জ্বলদর্চি

বাঘুইয়ের অনালোকিত রূপকথা-২/(উৎসব ১৪২৮)/ অমিত কুমার সাহু

বাঘুইয়ের অনালোকিত রূপকথা 
অমিত কুমার সাহু
পর্ব - ২ /


ভেলা-ডোঙা ও নৌকায় চড়ার গল্প :
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে একনাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হলে বন্যা হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। আর বাঘুই খালের অবস্থান বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে হলেও বন্যার জল উঠে আসতো বাড়ি থেকে ১০০ মিটারের কাছাকাছি। দাঁতন-২, নারায়ণগড় ও পটাশপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা বর্ষাকালে বন্যার সময় প্রায় দু কিমি শুধু জল আর জল। প্রাথমিকে ও মাধ্যমিকে পড়ার সময় দেখতাম গ্রীষ্মের পরিবর্তে আমাদের বর্ষাকালে ছুটি পড়তো। ফলে বন্যার জলে সাঁতার কাটা, ডিগবাজি খাওয়া, জলের মধ্যে সাঁতরে ও ডুব দিয়ে ধরাধরি খেলা, ভেলা-ডোঙা ও নৌকায় চড়া ইত্যাদি ছিল খুবই আনন্দের নৈমিত্তিক  ঘটনা। 

কলা গাছের ভেলা:  কলা গাছের নির্মিত অস্থায়ী জলযান হলো কলা গাছের ভেলা। আমাদের বাগান বাড়িতে প্রচুর কলার গাছ ছিল। কলাকাঁধি কাটার পরে কেউ থোড় খেতো না, ফলে ওই রকম তিন চারটি গাছকে কেটে কাদার উপর দিয়ে টেনেটেনে বন্যার জলের কাছাকাছি নিয়ে যেতাম। কলা গাছগুলিকে  ৫ ফুট মতো খাদি করে দুই প্রান্তে ও মাঝ বরাবর  সরু তরল বাঁশ কেটে খাদিগুলিকে পাশাপাশি রেখে গাছের এফোঁড় ওফোঁড় করে খিলা মেরে কলা ভেড়া বানাতাম। দু তিন জন চেপে ধজি বাঁশ মেরে বন্যায় ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়াতাম। সময়ের দিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। স্রোতের টান বেশি থাকার কারণে বাঘুইয়ের মূল খাল এড়িয়ে কাছেপিঠে মূলত মনোরঞ্জনের জন্যে বেড়ানো হতো। তবে দিন পনেরো মতো এই কলা গাছের ভেলা চলতো। তারপর কার্যকরিতা থাকতো না কারণ জলে থেকে থেকে কলাগাছগুলি পচে যেত ও ভার বাহন করার ক্ষমতা থাকতো না। আবার নতুন কলাগাছ কেটে ভেলা বানাতাম ; না জুটলে অগত্যা এক একটি কলাগাছকে ধরে ঢপাসী মেরে বা সাঁতরে ঘুরে বেড়াতাম এককথায় দুধের সাধ ঘোলে মিটাতাম। 

  
                  
 ডোঙায় চড়া :  ডোঙা হলো তাল গাছের নির্মিত জলযান। মাটির নিচ থেকে গুঁড়ি শুদ্দ তুলে ১২-১৫ ফুট দৈর্ঘ্যের খাদি করা হতো। গাছের উপরের অংশের কিছুটা কেটে মধ্যি খানের শাঁসকে অর্থাৎ ভিতরের নরম কাণ্ডকে  কুরিয়ে কুরিয়ে বের করে দেওয়া হতো দুই প্রান্তভাগ বদ্ধ থাকতো যাতে জল না ঢুকতে পারে। এলাকার ছুতোর মিস্ত্রিরা তাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে অবসর সময় বানাতো। একটি গাছ দিয়ে সিঙ্গল ডোঙা আবার দুটি ডোঙাকে বেঁধে ডাবল ডোঙার যান করা হতো। সিঙ্গল ডোঙা খুব ব্যালান্স করে বাইতে হতো কারণ যে কোনো মুহূর্তে কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার ভয় থাকতো। ডুবে গেলে অতল জলে ডুব দিয়ে দিয়ে পাড়ের দিকে টেনে টেনে এনে বিশেষ কায়দায় দোলা দিয়ে দিয়ে জল বের করতে হতো। আমাদের একটি ধান কুটা মেশিন ছিল। পাশাপাশি ৫/৬ টি গ্রামের মানুষজন ধান কুটার জন্যে আমাদের মেশিনে ধান নিয়ে আসতো। শশিন্দা ও বাবলা থেকে ডোঙা করে  কুটার জন্যে সেদ্ধ ধান নিয়ে আসতো। ডোঙাকে পাড়ে ঠেকিয়ে ডোঙার উপরে ধজিবাঁশ রেখে গাছে দড়ি বেঁধে রেখে আসতো। আমাদের মতো দুরন্ত কয়েকজন বন্ধু বঁড়শি আড়তে আড়তে ডোঙায় চাপার জন্যে সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকতাম। ডোঙাওয়ালারা চোখের আড়াল হলে গাছ থেকে দড়ি খুলে ডোঙা ও বাহানোর ধজি বাঁশ নিয়ে চম্পট দিতাম। ধান কুটার জন্যে ভিড় প্রচুর হতো তাই মাঝে মাঝে এক এক জন বন্ধুকে পাঠিয়ে দিতাম ডোঙাওয়ালার ধান কুটতে কতদূর বাকি আছে তা দেখার জন্যে। এটা ছিল পরের ডোঙা চুরি করে চড়া, যা খুবই  উৎকন্ঠার ও আনন্দদায়ক মুহূর্ত। বন্যার জল বেষ্টিত গ্রাম গুলিতে ডোঙাতে করে মাঝে মাঝে জনাচারেক লোক নিয়ে এগ্রাম থেকে ওগ্রামেও যাতায়াত করা হতো। ডোঙাতে তখনকার দিনে এক কিলোমিটার যাতায়াত করতে দশ পয়সা মতো খরচ পড়তো। 

 

নৌকায় চড়া -১ :  আমাদের গ্রামীণ এলাকায় তখন স্থলযান ছিল গরুরগাড়ি আর জলযান ছিল নৌকা। বর্ষাকালে বাঘুই খাল দিয়ে নৌকায় যাতায়াত  ও মাল পরিবহণ করা করা হতো। আমাদের পাড়ার একটি নৌকা, চকগোপালের ভূষণ বেরার ঘরে একটি, তাপিন্দা ও আড়গোয়াল থেকে একটি করে নৌকা বাঘুই খাল দিয়ে যাতায়াত করতো। উপরের দিকে খাকুড়দা আর নিচের দিকে বিশ্বনাথপুর ও নৈপুরের মাঝ বরাবর হয়ে কেলেঘাই পর্যন্ত। মূলত ধান নিয়ে যেতো বিক্রি করতে আর রবিবারে খাকুড়দা হাটে এক সপ্তাহের বাজার সামগ্রী আনতে যেত। বাঘুইতে নৌকা চলাচলের মতো জল থাকা অবস্থায় প্রতি সপ্তাহে শনিবার আমাদের এলাকা দিয়ে সকাল ১০ টা থেকে ১২ টার মধ্যে খাকুড়দা হাটে বিক্রি করার জন্যে ধান, পাট , মাদুর, মুগ, সরিষা, সবজি ইত্যাদি নিয়ে যেত। সন্ধ্যার পূর্বে খাকুড়দা নৌকা ঘাটে পৌঁছে যেত।  রাতে নৌকাওয়ালারা আঁচ কয়লার উনুনে রান্না করে নৌকার উপরে হোগলার তাঁবুতে রাত কাটাতো। পরের দিন রবিবারের হাটে ভোর ভোর সবাই এসে যে যার মালের পরিমাপ অনুযায়ী টাকা-পয়সা দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে যেত বিক্রি করার জন্যে। আবার  দুপুরের মধ্যে এক সপ্তাহের বাজার বস্তায় করে নৌকায় রেখে যেত। পরিবহণ করা হতো  আলু , সবজি, মশলা, নুন বস্তা, গুড় কুন্দা, সার ইত্যাদি। কার ঘরে কোন মাল কোথায় নামবে তা বলে নৌকায় রেখে যেত ও মালের পরিবহণ খরচ দিয়ে যেত। নৌকা ফেরার সময় গ্রামের মোড়ে মোড়ে খাল পাড়ে জোরে জোরে হাঁক দিয়ে মাল পত্র নামিয়ে দিয়ে যেত। তারপর যে যার মাল নৌকা- ঘাট থেকে নিয়ে যেত। আমাদের এলাকায় এলে হাঁক দিত বোস্টম ঘরে , সাহু ঘরে মাল আছে গো - লি যাও- গো- মাল , খাকুড়দানু মাল আসছে গো মাল।  শৈশবে আমরা নদীর পাশে পুকুর পাড়ে বসে নৌকা যাওয়া ও ফিরে আসার হিসাব করতাম। ফলে নৌকার যাতায়াতের খবরটা যথাস্থানে পৌঁছে দিতাম, বড়োরা তাতে খুশিও হতো। বাড়ির বারণকে উপেক্ষা করে কৈশোরের সীমাহীন উচ্ছ্বাসে পাড়ার  নৌকায় করে খাকুড়দা হাটে যাওয়া ও রাত্রিবাস করে পরের দিন ফিরে আসার অভিজ্ঞতা লেখকের একবার হয়েছিল।                                                                                       

নৌকায় চড়া -২ :  পাড়ার সবাই ব্যবসায়িক কাজে ও কৃষি কাজে প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ত থাকতো। প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমি থেকে ক্ষনিকের নিষ্কৃতি ও মনোরঞ্জনের জন্যে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে নৌকা বিহারে বেরিয়ে পড়তো। রাতে ক্ষুধা নিবারণের জন্যে সঙ্গে থাকতো ছোলা - মটর ভাজা মিশ্রিত  চালভাজা ও নারিকেল এবং জলের কলসি। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাতে ঘুরাঘুরি করে মাঝ রাতে ভাটি থেকে মাছ ঝেড়ে এনে বাড়িতে পৌঁছানো হতো। মাছ যাতে পচে নষ্ট না হয়ে যায় তাই রাতেই চলতো রান্নাবান্না  ও ভাজাভুজির কাজ। নদীতে প্রচুর মাছ পড়ার ফলে তেঁতুল দিয়ে বিভিন্ন মাছের টক বিভিন্ন হাঁড়িতে রান্না করে রাখা হতো। পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে রাতে নৌকা বিহারের ফলে বৌ-বাচ্চারা যেমন খুশি হতো তেমনি পারিবারিক মেলবন্ধন ঘটতো আর পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে একাত্মতা গড়ে উঠতো। 

নৌকায় চড়া -৩ : বাড়ি থেকে আমাদের হাই স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৩.৫ কিমি, হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। তবে  বর্ষাকালে কম জল থাকলে বাঁশ ভেড়া আর বন্যা হলে নৌকায় করে দেড় কিমি বাঘুই নদীর বন্যা পেরিয়ে আমাদের শশিন্দা স্কুলে যেতে হতো। বাঘুই খাল পার করানোর জন্যে স্কুল থেকে ঠিক করে দেওয়া আমাদের পাড়ার ও চকগোপালের বেরা ঘরের  দুটি নৌকা থাকতো। নিকটবর্তী দুটি গ্রামের পঞ্চম থেকে দশম শ্ৰেণীর ছেলে মেয়েরা যেত। সব মিলিয়ে জনা ৪০ মতো শিক্ষার্থী ছিল। মাঝে মাঝে নৌকো পাড়ে ঠেকার মুহূর্তে নোঙ্গর করার পূর্বে অনেকে পাড়ে ঝাঁপ দিতো। ফলে দোল খেতে খেতে নৌকা ডুবে যেত, যারা ভিজে যেত তাদের বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না। আবার স্কুল ছুটির পর ২ কিমি হেঁটে হেঁটে নদীর  পাড়ে এসে জোরে জোরে হাঁক দিতাম - স্কুল ছুটি হইছে -গো-ও-- নৌকা লি আইস -গো --  ও--- ও---- নৌকা। খুব ভোগ (ক্ষুধা ) লাগছে -গো-ভোগ, তাড়াতাড়ি নৌকা লিআইস - গো-ও নৌকাওয়ালা। কোলাহলহীন নদী নিস্তব্ধ জলরাশি ভেদ করে আমাদের খালি গলার হাঁক  এপার থেকে ওপারে প্রতিধ্বনিত হয়ে নিমেষে পৌঁছে যেত পাড়া প্রতিবেশী ও নৌকাওয়ালার কানে। কিছুক্ষণ পরে ওপারের লিলিপুটের মতো দেখা নৌকা ধীরে ধীরে পলকহীন নেত্রে ধরা দিতো। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঘাটে বাঁধা নৌকাকে নোঙ্গর  খুলে নিয়ে গিয়ে আমরা ধজি বাঁশ বেয়ে বেয়ে কাছে পিঠে ঘুরে বেড়াতাম।  নৌকা বানানো হতো মূলত শীত-বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে। দেখতাম  লম্বা-লগওয়ালা ৪০ ফুট মতো সরলা অর্জুনও বহড়া গাছকে কেটে খাদি করা হতো। হাতে টানা করাত দিয়ে গাছকাটা করাতি মিস্ত্রীরা তক্তা চিরত আর সুর করে করে তালে তালে গান গাইতো। এই লম্বা লম্বা তক্তাকে বড়ো বড়ো পেরেক মেরে মেরে কাঠামো তৈরী করতো নৌকা বানানো মিস্ত্রিরা। তারপর পিচ ও আলকাতরা মেরে সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করা হতো। নতুন বানানো নৌকা পুকুরের জলে ডুবিয়ে রাখা হতো। বন্যার সময় পাড়ার সবাই মিলে পুকুর থেকে তুলে কাদা মাটির উপর দিয়ে টেনে টেনে পুকুর পাড় পের্ করে বাঘুই খালে ফেলা হতো।  

আজ শৈশব পেরিয়ে আরও চার দশক অতিক্রান্ত হলো। শিক্ষা ও কর্মসূত্রে আমরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করি আর বয়সজনিত কারণে অনেকে মারাও গেছে । হাঁটু কাদা ঘেঁটে মেঠোপথের পরিবর্তে মোরাম - ঢালাই ও পীচ বিছানো পথে যাতায়াত হয়। বাঘুই খালের সংস্কার হয়েছে তাই বড়ো বন্যা খুব কম হয়। কাছাকাছি হাই স্কুল হয়েছে ফলে খাল পেরিয়ে শশিন্দা স্কুলেও আর যেতে হয়না।   বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আর মাছ ধরতে যায় না বললে চলে l ভেলা -ডোঙা ও নৌকা এখন  সময়ের ঘোরপাকে লুপ্তপ্রায়। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বাঘুই পাড়ে বসে দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ দেখতে দেখতে সোনালী স্মৃতি রোমন্থন করি আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভাবি সময় তুমি বড়োই নির্মম ও গতিশীল।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments