জ্বলদর্চি

এই যে আলোর আকুলতা-৯(উৎসব ১৪২৮)আবীর ভট্টাচার্য

এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য 
(নবম অধ‍্যায়)


 এই নির্জন রৌদ্রকরোজ্জ্বল গহন বন-মধ‍্যে প্রায় মানুষসমান উঁচু অত‍্যাশ্চর্য বল্মীকস্তূপ যেন বাল্মীকি-তপস্যার কথা মনে করিয়ে দেয়, এই বিংশশতাব্দীর শেষভাগেও আমাদের দুয়ারপ্রান্তে এখনও যে এমন অতীন্দ্রিয় স্হান আছে, তা দেখে, ভেবে শিহরিত হয় দেহমন। বিশেষতঃ জায়গাটির স্হান-মাহাত্ম্য এমনই যে বাচ্চারাও নিশ্চূপ হয়ে গিয়েছে, সম্বিত ফিরে এলো গোপীবল্লভপুরে এসে, মানুষজনের জটলা দেখে। 

ছোট্ট জনপদ,সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল, স্কুল,কলেজ: সবই আছে, যদিও এর মূল আকর্ষণ গোবিন্দ মন্দির। বিশেষতঃ গোপীবল্লভপুর বিখ্যাত বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র; বৃন্দাবনের অনুরূপ; কদম্বকানন, কুঞ্জভূমি, গোকর্ণবট, দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ, উড়িষ্যার রেখদেউল রীতিতে প্রস্তুত মূল মন্দিরটি কালের নিয়মে ভগ্নপ্রায় হলেও সেকালের মানুষের ভক্তি রসসিক্ত উৎকর্ষতার চিন্হ বহন করে চলেছে, মন্দির পাশের রক্তপায়িনী দেবীর সাধিকা বৈষ্ণবী রূপে পূজিতা রঙ্কিনীমন্দির অথবা ভুঁইঘরা সাধুর ডেরা,গাদীশ্বর মোহান্ত মহারাজের আবাসভূমি ইত্যাদি সর্ব-ধর্ম-সহিষ্ণুতার আলো জ্বালে মনে। ভাবতে অবাক লাগে, যে ভূমি এতোবড়ো বৈষ্ণবতীর্থ, সেভূমিতেই পল্লবিত হয়েছিলো অশান্ত বৈপ্লবিক নকশাল আন্দোলন! আবার, সেই ভূমিকেই আদিবাসী সম্প্রদায় মনে করেন, দামোদর নদীতীর তূল‍্য পবিত্র, প্রতিবছরেই বিশেষ দিনে, উত্তরবাহিনী এই সুবর্ণরেখা নদীতীরে পুর্বপুরুষের অস্হিদান ও আদ‍্যশ্রাদ্ধের জন্য সমবেত হয়ে থাকেন তাঁরা।
এমন ধার্মিক ও সাংস্কৃতিক ঔদার্য একমাত্র ভারতভূমিতেই সম্ভব।
            
এসব ভাবতে ভাবতে, গাড়ি পৌঁছে যায়, বেলেবেড়ার প্রবেশদ্বার ব‍্যাঘ্রেশ্বর মন্দির চত্বরে; নদীতীরবর্তী ছোট্ট লৌকিক শিবের মন্দির। সামনেই স্হানীয় পঞ্চায়েত দপ্তরের বাংলো 'ডুলুং', মরসুমী ফুলে প্রফুল্ল ছোট্ট দ্বিতল বাংলোটির নির্মানকর্তা পদাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অরনির কলেজবেলার বন্ধু; এখানে আসার কথা ঠিক হতে তাঁর সঙ্গেই প্রথম যোগাযোগ করেন, এই 'অফ্-বিট' ট‍্যূর-পরিকল্পনা বন্ধুটিরই। তাঁর আমন্ত্রণেই মধ‍্যান্হভোজের বিরতি,খানিক বিশ্রাম। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে কলস্বরা ডুলুং, সারাক্ষণ যে তার কতো কথা সঙ্গী উপলখন্ডের সঙ্গে…..মানুষের পরিবর্তন হয়, সম্পর্কেরও; চিয়ায়ত প্রকৃতি থেকে যায় অপরিবর্তনীয়। তিলে তিলে সে নিজেকে সাজিয়ে তোলে, ঋতুতে, প্রহরে; কিন্তু মুগ্ধতার অর্ঘ‍্যটুকুও তার পায়ে নিবেদনের সময় যে নেই! মরমী মানুষের জীবনভ'র এই অনিঃশেষ আকুতি রয়ে যায়, 'সে যে কাছে এসে চলে গেল,তবু জাগিনি…'
        
 সুন্দর আলাপচারিতা, ততোধিক সুন্দর আপ‍্যায়ন, ধন্যবাদ-জ্ঞাপন শেষে, পৌঁছনো গেল বেলেবেড়া প্রহরাজ-মহলে। গল্পে-গল্পে পল্লবিত লোককথা, কোন এক উড়িষ্যা-পরবাসী পুরুষ, ঝাড়গ্রাম রাজার কাছে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসেন, রাজা তাঁকে প্রহরমধ‍্যে অতিক্রম করা ভূমিভাগ দানের অঙ্গীকার করেন, পরে শর্তরক্ষাও করেন। সেই থেকে রাজার নাম প্রহরাজ। রাজা নিজে পেয়েছিলেন দান, যেমন অনেকেই পান, কিন্তু এই রাজবংশ বংশানুক্রমে সেই দান ফিরিয়ে দিয়েছেন এলাকাবাসীর হিতার্থে, অসংখ্য পুস্করিনীখনন, প্রজাহৈতৈষণা, সাহিত্য ও লোকশিল্প বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা...ইত্যাদি জনকল‍্যানী কার্যকলাপে বেলেবেড়া রাজা সত্যিই 'রায়বাহাদূর' ছিলেন।
        
 আজকের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে মনে হয়,এইসব মাপে ছোট,মনে বড়ো রাজারা যদি আরও একটু প্রচার পেতেন, যদি আমাদের দেশেও ইংল‍্যান্ড কি ফ্রান্সের দূর্গগুলির মতো সঠিক রক্ষনাবেক্ষন হতো….

ইতিহাস তো কথা বলে, শুধু শোনার কান আর দেখার চোখ চাই। এই যেমন, বেলেবেড়া পেরিয়ে, অদূরবর্তী রোহিনী গ্রামের উত্তরে ঝোপঝাড়ে ঢাকা ভোমরাগড়ের ধ্বংসাবশেষ-প্রান্তে এসে চোখে পড়েনা বিশেষ কিছুই। কিন্তু কান পাতলে, মন পাতলেই চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে জলছবি: আজ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয়শো বছর আগে, এই অঞ্চলের উগ্রক্ষত্রিয় রাজার গড়ের অদূরে, বাস ছিলো বরোজিয়াদের। সারাদিনের শ্রমের শেষে তাদের কন‍্যারা যেত নদীতে, নদী ব‍্যস্ত তখন সূর্য-রতি-বন্দনায়; মেয়েদের সহজিয়া গানে, গোধূলীবেলায় চলতো স্নান,জলকেলী। এমনই কোন এক অপরূপা গোধূলীতে অশ্বারোহী ছোট রাজকুমার সান্ধ‍্যভ্রমণকালে, দেখেন বরোজিয়া-কন‍্যা ভ্রমরকে; রূপকথার গল্পের মতো কৃষ্ণাঙ্গী সে কন‍্যের ছিলো দীঘল কালো চোখ,মেঘবরন চুল; দেখামাত্র হৃদয়-বিনিময়; যথারীতি দুপক্ষেই পিতৃ-আপত্তি; রাগান্বিত রাজা পান-বরোজে লাগিয়ে দিলেন আগুন; পুত্রকে করলেন দারুন অপমান; ক্ষোভে,যন্ত্রণায় ব‍্যর্থ প্রেমিকযুগলের  নদীজলে প্রাণবিসর্জন;....যেন দেশকাল পেরিয়ে, বিদেশী রোমিও-জুলিয়েট গাথা মনে পড়িয়ে দেয়। হয়তো সেসব দিন চলে গেছে, সুবর্ণরেখা-ডুলুং দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল; তবু সেদিনের সেই প্রান্তিক মানুষগুলির হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়ার  আনন্দ-বেদনাতুর প্রেমগাথা লোকগানে, যাত্রাপালায় মরমীয়া মানুষের মনে রয়ে গেছে। 

এখানকার মাটি রবীন্দ্রনাথের চরণ-স্পর্শের সৌভাগ্য পায়নি, পেলে হয়তো আরও কোন ক্ষুধিত পাষাণ রচিত হোত।
                             
সত্যিই, বিপুলা এ পৃথিবীর কতোটুকু জানি!.…..বিশেষতঃ যে দেশের নাম বেলেবেড়া, ডুলুং-সুবর্ণরেখার বালি জমে যার বিস্তার; সেদেশের বুকেও এতো ব‍্যথা! তার কান্নার অশ্রুবিন্দুগুলিই বুঝি জমে জমে 'অপরিচিত ঠিকানার উদ্দেশ বলে দিয়ে যায় কানেকানে'....'ওগো তুমি কিছু নিয়ে যাও'
               
 নিয়ে যেতেই তো এসেছেন ওনারা, নিয়ে যেতে এসেছেন প্রাণ-মন ভরে; অনুভব করতে এসেছেন অনাঘ্রাত প্রকৃতির রূপ-রস-ঘ্রাণ। তাই হয়তো ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আজ রাতটুকুর বিশ্রামের জন্য বেছে নিয়েছেন ডুলুং-সুবর্ণরেখার সঙ্গমে গড়ে ওঠা ছোট্ট দ্বীপের বাংলোটি। নাম তার 'কোদোপাল'.....এ অঞ্চলের ভূমিরূপের সম্পুর্ণ বীপ্রতীপ এক প্রাকৃতিক সৃষ্টি।মূল ভুখন্ড থেকে ডিঙি নৌকা বেয়ে এসে পৌঁছনো মাত্র সবাই উচ্ছসিত! 'বাঃ','ওয়াহ্'- ইত্যাদি শব্দবাণের সঙ্গে ভেসে এলো অরূন্ধতীর হালকা রসিকতা,

-এটাও কি আপনার বন্ধুরই পরিকল্পনা?

-হুম। অবশ্যই। ওরই তৈরি। ভালো না?

-খুবই ভালো। তবে ভদ্রলোকটি কিন্তু আরও বেশী ইন্টারেষ্টিং! সন্ধ্যায় আসছেন নাকি উনি?

-যাব্বাবা!! এটা যদি দোলা বা রূপার গলায় শুনতেন, এতটা অবাক হতেন না! কিন্তু তিনিও! 

স্বগতোক্তির মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, 'স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি…'

সঙ্গেসঙ্গে কুলকুল হাসির ঝর্ণাধারা, বুঝে বা না বুঝেই তায় ভেসে গেলেন সবাই। ইতিমধ্যে এসে পৌঁছে গেছেন অরণির সেই বন্ধু, সঙ্গে এলাকার যা যা ভালো খাদ‍্যবস্তু পাওয়া যায়, তার প্রায় সবই। রোহিনীর চিংড়ির চপ, রগড়ার রসগোল্লা..আরও সব কি কি! বোঝাই যাচ্ছে, ইট-লোহা-ড্রইং-বিলিং নিয়ে ঘর করলেও ভদ্রলোকের মনটি এখনও বেশ সরস!

আলাপ তো আগেই হয়ে গিয়েছিলো, এমন সুগন্ধী সব খাদ‍্যবস্তু দেখে ক্ষিদেও পেয়ে গেল; বেশী কথা না বলে, সবাই সেগুলির সৎব‍্যবহারে মন দিলেন; খাওয়া-দাওয়া, চা-পান, রসালাপে ভরে উঠলো বাংলোর বারান্দা, বন্ধুগর্বে ভরে গেল অরণির মন; আর হয়তো কখনও আসা হবেনা, দেখা হবেনা, তবু এই সব স্হানগুলি, খাবারগুলি, মানুষগুলি রয়ে যাবে স্মরণে; হয়তো আজও সাধারণ ভারতীয় জীবন এমনই; অতিথি বৎসল, আন্তরিক।
              
  ফিরে যাওয়ার আগে, বন্ধুবরের অনুরোধে, সবাই তাঁকে বিদায় জানাতে এলেন নদীতীরে। তখনও সন্ধ্যা হয়নি, শেষ আশ্বিনের আলো তার বিদায়বেলায়, বিপরীতমুখী দুই নদীসঙ্গমে, বিলায়েতী দক্ষতায় পুরিয়া-কল‍্যাণের সঙ্গে কোমল-নিষাদ মিলিয়ে এক অপুর্ব মূর্চ্ছনা সৃষ্টি করে চলেছে। গৈরিক সে রঙে তারুণ্যের উচ্ছলতা নেই, জৈবনিক ঐহিকতাও নেই, Wordsworth-এর Lucy Grey-এর মতো, অথবা, Shelly-এর  Skylark-এর  মতো মোহনাগামী মন যেন তার  পূর্ণতায় সম্পৃক্ত, প্রিয়-প্রতীক্ষায় হৃদয়-দ্বার তার খোলা; 'কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরণমালা'....

ধীরে ধীরে অন্ধকার নামে, পাখি ফেরে নীড়ে, আগামীকাল বাদে, তাঁদেরও বাড়ী ফেরার কথা; কতো কি দেখা হলো, কতো কি বাকি রয়ে গেল! কতজনকে কতো কি যেন বলার ছিলো, হয়তো বলা হোল না; হবেও না হয়তো কখনও। 'আর কি কখনও কবে,এমন সন্ধ্যা হবে…' এক অন্তহীন হাহাকার পরজের বিহ্বল মীড়ের মতো উপস্থিত সকলের মনে ডানা গুটিয়ে বসেছে, কখনও রসিকানন্দ মহারাজ, কখনও জগন্নাথ ধল, কখনও দিব‍্য সিংহ মান্ধাতা, কখনও কোন অনামী রাজকুমার হয়ে চিরতৃষার্ত আনন্দের মতো চিরায়মানা প্রকৃতির কাছে ফিরে ফিরে আসবে পুরুষ; যুগে যুগে ,কালে কালে। জীবনের পরম আনন্দিত বাণী শুনিয়ে যাবে বিদায়-বেলায়, 'পুনর্দর্শনায়'...
'পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন'; বিস্মরণের কুহেলিকা সরিয়ে মনে পড়বে হারিয়ে যাওয়া কোন প্রিয়মুখ, সেই শুভক্ষণে 'আকুল হৃদয়খানি সম্মুখে তার ছড়িয়ে ফেলো গো…'

চিত্র- লেখিকা
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. সবটাই সুন্দর... বর্ণনা, ভাষাপ্রয়োগ...রসবোধ... সব..

    ReplyDelete