জ্বলদর্চি

সুতোয় বাঁধা পুতুল-৭(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/সুমন মল্লিক

সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক

পর্ব – ৭


দশম অধ্যায়

২৯
দুপুরে সুকমলের ফোন এসেছিল৷ তৃষা এসেছে৷ সন্ধ্যায় আড্ডা হবে৷ সঙ্গে রাতের খাবার৷ বিহান স্কুল থেকে ফিরে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে৷ সন্ধেবেলা মাকে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বলে বেরিয়ে পড়লো৷ রূপাঞ্জনাকে আগেই বলে রেখেছে সব৷ তৃষা এসেছে কিনা জানতে চেয়েছিল রূপাঞ্জনা৷ বিহান সত্যি কথাই বলেছে৷ কিন্তু রূপাঞ্জনা কি কিছু আন্দাজ করেছে? মেয়েদের সিক্সথ সেন্স একটু বেশিই জোড়ালো হয়৷ এইসব ভাবতে ভাবতেই বিহানের বাইক এগিয়ে চললো সুকমলের বাড়ির দিকে৷ তৃষাকে দেখার জন্য কেন মনটা এতো আনচান করছে? ঠিক নয়, ঠিক নয় বিহান৷ নিজেকে সামলাও৷ মনে মনে নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকে বিহান৷
     সুকমলের সঙ্গে ঘরে ঢুকতেই বিহান দেখলো তৃষা এবং সুকমলের স্ত্রী বসে আছে বিছানায়৷ বিহানকে দেখেই একগাল হাসি নিয়ে তৃষা বললো, “কেমন আছিস বিহান? মিসেস কোথায়? বোস বোস৷”
     “আছি ভালোই৷ ওর শরীরটা ভালো না, তাই...”
     “উনি বাবা হতে চলেছেন৷ আপনি সোফায় আরাম করে বসুন বিহানবাবু৷” বিহানকে থামিয়ে দিয়ে বলে সুকমল৷
     “আরে দারুণ খবর তো! ক’মাস চলছে?” তৃষা জানতে চায়৷
     “এই কয়েকদিন আগেই ডাক্তার কনফার্ম করেছে৷ ও বাবার বাড়ি আছে এখন৷ আমি বলেছিলাম আসার কথা৷ বুঝিসই তো এই সময়...”
     “না না ঠিক আছে৷ বিশ্রামে থাকুক এখন৷ বাবার বাড়ি গিয়ে ভালোই করেছে৷ এরকম সময় আমার যা অবস্থা হয়েছিল! ভাগ্যিস মা ছিল, না হলে যে কী হতো! আমরা তখন দিল্লীতে৷ মা খবর পেয়েই চলে গিয়েছিল৷ টানা ছিল আমাদের সঙ্গেই৷” 
     “আমি চা করে আনছি৷ তোমরা বসে গল্প করো৷ এই, তুমি না দোকানে যাবে বলেছিলে...” প্রিয়া বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়৷
     “তোমরা বসে গল্প করো৷ আমি একটু আসছি৷” সুকমল বেরিয়ে যায়৷ 

বিহান ও তৃষা এভাবে একা ঘরে শেষ কবে সময় কাটিয়েছে মনে নেই ওদের৷ আগের সেই সময় হলে এতক্ষণে উন্মাদের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরতো৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা৷ পাথরের মতো বসে আছে দু’জন৷ নীরবতা ভাঙলো বিহান, “তৃষা, আমার কিছু কথা বলার আছে তোকে৷”
     “হ্যাঁ বল না৷ শুনছি৷”
     “তৃষা, আমি চাই না আমাদের অতীতটা আর কেউ জানুক৷ আশা করি তুইও এটাই চাস৷”
     “খুব ভালোবাসিস বৌকে, তাই না?”
     “সংসারে অশান্তি বয়ে আনাটা ঠিক হবে না আমাদের৷”
     “কতটা ভালোবাসিস বৌকে?” বিহানের পাশে এসে বসে তৃষা৷
     “আমাদের অতীতটা আমাদের মধ্যেই থাকুক৷” 
     “আমাকে যতটা ভালোবাসতিস তার থেকেও বেশি?” তৃষা চোখের বৃষ্টি ও আগুন৷
     “এটা কী ধরণের...” 
বিহানের ঠোঁটকে নিজের ঠোঁটে বন্দি করে ফেললো তৃষা৷ বিহান কিছুক্ষণ পাথর হয়ে থাকার পর বুকে চেপে ধরলো তৃষাকে৷ ঠিক আগের মতোই৷ 
     নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলো তৃষা৷ চোখে অপরাধবোধ ও অস্বস্তি স্পষ্ট৷ বিহানের দিকে তাকাতে পারছে না৷ এবারও নীরবতা ভাঙলো বিহানই, “তৃষা, আমি কাকে কতটা ভালোবাসি, এই প্রশ্ন এখন অর্থহীন৷ তুই আমার অতীত৷ রূপা আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ৷ তুইও এখন অন্য একজনের স্ত্রী৷ একটি সন্তানের মা৷ জানি, আমরা অতীতটা ভুলতে পারবো না কখনও৷ কিন্তু নিজের মধ্যে লুকিয়ে তো রাখতে পারি৷ তাই নয় কি?”
     “আই অ্যাম সরি বিহান৷ ছিঃ ছিঃ, এ কী করলাম আমি!”
     “ঠিক আছে৷ কোন ব্যাপার না৷ কিন্তু এরকম আর হবে না৷ ঠিক আছে?”
     “ছিঃ, তুই কী ভাবলি আমাকে! আমি...”
     “বললাম তো, ইটস ওকে৷ কিন্তু আজ আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমরা এখন থেকে ভালো বন্ধু হিসেবেই থাকবো৷”
     “বিহান, তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না – আমি তোকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম৷ কিন্তু বাবা-মা...”
     “ওসব কথা এখন থাক তৃষা৷ আমরা বরং সামনের দিকে তাকাই৷ ভালো থাকার চেষ্টা করি৷”
     “কিন্তু আমি তো ভালো নেই৷ বহু বছর থেকেই ভালো নেই৷”
     “কেন, হাসবেন্ট ভালোবাসে না তোকে? ছেলেও তো রয়েছে৷”
     “রাতুলই তো আমার জীবন৷”
     “হাসবেন্ট?”
     “সে আমাকে শুধু বিছানায় ভালোবাসে৷ অবশ্য সেটা ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু কে জানে৷” চোখ মোছে তৃষা৷

প্রিয়া চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকে৷ বিহান ও তৃষা একটা অদৃশ্য পর্দা টেনে নেয় নিজেদের মধ্যে৷ এই পর্দা বন্ধুত্বের৷ এই পর্দা ভালো থাকার, ভালো রাখার৷ বন্ধু হয়ে, বন্ধুর জন্য৷


৩০
অনেকক্ষণ টেবিলে কলম হাতে বসে থাকলো বিহান৷ মাথায় তখনও তৃষার কথাগুলোই ঘুরছে৷ তার মানে বিহান ভুল ভাবতো৷ তৃষা ওকে ভুলে যায়নি৷ শুধু ভোলার ভান করে গেছে৷ বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বিহান৷ সিগারেট ধরায়৷ আকাশে দারুণ মেঘ করেছে৷ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু পর পর৷ বিদ্যুৎ তো বিহানের মনেও চমকে চলেছে৷ হঠাৎ একটি লাইন ঠিক বিদ্যুতের মতোই আছড়ে পড়ে বিহানের চোখের সামনে৷ দ্রুত টেবিলে এসে বসে বিহান৷ লিখে ফেলে – তুমিও হয়েছিলে আমারই মতো একা৷



একাদশ অধ্যায়

৩১
ভেঙে গেলেও ভেঙে যায় না তো সব
স্মৃতি থেকে যায়, স্মৃতি করে কলরব

বিহানের নতুন কবিতার বইয়ে উৎসর্গের পাতার দু’টি লাইন৷ গত মাসেই প্রকাশিত হয়েছে৷ সুকমলের বাড়িতে সেদিনের আড্ডার পর আর দেখা হয়নি বিহান ও তৃষার৷ ফোনে কথা হয়েছে বার তিনেক৷ 
     সুকমলের টেবিলেই বিহানের নতুন বইটা দেখলো তৃষা৷ নাম ‘আলেয়া’৷ উৎসর্গের পাতায় চোখ আটকে গেল৷ সত্যিই তো, ভেঙে গেলেও সব তো ভেঙে যায় না৷ বিহানের মনেও কি তাহলে অতীত ঝড় তোলে? ঘুমের ভেতর এসে জড়িয়ে ধরে এখনও সেইসব সোনালি স্বপ্ন? নিজেকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলে তৃষা৷ কোন উত্তর পায় না৷ এই বইটির ভেতর কি কোন উত্তর রাখা আছে? সুকমলকে বলে বইটা কিছুদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে আসে তৃষা৷    
     রাতে খাবার পর মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে ঘরে চলে আসে তৃষা৷ বইটা লুকিয়ে রেখেছে ঘরে৷ ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে বইটা বের করে বসে৷ মনে যে প্রশ্ন উথালপাথাল করে চলেছে তার কোন উত্তর হয়তো রাখা আছে এই বইতেই৷ পাতা ওল্টায় তৃষা৷ 

ভোরবেলা আলো এসে বলে
          ভালো আছে তোমার পিপাসা৷

নেই, কিছুই নেই আর বাকি

সময়ের ফাঁকে ফাঁকে তবু কেন 
          ঝড় তোলে ভুল ভালোবাসা?

আঙুল কেঁপে ওঠে তৃষার৷ চোখের পাতা কেঁপে ওঠে৷ পাতা ওল্টায়৷  

এখন আর কাঁদে না কেউ 
জমানো কথার মাঝে বসে৷

কথাও কথা খোঁজে – 
তারপর একদিন কথাগুলি 
পুড়ে ছাই হয়
       একটি অগ্নিমানসে৷

ভেতরে ঝড় ওঠে তৃষার৷ যে প্রশ্ন মনে উথালপাথাল করছিলো, তার উত্তর আরও উথালপাথাল করে দিচ্ছিল সব৷ আর তার মাঝেই একের পর এক কবিতা পড়ে চলেছে তৃষা৷

যে আগুন নিভে গিয়েছিল একদিন
সে আগুন আবার বুকের মাঝে জ্বলে৷
আমি মূর্তির মতো শুধু দেখি
আর অশ্রু লুকোই হৃদয়ের অতলে৷

চোখ থেকে অশান্ত অশ্রুধারা নেমে আসে তৃষার৷ বুকে আগুন জ্বলে ওঠে৷ তাহলে বিহানের মনেও এখনও ঝড় তোলে স্মৃতি! বিহান এখনও তৃষার কথা ভাবে! নাহলে কীভাবে সম্ভব এরকম সব লইন লেখা! কবিতায় কবিতায় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় তৃষা৷ কিন্তু সেই উত্তরের ভেতর জন্ম নেয় নতুন প্রশ্ন৷

৩২
     “কেমন আছিস?” ঘুম থেকে উঠেই বিহান কে ফোন করে তৃষা৷ 
     “ভালো আছি৷ তুই?”
     “আছি রে, চলছে৷ রূপাঞ্জনা কেমন আছে?”
     “আছে ঠিকঠাক৷ আর তো বেশি দেরি নেই৷”
     “আচ্ছা, শোন না, তোর নতুন বইটা...”
     “তৃষা, পরে কথা বলি? স্কুলে যাবো৷ রেডি হতে হবে৷”
     “ওহ্ বুঝেছি৷ সরি সরি৷ আমি তাহলে পরে ফোন করছি৷ রাখি৷”
     “ওকে৷ বাই৷”

৩৩
    “হ্যালো৷ কোথায় আছিস এখন?” তৃষা ফোন করে বিহানকে৷
     “স্কুলে আছি৷” 
     “ক্লাস নেই তো?”
     “না৷ এখন টিফিন চলছে৷ বল৷”
     “তোর নতুন বইটা দাদার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি৷ পড়া হয়ে গেছে পুরোটা৷”
     “হুম৷ কেমন লাগলো?”
     “তুই কি এখনও আমাকে ভালোবাসিস বিহান?”
     “হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
     “তোর প্রতিটি কবিতার মধ্যে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছি৷ অশান্ত, অপার এক ভালোবাসা৷”
     “সেই ভালোবাসা আমি বহুদিন আগে কবর দিয়েছি নিজের ভেতরেই৷ ওটাকে খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করিস না কখনও৷ প্লিজ৷ আমিও করিনা৷”
     “তাহলে কবিতাগুলো?”
     “ওগুলো কবরের ওপরেই জন্ম নেওয়া একেকটি ফুল৷”
     “বেশ৷ আমি আর কোন প্রশ্ন করবো না তোকে৷”
     “আমাদের অনুভূতিগুলো আমাদের ভেতরেই কবর দিয়ে রাখতে হবে তৃষা৷ এটাই আমাদের ভবিতব্য৷”
     “বেশ তবে তাই হোক৷”
     “চল আমরা ভালো বন্ধু হয়ে থাকি আজীবন৷”
     “ঠিক আছে৷ ভালো থাকিস৷”
     “তুইও ভালো থাকিস৷ কথা হবে৷ বাই৷”

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments