জ্বলদর্চি

বাঘুইয়ের অনালোকিত রূপকথা/(উৎসব ১৪২৮)/ পর্ব -১/ অমিত কুমার সাহু

বাঘুইয়ের অনালোকিত রূপকথা : 

 পর্ব -১/   
অমিত কুমার সাহু



 
 


প্রায় পাঁচ পুরুষ ধরে ব্যবসায়িক সূত্রে আমাদের বসবাস বাঘুই  খাল (নদীর) পাড়ের অনতিদূরে অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থানার একেবারে পশ্চিম সীমান্তে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন-২ ও নারায়ণগড় ব্লক লাগোয়া আলমচক বেলদা গ্রামে। বর্ষাকালে ভয়ানক বন্যা ও খরস্রোতের কারণে এই নদী হিংস্র বাঘের ন্যায় রূপ ধারণ করে বলেই সম্ভবত বাঘুইয়ের এরকম নামকরণ। অন্যমতে বাঘুই খাল বরাবর ঘন জঙ্গলে কয়েক পুরুষ আগে বাঘ বাস করতো তাই বাঘ থেকে বাঘুইয়ের নামকরণ হয়েছে। শৈশবে বড়দের কাছে এই নদীকে কেন্দ্র করে শুনেছি কত রূপকথার গল্প। বাঘুই খালে বন্যার জলে ভেলা , ডোঙা ও নৌকা চড়ার  গল্প , মাছ ধরার গল্প ; গভীর রাতে নদী ঘাটের নৌকো খুলে নিয়ে চোরেদের চুরি করতে যাওয়ার গল্প , অমাবস্যার নিশুতি রাতে শ্মশানে ভূতের আলো কিংবা ভূতের সঙ্গে মানুষে সেঁনিতে জল বাহানোর গল্প,মাথাহীন লম্বা ক্ষমতাশালী পুরষা ভূত , বাঁশ গাছের বাঁদর ভূত,  বাঘুইতে জোৎসনা রাতে নৌকা বিহারসহ হাজারো গল্প।

 ধীরে ধীরে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি গল্পের রূপকথার ছোঁয়া ফিরে পাই বাস্তবিক জীবনে। নিজের বাড়ি সাহু পাড়াতে , আর নিকটবর্তী বেরা পাড়া , দাস পাড়া , পালেদেরও বাড়ি হলো বাঘুইয়ের কাছে। বাঘুইয়ের উৎস পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি ব্লকের ৯ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের জনবসতিহীনকরাট (৩৪৩) মৌজার জমিতে। মূলত বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে উত্তরে দাঁতন-১ ও নারায়ণগড় ব্লকের মধ্যে দিয়ে উত্তর পূর্ব বাহিনী গতিপথ ধরে দাঁতন-২ ব্লকের খাকুড়দা - ধনেশ্বরপুরে দীঘাগামী রাস্তার ব্রিজের তলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বামদিকে নারায়ণগড়ের গহিরা-শশিন্দা ও ডানদিকে দাঁতন-২ ব্লকের শেষ সীমা বাবলা গ্রামের মধ্য  দিয়ে পটাশপুর থানার পশ্চিম সীমানা বরাবর ডাইনে পাদিমা ও আলমচক বেলদাকে রেখে পটাশপুর-১ ব্লকের বিশ্বনাথপুরে প্রবেশ করেছে। ওখান থেকে সবং ব্লকের বারচৌকান বেসিনের কোপ্তিপুরে 'U' আকার ধারণ করে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে আয়মা বড়বড়িয়া দিয়ে গোকুলপুরের কাছে কেলেঘাই নদীতে মিলিত হয়েছে। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত বাঘুই  নদীর মোট গতিপথ প্রায় ৪২ কিমি। প্রকৃতপক্ষে বাঘুই হলো কেলেঘাইয়ের একটি উপনদী। মাঝে মাঝে বাঘুই খালের হড়কা বানে  ডুবে যাওয়া বেনা , কুমলা , খাড়ির বন জঙ্গল থেকে ভেসে আসতো বিষধর সাপ , নেউল , বুনো শেয়াল। দেখতে দেখতে বছর চল্লিশ অতিক্রান্ত হলো , স্মৃতিপটে গাঁথা বাঘুয়ের অনালোকিত রূপকথার গল্প বাস্তবে ছোঁয়ার জন্যে সাঁতার কাটি মনাসাগরে।  


মাছ ধারার গল্প :
প্রতি বছর বর্ষাকালে বাঘুই খালের দুপাড় বেয়ে বন্যা হতো। বন্যাতে বহু মানুষের পুকুর ভেসে মাছ যেমন আসতো তেমনি প্রায় ১৭ কি.মি. দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত কেলেঘাই থেকেও প্রচুর মাছ সাঁতরে সাঁতরে বাঘুই খালে আসতো। মাছ ধরার জন্যে  পাড়া-প্রতিবেশীরা অবসর সময়ে বাড়িতে বসে মাছ ধরার বিভিন্ন ধরনের উপকরণ অর্থাৎ জাল, পাটা, ঘনুই , ভাটা, মুগরী, চাড়ুয়া, খুঁনচি ইত্যাদি উপকরণ বানাতো। প্রতিবেশীদের নিয়ে মাছ ধরার একটি টিম থাকতো তার নেতৃত্ব দিতো নিরঞ্জন সাহু ও  ক্ষুদিরাম পাল আর অজয়দা , অসিতদা, মৃত্যুঞ্জয়দা , সুভাষদা,বদলদাসহ পাড়া প্রতিবেশী দাদারা। বর্ষার শুরুতে সদর পুকুরের পাড় থেকে ফারসি কোদাল (পাতি কোদাল) দিয়ে এক কিলোমিটার মতো নালা কেটে বাড়তি জল বাঘুইতে ফেলা হতো গোধূলি লগ্ন থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত। পুকুরপাড়ের ঘাইকাটা মহলে পাটা মারা থাকতো যাতে পুকুরের মাছ নদীতে যেতে না পারে আর  নদী থেকে মাছ উঠে এসে পাটাতে আটকে যেত। নতুন জলে প্রজননের আশায় পেটে ডিম ভর্তি পুঁটি, কই, পাবদা, ট্যাংরা, পাঁকাল, বাঙ,  ল্যাটা, চিংড়ি, নয়না সহ অনেক ধরনের মাছ স্রোতের বিপরীতে উঠে আসতো। আধ ঘন্টা খানিক পরে নদীতে পড়া জলের খানিক উপরে পাটা মারা হতো এবং পুকুর পাড়ের ঘাইতে মাটি দিয়ে জল বন্ধ করা হতো। ফলে নালার মধ্যে আটকে যাওয়া মাছগুলোকে সবাই মিলে টর্চ ,হেরিকেন , ডিম্ লাইট ,লম্ফ ইত্যাদি দিয়ে ধরা হতো। এই ভাবে একদিনে তিন চারবার চলতো মাছ ধরা। একে উজান মাছ ধরা বলা হতো। পুকুর থেকে উজানে কই মাছ ধরার গল্প তো লিখে শেষ করা যাবে না। 

আষাঢ় থেকে ভাদ্র বন্যার সময় বাঘুই খালে বড়ো বড়ো মাছ ধরা হতো। মূল খালের মাঝখানে বাঁশ ভেড়ার মতো  বড়ো বড়ো বাঁশ ও খুঁটি দিয়ে জলের লেভেলের কিছুটা উপরে বাঁশের পাড় বাঁধা হতো। বাঁশের পাড় থেকে বড়ো ফাঁসওয়ালা জাল পাতা হতো। বাঁশের  পাড় থেকে পাঁক মাটি পর্যন্ত জালটিকে টানটান করে ১০ ফুট মতো জলের নিচে ডুব দিয়ে দিয়ে পাঁকের সঙ্গে খিল মারা হতো, যাতে মাছ  ফাঁক পেয়ে উপরে উঠতে না পারে। আর স্রোতের বিপরীত দিকে বাঁশের পাড় থেকে জলের উপরে  জালকে ঝুলিয়ে রাখা হতো। ফলে স্রোতের বিপরীতে  রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল ইত্যাদি  সাঁতরে আসা মাছ জালে ধাক্কা দিয়ে বাধা পেয়ে লাফ দিয়ে পেরোতে চাইতো আর ঝুলানো জালে গিয়ে আটকে যেত। একেই সম্ভবত শিষ্ট বাংলায় মায়াজাল বলে। নদীর পাড়ে এক কোমর জল থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে খুঁটি দিয়ে বানানো খড়ের কুঁড়ে ঘরের আস্তানাতে মাছ ধরতে যাওয়া পাড়ার সবাইকে চুপটি করে বসে-শুয়ে - তাস খেলে জেগে কাটাতে হতো। মাঝে মাঝে জালে আটকে যাওয়া মাছের শব্দ পেলে কোমরে দড়ি বেঁধে পলিথিনের বস্তা নিয়ে আমি, সঞ্জয়, দেবু ও মধুর মতো কম ওজনের দুরন্ত  কিশোররা বাঁশের পাড়ে পাড়ে ব্যালান্স করে গিয়ে মাছেদের পাকড়াও করতাম । তারপর মাছেদের বস্তাবন্দী করে মুখ বাঁধা বস্তা জলে ভাসিয়ে দিতাম আর কুঁড়ে ঘরে থাকা অন্যরা দড়ির অপর খুঁট ধরে টেনে টেনে কুঁড়ে ঘরের খুঁটিতে বস্তা বেঁধে রাখতো। সকাল হলে সবাই মিলে মাছ গুলোকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাগাভাগি করা হতো। একদিন একটি বড়ো মাছকে রাতের অন্ধকারে বস্তাবন্দী করেছিলাম। সকালে ভাগ বাঁটোয়ারা করার সময় দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখা গেলো ১৩ কিলো ওজনের বোয়াল মাছ । ভাগ্যিস বস্তা পেতে ধরেছিলাম বলে সে যাত্রায় অক্ষত ছিলাম। হাতে ধরলে হয়তো বোয়ালের পেটে  হাতের অর্ধাংশ চলে যেত, আর কাটা হাতে রক্ত ক্ষরণে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল কারণ একে জলকাদাপূর্ণ রাস্তা ও গভীর রাত্রি, তারপর ওখান থেকে  অচল চিকিৎসা কেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ১৩ কি.মি.। দাদার সাথে বাঘুই খালে বোয়াল মাছ ধরার জন্যে বাঙ অথবা কই মাছকে কাঁটায় গেঁথে এক গলা জলে বঁড়শি পুঁততে যেতাম। আবার চিংড়া মাছ ধরার জন্যে সুগন্ধি চারা বানিয়ে ফিকা জাল ফেলতাম। চিংড়ি মাছের প্রিয় খাবারের চারা বানানো হতো মূলত খড়ে পুড়ানো কুঁড়ো -গরুর খাবারের তাড়ের উচ্ছিষ্ট - কাঁচা গোবর - পচাভাত বা পান্তা , মাদুরকন্ঠির সুগন্ধি মূলের ছেঁচা আর ভাতের ফেন ইত্যাদিকে চটকে বড়ো বড়ো গোলা তৈরী করা হতো।  গোলাগুলিকে বাঘুইতে বিশ হাত অন্তর অন্তর ফেলে পাটকাঠি পুঁতে পুঁতে নিশানা রেখে রেখে গোটা দশেক চারা ফেলা হতো। তারপর প্রথম চারার কাছ থেকে হাতে ফেলা জাল ফেলে ফেলে চিংড়া মাছ ধরা হতো। আর বন্যা কমলে বাঘুইয়ের নিকটবর্তী চাষের জমির আল কেটে ঘনুই , ভাটা , আরুন খালা ও চাড়ুয়াতে মাছ ধরা হতো।

   
 আশ্বিন - কার্তিক মাসে বাঘুইতে এক গলা পর্যন্ত জল থাকতো, ফলে মাঝখানে ফুট দশেক জল যাওয়ার পথ রেখে দুদিক প্রায় ১৫ ফুট মতো মাটির বাঁধ করা  হতো। প্রত্যেকের বাড়ি থেকে ঝুড়ি, কোদাল, বাঁশ  নিয়ে যাওয়া হতো। বাঁশ ফাটিয়ে বাতা করে তাঠিয়া করে খুঁটি দিয়ে দুদিক ১৫ ফুট করে ঘিরে ফেলা হতো। দুজন মাটি কাটতো বাকি ৬/৭ জন মাটি ভর্তি ঝুড়ি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বাতায় ঘিরে রাখা মাঝখানে মাটি ফেলে বাঁধ করা হতো । 

  মাঝ খানে ফাঁকা দশ ফুট জায়গায় জল যেত। দুপ্রান্তে ঘিরে রাখার ফলের জলের তোড় অর্থাৎ স্রোত প্রবল হতো। তার দু প্রান্তে কাঁচা বাঁশের  শক্ত খুঁটি মেরে ঘাই জাল মারা হতো। জালের দৈর্ঘ্যও প্রায় ২০ ফুট মতো হতো। জালের সাইজ শঙ্কু আকৃতির হতো এবং শেষ প্রান্তে বাঁশের সরু কাঁঠি দিয়ে বানানো খুঁনচি বাঁধা হতো তাতেই স্রোতের টানে জালে পড়া মাছ গিয়ে জমা হতো। মাঝ রাতে সাঁতরে গিয়ে খুঁনচি  ঝেড়ে ঝেড়ে মাছ বালতি ও বস্তাতে জমা করে রাখা হতো। সকালে পাড়াতে নিয়ে  এসে  ভাগাভাগি করা হতো। 

 মাঝে মাঝে জালে কুকুর, বুনো শিয়াল ও সাপ  স্রোতের টানে ঘাইজালে ঢুকে গিয়ে মারা পড়তো ফলে সে সব মাছ ফেলে দেওয়া হতো। ছোট বেলা শুনেছি যেখানে ঘাই জাল মারা হতো তার কিছুটা উপর দিয়ে গরু ও বাঘ  সাঁতরে পেরোবার সময় স্রোতটার টানে জালে পড়ে মারা গেছিলো। দুদিকের খুঁটি থেকে দুপাটি জালের ফুট সাতেক হাঁ একটি মাটির সঙ্গে জলের তলায় অপর পাটি জলের উপরে থাকতো। নিচের মাছ ধরার জন্যে গালি কিছুটা ফাঁকা রাখা হতো ফলে খালের উপরের মাছ ও নিচের মাছ জালে পড়তো। খুব সতর্ক ভাবে জাল মারতে হতো একটু এদিক ওদিক হলেই একেবারেই স্রোতের টানে জালের ভেতরে পড়ে মৃত্যু অনিবার্য্য। গতবছর গ্রামের বাড়ি গিয়ে শুনলাম কাছের গ্রাম চকগোপালের বেরা ঘরের ৩২ বছরের এক বিবাহিত দু সন্তানের বাবা ঘাই  জালে পড়ে মারা গেছে । সেই সব দুঃসাহসিক অভিযানের কথা ভাবলে মনে শিহরণ জাগে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. দুটি আর্টিকেল পড়লাম। লেখক বাঘুই এর করিডোর ধরে হেঁটে তুলে এনেছেন অতীত স্মৃতি। লেখকের ঠিকানা কোথায় ও পেলাম না।

    ReplyDelete