জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-৬/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত


কাল বাইপাসের ধারে সারাদিন ধরে বস্তি উচ্ছেদ অভিযান চলেছিল। বস্তি গুড়িয়ে এখানে বহুতল করবার প্ল্যান করেছে প্রোমোটাররা। কলকাতাকে ইলাস্টিকের মতো বাড়াতে হবে। আরও অফিস। আরও আবাসন। তবেই তো মহানগর। খবর পেয়ে এলাকার বস্তিবাসীদের সঙ্গে মেয়ের হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন প্রভা। পুলিশ এসেছিল। অনেকক্ষণ বোঝানোর পরও যখন অবরোধ তুলতে চায়নি মানুষগুলো,লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। তবে লাঠির আঘাত প্রভার গায়ে পড়েনি। তিনি বয়স্ক মানুষ। তাই হয়তো শুধু হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। কালকের মতো ভাঙার কাজ আটকে গেছে। তবে এভাবে কতদিন বুলডোজারের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে ওরা? আজ না হয় কাল অস্থায়ী এলাকাটা নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে। এখানে প্রভার মেয়ে বুল্টি থাকে। জামাই রোজ বিকেলবেলা বড় রাস্তার ধারে চাউমিন এগরোলের দোকান দেয়। দুটো নাতি এখনও প্রাইমারি স্কুলে যায়। কোনওরকমে তৈরি করা ছোট্ট বাড়িটা ভেঙে দিলে ওরা যাবে কোথায়?

     একাত্তর বছরের বৃদ্ধা প্রভার এ লড়াইটা নতুন। মৃত্যুর আগে স্বামী সুরেশের সকাতর কথাগুলো এখনও কানে বাজে তাঁর। "বুল্টিকে তোমার কাছে রেখে গেলাম প্রভা। ওকে দেখো। মেয়েটাকে আর বোকো না।" তিন বছর আগে সুরেশের চলে যাওয়া প্রভাকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাছে দাঁড় করিয়ে দেয়। মেয়ে জামাইয়ের ঘরে থাকতে মন চায়না। স্বামীর তৈরি করা মাটিটুকুই তাঁর স্বর্গ। এক কারখানার সিকিউরিটি গার্ডের পদে চাকরি করতেন সুরেশ। সামান্য টাকা বেতন। সেই টাকাতেই সংসার সামলে,মেয়েকে বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়েছেন। প্রাচীর দেওয়া এক চিলতে উঠোনসমেত দু কামরার ছোট বাড়ি করেছেন। বুল্টি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করলেও জামাইকে মেনে নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান করেছেন সাধ্যমতো। বিয়ের পর পর দেশের বাড়ি থেকে চলে আসা সুরেশ কলকাতার মতো জায়গায় নিজে বাড়ি করতে পারবেন,কোনওদিন ভাবতে পারেননি। আস্তে আস্তে কীভাবে যেন হয়ে গেল সব। এত বড় শহরে নিজেদের লোক বলতে মেয়ের বিয়ে হওয়ার আগে এতদিন শুধুমাত্র চয়ন ছিল। বুল্টির বিয়ে হওয়ার পর জামাই শ্যামল হয়েছে। শ্যামল ছেলেটি খারাপ নয়। শাশুড়ির নিয়মিত খোঁজখবর নেয়। ওষুধপত্তর দিয়ে যায়। চয়ন তো দেশের লোক। খুড়তুতো কাকিমার প্রতি ওর টান আলাদা তো হবেই। সুরেশ যখন বেঁচেছিলেন, চয়নের জন্য খুব ভাবতেন তিনি। আজ স্বামীহারা প্রভার জীবনে ঐ তিনটে মাত্র মানুষ। বুল্টি,শ্যামল আর চয়ন। ওদের কথা ভাবতে ভাবতেই দিন থেকে রাত পার হয় বৃদ্ধার।

     আজ সকালে মর্মান্তিক খবরটা পেয়ে প্রভা তাই ফোনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন।সেই মূহুর্তে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ ছিলনা পাশে। একাই নিজেকে সামলে কথা বলেছিলেন মেয়ের সাথে।

     খবরটা  বুল্টিই দিল। তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেননি প্রভা। রাত্রে এক খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাইপাসের ধারে মেয়ে জামাই যে বস্তিটায় থাকে,সেটা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ দেখেও কিছু করেনি। মোটা টাকা ঘুষ খেয়ে বরং নির্যাতন করছে এলাকাবাসীর ওপর। লাঠিচার্জ,জলকামানে নিরস্ত করতে না পেরে শেষে গুলি চালিয়েছে। সেকি এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ! হঠাৎ করে একটা গুলি এসে লাগল শ্যামলের বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জামাই। কাঁদতে কাঁদতে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল বুল্টি। তারপরই দেখলেন,মায়ের কাছে করুণ মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়ে। পরনে বিধবার থান। ঘুমটা তখনই ভেঙে যায়।ভেঙে গেল ফোনটা বাজতেই।
"হ্যালো মা,আমি বুল্টি বলছি।"

"বুল্টি!" বুকটা ধড়াস করে ওঠে প্রভার। "কী রে মা, কোনও খবর আছে? বস্তিভাঙা নিয়ে আবার ঝামেলা হচ্ছে আজ? পুলিশ এসেছে? দেখিস মা,সাবধানে থাকিস।"
"শোনো না,ওসব কিছু হয়নি। বস্তি আজ শান্ত। ভাঙাভাঙি করতে আসেনি কেউ। একটা অন্য খবর আছে।" বুল্টি বলল।

"অন্য খবর! কী খবর রে মা? খারাপ খবর নয় তো কিছু? তোরা সবাই ভাল আছিস তো বুল্টি?"
"হ্যাঁ মা,আমরা সবাই ভাল আছি। আসলে হয়েছে কী......" বলতে গিয়ে গলা থেকে স্বর বেরোয় না বুল্টির। কথা আটকে যায়।
"কী রে,থমকে গেলি যে! কী খবর বল্?" প্রভা জিগ্যেস করলেন।
"মা,চয়নদা মারা গেছে।" কথাটা বলে কান্না লুকিয়ে রাখতে পারল নি বুল্টি।
"কী আজেবাজে বকছিস!" প্রভা মানতে চাইলেন না।
"হ্যাঁ মা,আজ সকালে নেপালদা ওদিকে গিয়েছিল। ও-ওই এসে বলল তোমার জামাইকে। দু'একদিন নাকি বেলভিউতে ছিল। আজ ভোরে মারা গেছে। স্ট্রোক হয়েছিল। নেপালদা শুনে এসে যা বলল আমাদের।"নাক টানল বুল্টি।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন প্রভা। মাথাটা ঘুরে যাচ্ছিল। দেয়াল ধরে সামলে নিলেন। এ কী খবর শোনালো বুল্টি! চয়ন মারা গেছে!
     তাড়াতাড়ি করে আহিরীটোলা যাওয়ার বাস ধরলেন প্রভা। এক্ষুণি বৈশাখীর কাছে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। এত বড় বিপদ হয়ে গেল! ঋষভ আর ঐশীকে নিয়ে এখন করবে বৈশাখী?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments