জ্বলদর্চি

দুটি অণুগল্প /( শারদ১৪২৮)/সুকন্যা সাহা

দুটি অণুগল্প 
সুকন্যা সাহা 


গিরিধারী

" গিরিধারী ও গিরিধারী... রাধামাধব  ও রাধামাধব ..." এ   তুমি আমার কি সব্বোনাশ  করলা গা ! আমার  সঙ্গে তোমার   কি শত্রুতা ? এ আমারে   কি অসুখ দিলে গা ? আমারে  এমনে অচ্ছুৎ  কইর‍্যা রাখলা ? এমন অসুখ দিলা  যে তোমার  নিত্য সেবা পূজাও করতে পারুম না ? আমি তো উঠতেই পারি না ... জ্বরে যে গা আমার  পুইড়্যা  যায় !

    আনচুরি গ্রামের শতবর্ষের প্রাচীন এই রাধা গোবিন্দ  দেউলের   একমাত্র  সেবাইত নিমাই ভটচায লাল পাথরের মেঝের ওপর মন্দিরের উঠোনের এক কোণে পড়ে জ্বরে কোঁকায় আর জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে ...পাশের  কাঠ চাঁপা গাছটা   থেকে  ফুল ঝরে  পড়ে ঠাকুর দালান ভর্তি হয়ে  থাকে ...অন্য সময় হলে নিমাই ঠাকুর এই ফুলের মালা গেঁথে  পড়ান রাধা গোবিন্দকে ... কিন্তু এখন আর কে ওসব করে !

      বাঁকুড়া জেলার  প্রত্যন্ত গ্রাম এই আনচুরি ।মানুষগুলো এখানে  হতদরিদ্র । মাঠের কামকাজই ভরসা ...তাও যদি সেরকম উর্বর  ফসলী জমি হত ! লাল মাটির  রুক্ষ জমিতে  কি বা ফসল হয় ! গ্রামের  এক প্রান্তে এই রাধা গোবিন্দের  দেউল ...দোল , রাস জন্মাষ্টমীতে  এখনও এখানে উৎসব হয় ...গ্রামের ছেলে পিলেরা প্রসাদ পায় ...লোকে  বলে মন্দিরের নাকি অনেক শয় সম্পত্তি আছে ... নিমাই ঠাকুর   সে সবের  খোঁজ জানে ... তবে  জাগ্রত দেবতা বলে ঠাকুরের থানে  প্রণামীও নেহাত  কম  পড়ে না ...

       আর   এইসব কিছুর উদ্যোক্তা নিমাই পন্ডিত ... আজ তিনদিন   হল জ্বর   এসেছে নিমাই পন্ডিতের । দিনে তিন চার বার করে থেকে থেকে জ্বর আসে তার ... তাপে গা পুড়ে যায়...জিভ থেকে গলার ভিতর পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে...কি যে  এক অসুখ এসেছে গ্রামে ... ঘরে ঘরে জ্বর   ... আর  জ্বর  এসেছে  শুনলে কেউ ধারে পাশেও আসে না ... নিমাই  পন্ডিত  যখন জ্বরের ঘোরে জল জল করে  কোঁ কোঁ করে  তখন ছেলে ছোকরার দল দূর থেকে মজা দ্যাখে আর কেটে পড়ে ... অনেকে   মহামারীর ভয়ে ঘর থেকেই বেরোয় না ...শুধু মন্দিরের পাশের  কাঠ চাঁপা গাছটা থেকে চাঁপা ফুল ঝরে পড়ে ।  অবশ্যি মন্দিরের  পিছন দিকের লাগোয়া  বাগানে অন্যান্য ফুলের  গাছও আছে  প্রচুর ... টগর , রঙ্গন , বেল হাস্নুহানা ... এই সব ফুল দিয়েই রাধা  গোবিন্দের  পুজা  চলে   বারো মাস ...

     নিমাই পন্ডিতের তিনকূলে কেউ নাই। বিবাগী একা মানুষ ; অনেকে  বলে তার  বাংলাদেশে  সংসার   ছিল... বউ মরে  যাওয়ায় সে  সংসারের পাট চুকে বুকে  গেছে ... তারপর  দেশ ছেড়ে নিমাই পন্ডিত এদেশে এসে ডেরা বেঁধেছেন এই আনচুরি গ্রামে ... সেও প্রায় তিন দশক আগের  কথা ... সেই সময় গ্রামের মোড়লরা সবাই মিলে গ্রামের রাধা গোবিন্দ মন্দিরের  সেবা পূজার  ভার অর্পন করেছেন  এই নিমাই পন্ডিতের উপর ... সেই থেকে  নিমাই পন্ডিতও  মন্দিরেই পড়ে থাকে  দিন রাত ... ঠাকুর সেবাই তার   একমাত্র ধ্যান জ্ঞান ...লোকে বলে নিমাই পণ্ডিতের  এক ছেলে  ছিল তার নামও নাকি গিরিধারী ! অবশ্যি এসব লোক মুখের  রটনা ; সত্যাসত্য কে  বিচার   করতে যায় !

    সেদিন   রাতে  চরাচরে  বানভাসি জ্যোৎস্না ... জ্বরের ঘোরে  ভুল বকছেন  নিমাই পন্ডিত ... পিপাসার্ত দুটি ঠোঁট জল জল  করছে ... এমন  সময়  বারো  চোদ্দ বছরের একটি ছেলে   এগিয়ে  আসে ... বামুনের  ছেলে  বোধহয়, গলায় পৈতে আছে ...আঁজলা ভরে  জল দেয় নিমাই পন্ডিতের মুখে ... সারারাত বসে জলপট্টি দেয়  মাথায়... ভোরের দিকে  জ্বর  কমে আসে  নিমাই পন্ডিতের...
নিমাই  পণ্ডিত   ডাকেন , "গিরিধারী ও গিরিধারী ...
 ছেলেটি  সাড়া দেয় ... হুঁ... 
আমায়  কিছু খাইতে দে বাবা... বড় ক্ষুধা লাগছে ...
ছেলেটি একটা  বড় পাত্রে  সাবু মাখা   নিয়ে আসে ... সাবু মাখায় তুলসী পাতা  দেওয়া ...
বলে , খাও ... গোবিন্দের  প্রসাদ ...
নিমাই পণ্ডিত  হাঁ করে তাকিয়ে  থাকে  ছেলেটির  মুখের দিকে ... এ কে ? তবে   কি গিরিধারী স্বয়ং ?
গ্রামের   এক মোড়ল  বেশ  কয়েক দিন  পরে  খোঁজ নিতে  আসে  নিমাই পন্ডিতের ... মন্দিরে  ঢুকতে  গিয়ে  পা আটকে যায় তার ...একি ! মন্দিরে  তো গোবিন্দ মূর্তি নেই ... দাওয়ায় বসে  নিমাই পন্ডিত একমনে চাঁপা ফুলের  মালা গাঁথছে... আর  তার   সঙ্গে   বক বক  করছে   একটা  বারো চোদ্দ  বছরের কালো ছেলে ... মাথার চুল চূড়ো করে বাঁধা ... সেই চূড়োয় লাগানো একটি ময়ূর পাখা ...



চোখের আলোয় ...


এক

 সিঁড়ির দরজায় তালা খোলার  আওয়াজে সচকিত হয়ে ওঠে  শশিভূষণের   সমস্ত   ইন্দ্রিয়। সোহিনী বাড়ি  ফিরল তাহলে !  রোজই  এই  সময়  বাড়ি ফেরে   সোহিনী ... স্কুল   থেকে । স্থানীয় বকুল বীথি  প্রাইমারী স্কুলের  শিক্ষিকা সে । সোহিনী  আর   শ্যামল শশিভূষণের  বাড়ির   একতলার  ভাড়াটে ।  শশিভূষণ  জানেন  এরপর সোহিনী ঠিক ওপরে উঠে  আসবে ... সিঁড়িতে তার পায়ের   শব্দ  আর আর আঁচলের  মৃদু সুবাস  পান যে তিনি ... ঘড়ি দেখতে   না পারলেও  ঠিক এই সময়টার  জন্যই আকুল প্রতীক্ষা থাকে   তার... সোহিনীরা এ বাড়ীতে ভাড়া এসেছে  তাও প্রায় বছর ঘুরতে চলল ।অকৃতদার , জন্মাদ্ধ প্রৌঢ় শশিভূষণের জীবনে  সোহিনী  যেন  এক ঝলক  টাটকা বাতাস। বড় লক্ষী  মেয়ে  সোহিনী । শ্যামলের  সঙ্গে  তার  বিয়ে  হয়েছে   তা  বছর   পনেরো ।  এখনও ওদের কোনো   সন্তান  নেই  । স্কুল   থেকে  ফিরে  শশিভূষণের   ঘরে  রোজ ফ্রিজের  জল  খেতে  আসে   সোহিনী । সন্ধ্যেবেলায়  টিভিতে   সিরিয়াল   দেখতে   আসে ।  শশিভূষণ   জানেন  ওগুলো অছিলা।  আসলে নিঃসঙ্গ শশিভূষণের  সংগে  খানিকটা  গল্প করতে আসে ও। তাতে নিজেও খানিকটা   হালকা   হয় আর শশিভূষণের  সময়টাও ভালো কেটে যায় ।  তারপর  শশিভূষণের   জন্য   নিজের   হাতে   দুপুরের  খাওয়ার  বেড়ে তবে তার  ছুটি ... রান্নার লোক সেই কোন সকালে   রান্না   করে  দিয়ে যায় । অবশ্য সারাদিন রাত শশিভূষণের   কাছে   জগু নামে   একজন ভৃত্য থাকে । কিন্তু সোহিনী নিজেই বলে , জগুদা , আমি  থাকলে তোমার ছুটি, তুমি  একটু তোমার  ঘরে   গিয়ে  জিরিয়ে  নাও । শশিভূষনের জন্য এটুকু কাজ সে  ভালোবেসেই
করে,  তাছাড়া  শ্যামল তো  সারাদিন বাড়িই থাকে না , ডিউটি থেকে  ফিরতে ফিরতে তার  সেই  রাত   দশটা । শশিভূষণ ভুবার  বলেছেন সোহিনী  তুমি  তো এখানেই দুপুরবেলা  খেয়ে   নিলে পার ; আবার নীচে গিয়ে  রান্না  করার দরকার   কি ! কিন্তু সোহিনী রাজি  হয় নি । মুখে  বলেছে   দুজনের  তো রান্না ! তার আবার কষ্ট !শ্যামলের  জন্য এটুকু  কষ্ট   করতে   সোহিনীর   ভালোই লাগে ...  শুধু  শ্যামলই  বুঝল না ! দিন  দিন তাদের  সম্পর্কটা কেমন পানসে   হয়ে  যাচ্ছে ... সেটা কি শুধু  তাদের   সন্তান হল না  বলেই ?

  বুকভাঙ্গা  দীর্ঘশ্বাস পড়ে সোহিনীর !হাত মুখে   জল দিয়ে এসে ফ্যানের   তলায় বসে   সোহিনী ।  একটু দূরেই ইজিচেয়ারের  ওপর আধশোয়া  শশিভূষণ ।

  "জানো সোহিনী আজ আবার রবি ঠাকুরের ডাকঘর পড়লাম । কতবার  পড়া , তাও এখনও নতুন ভাবে ভালো লাগে ... সোহিনী জানে  ছোটোবেলা থেকেই শশিভূষণ  ব্রেইলে লেখাপড়া  শিখেছেন , চোখের আলো চলে গেলেও মনের আলো তিনি নিভতে দেননি কোনোওদিনই। পড়াশুনা চালিয়ে  গেছেন, খুলে   রেখেছেন  মনের সব  দরজা জানালা ।শশিভূষণ   বলে চলেন , পড়তে পড়তে  আবার মনে  হচ্ছিল আমি যেন  সেই অমল আর তুমি ... তুমি যেন সেই দইওয়ালা ,আমি যদি তোমার সঙ্গে  সেই পাঁচমুড়ো পাহাড় , শ্যামলী নদীর তীরে যেতে পারতুম তো যেতুম...সোহিনী হেসে ওঠে  আপনমনে , কি যে  বলেন  আপনি ! তাও যদি বলতেন অমল আর সুধা তবু হতো ! শেষে   কিনা আমি দইওয়ালা ! আবার আপনাকে পাগলামিতে ধরেছে ... চুপ করে যান শশিভূষণ ; কি করে বোঝাবেন সোহিনীকে  তিনি ... আজকাল যে  সোহিনীর চোখের আলোয়  দুনিয়াটাকে  নতুন করে  দেখছেন তিনি ! সোহিনীর  হাসি আর চুড়ির  রিনরিনে শব্দ মিলেমিশে অনেকক্ষণ তার কানে   রেশ থেকে যায় ...
                

     আজ প্রৌঢ়ত্বের  প্রান্তসীমায়  এসে শশিভূষণের  মনে হয়  বয়েসকালে  একটা বিয়ে  করলে হত, আসলে তিনি নিজেই তার বিড়ম্বিত ভাগ্যের সঙ্গে অন্য একটা মানুষের জীবন জড়াতে  চান নি ... নইলে পৈতৃক সম্পত্তি যা ছিল অনায়াসেই পাত্রী জুটে যেত  তার ; আর  তিনিও তো সারাজীবন ব্লাইন্ড স্কুলে পড়িয়েছেন , তার নিজের উপার্জনও তো কিছু কম ছিল না । আজ  অনেকখানি পথ পেরিয়ে  এসে   মনে হয় , জীবনের  সিদ্ধান্তটা  তার ভুলই হয়েছিল ... এই  বয়েসে তো একজন  সঙ্গীরও প্রয়োজন হয় !

 
 দুই

আজ কয়েকদিন হল শশিভূষণের  শরীরটা বিশেষ ভালো নেই । হার্টের অসুখ ধরা  পড়েছিল বেশ কয়েক বছর আগেই । সম্প্রতি সেটা বেড়েছে ; বুকের বাঁ দিকে একটা ব্যথা ... চাপ আসছে বারে বারে  ...ডাক্তার  এসেছিলেন , ই সি জি ও  হয়েছে , রিপোর্ট বিশেষ ভালো নয় , তাছাড়া প্রেশারও বেশি। শশিভূষণ অসুস্থ শুনেও বেশ কয়েকদিন ধরে সোহিনী  একবারও ওপরে আসে নি । শশিভূষণ জানেন কেন , দু-তিন দিন আগেই রাত্রে শ্যামল মদ খেয়ে  এসে সোহিনীকে মারধর  করেছে , শ্যামলের চীৎকার  আর সোহিনীর চাপা  কান্নার  আওয়াজে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় শশিভূষণের । ওপর  থেকেই

শ্যামলের অশ্রাব্য গালিগালাজ আর খিস্তি খেউড় কানে আসে  তার ... বুঝতে পারেন গন্ডগোলের সূত্রপাত  সোহিনীর ওপরে আসা নিয়েই ।মানুষ কত অবুঝ হয় ! সোহিনীর জন্য বড় কষ্ট হয় তার । মেয়েটি যে বড় ভালো ...

তিন

পরের দিনও সোহিনী এল না , তারপরের দিনও ... এল শ্যামল , ভাড়া দিয়ে গেল আর বলে গেল আগামী রবিবার তারা ঘর ছেড়ে অন্যত্র উঠে যাচ্ছে , এখান থেকে নাকি সোহিনীর স্কুলে যাতায়াতে অসুবিধা  হচ্ছে ... স্কুলের  কাছাকাছি তারা  অন্য ঘর ভাড়া দেখেছে , সেখানেই উঠে যাচ্ছে । একটাও কথা বলেন নি শশিভূষণ ... সোহিনী  তার কে ? তিনি তো বরাবর একাই ...


     রবিবার সকাল থেকেই  বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেছিলেন শশিভূষণ , সকালবেলা জগুকে যখন  ইজিচেয়ারটা বারান্দায় এনে  দিতে বলেন তখন  সে খানিক অবাকই হয়েছিল। বেলা বাড়তেই নীচের ঘরের মালপত্র সব একে একে ম্যাটাডোরে উঠছিল , আওয়াজ পাচ্ছিলেন শশিভূষণ । সব শেষে  সোহিনী  ওপরে এসে চাবি দিয়ে গেল । পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিল । সোহিনীর চোখ থেকে দু ফোঁটা চোখের জল পড়ল শশিভূষণের  পায়ের ওপর । ওর মাথায় হাত রাখলেন শশিভূষণ । নীচে নেমে  শেষবারের মতো সোহিনী তাকাল বারান্দার দিকে ... দেখতে না পেলেও ঠিক অনুভব করতে পারলেন শশিভূষণ , তার বুকটা হু হু করে উঠল । চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে নামল জল ... দূর থেকে তখন মাইকে ভেসে আসছে "চোখের  আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে ..."


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments