জ্বলদর্চি

কালিমান্তান (বোর্ণিও)-র লোকগল্প (সবজান্তা চিংড়ির সর্বনাশ)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—কালিমান্তান (বোর্ণিও

চিন্ময় দাশ 


সবজান্তা চিংড়ির সর্বনাশ

সমুদ্রে ঘেরা দেশ বোর্ণিও। যেদিকে তাকাও, শুধু জল আর জল। সেই জলের মাঝে ছড়ানো ছিটানো টুকরো-টাকরা সব দ্বীপ। বোর্ণিও দ্বীপটা অবশ্য বেশ বড়সড়। এখন তো এই দ্বীপের পূবদিকটা মালয়েশিয়া, আর দক্ষিণ ইন্দোনেশিয়ার অধিকারে আছে। 
কিন্তু আমাদের আজকের এই গল্প, এইসব দখলদারির বহু বহু কাল আগের কথা। বোর্ণিওর উত্তরে আছে দক্ষিণ চীন সাগর আর দক্ষিণে জাভা সাগর। বোর্ণিওর সেন্ট্রাল কালিমান্তান রাজ্যটা এই জাভা সাগর ঘেঁষা। কালিমান্তানের একেবারে দক্ষিণের অংশে আছে সেবাঙ্গাউ ন্যাশনাল পার্ক। মনে হবে যেন, জাভা সাগর ফুঁড়ে উঠে এসেছে ঘণ জঙ্গলটা। 

একবার হয়েছিল কী, ভয়াণক আগুন লেগে গিয়েছিল জঙ্গলে। বনের কত প্রাণী যে পুড়ে মরেছিল সেই দাবানলে, তার কোন  লেখাজোখা নাই। কিছু পুড়ে মরেছে, কিছু প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল উত্তরের পাহাড়মুখো হয়ে। সে ভারী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। 
পোড়া ছাই ছাড়া, গাছপালা নাই বিশাল এলাকা জুড়ে। নাই কোন জীবজন্তু। শূণ্য খাঁ-খাঁ প্রান্তর, দিগন্তরেখা পর্যন্ত ছড়ানো। চোখ পড়লেই বুক ফেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখে ভারি মজা হোল সমুদ্রের মাছেদের। হাজার হাজার রকমের মাছ জলে।

ভোলা মাছ হোল কিনারা এলাকার মাছেদের মোড়ল। সবাই বেশ মান্যি-গণ্যি করে তাকে। একদিন একটা সভা ডাকল সে।
ভোলা বলল—বনটা তো পুড়ে খাক হয়ে গেছে। ঝোপঝাড় তো দূরের কথা, বড় বড় গাছগুলোও সব সাফ। ফাঁকা জমিতে আমরা খেত-খামার বানাতে পারি না? 
এমন কথা কোন মাছ কবে শুনেছে? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সবাই। বিষয়টা যে কারও মগজে ঢোকেনি, বেশ বুঝতে পারল ভোলা। 
সে খোলসা করে বুঝিয়ে বলল—গাছপালা নাই। নাই কোন জীবজন্তুও। হাতি বলো, কি মহিষ, খরগোশ কেউ নাই যে খেতের ফসল নষ্ট করে দেবে। গর্তের ইন্দুরও নাই একটা। সব মরে ভূত। ফলে, ফসলের ক্ষতি হবে সে ভয় নাই। খামার গড়তে বাধা কীসের? 
মোট কথা সবাই রাজী হয়ে গেল। যা হোক, নতুন একটা কিছু তো করা যাবে। সেটাও কম আনন্দের কথা নাকি? 
মোড়ল তো ভারি খুশী। সে কাজের ধারা কী হবে, বুঝিয়ে বলে দিল সবাইকে। যৌথ খামার হবে না। আলাদা আলাদা খেত গড়া হবে সকলের। একদিনে একজনেরই খেত তৈরি হবে। সবাই একসাথে মিলে, খেতটা তৈরি করে দেবে। যার খেত, সেদিন তাকে কাজে লাগতে হবে না। সে ঘরে থেকে, সকলের খাবার তৈরি করবে। দিনের শেষে ফিরে, সবাই যেন পেট ভরে খেতে পায়, সেটাই তার দায়িত্ব। 

প্রথম দিন কাচনি মাছের জমি তৈরি হবে। তার তো আনন্দ ধরে না যেন। এমনিতেই কাচনির রঙ ধবধবে রূপোর মতো। আহ্লাদে সে রঙ যেন আরও জ্বলে উঠল। 
মোড়ল হওয়ার অনেক ঝক্কি। কেবল খবরদারি করলেই চলে না। সব দিকে নজর রাখতে হয় তাকে। ভোলা কাচনিকে ডেকে বলল—কাজে তো যাচ্ছি সবাই। কিন্তু তুমি রান্নার কিছু জানো তো? 
--সে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না,মোড়ল। তোমরা যখন মাটি তৈরি করবে, আমি খাবার বানিয়ে রাখব। নিশ্চিন্তে যাও। উপাদেয় খাবারই পাবে তোমরা।
সবাই মাঠে এসে হাজির হোল। কেউ গর্ত খুঁড়ছে ছুঁচালো লাঠি দিয়ে। কেউ বীজ পুঁতে দিচ্ছে একটা একটা করে। সমুদ্র থেকে জল বয়ে আনছে কেউ। গর্ত খোঁড়া, বীজ পোঁতা, জল ঢালা—এভাবেই কাজ করে যেতে লাগল সকলে। 

এদিকে কাচনি রান্নার উদ্যোগ নিয়েছে। উনুন খুঁড়ে বড় কড়াই চাপিয়েছে তাতে। জল ঢেলে, প্রথমে চাল দিল পরিমাণ মতো। কিছু সবজী দিয়ে দিল কুচ-কুচ করে কেটে। কড়াইর দিকে তাকিয়ে মনে ভাবতে লাগল, তেমন সুস্বাদু হবে কী এটা। কত ঘাম ঝরিয়ে আসবে সবাই। নিজেও বড় মুখ করে বলেছে সবাইকে। উপাদেয় খাবার দেবে তাদের। 

কী করা যায়, কী করা যায়! ভাবতে ভাবতে একটা উপায় এল মাথায়। টুক করে ছোট্ট একটা লাফ। গিয়ে পড়ল উনুনে বসানো কড়াইতে। কড়াই ভর্তি জল। তাতে সাঁতার কেটে বেড়াতে লাগল কাচনি।
সাঁতার কাটবে বলে কড়াইতে লাফায়নি সে। কতক্ষণ সাঁতার কেটে, ডিম পেড়ে ফেলল পেট থেকে। জলে ডিম ভাসতে দেখল যখন, লাফ দিয়ে কড়াই থেকে নেমে এল। খুশি মনে আগুন জ্বেলে দিল উনুনে। 
খানিক বাদেই রান্নার সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল। বাতাস বয়ে যাচ্ছে খেতের জমির উপর দিয়ে। কাজ ছেড়ে, বাতাসে নাক টানতে লাগল মাছেরা। বেশ বুঝতে পারল, রান্না তৈরি হয়ে গিয়েছে। 
তড়িঘড়ি করে খেত থেকে ফিরে এল সবাই। খেতে বসে সে কী ফূর্তি! এত সুস্বাদু রান্না করবে কাচনি, ভাবতেই পারেনি কেউ। চেটেপুটে খেল সকলে। সত্যিই ভারি উপাদেয় হয়েছে খাবারটা। 

সবাই বলতে লাগল—কীভাবে রান্নাটা করলে, বল না গো।
কাচনির মুখে মিষ্টি হাসি—তা আমি বলছি না। সেটা গোপনই থাক।
সেদিনের মত চলে গেল সকলে। কিন্তু খানিক বাদেই একটা মাছ ফিরে এল চুপিচুপি। সে হোল কামিনা মাছ। সেও দেখতে ভারি সুন্দর। একেবারে কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ তার। দেখতে যেমন, তেমনই মিষ্টি তার স্বভাবও। 
সে এসে ধরে পড়ল কাচনিকে— মোড়ল বলল, আগামীকাল আমার জমিতে কাজ হবে। বলো না গো, কী করে এমন সুন্দর রান্নাটা করতে হয়। 
কাচনি তাকে সুন্দরটি করে সব বুঝিয়ে দিল। কড়াইর জলে চাল আর সবজী ফেলে, কীভাবে নিজে সেই কড়াইতে লাফিয়ে নেমে গিয়েছিল। সাঁতার কাটার পর ডিম পেড়ে নেমে এসে, আগুন জ্বেলেছিল উনুনে।
পরদিন সবাই এসে জড়ো হয়েছে কামিনার জমিতে। কামিনা তাদের বলল—মোড়ল এবং তোমাদের সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। আজ আমার জমি তৈরি করে দেবে তোমরা। এ আমার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। দুপুরে কাজ সেরে এসো। আমিও চেষ্টা করব তোমাদের জন্য উপাদেয় খাবার বানিয়ে রাখবার। 

মোড়ল বলল—কামিনা, তুমি পারবে তো রান্না করতে?  
 কামিনার মুখে হাসি—দ্যাখোই না, পারি কি না। উপযুক্ত খাবারই পাবে সবাই। আগাম বলে রাখলাম।
সবাই চলে গেলে, উনুনে কড়াই চাপাল কামিনা। জল ঢালল। চাল, সবজী দিয়ে দিল কড়াইতে। তার পর, কাচনি যেমনটি বলেছিল, ঠিক তেমনি করে ছোট্ট একটা লাফ। সোজা কড়াইতে পড়ে সাঁতার কাটতে লাগল সে। খানিক বাদে অনেকখানি ডিম পেড়ে, নেমে এল কড়াই থেকে। আগুন জ্বেলে দিল উনুনে। 
সেদিনও ভারি সুস্বাদু হয়েছে রান্নাটা। বেশ তৃপ্তি করেই খেল সবাই। সবাই জানতে চাইল—কী করে হোল গো এমন সুন্দর রান্না। 
কামিনার মুখেও সেই হাসি—ওটা গোপনই থাক। 
পরদিন কাজ হবে টাকচাঁদা মাছের জমিতে। সে এসে কামিনাকে ধরে পড়ল—এতজনের খাওয়া। রহস্যটা একটু বলে দাও, ভাই। 

টাকচাঁদাও মন্দ লোক নয়। তাছাড়া, দেখতেও বেশ সুন্দর। বিশেষ করে পাখনাগুলো। কেউ যেন কমলা রঙে ডুবিয়ে দিয়েছে তার পাখনাগুলোকে। কামিনা তাকে শিখিয়ে দিল, কী করে রান্নাটা করতে হবে। 
এইভাবে চলতে রইল। যেদিন যার পালা, সে এসে আগের দিনের মাছের কাছে রন্নার পদ্ধতি শিখে যায়। 
দেখতে দেখতে কাজ প্রায় শেষ হয়ে এল। একেবারে শেষের দিনে এল চিংড়ির পালা। আসলে হয়েছে কী, চিংড়িকে মাছ বলে গ্রাহ্যই করে না কেউ। সবারই একটাই কথা, চিংড়ি আবার মাছ কিসের? ও তো আসলে একটা পোকা। কী বেঢপ চেহারা। সরু ল্যাগবেগে কতগুলো লম্বা লম্বা ঠ্যাং। সামনে বড় বড় দুখানা দাঁড়া। এক্কেবারে সাঁড়াশি যেন। আর, চোখ দুটো? সে দুটো তো ওপর-নীচে ওঠানামা করে। ঘুরপাকও খায়। কী বিচ্ছিরী, কী বিচ্ছিরী!

চিংড়ির খেতে সবাই জড়ো হয়েছে। কিন্তু চিংড়ির কোন হেলদোল নাই। কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব। বিশেষ করে রান্নার ব্যাপারটাতে কোন কৌতুহলই নাই তার। 
অগত্যা মোড়ল নিজেই জিজ্ঞেস করল—কীহে, রান্নার কিছু জানো তো? না কি শিখে নেবে কারুর কাছে? 
চিংড়ির সব সময় একটা সবজান্তা ভাব। দুনিয়ার কারও কাছে তার কিছু শেখবার নাই। সে গুমোর দেখিয়ে বলল—কেন, আমি কি রান্না জানি না নাকি? অন্য কারও কাছে জেনে নিতে হবে কেন? দুপুরে ফিরে এসো সবাই। এ ক’দিন যেমন রান্না পেয়েছ, আজও তাই পেয়ে যাবে। দুশ্চিন্তা করার কোন দরকার নাই। 
সবাইকে কাজে লাগিয়ে রান্নাঘরে ফিরে এল চিংড়ি। উনুনে কড়াই চাপিয়ে জল ঢেলে দিল। চাল ঢালল। কাটাকুটি করে সব্জী ঢালল। এবার আগুন ধরিয়ে দিল উনুনে। আগুনের তাতে সব কিছু টগবগ করে ফুটে উঠল যখন, অমনি এক লাফ।
গুণে গুণে দশখানা পা আছে চিংড়ির। আর আছে লেজের শক্তপোক্ত ক’টা পাখনা। সেগুলোতে ঠেস দিয়ে এমন একখানা নিখুঁত লাফ দিল যে, ভুলের কোনও যায়গা নাই। সোজা গিয়ে পড়ল ফুটন্ত কড়াইতে। তার পর? তারপর সবজান্তার যা হবার, তাই হয়েছে!
এদিকে দুপুর গড়িয়ে যেতে বসেছে। রান্নার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বাতাসে, কিন্তু চিংড়ির ডাক নাই। সবাই উঠে এল মাঠ থেকে। কিন্তু সেখানেও চিংড়িকে দেখা গেল না । ধারে কাছেও কোথাও নাই সে। এমনটা তো হয় না কোনদিন! 

মোড়লের কথায় খেতে বসে গেল সবাই। খাওয়া সেরে খোঁজ করা যাবে হতভাগার। তার জমিতে কাজ করে এলো এতগুলো প্রাণী। সে নিজেই কোথায় কেটে পড়েছে। 

খেতে বসে আবার সবাই অবাক। আজকের রান্নাটা যেন আরও ভালো হয়েছে। সবার চেয়ে সেরাই বলা যায়। মোড়ল বলল—যাই বলো বাপু, রান্নার হাত আছে চিংড়ির, এটা মানতেই হবে। কারুর পরামর্শ না নিয়েও, কত মুখরোচক করেছে খাবারটা। 

সেদিন খাবার পরিবেশন করছিল লাউবুছা নামের একটা মাছ। সবাইকে দেওয়ার পর, নিজের খাবার তুলতে গিয়ে, চমকে গেল সে। কড়াইর একেবারে তলানিতে পড়ে আছে চিংড়িটা। পাকিয়ে একেবারে অর্ধচন্দ্রের মত হয়ে গেছে তার চেহারা। গায়ের সবজে রঙ উধাও। সারা গায়ে টকটকে লাল রঙ মেখে, পাথরের মত পড়ে আছে বেচারা!

যখনই আমাদের কারও খাবার পাতে, সবজীর ভিতর লাল রঙের বাঁকা চেহারা নিয়ে কোন চিংড়ি চোখে পড়বে, তখন মাছটার জন্য সমবেদনা নয়, বরং একটা কথা স্মরণ করা খুব জরুরী—প্রয়োজন হলেই অন্যের পরামর্শ নিতে যেন দ্বিধা না করি কেউ। কেন না, সর্বনাশ হয় সবজান্তাদেরই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments