জ্বলদর্চি

আবদুলরাজক গুরনাহ -এক উদ্বাস্তুর প্রতিবাদী লেখনী/সজল কুমার মাইতি

আবদুলরাজক গুরনাহ
এক উদ্বাস্তুর প্রতিবাদী লেখনী

সজল কুমার মাইতি

আবদুলরাজক গুরনাহ এই বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের সাহিত্যের নোবেল পদকজয়ী। গুরনাহের জন্ম ১৯৪৮ সালে। আফ্রিকা মহাদেশের তাঞ্জানিয়া রাষ্ট্রের জাঞ্জিবর নামক এক সুন্দর দ্বীপে জন্ম। এই দ্বীপে ছোটোবেলা কেটেছে গুরনাহের। ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ জাঞ্জিবর একটি মহানগর। এই দ্বীপেই গুরনাহের বেড়ে ওঠা। কিন্তু ভাগ্যের কালচক্রে উনিশ শতকের ষাটের দশকের শেষভাগে জন্মভূমি চ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে ইংল্যাণ্ডে আসতে বাধ্য হন গুনরাহ। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এই জাঞ্জিবর দ্বীপ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীন হয়। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র একসময় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কেন্দ্র ছিল। বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি যেমন - পর্তুগীজ, আরব, জার্মান ও ব্রিটিশদের বিভিন্ন রকমের অত্যাচারের সাক্ষী থেকেছেষএই দ্বীপ। এই দ্বীপরাষ্ট্র জাঞ্জিবর সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্যে বহুকাল থেকে যুক্ত। দাস ব্যবসা ও ঐতিহাসিকভাবে এই রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত। এই জাঞ্জিবর গ্লোবাইলেজশনের আগে ও এক বিশ্বজনীন সমাজের অংশ ছিল। এই স্বাধীন দ্বীপের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন আবেদ আমিনি কুমাশে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই রাষ্ট্রপতির রাজত্বে আরব দেশীয় নাগরিকদের ওপর অত্যাচার, হানাহানি ও বিতাড়ন শুরু হয়ে যায়। গুরনাহ এই ধর্মীয় গ্রুপের অনর্ভুক্ত হওয়ায় অত্যাচারের শিকার হয় এবং স্কুল শিক্ষা শেষ করে আঠের বছর বয়সে নিজের পরিবার ও দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরমধ্যে এই দ্বীপ নব গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম তাঞ্জানিয়া রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

  নির্বাসিত জীবনে গুরনাহ বহুকষ্টে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান। এই অবস্থায় গুরনাহ তার লেখালেখিতে হাত পাকাতে থাকেন। ইংল্যাণ্ডে উদ্বাস্তু অবস্থায় একুশ বছর বয়সে গুরনাহের লেখক জীবনের শুরু। যদিও গুরনাহের মাতৃ ভাষা স্বহিলি; ইংরেজি তার সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে গুরনাহ শেক্সপিয়র ও ভি এস নাইপলের লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি ক্যান্টারবেরির কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। অবসরের সময় পয্যর্ন্ত গুরনাহ এই পদে কাজ করে গেছেন। এই সময়ে তিনি মূলত ওলে সোয়েঙ্কা, নুইগি ওয়া থিয়ঙ্গ ও সলমন রুশদির লেখা নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আলোচনা করতেন। 
  গুরনাহের লেখা দশটি উপন্যাস ও কিছু ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখার মধ্যে উদ্বাস্তু জীবনের উথাল পাথালের ঘটনাই মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। এই সকল লেখা তার মাতৃ ভাষা স্বহিলিতে নয়, এই লেখাগুলি তার সাহিত্যের ভাষা ইংরেজিতে লেখা। যদিও তার জীবনের শুরুর লেখাকে সাহিত্য বলা যাবে কিনা সে প্রশ্ন থাকতে পারে। আরবি ও পার্সি কবিতা, আরব্য রজনী ও কুরআনের সুরা - এইগুলি সাহিত্যের পর্যায় পড়ে কিনা তা পাঠকের বিচার্য। গুরনাহ তার লেখায় ইংরেজি সাহিত্যের প্রচলিত প্রথা থেকে সরে এসে আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার লেখায় গুরনাহ বারে বারে চেষ্টা করেছেন প্রাক ঔপনিবেশিক আফ্রিকার নস্টালজিক স্মৃতি পরিহার করার চেষ্টা করতেন। তার লেখায় গুরনাহের নির্বাসিত জীবনের কথা, উদ্বাস্তু জীবনের কথা এবং যে জায়গা তিনি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই স্মৃতি কথা ও তার লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে। 

  গুরনাহের প্রথম উপন্যাস ' মেমরি অফ ডিপার্চার' ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। তারপর একে একে তার অন্য উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়। ১৯৮৮ সালে ' পিলগ্রিমস ওয়ে ', ১৯৯০ সালে ' ডোট্টি ', ১৯৯৪ সালে ' প্যারাডাইস', ও ১৯৯৬ সালে ' অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স ' উপন্যাসগুলি প্রকাশ পায়। গুরনাহের এইসব উপন্যাসগুলির মধ্যে তার নির্বাসিত উদ্বাস্তু জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা ভেসে উঠেছে। তার লেখনী যেন এক প্রতিবাদীর লেখনী যা শুধু তার নিজের উদ্বাস্তু জীবন, নির্বাসিত জীবনের অন্ধকারময় দিকগুলি তুলে ধরেনি;  এই লেখনী হাজার হাজার উদ্বাস্তুর বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছে। এ যেন এক রাষ্ট্র, এক মহাদেশের কথা নয়। এ সারা বিশ্বের অগনিত বঞ্চিত, দরিদ্র, অসহায় মানুষের আর্তনাদ। তারা গুরনাহের উপন্যাসের মাধ্যমে নিজেদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে। এছাড়াও গুরনাহের অন্য উপন্যাসগুলি হল - ' বাই দ্য সি ' ( ২০০১), ' ডেজারশন ' (২০০৫), ' দ্য লাস্ট গিফট ' ( ২০১১), ' গ্রেভেল হার্ট ' (২০১৭), ' আফটার লাইভস ' (২০২০)। এছাড়াও গুরনাহের লেখা কিছু ছোট গল্প ও আছে।

  গুরনাহের লেখার মূল বৈশিষ্ট্য হল সত্যের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ও সরলীকরনের প্রতি অনীহা। এই বিষয়ে তিনি কোনরূপ সমঝতার পক্ষপাতী নন। একই সঙ্গে তিনি প্রতিটি ব্যক্তির ভাগ্য নিজের গভীর আবেগের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন, কিন্তু নিজের কমিটমেন্টের বিষয়ে কখনও নতিশিকার করতেন না। তার উপন্যাসগুলি চিরাচরিত বর্ননামূলক যেমন ছিল, তেমন পূর্ব আফ্রিকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় জীবনের মধ্যে বিচরন কোরতো। এই বৈচিত্র্যের কাহিনি বিশ্বের অন্য প্রান্তের লোকজনের কাছে এতদিন অজানা ছিল। গুরনাহের সাহিত্যকৃতির বিশ্ব সদা পরিবতনশীলতা - সে  স্মৃতি, নাম, কিংবা কাহিনীর চরিত্রের পরিচিতি হোক। গুনরাহের সৃষ্টি সম্ভবত সুনির্দিষ্ট কোন সম্পূর্নতা প্রাপ্তির পথ অবলম্বন করে না। তার প্রতিটি লেখা এক অন্তহীন অন্বেষণ, যার ছত্রে ছত্রে উপস্থিত বৌদ্ধিক আবেগের স্পর্শ। গুরনাহের লেখার এই বৈশিষ্ট্যই নোবেল কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। নোবেল কমিটি সেই বৈশিষ্ট্যের পরিচিতি সারা বিশ্বের সঙ্গে করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। সেই স্বীকৃতির প্রাপ্তি এই নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার। নোবেল কমিটি আমাদের সামনে বিশ্বের উদ্বাস্তুদের নির্বাসিত জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার কিছু জলছবির স্বাদগ্রহনের সুযোগ করে দিয়েছেন গুরনাহকে এই পুরষ্কার প্রদানের মাধ্যমে। এতদিন আড়ালে থাকা এই সাহিত্য চর্চা শুরু করা যাক।

তথ্যসূত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগ।
..........
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments