কত সালে, আর এ যাবৎ কতগুলি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে? "বাল্মীকি" পত্রিকার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে একটু বলুন।

উঃ- "বাল্মীকি" পত্রিকার আগে নাম ছিল "সাইক্লোন", তখন নজরুল ইসলামের কবিতা পড়ছি, সুকান্তের কবিতা পড়ছি তাই মনের মধ্যে একটা বিপ্লবী বিপ্লবী হাবভাব ছিল। তাই এরম একটা নাম রেখেছিলাম। আসলে আমি কমিউনিস্ট হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঐ যে বলে না সন্নাসী হওয়া সহজ কিন্তু কমিউনিস্ট হওয়া সহজ নয়। সে যাই হোক, "বাল্মীকি" পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ১৯৭৬ সালে। তারপর থেকে প্রায় পঁচিশ তিরিশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এবারও প্রকাশিত হবে, সব মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছি। জানো, বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে একবার এই পত্রিকাটি পুরষ্কারের জন্যও মনোনিত হয়েছিল, ওনাদের খুব ভালো লেগেছিল এই পত্রিকাটি। কিন্তু কোথাও গিয়ে আমার যেন মনঃপুত হয়নি, আমার যেন মনে হয়েছিল আরও ভালো হতে হবে এই পত্রিকার মান, তাই আমি নিজেই পুরষ্কার গ্রহণ করতে রাজি হইনি। আসলে নিজের ভেতর থেকে তৃপ্তিটা খুব প্রয়োজন। পুরষ্কারটাই তো আর বড় কথা নয়। 

৮. "চিত্রকল্প"-আপনার ছবি আঁকা শেখানোর স্কুল, কবে শুরু এই পথচলা আর কেমন ছিল শিক্ষক শ্যামল বরণ সাহার অভিজ্ঞতা?

উঃ- প্রথম যখন হরিজন বিদ্যালয়ে ছবি আঁকার স্কুল খুলি, ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র চারজন, তারপরের দিন হল উনিশ জন, তারপর পঞ্চাশ। এই ভাবে ধীরে ধীরে চিত্রকল্প থেকে অনেক অনেক ছাত্র ছাত্রী বেরোতে লাগলো। ঠাকুরানন্দ পাল বিদেশে স্কলারশিপের সুযোগ পেলেন। উনি এখন বর্ধমান আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল। কানাডা থেকে দু দু বার এলিজাবেথ গ্রিনফিল্ড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ঠাকুরানন্দ। এছাড়া কুশল বনিক, কুন্দন মন্ডল, সুশান্ত মন্ডল, নন্দিনী ঘোষ রয়েছেন যাঁরা বর্তমানে শিল্পী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। নিজে ছাত্র হিসেবে অনেক কষ্ট করেছি, শুভাপ্রসন্ন স্যারের কাছ থেকে ছবি আঁকার শিক্ষা গ্রহণ করেছি। বর্ধমান-এর মতো মফস্বল শহর থেকে যাতায়াত করে বহু কষ্টে শুভাপ্রশন্নের  মতো শিক্ষকদের কাছ থেকে বহু কিছু শিখেছি। শুভাপ্রসন্ন ছাড়াও রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়,গনেশ পাইন, প্রকাশ কর্মকার, রবীন মন্ডল এনাদের কাছ থেকেও ছবি এঁকে জীবন চালাবার প্রেরণা পেয়েছি। সে সব ছিল একদিন। তারপর যখন নিজে শিক্ষক হলাম, সে যে কি আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না।  কোনদিনই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি, এইটেই চেয়েছিলাম। লিখব আঁকব, আঁকব লিখব। আর সময় পেলে বাগান করব। 

৯. ছবি আঁকা, কবিতা লেখা এসবের জন্য তো একটা অবসর সময় দরকার, ছবি আঁকার ইস্কুল সামলে, প্রকাশনার কাজকর্ম সামলে অবসর পান ? রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কবি বুদ্ধদেব বসুর সেই বিস্ময়চর্চা উচ্চারণ করেই বলছি, এত কাজের সঙ্গে এত অবসরকে আপনি মিলিয়েছেন কী করে!

উঃ-  এসব তো আমার প্রাণের আরাম। লেখা আর আঁকা ছাড়া যে আমি বাঁচতে পারি না। তাই হয়ে যায়, সবকিছুই প্রাণের আরামের জন্য হয়ে যায়, অসুবিধা হয় না। 

১০. প্রথম "অনির্বাণ" তারপর "সাইক্লোন" তারপর "বাল্মীকি", প্রথম "বাকচর্চা" তারপর "পূর্ব-পশ্চিম" তারপর "দক্ষিণের বারান্দা", খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এই যে নামগুলো বারবার বদলাচ্ছে অথচ কর্মকাণ্ড একই, এটা কেন? এটার কি খুব দরকার ছিল?

উঃ- ঐ যে শঙ্খ বাবু বলেছেন, "এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়"। বারবার গড়ছি বারবার ভাঙছে। বারবার নাম পাল্টে সে যেন নিজেকেই বারবার দেখা। কর্মকাণ্ড একটাই লক্ষ্য একটাই, সবাইকে এক ছাদের নিচে আনা। এখানে প্রতিষ্ঠিত অ-প্রতিষ্ঠিত নয়, শুধুমাত্র নামকরা কবি সাহিত্যিক নয়, আমার ইচ্ছে সকলকে একসাথে নিয়ে এগিয়ে চলা। 

১১. "দক্ষিণের বারান্দা" নিয়ে তরুণ প্রজন্মের  অনেক স্বপ্ন, আপনার আগামী পরিকল্পনা সম্পর্কে একটু জানতে চাইব।

উঃ- শরীর একদম ভালো থাকে না। তাই ঠিক করেছি, ভালো করে ছবি আঁকব, জমিয়ে কটা প্রর্দশনী করব আর "দক্ষিণের বারান্দা" থেকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বই বের করব, এটুকুই। কোন বানিজ্যিক সফলতা পাওয়ার আশায় নয়। আসলে যে শহরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে সে শহরকে দেখলেই যেন বোঝা যায় যে এর একটা আলাদা সাংস্কৃতিক দিক আছে, শিক্ষার ছাপ আছে, একটা রুচিবোধ আছে, যেন প্রোডাকশন দেখলেই সেটা বোঝা যায়, এটা আমার খুব ইচ্ছে। "বাল্মীকি" প্রকাশ করব, তা সে ত্রৈমাসিক হোক বা ষান্মাসিক বা বছরে একবারই হোক, কিন্তু সেটা যেন হয় একেবারে অ্যালবামের মতো। যেন দেখলেই বোঝা যায় যার হাত ধরে বেরিয়েছে তিনি ছবি আঁকেন। এ বিষয়ে বরাবরই আমার মনে হয়েছে বেশিরভাগ লিটিল ম্যাগাজিনই যেন সেটা ক্যারি করে না, অবশ্য ইদানিং অনেকটাই হয়েছে। 

১২. এই শহরের কবি সুব্রত চক্রবর্তীর কথা কিছু বলুন।

উঃ- বর্ধমানে থাকার সুবাদে সুব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ বেশী পেয়েছি। সুব্রত চক্রবর্তী বর্ধমান রাজ কলেজের ফিজিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। আমি ঐ কলেজের ছাত্র ছিলাম। বাংলার ছাত্র হলেও আমি কিন্তু কলেজ সাহিত্যের প্রকৃত শিক্ষাটা একজন ফিজিক্সের অধ্যাপকের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। উনি বলতেন, " কখনও বলবে না রবীন্দ্রনাথ পড়েছি জীবনানন্দ পড়েছি, বলবে পড়ছি।" 

১৩. কবি আলোক সরকার, আপনি তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন, ওনার সম্পর্কে যদি দু-এক কথা বলেন। 

উঃ- লেখার শুরু থেকেই যিনি আমাদের পক্ষীমাতার মতন লালন করেছেন তিনি আলোক সরকার। আমি শ্যামসুন্দর কলেজের ছাত্র ছিলাম না তাই সরাসরি আলোক সরকারকে শিক্ষক হিসেবে পাইনি। তবে বহুবার গেছি ৪৫এ, রাসবিহারী এভিনিউ-এ। আলোক সরকারের বিখ্যাত কাগজ "শতভিষা"য় আমার অনেক কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে। 

১৪. "বাকচর্চা" এবং "দক্ষিণের বারান্দা" থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই এর নাম জানতে চাইব।

উঃ- বাকচর্চার উল্লেখযোগ্য বই:

দেবদাস আচার্য : আচার্যের ভদ্রাসন
গৌতম বসু : অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে
নির্মল হালদার: ধান ও জলের ধ্বনি(কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার পেয়েছিল এই বইটি)

দক্ষিণের বারান্দার উল্লেখযোগ্য কবিতার বই:

সুব্রত চক্রবর্তী : বালককালের টালবাহানা
রূপক মিত্র: হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন
রাজকুমার রায়চৌধুরী : হিংসার দাগ
বিভাস সাহা: ব্যাকপ্যাকে এনেছি শ্রাবণ
সঞ্চয়িতা কুন্ডু : রোদের মুখে জল দাও
সূর্য মন্ডল: ঘোড়ার চাল আড়াই ঘর 

প্রবন্ধ:

সঞ্জয় ভট্টাচার্য: তিনজন আধুনিক কবি
তারাদাস বন্দোপাধ্যায়: আমার বাবা বিভূতিভূষণ
স্বপ্নকমল সরকার: অর্কপ্রভ বিদ্যাসাগর


১৫. চাকরি বাকরি না করে আপনি যে এইসমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতেন, আপনার বাবা এসব কি চোখে দেখতেন?

উঃ- একবার কি হয়েছে, বাবার এক বন্ধু বাবাকে বেশ আপ্লুত কন্ঠে বললেন, শুনলাম তোমার ছোট ছেলে নাকি প্রকাশনার কাজকর্ম করছে! বাবা শুনে হাসতে হাসতে বললেন, " তাই তো দেখলাম, বাড়িতে প্রকাশক আর লেখক জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে"। আসলে বাল্মীকি প্রকাশনা থেকে তখন  সদ্য কবি রাজকুমার রায়চৌধুরীর " নগ্ন সাদা হার " কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে আমারই উদ্যোগে। আর আমাদের বন্ধুত্ব তো সর্বজনবিদিত। একসাথে থাকা, খাওয়া, ঘুমোনো সব। আসলে বাবা বন্ধুকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তাঁর ছোটছেলেটি এখনও সেই অর্থে অর্থনীতি বুঝে উঠতে পারেনি, যা করে নেহাতই ভালোবেসে। বাণিজ্যিক সফলতা পাওয়ার আশায় যে আমি কোন কাজ করতেই পারি না এ যেন বাবা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশ্বাস করতেন। 

১৬. প্রকাশ-শ্যামলবরণ- রাজকুমার কেমন ছিল সেই জার্নি?

উঃ- আমার তিনজন হরিহর আত্মা। আমি আর রাজকুমার শহর বর্ধমানে থাকি। প্রকাশ থাকে পানাগড়ে। পানাগড়ে থাকলে কি হবে! সাতসকালে চলে আসত বর্ধমানে। আমি আর রাজকুমার প্রকাশের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম কার্জনগেটে। তিনজনে জলযোগে পদ্মপাতায় কচুরি খেয়ে জলখাবার সারতাম দিনের পর দিন। বেশীরভাগ দিন পয়সা মিটাতো প্রকাশ। তিনজনে শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতাম। আর কোন প্রেসে ভালো স্মলপাইকা টাইপ আছে খুঁজে বেড়ানোই ছিল আমাদের একমাত্র মহাকাজ। আমরা তিনবন্ধু মুষলধারা আড্ডায় কত না ভিজেছি। 

১৭. প্রায় শেষের দিকে এসে গেছি, এবার কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন, কবি সঞ্চয়িতা কুন্ডু না গৃহবধূ সঞ্চয়িতা কুন্ডু, কাকে বেশি কাছ থেকে চেনেন এবং নিবিড় ভাবে চেনেন?

উঃ- গৃহবধূ! আসলে আমি তো সঞ্চয়িতাকে বিয়ে করিনি, সঞ্চয়িতা আমাকে বিয়ে করেছে। তাই ও স্বামী পেয়েছে।  খুব দক্ষ হাতে সামলেছে সংসার। ভীষণ সাহসী ও। প্রচুর পরিশ্রম করে। ও বলেই সম্ভব হয়েছে। ভীষণ অসুস্থ হয়েছি বহুবার। সঞ্চয়িতা না থাকলে জানি না কি হত! তাই আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় প্রত্যেক পুরুষের অবশ্যই বিয়ে করা উচিত। তবে সঞ্চয়িতার পরিচয় আমার কাছে আগে কবি হিসেবেই। সবকিছু সামলেছে অথচ নিজের লেখালেখির জগত থেকে কখনও সরে আসেনি। সেই ছাত্রীজীবন থেকে বহু নামকরা পত্র-পত্রিকায় লিখছে। অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। 

১৮. ৩৭ কালনা রোড না বাগুইআটি?

উঃ- ৩৭ কালনা রোড, অবশ্যই। এখানে আমি জন্মেছি। কলকাতায় যাই, কলকাতার নিজস্ব একটা আগুন আছে, আমাকে ছ্যাঁকা দেয়, অনেক কাজ করতে পারি। কিন্তু এই যে বর্ধমান, এর অদ্ভুত একটা টান আছে। তবে এই যে জলবায়ু, এ বড্ড মানুষকে অলস করে দেয়, কাজ করবার জন্য ঠিক না। তবু বলব, আমার কাছে আগে ৩৭ কালনা রোড। 

১৯. নন্দীগ্রামের জন্য পদযাত্রা না একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য মিছিল।

উঃ- দেখো, দুটোতেই রক্ত এবং অশ্রু মিশে আছে। নন্দীগ্রামে বহু মানুষ মারা গেছে। আবার ভাষার জন্য প্রাণ হারিয়েছেন যাঁরা তাঁদের জন্যও সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বাইশে শ্রাবণ কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস সেখানেও কান্না। যেখানে অশ্রু সেখানেই কবি। তা সে বাইশে শ্রাবণ হোক বা একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা নন্দীগ্রামের জন্য পদযাত্রা। যেখানে অশ্রু সেখানেই আমি এবং আমার প্রতিবাদ। 

২০. তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে আপনার বার্তা-

উঃ- তরুণ প্রজন্ম খুব ভালো লিখছে, পরীক্ষা নিরীক্ষাও করছে। বেশ ভালো লাগছে। শুধু একটাই কথা বলব, খ্যাতির জন্য নয় বা কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, শুধুমাত্র ভালোবেসে লিখে যেতে হবে। ভালো লিখলে খ্যাতি এমনিই ধরা দেবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments