জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-৫/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি :: ৫
----------------------------------------
তপেস তাঁতিয়া একজন সফল মানুষ

তপেস তাঁতিয়া একজন সফল মানুষ। অন্তত তার পরিচিতেরা সেরকমই বলে। পূর্বপুরুষের অগাধ সম্পত্তি, ভারতের বিভিন্ন শহরে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট। দেশি, বিদেশি সব মিলে সতেরােটা গাড়ির মালিক। অবিশ্বাস্য ব্যাংক ব্যালেন্স। নিজে তার পেশায় প্রতিষ্ঠিত সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। অথচ এই সেদিন পঞ্চাশ বছর পার করে হঠাৎ তাঁর মনে হতে শুরু করল জীবনে কিছুই করতে পারেননি তিনি। অনেক বেশি উপভােগ্য রােমঞ্চকর হতে পারত সবকিছু। কিন্তু অপদার্থতার বােঝা বয়ে, একেঘেয়ে রসকষহীন জীবনকে সঙ্গী করে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁকে। একথা তার ঘনিষ্ঠমহলের কয়েক জনকে তিনি বলেছেন এখনো পর্যন্ত। তাদের সকলের প্রতিক্রিয়াই মােটামুটি একই রকম। কেউ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছে । কেউ চোখ কপালে তুলেছে । কেউ আড়ালে বলেছে, তপেসটার মাথা একদম গেছে । তাঁর এখনই মানসিক রােগের ডাক্তার দেখানাে দরকার।

এদেরই মধ্যে তপেসের ঘনিষ্ঠতম হল দীননাথ সরেন। ছােটবেলা থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব। এক স্কুলে পড়াশােনা তারপর দুজন দু দিকে। দীননাথ টলিউডে সিনেমার ডায়ালগ লেখক আর তপেসের কথা তাে আগেই বলেছি। এমনিতে স্বভাব চুপচাপ তপেস নিজের কথা বলতে বিশেষ পছন্দ করেন না । কিন্তু দীননাথের কাছে তিনি কিছু লুকোন না।  এখনো পর্যন্ত তাঁর যে জীবনবৃত্তান্ত শােনা গেছে দীননাথের কাছ থেকে তা হলো এ রকম, তপেসের সঙ্গে দীননাথের আলাপ সেই ছয় বছর বয়স থেকে। তখনকার দিনে আজকের মতাে তিন বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করার রীতি রেওয়াজ ছিল না। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তত দুশ্চিন্তাও ছিল না বাবা, মায়েদের। বাচ্চারা ইঁদুর দৌড়ে শামিল না হয়ে, নিয়মের খাঁচায় বন্দি না হয়ে, ছোটবেলা কাটাত ছোটবেলার মতাে।
এখনকার অভিভাবকদের মতাে ছিল না তখনকার অভিভাবকেরা। তাঁদের কখনো মনে হতো না যে বাচ্চারা বাড়ি থাকা মানেই জ্বালাতন। বিশ্বায়নের যুগ সেটা ছিল না। ফলে উদার হাওয়া, অনুদার প্রতিযােগিতা, কিছু করার বাসনা, কিছু হওয়ার স্বপ্ন, এসব নিয়ে পরােয়া করারই চল ছিল না সে যুগে। খেয়ে, ঘুমিয়ে, চাকরি ব্যবসা করে সময় কাটত অভিভাবকদের । তারপর বড়রা বুড়াে হতো । বাচ্চারা বড় হতো।   এভাবে জীবনচক্রের সমাপ্তি হতো। এখন দিনকাল  পাল্টেছে। মানুষ বেশি বয়সে বাবা মা হয়। চল্লিশের পর জীবন শুরু হয়। আনন্দও বাড়ে, হার্টের ব্যামাে, ডায়াবেটিসও বাড়ে।

সে যুগে এবং সে বয়সেও তপেস ছিলেন অসাধারণ শান্ত, স্রোতের বিপরীতে চলা একজন ছােট মানুষ। শিশু সুলভ হই-হট্টগােল, দুষ্টুমি, হঠকারিতা এসব তাঁর ভালাে লাগত না। বাবা সরকারি কন্ট্রাক্টর। অসম্ভব সুনাম আর কাজের চাপ। মা সে যুগে এক স্থানীয় হাইস্কুলে জীবন বিজ্ঞানের টিচার। ছাত্রছাত্রী নিয়ে জীবন কাটে। নিশ্ছিদ্র নিরুপদ্রব সংসার জীবন তাঁদের। দুজনেই খুব ঘরমুখাে। দিনের কাজ শেষ করে সন্ধে সাতটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার ডিসিপ্লিন তাঁরা ভীষণভাবে মেনটেন করতেন। যে সব মানুষদের কাছে বাড়িই সব, প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব গৌণ সে সব মানুষদের অন্যরকম একটা সমস্যা হয়। কারণে অকারণে তাঁরা মানুষের ক্রোধ ও ঈর্ষার কারণ হন। কিন্তু এই পরিবারের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল এই যে তাঁরা ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে ।  এবং তা ছিল তাঁদের পরােপকারিতা ও অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতার কারণে।  কিছু মানুষ আছে, যাদের ভীষণ রকম বারফট্টাই। মুখে জগৎ মেরে দেওয়া, হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা অ্যাটিচুড। নিজের ঢাক বাজাতে বাজাতে কখন যে তা ফেটে চৌচির হয়ে যায় তা খেয়ালই করে না তারা, বাজাতেই থাকে ক্রমাগত। এদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে।
অন্য একদল মানুষ শুরু করে নিঃশব্দে, চুপিসারে। তারপর ধীরে ধীরে নিজগুণে মানুষের মনে তাদের জায়গা পাকা করে নেয়। সে জায়গায় থেকে তাদের আর সরানাে যায় না। তপেসের বাবা মা ছিলেন সে ধরনের মানুষ। এরকম পরিবার থেকে উঠে আসা তপেস যে স্রোতের বিপরীতে হাঁটবেন এ আর বিচিত্র কী ? শান্ত স্বভাবের কারণে বন্ধু-বান্ধবও বিশেষ একটা ছিল না তাঁর। তা নিয়ে অবশ্য ভ্রুক্ষেপও ছিল না কোনােরকম।  একাকিত্ব বােধ ছিলই না তাঁর মধ্যে। পরিবার, পরিবেশ, গাছপালা, পড়াশােনা ইত্যাদি নিয়ে বেশ নিটোল জীবন কাটাতেন তিনি।

এ কারণে অবশ্য অন্য স্বাভাবিক আচরণের বাচ্চাদের টার্গেটও হতে হতো তাঁকে। তার অন্তর্মুখিতাকে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করে সে সব বাচ্চারা তাঁকে নানারকম ভাবে অপদস্থ করত। গবেট, পাগল, মেনিমুখো ইত্যাদি বিভিন্ন বিশেষণে তাঁর পরিচয় দিয়ে প্রভূত আনন্দ পেত তারা।
মাথা ভালাে ছিল তপেসের। শান্ত স্বভাবের কারণে মনযােগও ছিল অবিশ্বাস্য রকম বেশি। পড়াশােনায় বসতেন যখন, কানের কাছে কাঁসর ঘন্টা বাজালেও তখন শুনতে পেতেন না তিনি। খাবারদাবার রেডি করে চেঁচিয়ে ডেকেও মা সাড়া পেতেন না। তাতে মাঝে মধ্যে বিরক্ত হতেন তিনি । সন্দেহ হতো, ছেলে ইচ্ছে করেই এরকম করে কি না। এ কারণে অবশ্য কোনােদিনই তাকে বিশেষ বকাঝকা খেতে হয়নি। একবার পড়লেই দাঁড়ি ,কমা সমেত সবকিছু মুখস্থ হয়ে যেত তাঁর। অঙ্কে ভুল হতো না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে মাস্টারমশাইদের প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। প্রিয়পাত্ররা অনেক সময় তাদের এই ইমেজের কারণে মাস্টারমশাইদের কাছ থেকে অবাঞ্ছিত কিছু সুযােগ সুবিধা নেয়। তপেসের মধ্যে এসবও ছিল না। সুতরাং সে ব্যাপারেও সমস্যা ছিল না কোনাে।

স্কুল থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে প্রথমে হােমটাস্ক শেষ করতেন তপেস। তারপর আঁকার খাতা নিয়ে বসতেন। রং পেনসিল দিয়ে ড্রয়িং খাতায় যে সব আঁকিবুকিগুলি সেই বয়সেই করতেন,  তা বারাে ক্লাসের ছেলেদের মানসিক পরিণতির সঙ্গে মেলে। প্রতিটি কাজে ভাবনা ও যুক্তির খােরাক থাকত যা দেখে তার আঁকার মাস্টারমশাইও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতেন—এ ছেলেটা করে কী? বড় হয়ে শেষমেশ কীসে দাঁড়াবে এ?  প্রকৃতি, সবুজ, এসব ভীষণ প্রিয় ছিল তাঁর। মাঠে গােরু চরানাে রাখাল, ও তার মুখের আড়বাঁশির সুর, কলসি কাঁখে জল আনতে যাওয়া গ্রামের বউয়ের চলার ছন্দ, মিঠাইয়ের দোকানে খালি গায়ে বসে থাকা ভুঁড়ি বার করা ময়রা এ সব দৃশ্য খুব উপভােগ করতেন তিনি।  সত্যিকারের জীবনের সন্ধান পেতেন যেন সব কিছুতে।

অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুরের যে স্কুলটাতে তিনি পড়তেন, তাঁর সময় সে স্কুল ছিল অতি সাধারণ মানের। প্রতিবার প্রচুর ছাত্র ফেল করত পরীক্ষায়। তিনি প্রথম হতেন। যদিও শহরের স্কুলে প্রথম হওয়া ছাত্রদের মতাে অত নম্বর পেয়ে নয়। গ্রামের স্কুলগুলির অত ভড়ং আর প্রচার থাকে না। নম্বরের শতাংশ ও পাশ ফেলের হার দিয়ে যে স্কুলের কৃতিত্ব জাহির করতে হয় সে সব বােধই থাকে না । সে কালে তাে ছিলই না। তা না হলে নিশ্চিত ভাবে শতকরার হিসাবটা তপেসেরও খুব একটা ফেলে দেওয়ার মতাে হতো না। | বয়ঃসন্ধিকালে তপেস বিগড়ে যাওয়ার কোনােরকম চেষ্টা করেননি। ভীষণ বাধ্য ও নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। অন্যদের মতাে বিড়ি খেয়ে, সমবয়সি মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে, বা স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখে হিরাে হওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো।
যুক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এ সব ব্যাপারগুলি এই বয়সের একটা ছেলের পক্ষে অস্বাভাবিক ঠিকই, তবে এটাও তাে ঘটনা যে যুক্তি প্রতিটি মানুষের মনের গভীরের খবর রাখে না! প্রত্যেকে অন্যের থেকে আলাদা এ জগতে, এবং নিজের নিয়মে নিজের মতাে করে বাঁচে সবাই। কারও জীবনধারা হয়তাে অন্যের চোখে অস্বাভাবিক বা পাগলামি, কিন্তু তাতে কী? সমাজ বা অন্যের মেপে দেওয়া নিক্তিতে যে  পথ চলতে হবে এরকম তাে মাথার দিব্যি দেয়নি কেউ! আর কোনটা খ্যাপামি, কোনটা স্বাভাবিকত্ব এটা সঠিক বিচারের ক্ষমতা যদি যুক্তির থাকত তাহলে পৃথিবীর সবকিছু তাে যুক্তি মেনেই চলত! ভালােবাসা, ঘৃণা, আবেগ, অনুশােচনা, আকর্ষণ, বিকর্ষণ এসবের কোনাে গুরুত্ব থাকত না।

অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি কথায় কথায়। তরতর করে এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে উঠে, বড় হতে হতে একদম ঝড়ের গতিতে তপেস যখন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করলেন তখন তাঁর বয়স মােটে চব্বিশ বছর। এমনিতে কপালটা ভালাে ছিল। কারও অধীনে কাজ না করে বাবার মদতে নিজেই শহরে একটা ফার্ম খুলে তাতে সে বসে গেলেন তিনি এবং বছর পাঁচেকের মধ্যে এমন সুনাম অর্জন করলেন যে বয়সে বড় তার5 পেশায় ঘষটাতে থাকা'রা তাঁকে ঈর্ষা করতে শুরু করল।
এ সবই তাে হল, কিন্তু জীবনের অন্য দিকগুলো? সেগুলাে আর হল কোথায় ? যে সময় চলে যায় হাজার চেষ্টাতেও তা আর ফিরে আসে না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সে জীবনকে উপভােগ করার পদ্ধতি ও উপায় ভিন্ন  ভিন্ন। সাধারণ মানুষদের যেগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার ইচ্ছে ও উপায় কোনােটাই থাকে না এবং তাতেই তারা ধন্য হয়। সুখ যতটা স্মৃতিতে, ততটা বর্তমানে নয়। আজকের বাস্তব আগামীকাল স্মৃতি হয়ে সুখ বা দুঃখ দেয়। যার স্মৃতির ভাণ্ডার যত বড় ,সে তত ভাগ্যবান। যার তা নেই  সে বড় অসহায়। তিরিশ বছর বয়সে তপেস তাঁর সে অসহায়তার ব্যাপারটা প্রথম অনুভব করলেন। শারীরিক, মানসিক বিকাশের ব্যাপারটা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মানসিকতাও ভিন্ন ভিন্ন। প্রতিটি মানুষ তা সে ইথিওপিয়ার ভিখারি হােক বা আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, একে অন্যের থেকে আলাদা । সুতরাং বেচারা তপেসের বয়ঃসন্ধি যদি তিরিশ বছরের পর থেকে আসতে শুরু করে তাহলে তাঁর আর দোষ কী? ক্রমশ তার শরীর ও মনের পরিবর্তন তিনি আস্তে আস্তে টের পেতে শুরু করলেন এই বয়সের পর থেকে। আগে সমবয়সি অথবা বয়সে অল্প কম মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে কেমন যেন বাধাে বাধাে ঠেকত। কথা বললেও তাদের দিদি অথবা বােন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে  পারতেন না তিনি। এখন তাদের দেখলেই শরীরে কেমন যে একটা রােমাঞ্চ অনুভব হয়! মনে হয় যদি  একটু ঘনিষ্ঠ হওয়া যেত! যদিও ইনহিবিশনের কারণে এগুলো পেরে উঠতেন না কখনো।  বহুদিন ভেবেছেন এ ব্যাপারটা নিয়ে। আচ্ছা এই ব্যাপারটাকেই কি লিবিডাে বলে? ফ্রয়েড কি এ ধারারই উপাসক ছিলেন? পৃথিবীর যাবতীয় শারীরিক আচার, অনাচার, বৈধতা অবৈধতা, সবই কি এর কারণেই ? এসব ভাবতে ভাবতে মাথা গুলিয়ে তিনি একবার একজন মনােবিদের কাছে গিয়েছিল। মনােবিদ মন দিয়ে সবকিছু শুনে, তার চিন্তাভাবনার মধ্যে কোনাে অস্বাভাবিকত্ব নেই, এই রায় দিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন পরিণত মানুষের মতাে ভাবনাচিন্তা করা অভ্যেস করতে। এ ব্যাপারটা তাে কতদিন ধরেই চাইছিলেন  তিনি ! কারও সমর্থন চাওয়ার ব্যাপারে আড়ষ্টতার কারণে অথবা নৈতিক সমর্থন না জোটার কারণে সায় পাচ্ছিলেন না
মন থেকে। শেষে তা জোটায় আশ্বস্ত হলেন যেন। বছর ছয়েকের মধ্যে একাধিকবার বিভিন্ন বয়সের মেয়ে ও মহিলার সঙ্গে ছোট বড় সম্পর্কের শেষে, বয়সে তাঁর থেকে তিন বছরের বড় তার এক ক্লায়েন্ট সেঁজুতির সঙ্গে থিতু হয়ে গেলেন শেষপর্যন্ত।  সেঁজুতি শহুরে আধুনিক মেয়ে। পেশায় চিকিৎসক। গাইনিকলজিস্ট। বহু মানুষের ঘর ভরিয়েছেন কিন্তু নিজের ঘর বাঁধা হয়নি। একজনের সঙ্গে ব্যর্থ লিভ ইনের পর তাঁরও একটা স্থায়ী ঠিকানার দরকার হয়ে পড়েছিল। সুতরাং অসুবিধে নেই কিছু। সেঁজুতি তপেসের মনে রঙের জোয়ার এনে দিলেন যেন। জীবনে এই প্রথমবার তপেস টের পেলেন প্রেমের আকর্ষণ কী দুর্নিবার। এবং তিনি কি অবহেলায় এতদিন নিজেকে এ রস থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন। দিনগুলাে রূপকথার রাজারানীর মতাে পক্ষীরাজ ঘােড়ায় চড়ে কাটতে শুরু করল তাঁদের। সিনেমা হল, মল, একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, মুখােমুখি চুপচাপ বসে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা, এভাবে স্বপ্নের ঘােরে কাটতে থাকল জীবন। এতে পেশাগত ক্ষতি দুজনেরই হল সামান্য কিন্তু তাতে কীসের পরােয়া? এই করতে করতে শেষপর্যন্ত একঘেয়েমি এলো সে জীবনধারাতেও। ফলত  পাঁচ বছরের মধ্যে দুজনে দুদিকে নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরে যেতে হলো আবার। সেঁজুতির তাে সমস্যা ছিল না মানসিক দিক থেকে। কিন্তু তিনি তপেসের জীবনে এসে তাঁকে যেন  মানসিক ও শারীরিকভাবে  আরো বেশি পরিণত করে দিয়ে গেল । এখন তিনি একদম অন্যরকম। আগেকার ঘরকুনাে সেকেলে ভাবনাচিন্তাগুলিকে প্রশ্রয় দেন না । যাকে যা বলতে হয় অনায়াস নিঃসঙ্কোচে বলে দেন। প্রশংসা করে নিন্দা করেন  অকপট ভাবে। কোনাে মহিলাকে ভালাে লাগলে পরিষ্কার বলেন তাকে। তাতে বিতাড়িত  অথবা আমন্ত্রিত হন। সামজিক জমায়েতে স্বচ্ছন্দ।

বিভিন্ন পেশা ও মনের মানুষের সঙ্গে হেলায় মিশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন। হালকা ঠাট্টা তামাশার মধ্যেও জীবনের রং খুঁজে পান।
কোন ব্যাপারটা সত্যি, কোন ব্যাপারটা মিথ্যে, মানুষের কাছে এটা ভীষণ অস্পষ্ট ধোঁয়াশার একটা বস্তু। যদি নিজের ব্যাপারে বিশ্বাস ও সততা থাকে তবে গতকালকের  মতাে আজকের দিনটাও সত্যি। হতেই পারে কাল সূর্যটার রং অন্যরকম লাগছিল আজ অন্য, তার অর্থ এই নয় কালকের সত্যিটা আজকে মিথ্যে হয়ে গেল। সূর্য তার মনের রং বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের রং বদল করেছে এটাও হয়।  জন্মের পর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষ বিভিন্ন পরিণতির  মধ্যে দিয়ে যায়। কখনো  সে ভাবুক, কখনো বেপরােয়া, কখনো হিংস্র, কখনো শান্ত। কখনো পশু, কখনও প্রেমিক। কোন সত্তাটাকে উপেক্ষা করবে সে? সবাই তাকে নাড়া দিয়ে গেছে যে! বিজ্ঞানের মতাে দর্শনটাও যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে চলতেই থাকে !  তার নাগালে থাকার জন্যে মানুষকেও তাে ছুটতে হয়, মননের নাগাল পাবার জন্য!


এ সবই  এখন বােঝেন তপেস। তবুও কেমন যেন একটা অভাব বােধ। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতাে শৈশব ও কৈশাের কাটাতে না পারার যন্ত্রণা কুরে কুরে  খায় তাকে। অথচ সমৃদ্ধির শেষ নেই তার। গাড়ি আছে। বাড়ি আছে। স্বাচ্ছন্দ্য আছে তবু যেন কিছু নেই। তার সঙ্গে বড় হওয়া মানুষগুলােকে চোখে পড়ে না আশপাশে। কালের নিয়মে জীবিকার সন্ধানে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে তারা। কেউ গরিব, কেউ অসামাজিক, কেউ অপরাধী, বেশিরভাগই ভালাে নেই সেই অর্থে। তবুও তাদের শৈশবের দিকে তাকিয়ে তপেসের ভীষণ ঈর্ষা হয়। এটাও মানুষের স্বভাব যে সে নিজেরটা নিয়ে  সন্তুষ্ট নয় কখনো। সবার মধ্যে একটা তাড়না, যন্ত্রণা, অভাববােধ, হতাশা। কেন এমন হয় ? ছোটবেলায় যে ভাবে জীবনকে বেছে নিয়েছে মানুষ, বড়বেলা তাে তাকে সে হিসেবেই তা ফেরত দেবে! এক জন্মের হিসেব তাে অন্য জন্মে বর্তায় না। একজনের হিসেবও অন্য জনের হিসেবের সঙ্গে মেলে না। তাহলে অতীতের দুঃখ ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা কেন? তুলে রাখার কারণ হলো অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা । সে কিছুতেই বুঝতে পারে না চরম প্রাপ্তি কীসে ? কারো ঘর আছে, কারো নেই ।  কারো শান্তি আছে, সুখ নেই।  কারো সমৃদ্ধি আছে, অভাবের বিলাসিতা নেই। সব মিলিয়ে ভালাে নেই মানুষ। আর তপেস? তিনিও তাে মানুষ! তাঁর দুঃখের শিকড়টা যে আরও গভীরে। ছােটবেলায় বড় হওয়ার তাগিদে সবকিছু পাওয়া হয়নি। বড় হয়েছেন  তিনি। কিন্তু অর্থ দিয়ে কি ফিরিয়ে আনা গেছে শৈশব ? এ এক অদ্ভুত সমস্যা! কত চাহিদা, শখ, আহ্লাদ এক জীবনে! উপন্যাসের মতাে অনেকগুলাে অনুচ্ছেদে যদি ভাঙা যেত জীবনটাকে তাহলে সব সখ আহ্লাদ মিটিয়ে সম্পৃক্ত হতে পারত মানুষ। কিন্তু তা আর হয় কই?
কারও বড় হওয়ার তাড়নায় ছােটবেলা হারিয়ে যায়। কারও রঙিন শৈশব  বড়বেলাকে করে যন্ত্রণাময়। তপেসের শৈশব হারিয়েছে। অপ্রাপ্তির টানাপােড়েনে অতি সাধারণ মানুষ তিনি এখন।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments