জ্বলদর্চি

সুতোয় বাঁধা পুতুল-৬(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/সুমন মল্লিক

সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক

পর্ব – ৬


অষ্টম অধ্যায়

২৩
ধাঁ চকচকে কনফারেন্স হল৷ প্রকাশক ভালোই আয়োজন করেছে৷ প্রকাশক বিহানেরই কলেজের বন্ধু জয়৷ মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসে আছে বিহান ও রূপাঞ্জনা৷ আজ এখানেই বিহানের নতুন কবিতার বই ‘ভ্রমের ভেতর ভালো আছি’ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পাবে৷ বিহান ও রূপাঞ্জনার পরিচিতরা তো ঢুকছেই৷ জয়ও ওর প্রকাশনার তরফ থেকে অনেককেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷ দেখতে দেখতেই হল প্রায় ভরে গেল৷ সঞ্চালিকা এবার একে একে মঞ্চে ডেকে নিচ্ছে অতিথিদের৷ সবশেষে বিহানেরও ডাক পড়লো৷ মঞ্চে গিয়ে বসলো বিহান৷ মঞ্চ থেকে ঘরে বসে থাকা প্রত্যেককে দেখা যাচ্ছে৷ এ কী তৃষা যে! বিহান চমকে উঠলো৷ জয়ই নিশ্চয় ডেকেছে৷ ঘরের ভেতর চোখ ঘোরাতে লাগলো বিহান৷ ওই তো রূপাঞ্জনা আর রূপক বসে আছে৷ এককোণায় সুকমলও বসে আছেন৷ মুখে হাসি৷ বিহানের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় হলো হাসিতেই৷ হঠাৎ দ্যাখে তৃষা উধাও৷ তবে কি দেখাটা ভ্রম ছিল? এই ভ্রমের ভেতরেই কি বিহান ভালো আছে?

     বইটির মোড়ক উন্মোচন হবার পর বিহান বই এবং তার ভেতরের কবিতাগুলি নিয়ে কিছু কথা বলে৷ ঘরের প্রত্যেকে মগ্ন হয়ে শোনে ওর কথা৷ এরপর সঞ্চালিকা বিহানকে কবিতাপাঠ করতে বলে বই থেকে৷ বিহান কবিতাপাঠ করে৷ জ্বলে ওঠে একের পর এক মোবাইলের আলো৷ কেউ ছবি তোলে, কেউ ভিডিও করে৷ তরুণদের মধ্যে বিহান খুবই জনপ্রিয় একজন কবি এই মুহূর্তে৷

     সবশেষে বইসই ও বই বিক্রি৷ এক নাগাড়ে সই করে চললো বিহান৷ কেউ কেউ আবদার করলো দু-এক লাইন কিছু লিখে দিতে৷ হাসিমুখে লিখে দিলো বিহান৷ অনেকে ছবিও তুলতে চইলো একসঙ্গে৷ সেই আবদারও মেটালো৷ এরপর কয়েকজন সংবাদিকের মুখোমুখি হয়ে রূপাঞ্জনার পাশে এসে বসলো বিহান৷ রূপাঞ্জনা, রূপক ও জয় সুকমলের সঙ্গে গল্প করছিল৷ রূপাঞ্জনা বললো, “মিটলো সব?”
     “হ্যাঁ৷ আপাতত৷” বিহানের মুখে প্রসন্নতার মৃদু হাসি৷ “সুকমলবাবু, আপনার সঙ্গে হওয়া অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়েও একটি কবিতা আছে বইতে৷”
     “তাই নাকি, দারুণ তো! আমি কিনেছি৷ বাড়ি গিয়ে রাতে পড়বো৷ একটা সই করে দিন৷” সুকমলের মুখে চওড়া হাসি৷
     “আর আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে?” সই করতে করতেই বললো বিহান৷
     “ইয়ার এনডিং৷ বোঝেনই তো৷ দম ফেলার সময় নেই৷ আজ রোববার হওয়ায় অুষ্ঠানে থাকতে পারলাম৷”
     “আপনি এসেছেন, ভীষণ খুশি হয়েছি৷”  
     “বিহান, চল দেখা যাক কত কপি উঠলো আজ৷ রূপাঞ্জনা, রূপক তোরাও আয়৷” জয় বলে বই সাজানো টেবিলের দিকে এগিয়ে চললো৷ পিছু নিলো রূপক৷ 
     “আচ্ছা বিহানবাবু, একমিনিট সময় নিচ্ছি, একটা কথা ছিল৷ আপনার মিসেসও আছেন৷” সুকমলের মুখে তখনও সেই চওড়া হাসি৷
     “আরে আপনি বলুন না৷ ওখানে একটু পরে গেলেও হবে৷ জয় আর রূপক তো গেল ওখানে৷”
     “পরশু আমার ম্যারেজ অ্যানিভারসারি৷ দশ বছর হল৷ আমি তো জানি না কিছুই৷ মা-ছেলে মিলে একটা পার্টির আয়োজন করেছে৷ একেবারেই ঘরোয়াভাবে৷ আমার তো বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই এখানে৷ অফিসের কয়েকজনকে বলেছি৷ আপনাদের দু’জনকে কিন্তু আসতেই হবে৷ সন্ধেবেলা৷ আমার মিসেস বিশেষ করে বলেছে৷ আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চায়৷” 
      “আপনি আমার ডাকে আজ এসেছেন৷ আমরাও আপনার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম৷ অবশ্যই যাবো আমরা৷ কি বলো রূপা?”
     “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো আমরা৷ সাতটার দিকে পৌঁছে যাবো৷” রূপাঞ্জনার চোখে উত্তেজনা৷ অনেকদিন হলো কোন নিমন্ত্রণ বাড়ি যায়নি৷
     “তাহলে আজ চলি৷ পরশু দেখা হচ্ছে৷” সুকমল উঠে পড়ে৷
     “একদম৷” বিহান ও রূপাঞ্জনা দরজার দিকে এগিয়ে চলে সুকমলের সঙ্গে৷


২৪
স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে বিহান৷ নতুন কবিতার বইয়ের জন্য স্কুলের বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে পেয়েছে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা৷ যারা গতকালের অনুষ্ঠানে যারা যেতে পারেনি তারা জেনে নিয়েছে কোথায় পাওয়া যাবে বইটা৷ দুপুরের দিকে ফোন আসে রূপাঞ্জনার৷ বিহান বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই শরীরটা সুবিধের বোধ হয়না৷ বিহান ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে বলে রূপাঞ্জনার নার্সিংহোমেই৷ 

     ডাক্তার ম্যাডাম রূপাঞ্জনাকে ভালো করেই চেনে৷ চেম্বারের ভেতর বসে আছে বিহান৷ পর্দার ওপারে রূপাঞ্জনাকে দেখছে ডাক্তার৷ কয়েক মিনিট পর দু’জনই হাসিমুখে বেরিয়ে এলো৷ চেয়ারে বসে ডাক্তার ম্যাডাম বিহানকে জানালো যে সে বাবা হতে চলেছে৷ বিহানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো৷ মুখে হাসি৷ আনন্দের এক অদ্ভুত স্রোত বয়ে যাচ্ছে মনে৷ রূপাঞ্জনার হাত চেপে ধরলো খুশিতে৷ ডাক্তার কিছু প্রয়োজনীয় টেস্ট আর ওষুধপত্র লিখে দিলো এবং রূপাঞ্জনার খেয়াল রাখতে বললো বিহানকে৷

২৫
সন্ধেবেলা রূপাঞ্জনার বাবা-মা আসে বিহানদের বাড়িতে৷ মিষ্টিমুখ হবার পর গল্পে মেতে ওঠে দু’জনের বাবা-মা৷ বিহান ও রূপাঞ্জনা তখন ওদের ঘরে বসে খুনসুটি করছে৷ বিহান বলছে মেয়ে হবে৷ রূপাঞ্জনা বলছে ছেলে হবে৷ দু’জনই নামও বলছে একের পর এক৷
     বসার ঘর থেকে ডাক এলো৷ রূপাঞ্জনাকে কিছুদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চায় ওর বাবা-মা৷ বিহান জানায়, কাল একটা নিমন্ত্রণ আছে৷ পরশু টেস্টগুলো করিয়ে ও-ই রূপাঞ্জনাকে নিয়ে যাবে৷ 


নবম অধ্যায়

২৬
কাঞ্জিভরম শাড়িতে অসাধারণ লাগছে রূপাঞ্জনাকে৷ আজ একটু সময় নিয়েই সেজেছে রূপাঞ্জনা৷ বিহান স্কুল থেকে টিফিনেই চলে এসেছে৷ ফেরার পথে গিফ্টও কিনে এনেছে৷ সন্ধ্যায় যাবার পথে শুধু ফুলের বুকেটা কিনে নেবে৷ রূপাঞ্জনার থেকে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না বিহান৷ আলমারি থেকে শেরওয়ানি বের করে বিহানকে তৈরি হয়ে নিতে বললো রূপাঞ্জনা৷
     ঠিক সাতটার দিকেই সুকমলের বাড়িতে পৌঁছে গেল ওরা৷ রাস্তা চিনতে খুবেকটা এসুবিধে হয়নি৷ সুকমল বাইরেই দাঁড়িয়েছিল৷ বিহানকে সস্ত্রীক আসতে দেখেই এগিয়ে আসতে আসতে বললো, “আসুন আসুন৷ কী যে ভালো লাগছে আপনাদের দেখে৷ আপনারা এলেন, ভীষণ খুশি হয়েছি৷”
     “আপনার নিমন্ত্রণ পেয়ে আমাদেরও ভীষণ ভালো লেগেছিল সুকমলবাবু৷ আর আজ আসতে পেরে আরও ভালো লাগছে৷ এই সুযোগে বৌদির সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যাবে৷” সুকমলের হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে বিহান৷
     “হ্যাঁ, আর আপনার ছেলের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে৷” রূপাঞ্জনা মুখে হাসি রেখে বলে৷
     “নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই৷ চলুন, ভেতরে চলুন৷” বিহান ও রূপাঞ্জনাকে ভেতরে নিয়ে যায় সুকমল৷ 

ছাদের ওপরই পার্টির আয়োজন হয়েছে৷ বাড়িওয়ালা ভালো মনের মানুষ নিশ্চয়ই৷ ছাদটা বেশ বড়সড়৷ লোকজন খুব বেশি হলে চল্লিশজন মতো হবে৷ ক্যাটারার রয়েছে৷ বুফে সিস্টেমে খাওয়া দাওয়া৷ এক কোণে ড্রিংসের ব্যবস্থা৷ সুকমল এবং তার স্ত্রী যে বেশ রঙিন মেজাজের মানুষ তা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে৷ সুকমল ছেলের সঙ্গে বিহানদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে মাকে ডেকে আনতে বললো৷ 
     টেবিলে বসেছে রূপাঞ্জনা৷ বিহান প্লেটে ফিশ ফিঙ্গার নিয়ে এসে পাশে বসলো৷ কথা বলার লোক নেই৷ সবাই এখানে অপরিচিত৷ একটু অদ্ভুতই লাগছিলো৷ ওরা ঠিক করলো খুব বেশি দেরি করবে না৷ খাওয়া-দাওয়া হলেই বেরিয়ে পড়বে৷ 

     “এই যে আমার স্ত্রী, প্রিয়া৷” স্ত্রীকে নিয়ে হাজির সুকমল৷
     “আরে আপনি!” একসঙ্গে বলে ওঠে বিহান ও রূপাঞ্জনা৷ দু’জনের মুখেই বিস্ময় মেশানো হাসি৷ 
     “আপনাদের আগে থেকেই পরিচয় আছে?” সুকমল একবার বিহানদের দিকে, একবার স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছে৷
     “উনি আমাদের তৃষার কলেজ ফ্রেন্ড৷ আমাদের দেখা হয়েছিল একবার ট্রেনে৷ আমার সঙ্গে তৃষা ছিল৷ সেখানেই পরিচয়৷” প্রিয়া হাসি-হাসি মুখে জবাব দেয়৷
     “তৃষা আসেনি? আপনার দেওর?” প্রিয়ার হাতে গিফ্ট আর ফুলের বুকে তুলে দিয়ে প্রশ্ন করে রূপাঞ্জনা৷
     “না৷ দেওর ছুটি পায়নি৷ ও থাকলে পার্টি পুরো জমিয়ে দিতো৷ ভীষণ মস্তি করতে পছন্দ করে৷” প্রিয়া রূপাঞ্জনাকে ঘরে নিয়ে যায় রুমগুলি দেখাতে৷ 
     “চলুন আমরা ওদিকে গিয়ে বসি৷ আমার ব্যাংকের কয়েকজন এসেছে৷ আসুন পরিচয় করিয়ে দিই৷” বিহানকে নিয়ে সুকমল এগিয়ে যায় ড্রিংসের টেবিলের দিকে৷

২৭
পরদিন সকাল সকাল রূপাঞ্জনাকে টেস্টগুলি করাতে নিয়ে যায় বিহান৷ ফিরে এসে আবার বেরিয়ে পড়ে স্কুলের জন্য৷ স্কুলের সবাই ভীষণ খুশি৷ খাওয়া-দাওয়া নিয়ে নানান কথা চলে৷ দুপুরের দিকে ফোন আসে সুকমলের৷ “কাল তো ঠিকমতো কথা হলো না বিহানবাবু৷ আরেকদিন সময় করে আসুন ওয়াইফকে নিয়ে৷ জমিয়ে আড্ডা হবে৷ তৃষা আসছে আগামী সপ্তাহে৷ ওর মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না৷ তখনই না হয় আসুন৷”
     “তৃষা কি একাই আসছে? না, আসলে ওর হাসবেন্ট, মানে আপনার ভাই তো ভীষণ ব্যস্ত মানুষ৷ ছুটিটুটি খুবেকটা পাননা শুনেছি৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম৷”
     “আপনি ঠিকই শুনেছেন৷ ও একদমই ছুটি পায়না৷ তৃষা একাই আসছে ছেলেকে নিয়ে৷”
     “আচ্ছা৷ আমি আসবো তাহলে একদিন৷ ফোন করে নেবো আপনাকে৷ মিসেস আসতে পারবে না হয়তো৷ ও প্রেগনেন্ট৷ পরশুই ডাক্তার কনফার্ম করেছে৷ তাও বলে দেখবো একবার৷”
     “ও তাই নাকি! এ তো দারুণ খবর! কংগ্র্যাচুলেশন৷ মিসেসকে আমার আর প্রিয়ার তরফ থেকে শুভেচ্ছা জানাবেন৷ মিসেসকে বলে দেখুন, যদি আসতে পারে৷ জোর করার দরকার নেই৷ এই সময় শরীর তো ভালো থাকে না৷”
     “অনেক ধন্যবাদ৷ বলে দেখবো ওকে৷ আর আপনাদের শুভেচ্ছাও পৌঁছে দেবো৷ তৃষা আসুক৷ একদিন দেখা হচ্ছে তাহলে আপনার ওখানে৷”
     “একদম৷ ঠিক আছে তাহলে৷ ভালো থাকুন৷”
     “আপনিও ভালো থাকবেন৷ বাই৷”
     “বাই৷”

তৃষা আসছে৷ অদ্ভুত একটা খুশির রেণু ছড়িয়ে পড়ে বিহানের মনে৷ বিহান বুঝতে পারে৷ কিন্তু সেটা কি উচিৎ? এখন? এতো বছর পর? যেখানে জীবনের সবটা জুড়ে এখন শুধু রূপাঞ্জনা? নিজেকেই প্রশ্ন করে বিহান৷ উত্তর আসে – না৷ বিহান ঠিক করে, এবার তৃষার সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে৷ রূপাঞ্জনা থাকবে না৷ এটাই সুযোগ৷ বিহান আর তৃষার অতীতটা রূপাঞ্জনার জানা ঠিক হবে না৷ 

২৮
ব্যাগ গুছোচ্ছে রূপাঞ্জনা৷ বিহান খেয়েদেয়ে ঘরে ঢুকলো৷ বিহানের মনটা একটু খারাপ৷ রূপাঞ্জনা চলে যাচ্ছে আজ বাবার বাড়ি৷ না জানি কতদিনের জন্য৷ বাড়ি ফিরে রূপাঞ্জনার দেখা না পেলে বিহানের তো ভালো লাগবে না৷ রূপাঞ্জনা মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তো ঘুম আসবে না বিহানের৷ তবে এসব ভাবলে চলবে না৷ রূপাঞ্জনা এখন গর্ভবতী৷ তাছাড়া অনেকদিন হলো বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকেনি কিছুদিন৷ নিজেকে সামলে নিলো বিহান৷ আগামী কিছুদিন তবে কবিতার সঙ্গেই কাটুক, নিজের সঙ্গে নিজের কথা হোক একান্তে৷

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments