জ্বলদর্চি

সুতোয় বাঁধা পুতুল-৯(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/সুমন মল্লিক

সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক

পর্ব – ৯


চতুর্দশ অধ্যায়

৩৯
রূপাঞ্জনার নিথর দেহের পাশে পাথরের মতো বসে আছে বিহান৷ কে জানতো এই দিনও আসবে৷ চোখে অবাধ্য নীরব অশ্রুধারা৷ মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠছে বিহান৷ খবর পেয়ে অনেকেই এসেছে৷ বিহানের স্কুলের কয়েকজন কলিগ, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী এসেছে৷ এসেছে সুকমল তৃষাকে নিয়ে৷ তৃষার বাড়িতে ভীষণ ঝামেলা হয়েছে রাতে৷ তৃষার মায়ের ফোন পেয়ে সুকমল গিয়েছিল৷ অনেক কথা কাটাকাটি, বোঝাবুঝির পর সুকমল ফিরে আসে৷ তৃষার মা-ও ভেঙে পড়েছে৷
     তৃষা ও সুকমল অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ৷ বিনা দোষেও অপরাধীর মতো মনে হচ্ছিল নিজেদের৷ বিহানের পাশে থাকার মুখটুকুও নেই তৃষার৷ লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে৷ কে আসছে না আসছে সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই বিহানের৷ পাথরের মতো বসে আছে৷ বিহান অপলক তাকিয়ে আছে রূপাঞ্জনার মুখের দিকে৷ মাঝে মাঝে শুধু ওর শরীরটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ 
     অনেকক্ষণ বসে থাকার পর শেষে চিতায় তোলা হলো রূপাঞ্জনাকে৷ সবাই একযোগে ধ্বনি দিতে লাগলো৷ পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করছে৷ খানিকক্ষণ বাদে একটা আগুনের চাদর ঢেকে নিলো রূপাঞ্জনাকে৷ বিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ ওর চোখের সামনে একটু পরেই উধাও হয়ে যাবে রূপাঞ্জনা৷ বিহানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছে৷
     শ্মশানের কাজ শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়৷ তারপর একে একে সবাই বেরিয়ে যেতে থাকে৷ বিহান তখনও পাথরের মতো বসে আছে৷ তৃষা ওর পাশে গিয়ে বসে৷ কিছু বলে না তৃষা, শুধু বসে বিহানের পাশে৷ অনেকক্ষণ পর তৃষার দিকে তাকায় বিহান৷ শুকিয়ে যাওয়া চোখ দুটো আবার জলে ভরে ওঠে৷ তৃষা কী বলবে বুঝে পায় না৷ বিহান কিছু একটা বলার চেষ্টা করে৷ ঠোঁট কাঁপতে থাকে৷ তারপর হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বিহান৷ অজ্ঞান হয়ে যায়৷

৪০ 
দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর বাড়িতে ফিরে আসে বিহান৷ সে-বাড়ি তো বাড়ি নেই আর৷ যে বাড়িতে রূপাঞ্জনা নেই, সেটা কোন বাড়ি নয় বিহানের কাছে৷ কিন্তু সেসব ভাবার শক্তিটুকুও লোপ পেয়েছে বিহানের৷ বিহান কাউকেই আর চিনতে পারছে না৷
     টেবিলের সামনে এমনভাবে বসে আছে বিহান যেন প্রথমবার এখানে বসেছে৷ বইপত্র, কাগজ, কলম, কম্পিউটার কোনটাই যেন ওর নয়৷ পাথরের মতো সেসবের দিকে চেয়ে আছে বিহান৷ না, কোন লাইন আর আছড়ে পড়ছে না বিহানের ওপর৷ রূপাঞ্জনার মতো কবিতাও যেন পুড়ে ছাই হয়েছে চিরতরে৷ কিন্তু বিহান সেটা বুঝতেই পারছে না৷ শুধু বসে আছে চেয়ারে৷ এভাবে বসে থাকাই এখন ওর ভবিতব্য৷ 


পঞ্চোদশ অধ্যায়

৪১
রাজার সঙ্গে তৃষার এরপর রোজই ঝামেলা হতে লাগলো৷ রূপাঞ্জনার ওভাবে চলে যাওয়াটা তৃষা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি৷ আর তারপর বিহানের অমন অবস্থা৷ সবকিছুর জন্য রাজা দায়ী৷ রাজাকে একজন অপরাধীর মতো দেখতে লাগলো তৃষা৷ 
     মাঝে মধ্যেই কখনও তৃষার মা, কখনও সুকমল এসে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতো৷ একদিন ঝামেলা এতোই চরমে পৌঁছে গেল যে তৃষা ছেলেকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে গেল৷ সুকমল অনেক বোঝানোর পরও তৃষা ফেরেনি৷ সুকমলেরও ততদিনে ভাইয়ের কীর্তির জন্য লজ্জায় মাথা একেবারে মাটিতে মিশে গেছে৷ 
     অবশেষে একদিন তৃষা ডিফোর্সের কাগজপত্র পাঠালো রাজাকে৷ তৃষার মা, সুকমল এসবের কিছুই টের পায়নি৷ উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৃষা নিজেই সবকিছু করেছে৷ কিন্তু বেঁকে বসেছে রাজা৷ সে কিছুতেই ডিভোর্সে রাজি নয়৷ দিন এভাবেই কাটতে থাকে৷

৪২
মাঝে বেশ কয়েকদিন বিহানকে দেখতে গিয়েছিল তৃষা৷ একদিন গিয়ে দ্যাখে বিহান নিজে নিজেই বিড়বিড় করছে৷ চেহারা তখন একদম উন্মাদের মতো হয়ে গেছে৷ তৃষার দিকে একবার দেখে আর তাকায়নি বিহান৷ তৃষাকে চিনতেই পারেনি বিহান৷ পাথরের মতো বসে ছিল চেয়ারে৷ চোখের পলকও স্থির৷ টেবিলে চায়ের কাপ রাখা৷ অর্ধেক চা তাতে৷ কে জানে কখন থেকে ঠান্ডা হয়ে পড়ে আছে৷
     বিহানের জন্য খুব কষ্ট হয় তৃষার৷ নিজেকে অপরাধী বলে মনে হতে থাকে৷ আর তার থেকেও বেশি ঘৃণা জমা হয় নিজের স্বামীর প্রতি৷ বিহানের মাথায় হাত রাখে তৃষা৷ বিহান তাকায় না৷ ওর স্থির নজর আটকে থাকে টেবিলে রাখা বইয়ের দিকে৷ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামে তৃষার৷ আর থাকতে পারে না তৃষা৷ আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে৷


৪৩    
রাজার প্রতি ঘৃণার বারুদ জমতে জমতে ততদিনে একটা বিস্ফোরকের জন্ম হয়েছে তৃষার মনে৷ মাঝে ডিভোর্সের জন্য অনেক চেষ্টা করেছে৷ উকিলের সঙ্গে অনেকবার দেখাও করেছে৷ কিন্তু কোন লাভ হয়নি৷
     এভাবেই আট মাস সময় কেটে যায়৷ একদিকে তৃষার মা এবং অপরদিকে সুকমল ও তার স্ত্রী, বোঝাতে বোঝাতে তারা সকলেই ক্লান্ত৷ বিহানের জীবনে নেমে আসা অকারণ অন্ধকারের সমান্তরালে হাঁটতে চায় তৃষা৷ ক্রমশ নিজের ভেতরই গুটিয়ে আসতে থাকে৷    
     এরপর হঠাৎ একদিন তৃষার হাসবেন্ট রাজার প্রাণহীন দেহ উদ্ধার হয় একটি বারে৷ রূপাঞ্জনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে বদ্ধ মাতাল হয়ে যায় রাজা৷ সন্ধের পর থেকে ওই বারেই বসে থাকতো৷ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে নেশার অতলে ডুবে নিজের পাপ ধোয়ার চেষ্টা করতো হয়তো৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় না রাজার শরীরে৷ কিন্তু বিষের হদিশ পাওয়া যায়৷ কেউ কোন অভিযোগ না জানালেও পুলিশ নিজে থেকেই তদন্ত শুরু করে৷ সুকমল, তার স্ত্রী, তৃষা, তৃষার মা সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ৷ বিহান এবং রূপাঞ্জনাদের বাড়িতেও যায়৷ কিছু তথ্যপ্রমাণ হাতে আসে পুলিশের৷ তার ভিত্তিতেই তদন্ত এগিয়ে চলে৷

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments