জ্বলদর্চি

এই আমি আর পুজো/(উৎসব ১৪২৮)/কাবেরী বোস

এই আমি আর পুজো
কাবেরী বোস

আমার জীবনে দুর্গা পুজো এসেছে নানা রূপে, নানাভাবে। কেননা প্রতিক্ষেত্রে দেখার চোখ বদলেছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের সঙ্গে । আর অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গি বদলের জন্য বদলেছে জীবনের ধারণা । ছোটবেলায় যখন নতুন জামা পরে বাবার হাত ধরে প্রতিবছর হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতে যেতাম, তখন এক অন্য অনুভূতি ---ক'টা ঠাকুর দেখলাম তা গোণা, আর ফেরার সময় অতি অবশ্যই পায়ে ফোসকা --- যার জেরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা । সেই বয়সে অন্য এক কৌতুহল ! তাই ঠাকুর দেখার সাথে সাথে রাস্তায় চলমান অসংখ্য মানুষজনকে পর্যবেক্ষণ করা --- কারণ তখন তো উপলক্ষ ছাড়া আজকের মত এত বেরোনো যেত না। তখন যে খুব বেশি জামাকাপড় হত, তা কিন্তু নয় । ষষ্ঠীর দিন একটা নতুন জামা আর অষ্টমীর অঞ্জলি দেবার জন্য একটা দামী ভালো জামা --- এ যেন তখন বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়তো । দুটোর বেশি জামা হলে তা পরা হত নবমীর দিন । 

নবমীর দিন বলতে মনে পড়ল সে যেন এক অন্য আয়োজন ! নবমীর সকাল থেকেই নারকেল ছাড়াতে আরম্ভ করতেন বাবা --- কেননা নারকেল ছাড়িয়ে, শিলে বেটৈ, কড়াইতে পাক করে মা নানারকম মিষ্টি-ছাপা আর নাড়ু তৈরি করতেন । এছাড়াও ময়দা দিয়ে তৈরি হতো কুচো নিমকি । আর তার সাথে নবমীর রাতে বড় গামলায় ভেজানো হত ঘুগনির ছোলা । পরদিন সকালে তাই দিয়েই মা তৈরি করতেন তার হাতের বিখ্যাত ঘুগনি। মায়ের হাতের ঘুগনি খেতে অনেকেই আসতেন দশমীর দিন । কত মানুষ যে আমাদের বাড়ি আসতেন, তা গুনে শেষ করা যাবেনা ।

আজ এই বয়সে এসে যখন সেই সময়ের কথা ভাবি, তখন উপলব্ধি করি মার সেই ব্যস্ততা --- সেই উনোনের আঁচে ঘুগনি রান্না ---  ওহ ! কি সেসব সোনার দিন ! তখন তো আর প্রেসার কুকার ছিল না ! তাই কড়াইতেই সিদ্ধ হত, আর তাতেই রান্না ।

এরপর এলো কিশোর বয়সের পদচারণা । কিছু রহস্যময়তা, কিছু কৌতুহল আর কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গির বদল --- সবই কিন্তু পূজাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। পুজোর উন্মাদনা, শিশু বয়সের আনন্দের চেয়ে একটু যেন আলাদা হল --- চারপাশের মানুষজনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গির যেমন পরিবর্তন হলো, তেমনই মনে হয় তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা রদবদল হয়েছিল ।

তারুণ্যের উন্মাদনা আর তারুণ্যের ভাবনায়, লাবণ্যের দেখার চোখ --- সবই বোধহয় আলাদা । এইসময় জগতটা অনেক বড় হল --- আমিও সময়ের জোয়ারে গা ভাসালাম । কিন্তু খুবই সাময়িক তা । আমরা রক্ষণশীল, যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার ফলে অনেক আকাঙ্ক্ষা, অনেক ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে হয়েছিল । কিন্তু পুজো, পুজোই হয় । তাই তার পদধ্বনি সেই বয়সে অন্তরে গ্রথিত হয়ে গিয়েছিল । অনেক সাময়িক কল্পনা, যার ওপর ভর করে আমার মন ছুটে যেত এক অদ্ভুত সুন্দর অজানা জগতে --- শুধুই অনাবিল আনন্দ, হাসি আর গান । সেই সময় মা দুর্গাকে দেখার চোখও বদলে গিয়েছিল । সাজগোজের দিকে একটু বেশি নজর ! পোশাকের একটু সামান্য হলেও পরিবর্তন এবং সর্বোপরি, একেবারে চোখের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন --- যা বোধহয় সবার জীবনে সহজাত ।

এইভাবে স্তরে স্তরে জীবনের উত্তরণে, জীবন পৌঁছে গেছে অভিজ্ঞতার দ্বারপ্রান্তে । যেখানে শৈশবের অপার বিস্ময় নয়, কৈশোরের রহস্যময়তা নয়, যৌবনের তারুণ্যে উদ্ভাসিত আলোকোজ্জ্বল উল্লাস নয় --- এবার শুধু অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ পুজো ! এই পূজো নিয়মের পুজো । অষ্টমীর দিন অঞ্জলী দেওয়া, তিনশ বছরের অতি প্রাচীন এক পূজামণ্ডপে ---

অভিজ্ঞতায় পূর্ণ জীবনে স্মৃতির ঝুলি নিয়ে এখন শুধুই স্মৃতিচারণা --- আমাদের সময় এই হতো, ওই হত ! কিন্তু বিষয়টা সত্যিই তো তাই ! আগে পুজোয় বাড়িতে কত আয়োজন, কত পরিশ্রম ! এখন জীবন অন্যরকম । কারণ এখন সবই কিনতে পাওয়া যায় । আর আমরা তো নিজেরাই আর পারিনা বলে দায় এড়াই । কিন্তু গ্রামের যেসব মহিলারা এসব তৈরি করেন, তারা তো ঠিকই বানাচ্ছেন ।আমাদের মতন এড়িয়ে যাচ্ছেন না । আগে আসলে এত টাকার দরকার ছিল না । কেননা তখন চাহিদা কম ছিল অনেক, ফলে অল্প টাকায় সুষ্ঠুভাবে আনন্দের সঙ্গে জীবন চলে যেত । কিন্তু এখন আর জীবন সেভাবে যায় না । এখন পুজো আসার আগে সবার আগে ডাক্তারের কাছে শরীর চেকআপ করতে যেতে হয় সব ! ঠিকঠাক আছে তো সব ? পুজোটা শান্তিতে কাটবে তো? এই ভাবনাগুলো তো মনের মধ্যে কাজ করে !

তবু আকাশে সাদা মেঘ দেখলে মন চঞ্চল হয় বৈকি ! বিনা মেঘে বজ্রপাত তো শরৎ আকাশেই হয় ! শরতের আকাশে যেন পরতে পরতে কৌতুহল, রহস্যময়তা, উন্মাদনা, উচ্ছাস --- তাই সর্বদাই কি হয়, কি হয় ভাব !
ফলে, সব মিলিয়ে পুজো আর আমি বুঝি একাকার হয়ে যাই । মায়ের মৃন্ময়ী রূপ এখনো আমাকে পাগল করে । ওই মুখের দিকে তাকিয়ে কত আশা, কত প্রার্থনা, কত না-বলা কথা বলেছি ! তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই । তাই তিনি আছেন আমার জীবনের সর্বাঙ্গীন, অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে । যতই দিন যাক, মায়ের পদধ্বনি মনকে আনন্দে নাড়া দেয় । ভবিষ্যতের ভাবনায় বিভোর করে । ভালোবাসার হোমানলে দগ্ধ করে । আর চারিপাশ এক অপরূপ স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে । 
তাই, জয় মা ! তোমারই জয় হোক ! জয় হোক ! জয় হোক !

      "পুজো - পুজো"

বাদল শেষে শরৎ মেঘের, আকাশে আনাগোনা ---
আসছে পুজো দুগ্গামা-এর পদধ্বনি যায় শোনা ।
কাশফুলের সাদা চাদর উড়ছে দিগন্ত জুড়ে ---
বাতাসে বাতাসে ঘোর লেগেছে, বসুধানন্দপুরে ।
কাশফুল আর দুর্গাপূজা মিলেমিশে একাকার ---
সত্যজিতের অপু-দুর্গার নস্টালজিয়া সবাকার ।
মা আসেন চড়ে নৌকা, গজ, দোলা বা ঘোড়া---
লক্ষ প্রাণের দোলা লাগিয়ে, মিলন সুরে জোড়া ;
চারটিদিনের পুজো উৎসবে, চলো সবাই সামিল হই ---
বিশ্ব মাতার যাওয়া-আসার, সাক্ষী হয়ে রই ।
 হোল ফ্যামিলী,মা এভাবেই এসো প্রতিবার সবাই
আমরা তোমার প্রতিক্ষাতেই, বাকি দিন আনন্দে কাটাই
জীবনযুদ্ধের টানাপোড়েনে ক্লান্ত আমার এ মন ---
পুজো মানেই আনন্দ আর হৃদয় উন্মন ।
সবাই আমরা ভালো থাকি যেন পুজোর দিনে,
এই কামনা করে আমি, ইতি দিলাম টেনে ।।

কাবেরী বোস। 
প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা
হরিনাভি এ. এস. স্কুল 
হরিনাভি / সোনারপুর / কল-১৪৮


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments