জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫৫(উৎসব -৪)


সম্পাদকীয়,

সু আর কু দুই ভাই বোন। সু খুব ভাল মেয়ে আর কু কিন্তু ভারি দুষ্টু ছেলে। আজকের উৎসব এই সুকুর গল্পে ভরা। সেটা কেমন?  এই যেমন ধরো মা দুগগা ভাল তো অসুর দুষ্ট। তাইতো মা দুগগা ত্রিশূল বিদ্ধ করে যুদ্ধে হারিয়ে দিল মহিষাসুরকে। অসুরদলনীর সেই মূর্তি প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পূজিত হল। আর তোমরা আমরা ভিড় করে সেই মূর্তি দেখতে গেলাম। পুরুলিয়ার এক অখ্যাত গ্রামের মাটির ঘরের তেমনই এক দুর্গা মূর্তির ছবি পাঠিয়েছেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক সুদীপ পাত্র। শুধু কি দুর্গা আর অসুর! আমরাও তো দুবছর ধরে প্রতিনিয়ত করোনাসুরের সঙ্গে লড়ছি। সেই নিয়ে গৌর জ্যেঠু অনিকেত নামে যে উপন্যাসটা লিখছিলেন এবারের সংখ্যায় তার চতুর্থ পর্ব। আর একটা মজার কথা এবারের সংখ্যা থেকে তপশ্রী আন্টি তোমাদের জন্য আর একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখে পাঠিয়েছেন। সেটা সুএর গল্প না কুএর তা বাপু তোমাদের পড়েই বলতে হবে, হ্যাঁ। এবার বলোতো, স্কুলে গিয়ে ক্লাস করা ভাল না অনলাইনে ক্লাস। আমি জানি আগের বছর যখন প্রথম প্রথম অনলাইনে ক্লাস শুরু হল তখন তোমরা কি মজাই না পেয়েছিলে। আর যত দিন যাচ্ছে তত বিরক্ত হয়ে উঠছ ঘরে বসে বসে। করোনাসুরের প্রতি বিরক্ত হয়েছো তো? তাহলে পড়ে ফেলো রতনতনু জ্যেঠু আর পীযূষ আঙ্কেলের লেখা কবিতা আর ছড়া গুলো। মন ভালো হয়ে যাবে। এটাকেই বলে সুএর জয়। যেমন বিপ্লব জ্যেঠু বুলবুলি দুটোকে যতই দুষ্টু বলুক সেটাতো বিশ্বদীপ আঙ্কেলের গল্পের ডায়নোসোরের মতো নয়। আবার শ্যামলী আন্টির গল্পের বেড়ালটা.... কেমন?  বলব না। তোমরাই পড়ে জানিও সেটা সু না কু। অভিজিৎ আঙ্কেলের গল্পের হরিণ ছানাটা কিন্তু পশমের। আর তোমাদের বন্ধু প্রীতি লিখেছে একটা ভাল স্বপ্নের গল্প। স্বপ্ন অনেক সময় ভাল অনেক সময় ভয়ের হয়। সেটা আর এমন কি, কিন্তু বাস্তবের ঘটনা যদি ভয়ঙ্কর হয় তখন কিন্তু কিছু পালটানো যায় না। যেমন, আফগানিস্তানের কথাই ধরো না। কত শিশু মহিলা যে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছে তার সীমা নেই। আফগানিস্তানের সেই ভয়ঙ্কর ছবি লিখে পাঠিয়েছে তোমাদের বন্ধু সুপ্রিয়। আর এই সু কুর গল্পগুলোর জন্য চিত্রশিল্পী শ্যামাপ্রসাদ ব্যানার্জি, শিল্পী সরকার, বানীয়া সাহা ও সৌতি বসাক অসাধারণ ছবি এঁকে পাঠিয়েছেন। খুদে শিল্পীরাও তাদের তুলির টানে অসুরদলনী মা দুর্গার ছবি এঁকে পাঠিয়ে সুএর পাল্লা ভারি করেছে। কি তাহলে হল কিনা সুএর জয়? দুগগা দুগগা।  - মৌসুমী ঘোষ।



ধারাবাহিক উপন্যাস   

অনিকেত (পর্ব ৪)

গৌর বৈরাগী


(সাত) 

অহি-নকুল লোকটা আদর খেকো। ঘামাচি মারার মধ্যে একটা আরাম আছে। সেই আরাম খেতে খেতে লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেশ ভালো মতো ঘুমোচ্ছিল। যখন কোনো সাড় নেই শরীরে। হঠাৎ কে যেন ঠেলা মারল। চট করে ঘুমটা ভেঙে গেল অহি-নকুল এর। প্রথমেই তাকিয়ে দেখল অদ্ভুত দাস তখনো ঘামাচি মারচে। অহি-নকুল বলল, তোর হল? —হ্যাঁ হয়েছে। —কটা হয়েছে? —আজ্ঞে দুশো একান্নটা। —তারমানে দুশো একান্নটা সিকি পাওনা হয়। —তা দুশো একান্নটা সিকিতে কত টাকা হয় অদ্ভুত? —অত হিসেবে আমার দরকার নেই কাকা। আর টাকা পয়সা নিয়ে আমি করবই বা কি! আপনি আমাকে খেতে দিন। 

কথা শুনে যারপরনাই খুশি হল অহিনকুল। ঘামাচি মারার টাকা তাকে আর দিতে হবে না। এর চেয়ে বড় আনন্দের কথা আর কী আছে। তাই বেশ খুশীর গলায় বলল, বেশ বেশ। তা কি খাবি বল? সকালের কটা রুটি আছে তরকারিও কিছু আছে। তা ক'টা রুটি দেবো? অদ্ভুত বলল ,আমি রুটি খাই না। —তাহলে দুপুরের ভাতটা খেয়ে নে। তোর কাকিমা ভাতের সঙ্গে আজকে চুনো মাছের ঝাল করেছে, পোস্ত করেছে, টক  করেছে। তাই তোকে দিতে বলি? —আমি ভাতও খাই না কাকা। —সেকি তুই ভাত খাস না, রুটিও খাস না! ভারি অবাক হলেন অহি-নকুল কাকা, তাহলে তুই খাস কি? —আজ্ঞে আমি মার খেতে খুব ভালোবাসি। —সে আবার কি! মার খাওয়া সেতো কষ্টের জিনিস। সে জিনিস আবার কেউ ভালবাসে না কি? —আজ্ঞে আমি ভালোবাসি। আমার কাছে মার খাওয়া মোটেই কষ্টের নয়। মার খেলে আমার খুব আনন্দ হয়, সুখ হয়, মনে হয় জীবনে এর চাইতে আনন্দের কিছু নেই।

এই প্যাংলা মতো ছেলেটা সত্যিই অদ্ভুত। অদ্ভুত এর মধ্যে ভূতটা লুকিয়ে আছে। ভূত বলেই বোধহয় মার খেলে সুখ হয়, আনন্দ হয়। অদ্ভুত কথা বলে উঠল, কি হলো কাকা, শুরু করুন। —কী শুরু করবো? —ওই যে বললুম মার। দুশো একান্নটা  ঘামাছি মেরেছি। তার বিনিময়ে আমার তো কিছু মার পাওনা হয়। ঠিক কি না বলুন? না না আপনি কথায় কথায় এটা এড়িয়ে যেতে পারেন না। নিন আপনি শুরু করুন এবার। বলতে বলতে লোকটা পিঠ পেতে দাড়াল। বলল, পিঠে আগে পঞ্চাশটা কিল মারুন। তারপরও আমার দুশো একটা  মার পাওনা হয়।

অহি-নকুল কাকা জীবনে এমন বিপদে কোনদিন পড়েন নি। হিসেব ঠিকই আছে। ঘামাছি মেরে অদ্ভুতের ওই টাকা পাওনা হয়েছে। সে টাকার বিনিময়ে যদি মার নেয় তাহলে তো কিছু বলার নেই। মার শুরু করলেন তিনি। পিঠে কিল মেরেই শুরু হল। হঠাৎ অদ্ভুত বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান। অমন নরম সরম কিলে কি হবে শুনি? বেশ কড়া করে মারুন।  —সেটা আবার কি রকম? —আপনি দেখছি কিছুই জানেন না কাকা। ঐরকম নরম আর হালকা কিলে কিছুই কাজ হবে না। কিল মারুন গুম গুম করে। তবেই না তাকে মার বলে। নিন শুরু করুন। দেখবেন প্রতিটা মারের পর যেন গুম গুম শব্দটা পাওয়া যায়। 

যেমন যেমন অদ্ভুত বলল তেমন করেই তিনি মারছেন আর এই ভূতটা মনে মনে গুনছে। তার কষ্টও হচ্ছে বেশ। এমন যে কেউ করতে পারে তার ধারনাতেই নেই। এমনি এমনি কাউকে মারা খুব কষ্টের। খানিকটা পরেই তিনি বললেন হয়ে গেছে। অদ্ভুত বলল, কত হল? কাকা বললেন, ওই যে পঞ্চাশটা। অদ্ভুত বলল, না কাকা মোটে তেইশটা হল। —তুই গুনেছিস বুঝি? —না গুনলে যে ঠকিয়ে দেবে লোকে। এইতো আপনি আমাকে ঠকিয়ে দিচ্ছিলেন আরেকটু হলে। নিন আবার শুরু করুন।

উপায় নেই, আবার শুরু করতে হল অহি-নকুল কাকাকে। পিঠে কিল মারাটা যে এত কষ্টের আগে কোনদিন জানতে পারেননি। এতদিন জানতেন যে কিল খায় কষ্ট শুধু তারই। আজ অন্যরকম জানলেন। যখন একান্নটা শেষ হল, তখন একটা বড় করে শ্বাস ফেললেন তিনি। তিনি হাঁপাচ্ছেন। দরদর করে ঘামছেন। এবার তারই খিদে পেয়েছে। চান করে খেতে বসবেন। খিদেয় শরীরটা আনচান করছে। তিনি আস্তে করে বললেন, আজ এই পর্যন্ত থাক। —তা কি করে হয় কাকা। অদ্ভুত, নামে ছেলেটা, ভাঙা দাঁত বার করে হেসে ফেলল। এখনো দুশোটা মার খাওয়া বাকি। —আধখাওয়া করে কি উঠে যাওয়া যায়, আপনিই বলুন। নিন শুরু করুন, ও দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে। কিল হয়ে গেল এইবার চড় মারুন গালে। ত্রিশটা করে দুগাল মিলিয়ে ষাটটা চড়। বলে গাল পেতে দাঁড়ালো ছেলেটা। 

বলে কি ছেলেটা, এই ভাঙ্গা চোরা দুটো গাল ষাটটা চড় সহ্য করতে পারে নাকি? তার আগেই গাল থেকে গালটা না খসে যায় কিন্তু অদ্ভুত এর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বলল, নিন শুরু করুন কাকা। আমার বেশ চড়-খিদে পেয়েছে।
      কিন্তু শুধু চড়খিদেতে এসে থামল না। চড়ের পর দিতে হলো চিমটি। তারপর রাম-গাট্টা। তারপর শুরু হল বেতের বারি। সপাং করে একবার করে মারছে আর অদ্ভূত বলছে, দারুন। আবার আবার কাকা। অহি-নকুল কাকা সপাং করে বেত নামিয়ে আনছে পিঠে। অদ্ভুত বলছে, সুন্দর সুন্দর। কাকা, আপনি চালিয়ে যান। 

এরকম যে হয়, এরকম যে হতে পারে কোনদিন ভাবেননি অহি-নকুল কাকা। মার যে খাবার জিনিস হতে পারে। মার খেয়ে যে সুখ হয় এই প্রথম  দেখলেন তিনি। যখন মার শেষ হল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আজ অ- বেলাতেই তার চান খাওয়া সারতে হল। তখনই তার চোখ জড়িয়ে আসছে, খুব ক্লান্তি লাগছে। বিছানায় শুতেই চোখ বুজে এল। ঘুম থেকে যখন উঠলেন তখন তার গায়ে জ্বর, প্রবল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। রাতে আর খাবার ইচ্ছে হল না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেন, তখনও গায়ে জ্বর। এরকম হবার কথা নয়। তিনি রাস্তাঘাটে বের হন নি। তার সঙ্গে কারো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। চারপাশে পোকার উৎপাত শুনছেন। কিন্তু তিনি ঘরবন্দি। পোকা আসবে কোথা থেকে। তাহলে জ্বর এলো কেন? সকালে উঠে দেখলেন শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। খিদে নেই। গায়ে তখনো জ্বর। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে বাইরের রকে গিয়ে বসলেন।

আট

সকাল আটটায়  হেঁটে আসছিল অনিকেত তখনই সেই লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটার নাম অহি-নকুল। দিন চারেক আগে তার সঙ্গে বিচ্ছিরি ব্যবহার করেছিল যে। পা থেকে চটি খুলে হাতে নিতে বলেছিল। আসলে বলা নয় খানিকটা অর্ডারই বলা যায়। সে তখন অনিকেত  নয় সে তিনদিন আগের অনি। যে ছিল  হাঁদা গঙ্গারাম। আর চালচুলোহীন একজন। না হলে তার চটিতে চটাস চটাস করে শব্দ হচ্ছে, আর এই শব্দের জন্য তাকে পায়ের চটি হাতে তোলার আদেশ জারি করে লোকটা। অনিটা ছিল এমনই হাঁদা যে তার কথা শুনে পায়ের চটি হাতে তুলেছিল।  কথাটা মনে ছিল তার।

ঝাড়ালো কদম গাছের নিচে পুরনো আমলের একতলা বাড়ি। রাস্তার ধারে লম্বা রোয়াক। এর আগের দিন এই রোয়াকে বসেই দাঁত মাজছিল লোকটা। তাকে দেখেই দাঁত মাজা থামিয়ে উটকো ক’টা প্রশ্ন করল। আজও তাই জায়গাটা ভয়ে ভয়ে পার হচ্ছিল সে। লোকটা বসে আছে। আজ দাঁত মাজছে না। জুলজুল করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ওর মনে কি ধান্দা আছে কে জানে। চোখাচোখি হতেই লোকটা কথা বলল, এই যে ভাই একটু শুনবেন?

একথা শুনে যার পর নাই অবাক হল অনিকেত।  আশ্চর্য ভোলবদল হয়ে গেল নাকি! এর আগের দিন এই লোকটাই তাকে 'তুমি' বলে কথা বলেছে। কথার মধ্যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল। এই লোকটাই তাকে  চটিজোড়া হাতে নিতে বাধ্য করেছিল। আর এখন নরম গলায় বলল, একটু শুনবেন। গলায় আদেশ নয় অনুরোধ।

কিন্তু এমন ভোল বদল কেন? সামান্য পোশাক-আশাকেই এই বদল। সে অবশ্য সত্যিই বদলে গেছে। শরীরে মানে পোশাক-আশাকে তো বটেই মনেও বদলে গেছে। হাওয়াই চটি ফেলে তাকে বুট জুতো পরতে দিয়েছিল বড়বাবু। জুতোটা ফিটও করে গেছল তার পায়ে। ওই জুতো পায় একটু হাঁটাচলা করার পরই মনে হয়েছিল  একটু  যেন অন্যরকম। সে যেন সে নয় , অন্য একজন। তারপরই সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স, পেশেন্ট, হাসপাতাল, ইমারজেন্সি। তখন অন্য আর কিছু ভাবার সুযোগ হয়নি। দ্বিতীয় পেশেন্টকে ইমারজেন্সিতে দিয়ে সে ফিরেছিল থানাতে। বড়বাবু তেমনই বলেছিলেন। থানায় যেতেই বড়বাবু পরপর কটা প্রশ্ন করেছিলেন। খিদে পেয়েছে কিনা? তুই কোথায় থাকিস? বাড়িতে তোর আর কে কে আছে? এখন তুই কোথায় যাবি? এতগুলো প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু বলতে পেরেছিল, আমার খুব খিদে পেয়েছে স্যার।

তার বলার ভঙ্গিতে স্যার যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। হাতে একটা নতুন সাবান ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আগে বাথরুমে গিয়ে সাবান মেখে ভালো করে চান করে আয়। চান করে আসার পর সে দেখেছিল, একদিকে  রাখা বেশ কিছু পোশাক আশাক। তার মধ্যে ছিল একটা ফুলপ্যান্ট আর একটা জামা। পুরনো জিনিস কিন্তু কাচা এবং ইস্ত্রি করা। পড়ার পর একটু ঢিলে হয়েছিল বটে কিন্তু মোটামুটি ফিট করে গেছিল।

বড়বাবু তাকিয়ে বলেছিলেন, একটু বড় হয়েছে বটে কিন্তু খুব একটা বেমানান হয়নি। বড় বাবুর চেম্বারে রাখা আয়নায় সে নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেছিল। সে সত্যি সত্যি অনি থেকে অনিকেত হয়ে গেছে।

এবার যা তুই খেয়ে নে, বড়বাবু  বলেছিলেন, বাইরে হারাধন তোর জন্য একটা ডিস এনেছে।

ঠিকই বাইরে এসে দেখল একটা তেঢ্যাঙা তাগড়াই চেহারার ছেলে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে যেতেই বলল, তুমি তো কিছু খাওনি, এটা বারোয়ারি ক্যান্টিন থেকে তোমার জন্য আনানো হয়েছে। অনেকদিন বাদে পেট ভর্তি করে ভাত খেয়েছিল অনিকেত। ভাত ডাল একটা তরকারি সঙ্গে ডিম। এত মহার্ঘ খাদ্য কতদিন যে সে খায়নি। তার শরীর স্বাস্থ্য এখন চকচকে আর জেল্লাদার। শুধু যে পোশাক-আশাক তা কিন্তু নয়, আবার ভরপেট ভাতের কথাও বলা যাবে না। সকালবেলা হলেই সে থানায় চলে আসছে। শুধু বড়বাবু বলেছে বলে নয়, একদল ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মিশে আর তাদের সঙ্গে চোরকি পাক দিতে দিতে। হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধপত্তর একটা ছোটখাটো যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দুদিনেই সে এক অন্যরকম  মানুষ হয়ে গেছে। 

রোয়াকে বসেই লোকটা খুক খুক করে কাশল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, একটু আসবেন ভাই। অনিকেতের মুখে এখন মাস্ক। সে এখন বেশ সচেতন। কিন্তু ওই লোকটার মুখে কিছু নেই। তার ওপর কাশছে। পকেট থেকে একটা মাস্ক বার করে এগিয়ে দিল অনিকেত। দিনকাল বড় খারাপ কাকা। এই নিন মাস্কটা পরুন। এই ক’দিনের অভিজ্ঞতায় অনিকেতের বেশ কিছু জানা হয়েছে। সে বলল, আপনার কি শরীর খারাপ? অহি-নকুল কাকা ঘাড় নাড়লেন। তারপর আস্তে করে বললেন, কাল থেকে আমার জ্বর হচ্ছে।

 —জ্বর! সঙ্গে কাশি আছে কি? —না, কাশি টাসি কিছু নেই। —নাকে গন্ধ পাচ্ছেন? রোগীদের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে আর হাসপাতাল যাওয়া আসা করে অসুখের লক্ষণগুলো প্রাথমিকভাবে ধরতে পারছে অনিকেত। জ্বর একটা লক্ষণ, কাশি একটা লক্ষণ, শ্বাসকষ্ট একটা লক্ষণ, আর শেষে গন্ধ না পাওয়াটা একটা লক্ষণ। 

—নাহে, ওসব কোন লক্ষ্ণণই  আমার নেই। আমার শুধু জ্বর, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অনিকেত বলল, কি করে বাধালেন জ্বর? মার দিতে গিয়ে জ্বর বাধালুম বাবা। এ তো যেমন তেমন মার নয়। এতো মার মারতে হয়েছে। সেকি মার দিয়ে শরীর খারাপ! খুব মার খেলে শরীর খারাপ হয় এ রকমই শোনা ছিলে এতদিন। তা কাকে মারলেন? অনিকেত জানতে চাইল। লোকটার নাম অদ্ভুত দাস। লোকটা বলছি বটে আসলে সে লোক নয় একটা ভূতই। তা না হলে অমন মার, কি নেই সেই মারে বলুন। কিল, চড়, ঘুষি, গাট্টা এলোপাথারি হাত চালাতে হলো আমাকে। এক-আধ বার নয়, মোট দুশো এক্কান্ন বার। 

অনিকেত অবাক গলায় বলল, এত মার যাকে মারলেন তার কিছু হল না? হল বৈকি। কী হল? মার খেয়ে তার যারপরনাই আনন্দ হল আশ্চর্য! 

—এতে আশ্চর্যের কিছু নেই বুঝলেন। ওটা আসলে তো অদ্ভুত, মানে লোকটার কথা বলছি আর কি। আবার যে লোক বলছি সেটাও ঠিক না। বরং ভূত বললেই ঠিক হয়। লোকটা কাজেও খুব ওস্তাদ। মুখ থেকে কথা খসবার আগেই কাজ করে দিচ্ছে। সে তো ভালো কথা। ওকে দিয়ে ভারী ভারী কাজ করিয়ে নিন। নিলাম কিন্তু তারপর … 

—তারপর কী? —তারপরই তো আসল খেল।  কাজ শেষ করেই  ও মার খেতে চাইবে। তখন আপনাকে দমাদম মারতে হবে ওকে। কাউকে মারা যে কি পরিশ্রমের কাজ সেটা আমি গতকাল টের পেয়েছি। —তো আমাকে কি করতে বলেন কাকা? আপনি সামনে গিয়ে শুধু একটু দাঁড়াবেন। আমার মনে হয় তাতেই কাজ হবে। —কী করে বুঝলেন? আমার মনে হয় ও পুলিশকে কিছু ভয় টয় পায়। আপনি গিয়ে দাঁড়ালে কিছু কাজ হবেই। —কিন্তু আমি যে পুলিশ এ কথা কে বলল আপনাকে? —বলতে হয় না, জানা যায়। পুলিশের গাড়িতে কদিন আপনাকে ছোটাছুটি করতে দেখেছি। বড়বাবু সঙ্গে যেতে দেখেছি, এমনি যেতেও দেখেছি। আপনার পোশাক-আশাকও খানিকটা পুলিশের মত। ঠিক কিনা?

অনিকেত বেশ অবাক হল। তাকে ভালো করে লক্ষ্য করেছে অহি-নকুল কাকা। সত্যিই সে পুলিশের গাড়িতে এখন যাতায়াত করছে। পুলিশের গাড়ি  এখন চোর ধরতে যায় না। ডাকাত বা মস্তানি কিংবা তোলাবাজি থামাতেও যায় না। এখন একটাই কাজ, করোনার। করোনা ভাইরাসের জ্বালায় সবাই অস্থির। সাধারণ মানুষ সবাই ঘরবন্দী। একমাত্র পুলিশরাই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঠিকই ধরেছেন কাকা, পুলিশের কাজ বেড়েছে। আমি পুলিশ না হলেও ওদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছি। কিন্তু আপনার ভূত তাড়াবার কাজ আমি জানিনা। 

অহি-নকুল কাকা হাসলেন। বললেন, পুলিশ এমন কাজ নেই যা পারে না। সাঁতার কাটতে পারে, গাছে উঠতে পারে, গাছে ঝুলতে যাওয়া মানুষকে গাছ থেকে  নামাতে পারে, এমনকি হাওড়া ব্রিজের ওপর থেকে লোক নামাতে দেখেছি পুলিশকে। ভূত তাড়ানো তো তাদের কাছে খুবই সহজ কাজ। আপনি একটু চেষ্টা করুন ভাই। অনুরোধ ফেলতে পারল না অনিকেত। সে বলল, চলুন দেখি। 

বাড়িটা যে খুব বড় তা নয়। পুরনো আমলের একতলা, পেটাই ছাদ, খান চারেক ঘর। তো এটুকু দেখতে আর কতক্ষণ লাগে। ঘর দেখা হল, খাটের নিচে দেখা হল, রান্নাঘর ভাঁড়ার-ঘর, এমনকি সিঁড়ি ঘরও বাদ গেল না। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অদ্ভুত কে তো নয়ই, তার কোনো চিহ্নও কোথাও নেই। গেল কোথায় সেটা। অহি-নকুল কাকা বললেন, পুলিশকে দেখে  ও সটকেছে নিঘঘাত।অনিকেত বলল, আপনি আমাকে চিনলেও চিনতে পারেন। হয়তো পুলিশের গাড়িতে যেতে দেখেছেন। কিন্তু ও তো আমাকে দেখেনি।

—দেখেনি, তবে ব্যাটা গন্ধ পেয়েছে। পুলিশের গায়ে একটা পুলিশ পুলিশ গন্ধ আছে জানেন। সেই গন্ধটা ও পেয়েছে। আর পুলিশ যে এত উপকারী, মানে এখন যেটা দেখা যাচ্ছে আর কি, সেটা তো ওই অদ্ভুত  দাস জানেনা। ও জানে পুলিশ মানেই ডেঞ্জারাস কিছু। তাই আড়ালে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। আপনি চলে গেলে ও দেখা দেবে। 

কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। তা হবে, এদিকে আমি যে বড় মুশকিলে পড়ে যাব ভাই। ব্রেকফাস্টে অলরেডি ওর মার পাওনা হয়ে গেছে। আগে থেকেই বলে রেখেছে কিল চড় ঘুষি দিয়ে আর চলবে না। আমার বাবার আমলের একটা শংকর মাছের চাবুক ছিল। ব্যাটা আলমারি থেকে চাবুকটা বার করে রেখেছে। বলে রেখেছে, খেতে হলে এই শংকর মাছের চাবুকের মার খাওয়াই ভালো। ব্রেকফাস্টে আপনি শংকর মাছের চাবুক চালান। এখন আমি কি করবো বলুন ভাই? 

এত পরিশ্রম এই বয়সে কি আমি পারি? ঠিক আছে, বলে পকেট থেকে একটা ছোট মোবাইল বার করে অনিকেত। তারপর বলে, স্যার এটা আমাকে দিয়েছে। বলেছে, এটা তোর কাছে রাখ। কখন ডাকাডাকির দরকার হয়। এই নাম্বারটা আপনি রাখুন। একটা কাগজের টুকরো অহি-নকুল কাকার দিকে বাড়িয়ে দেয় অনিকেত। খুব ঝামেলা করলে আপনি আমাকে এই নাম্বারে কল করবেন। 

—বেশ বেশ, অহি-নকুল কাকা যেন হাঁফ ছাড়লেন। এতেও কাজ হবে মনে হচ্ছে। অন্তত ভয়টা তো দেখান যাবে। (ক্রমশ)        


    


ধারাবাহিক উপন্যাস

গোলোকধাঁধা

তপশ্রী পাল

আজকাল রোজ, খবরের কাগজ পড়ে সৌজন্য। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর বাবা বলেছেন এটা ভীষণ জরুরী। সাধারণ জ্ঞান, মানে জিকে বাড়ানোর জন্য তো বটেই, পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে, খেলাধূলার জগতেই বা কী হলো এ সব এখন থেকে পড়বার অভ্যাস না করলে অন্ধকারেই থেকে যেতে হবে। এমনিতে বাংলা তো বেশী পড়াই হয় না সৌজন্যর। তাই বাড়িতে বাংলা কাগজ রেখেছেন বাবা, যাতে সৌজন্য একটু বাংলাটা রপ্ত করে নিতে পারে। 

পুজো প্রায় এসে গেছে। কাগজ এখন শুধু পুজোর জামাকাপড়, জুতো, আরো নানা জিনিসের বিজ্ঞাপণে ভরা। আর খবর বলতে তো সেই কতজন করোনার কবলে পড়লো আর কতজন ভ্যাক্সিন নিলো! বোর হয়ে সেদিন খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাত চতুর্থ পাতার তলার দিকে একটা মজার বিজ্ঞাপণ চোখে পড়লো সৌজন্যর! একটা কোম্পানীর তরফ থেকে ট্রেজার হান্ট হচ্ছে পুজোর সময়! পঞ্চমীর দিন থেকে পরপর কদিন কাগজে একটা করে ছড়ার ধাঁধা দেওয়া হবে। প্রথমটা সমাধান করতে পারলে একটা পুজো প্যান্ডেলের নাম পাওয়া যাবে। সেখানে পৌঁছোলে পাওয়া যাবে একটা সূত্র। পরদিনের ছড়ায় থাকবে একটা শূন্যস্থান। সেখানে ঐ সূত্র বসালে হবে দ্বিতীয় ধাঁধা। সেটা সমাধান করলে পাওয়া যাবে পরের পুজো প্যান্ডেলের নাম। এ ভাবেই এগোবে। নবমীর দিন শেষ প্যান্ডেলের নাম ক্র্যাক করতে পারলেই সেখানে থাকবে দারুণ গিফট! এর জন্য গ্রুপে নাম দিতে হবে কোম্পানীর ওয়েবসাইটে। এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝলো না সৌজন্য। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে। যে গ্রুপ সবার আগে সমাধান করে শেষ প্যান্ডেলে পৌঁছবে, তারাই পাবে সেই দারুণ গিফট! কী গিফট, সেটা কিন্তু বলা নেই। মনে মনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো সৌজন্য! বিকেলে কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করতে হবে। এখন অবশ্য করোনাটা একটু কমেছে। দেখা যাক বাবা যদি একসাথে বেরোতে দেয় তবে তো!       

বিকেলে অভিজ্ঞানকে ফোন করতেই ও খুব উতসাহ দেখালো! বললো “এ তো আমাদের গেমের মতো রে! চল সমাধান করার চেষ্টা করি! আমাদের গ্রুপের মন্দিরার খুব বুদ্ধি! ও আগে বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়তো তো, ও বাংলা ধাঁধা ভালো বুঝবে! ওকে দলে নিতে হবে। আর সুদক্ষিণা, উপল আর শিবমকেও নিয়ে নেবো। পাঁচজন তো হয়েই গেলো! উপল শুনে বললো “তোরা আমার দাদা নীলোৎপলকে নিয়ে নে গ্রুপে! ও তো ট্রেজার হান্ট গেমে প্রাইজ পেয়েছিলো! সবগুলো লেভেল ক্র্যাক করেছিলো!” 

বাবাকে জানালো সৌজন্য। বাবা বললেন “পুজোর কদিন তো তোমাদের কাজকর্ম নেই। বেশ, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়াই না হয় দাও। তবে কোন প্যান্ডেলে কোথায় যাচ্ছ বলে যাবে কিন্তু। বাড়ির গাড়িতেই সবাইকে নিয়ে যেও, তাহলে ড্রাইভার আঙ্কল তোমাদের সঙ্গে থাকবেন। নীলোৎপলই ওয়েবসাইটে ওদের গ্রুপের সবার নাম রেজিস্টার করে দিলো। গ্রুপের নাম হলো “হান্টার সেভেন”।   

পঞ্চমীর দিন উৎসাহে সৌজন্যর আর একটুও মন বসলো না অনলাইন ক্লাসে। আজ হয়েই ক্লাস শেষ। আবার সেই লক্ষ্মীপুজোর পর! কখন কাগজ খুলে বসবে আর ছড়াটা দেখবে? তাড়াতাড়ি সল্ভ না করতে পারলে অন্য দল পৌঁছে যাবে তো! কাগজ খুলে চতুর্থ পাতার নীচে গিয়ে ছড়াটা তাড়াতাড়ি টুকে নিলো সৌজন্য! তারপর ফোনে বলে দিলো গ্রুপের সবাইকে। 

“বাঙ্গালী ভদ্রলোককে সম্বোধন শব্দ

বুঝতে না পারলেই তুমি হলে জব্দ

তারপরের শব্দে সেথা ফুল ফুটে আছে

দুইয়ে মিলে প্যান্ডেল ব্রিজের কাছে”


ছড়া নিয়ে সারা সকাল মাথা খুঁড়তে লাগলো সৌজন্য! বাঙ্গালী ভদ্রলোককে কী বলে সম্বোধন করে রে বাবা! ইংরাজীতে মিস্টার বলে। বাংলায়ও তো বাবাকে সবাই মিস্টার চৌধুরীই ডাকে! কিন্তু প্যান্ডেলের নামে মিস্টার? উঁহু। আর তার পরের শব্দ? তাতে আবার ফুল ফুটে আছে! তাহলে তো হয় মিস্টার ফ্লাওয়ার! নিজের মনেই হেসে উঠলো সৌজন্য! নাঃ বন্ধুগুলোও কেউ ফোন করছে না। এদিকে তাড়াতাড়ি সল্ভ না করতে পারলে কখন বা যাবে সেই প্যান্ডেলে? কত দূর প্যান্ডেল তাই বা কে জানে? বেশী দূর হলে বাবা যেতেই দেবেন না হয়তো! 

মা নতুন জামাগুলো সব দিয়ে গেছেন সৌজন্যর বিছানার ওপর! অন্যবার হলে এতোক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তো সৌজন্য! বিশেষ করে এবার মার কাছে বিশেষ করে চেয়ে রেখেছিলো ডিস্ট্রেসড জিন্স! একটু ছেঁড়া ছেঁড়া! খুব স্টাইল এখন! কিন্তু এই ধাঁধা নিয়ে সাত পাঁচ ভেবে ভেবে জামাকাপড়গুলোর দিকেও তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না সৌজন্যর। বাবা ঘুরে উঁকি মেরে বললেন “আজ রাতে ঠাকুর আনতে যাবো আমরা! যাবি নাকি আমার সঙ্গে?” এককথায় মাথা নেড়ে দিলো সৌজন্য! অন্য সময় হলে এক লাফে রাজী হয়ে যেতো!  

ধাঁধা সল্ভ করতে না পেরে, শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে স্নান করে এলো সৌজন্য। দুপুরে নির্ঘাত পোলাউ করেছেন মা! ঘি এর গন্ধে মনটা আর পেটটা আনচান করছে! কিন্তু ধাঁধাটা মাথায় চেপেই আছে, বোঝার মতো। স্নান সেরে এসে শিবম আর উপলকে ফোন করে ফেললো সৌজন্য। কিন্তু ওরা কেউ কিছুই ভেবে পায়নি এখনো। তবে কি হেরে যাবে হান্টার সেভেন? মা বারবার খাওয়ার তাড়া দিচ্ছেন। হতাশ হয়ে যখন খেতে চলে যাবে ভাবছে সৌজন্য, এমন সময় মন্দিরার ফোন!  


ও নাকি সল্ভ করে ফেলেছে! কী মেয়েরে বাবা! তাড়াতাড়ি সৌজন্য বলে “বল, বল! কোন প্যান্ডেল? যেতে হবে তো!” “বলবো, তবে আইস্ক্রিম খাওয়াতে হবে সেই প্যান্ডেলে গিয়ে!” “বেশ, বেশ খাওয়াবো!” “তবে শোন, বাঙ্গালী ভদ্রলোককে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করা হয়, যেমন তোর বাবা হলেন সৌরভবাবু। আর ফুল ফুটে থাকে বাগানে! দুইয়ে মিলে, কী হলো তবে?” সৌজন্য বলে উঠলো “বাবুবাগান” মন্দিরা বলে “তাও বুঝলি না? আরে বোকা, ঢাকুরিয়া ব্রিজের পাশেই বাবুবাগানের বিখ্যাত পুজো! বাবুবাগান সার্বজনীনের প্যান্ডেলের কথা বলা হয়েছে ধাঁধায়! এবার হলো তো?” “হুম, অর্ধেক হলো। এবার সূত্রটা প্যান্ডেলে গিয়ে বার করতে হবে! শোন, তুই রেডি হয়ে থাক! আমি খেয়ে উঠেই গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি। তোদের সবাইকে তুলে প্যান্ডেলে পৌঁছতে হবে যত তাড়াতাড়ি হয়!

সৌজন্যদের গাড়িটা ভাগ্যিস সেভেন সিটার! বাবাকে বলে কোনরকমে পোলাউ দিয়ে একথালা খেয়েই বেরিয়ে পড়লো সৌজন্য! এক এক করে বন্ধুদের তুলে যখন বাবুবাগানের প্যান্ডেলের সামনে পৌঁছলো তখন বেলা তিনটে বাজে। ভাগ্যিস ড্রাইভার আঙ্কল চেনে প্যান্ডেলটা, নইলে এই ব্রিজের ধারে সরু রাস্তায় ঢুকে খুঁজেই পেতো না ওরা। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এখানে এতো বড় একটা পুজো হয়! খাড়া দুপুরে প্যান্ডেল একদম ফাঁকা! এমনিতেই করোনার জন্য পুজো প্যান্ডেলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকেই দেখতে হবে! অভিজ্ঞান বললো “সূত্রটা কী আর কোথায় থাকবে বল দেখি! সেটা বোঝা তো ধাঁধার চেয়েও শক্ত!” নীলোৎপল বললো “কমন সেন্স লাগা! দ্যাখ, প্যান্ডেলে তো ঢোকা বারণ। তাহলে প্যান্ডেলের সামনে বা বাইরেই নিশ্চয় কিছু একটা আছে যেটা খুব চোখে পড়ার মতো! সেটার কথাই বলা হয়েছে।“ 


সৌজন্য আর ওর বন্ধুরা তাকিয়ে দেখে বাবুবাগানের পুজো-প্যান্ডেলের বাইরে খানিকটা খোলা জায়গা। তার আগে, ঢোকার মুখেই একটা ইন্সটলেশন আর্ট! বাবা বলেছিলেন প্যান্ডেলের বাইরে যে সব বিশাল ক্রাফটগুলো করা হয়, যাকে বাংলায় বলে “ভাস্কর্য”, তার ইংরাজী নাম “ইন্সটলেশন আর্ট” কারণ এগুলো এতো বড়ো যে অন্য কোথাও বসে করা যায় না। এখানে বসেই শিল্পীরা বেশ কিছুদিন ধরে নানা জিনিস দিয়ে বানান এগুলো। তারপর ইন্সটল করতে হয় লোহার স্ট্রাকচার করে! বাবুবাগানের প্যান্ডেলের বাইরে একটা বিরাট সাইজের কলসি বা কলস! অসংখ্য ছোট ছোট রবারের পাইপ কেটে তৈরী! কিন্তু অসাধারণ দেখতে হয়েছে! পুরো জিনিসটা প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু! সেটা আবার একটা মঞ্চের ওপর বসানো! পুজোপ্যান্ডেলের বাইরে রাস্তার ওপর একটা ছোট স্টেজ বেঁধে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক আর কয়েকটি ছেলে বসে আছে! সেখানে কত্তো যে বড়ো বড়ো মেডেল রাখা আছে তার ঠিক নেই! নীলোৎপল বললো “দেখেছিস? এগুলো সব এই পুজো প্রাইজ পেয়েছে এক এক বছর।“  ওরা কজন ঘুরঘুর করছে দেখে কয়েকটি ছেলে এগিয়ে এলো। বললো “তোমরা কি ট্রেজার হান্ট করছো?” সৌজন্য একটু ইতস্ততঃ করে বললো “হ্যাঁ!” ছেলেরা ওদের গ্রুপের নাম লিখে নিলো। তারপর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো “এই নিয়ে সাত নম্বর গ্রুপ এলো রে!” হান্টার সেভেন একটু দমে গেলো। তার মানে ওদের আগেই আরো ছটা গ্রুপ এসে ঘুরে গেছে! নাঃ আরো তাড়াতাড়ি সল্ভ করতে না পারলে আশা নেই!     


সুদক্ষিণা বললো “আমার তো মনে হচ্ছে এই কলসীটাই সেই সূত্র!” সবাই একমত হলো যে এটাই সম্ভবতঃ সেই সূত্র! কিন্তু পরের দিনের ধাঁধা পেলে তবে বোঝা যাবে শূন্যস্থানে এটা বসালে ঠিক ঠিক মানে হচ্ছে কি না। যাই হোক পাশেই নানা খাবারের স্টল। মা অবশ্য বাইরে কিছু খেতে বারণ করেছিলো। কিন্তু মন্দিরা আইস্ক্রিম না খেয়ে ছাড়বে না। তাই “হান্টার সেভেন” আইস্ক্রিম খেয়ে, আরো কিছু ঠাকুর দেখে বাড়ি ফিরলো!


পরদিনের মানে ষষ্ঠীর ছড়াটা পড়ে সৌজন্যকে প্রথম ফোন করলো সুদক্ষিণা। বললো “আজ ছড়াটা আরো কঠিন করে দিয়েছে রে! শোন কী লিখেছে –

______ ভরা জল, পুকুরঘাটে চল

পুকুর পাড়ে পুজো, আলোয় সে ঝলমল

পড়াশোনার স্থান, সেথায় অবস্থান

চৌকো কেন বল! পুকুরঘাটে চল!


সৌজন্য ছড়াটা শুনে বললো “দাঁড়া দাঁড়া! কলসীটা তার মানে ঠিকই আছে! বেশ সুন্দর বসে যাচ্ছে! তাহলে দাঁড়াচ্ছে –


কলসী ভরা জল, পুকুরঘাটে চল

পুকুর পাড়ে পুজো, আলোয় সে ঝলমল

পড়াশোনার স্থান, সেথায় অবস্থান

চৌকো কেন বল! পুকুরঘাটে চল!


এ তো সোজা! বলাই তো আছে পুকুর পাড়ে পুজো! কোথায় পুকুর পাড়ে প্যান্ডেল হয় সেটা বার করলেই তো –“

“ইশ অতো সোজা? কতো পুকুর বল তো কলকাতায়! অনেক পুজোই পুকুর পাড়ে হতে পারে। কোনটার কথা বলছে কে জানে?”

“আর ঐ পড়াশোনার স্থান? সেটা আবার পুকুর পাড়ে গেলো কী করে? পুকুর পাড়ে বসে কেউ পড়াশোনা করে? তারপর শেষ লাইনটা! চৌকো কেন বল! কোনটা চৌকো? পুকুর পাড় না কি পড়াশোনার স্থান? নাঃ খুব কনফিউসিং! নীলোৎপলদাকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে!”


বাইরে ঢাকিরা এসে গেছে! বেশ জোরে ঢাক বাজছে! এই সময় মা দুর্গাকে অস্ত্র পরানো হয়! মায়ের ডাকে কিছুক্ষণের জন্য পাড়ার প্যান্ডেলে যেতেই হলো। ষষ্ঠীপুজো সেরে প্রসাদ নিয়ে মায়ের সাথে ফিরলো সৌজন্য। বাবা এখনো প্যান্ডেলে। 

মায়ের স্মার্ট ফোনটা একটু সময়ের জন্য চেয়ে নিলো সৌজন্য। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে একটা কনফারেন্স কল করলো। তাড়াতাড়ি সমাধান করতে হলে এটাই সবচেয়ে সহজ পন্থা!   

নীলোৎপল বললো “দেখ কমন সেন্স হলো সবচেয়ে আনকমন জিনিস। সাধারণ জিনিসটা আমাদের মাথাতে আসেই না! এখানে যে সব পুজোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলো সব ফেমাস পুজো কলকাতার, কোন গ্রামগঞ্জের পুকুর ধারে পুজো খুঁজে লাভ নেই। ভাব, কলকাতায় পুকুরধারে বড়ো পুজো বললে কোন পুজোর কথা মনে পড়ে?” অভিজ্ঞান সাধারণতঃ চুপচাপ থাকে। আজ হঠাত বলে উঠলো “আমি গতবছর সারারাত ঠাকুর দেখেছিলাম স্পেশাল বাসে! সেবার মাঝরাতে মধ্য কলকাতার বিখ্যাত পুজোগুলো দেখিয়েছিলো! একটা পুজো দেখেছিলাম বিরাট চৌকো লেকের ধারে! চারিদিকে দারুণ আলোয় সাজানো! বেশ মিলে যাচ্ছে ছড়াটার সঙ্গে। দাঁড়া বাবাকে জিজ্ঞাসা করে বলছি কোন পুজো!” খানিক পরে অভিজ্ঞান জানালো ওটা কলেজ স্কোয়ারের পুজো ছিলো! সৌজন্য দেখলো একেবারে মিলে যাচ্ছে। পড়াশোনার স্থান হলো কলেজ। আর কলেজ স্কোয়ার তাই চৌকো! অতএব ষষ্ঠীর দিন হান্টার সেভেনকে নিয়ে গাড়ি চললো মধ্য কলকাতার দিকে। 


কলেজ স্কোয়ারের চারিদিকে গেট দিয়ে আটকানো। এক গেট দিয়ে ঢোকা, অন্যটা দিয়ে বেরোনো। প্রচুর হাঁটতে হয় ঠাকুরের কাছ অবধি পৌঁছোতে। আজ সমাধান করে পৌঁছোতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে অসাধারণ আলো ঝলমল করছে! ড্রাইভার আঙ্কল বারবার করে বলে দিয়েছে সবাই হাত ধরে থাকতে। বেরোনোর সময় কোনদিক দিয়ে কোন রাস্তায় নিয়ে বার করে ঠিক নেই। গাড়ি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল! নীলোৎপলদার কাছে স্মার্ট মোবাইল আছে অবশ্য। ড্রাইভার আঙ্কলকে ফোন করতে হবে। পায়ে হেঁটে পুকুর ধার দিয়ে ঠাকুরের কাছ অবশি পৌঁছল ওরা। হঠাত মন্দিরা বললো “আচ্ছা, তোরা কিছু ফিল করেছিস? আমার তখন থেকে মনে হচ্ছে আমাদের ঠিক পিছনেই কেউ আসছে! কিন্তু তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারছি না!” উপল হা হা করে হেসে বললো “তুই বললি বটে! সবাই তো একজনের পিছনে একজন হেঁটে হেঁটে চলেছে পুকুরধার দিয়ে! একসাথে ভীড় করা তো বারণ! আমাদের পিছনে কেউ না কেউ তো আসবেই!” 

“আরে না না, এটা অন্যরকম। হঠাত মনে হলো আমার ঘাড়ে কেউ নিশ্বাস ফেলছে!”

“ধুর, সবার মুখে তো মাস্ক!”

“তোরা বিশ্বাস করছিস না! কেউ একটা ছিলো। আমি বারবার পিছনে তাকাচ্ছি দেখে আমাদের পার হয়ে চলে গেলো একটা ছেলে!”

“যাক গে, আমরা আমাদের কাজ করি!” বললো নীলোৎপল।

অপূর্ব ঠাকুর হয়েছে! সবার মুখে মাস্ক, কিন্তু ভীড় হয়েছে বেশ! ওরা যখন সেই বিশেষ জিনিসটা কী হতে পারে

চারিদিকে সেটা খুঁজছে, দেখে আরো বেশ কয়েকটি দল হাতে কাগজ পেন নিয়ে একই ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে! তার মানে অনেকেই আছে কম্পিটিশনে! প্যান্ডেলে প্রচন্ড জোরে ঢাক বাজছে! কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। তাও অভিজ্ঞান সৌজন্যর কানে কানে বললো “দ্যাখ, জিনিসটা কী, খুব সাবধানে আলোচনা করতে হবে নিজেদের মধ্যে! জোরে কিছু বলবি না কেউ!” 

ওরা ঠিক করলো কে কী অবসার্ভ করলো সেটা মনে মনেই রাখবে। তারপর এখান থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত হবে সঠিক জিনিস কোনটা!

এবারের থিম রঙ বোধহয় গোলাপী। চারিদিকে গোলাপী আলোর ঝরণা। দুর্গা ঠাকুরের পরণেও গোলাপী বেনারসী! গাছের গায়ে গোলাপী টুনি জড়ানো! কার্তিক গণেশের ধুতির রঙও গোলাপী! দুর্গার পিছনে গোলাপী লাল দিয়ে বিরাট চালচিত্র! 


বেরোনোর সময় একটা অন্ধকার গলিতে এসে পড়লো ওরা। বেশ গা ছমছম করছে। হঠাত লোকজনও কমে গেছে চারিদিকে। সুদক্ষিণা হঠাত বললো “তোরা শুনতে পাসনি ঢাকের জ্বালায়! কে একটা লোক আমার কানের কাছে বলে গেলো “সল্ভ করো, নইলে বিপদ!” সবাই একসাথে বলে উঠলো “সে কী রে!”

সৌজন্য তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে ফোন করলো। যতটা সম্ভব একসাথে হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। গাড়ি এসে যেতেই উঠে বাঁচলো! নীলোৎপল বললো “শোন, বাড়ি ফিরে চল! আর বেশী ঘোরাঘুরি না করাই ভালো!”

গাড়িতে চুপচাপ বসে রইলো ওরা। সেই জিনিসটা কী হতে পারে তাই নিয়ে আর আলোচনা করার কথা মনেই ছিলো না কারো।




রতনতনু ঘাটীর গুচ্ছ কবিতা

অনলস্যারের ক্লাস                                                      

পথের দু’ধারে ঘাসের কত না ফুল  
তার শেষে সেই ভ্যাবলা নদীর বাঁক
ভাঙা সাঁকোটার নীচে জল ছুঁইছুঁই 
সেই গল্পটা তবে শুরু করা যাক।

সঙ্গে সে যে আর-একটা পথ জুড়ে
আলসেমি করে শুয়ে থাকা ছোট নদী?
বিবেক বলল, ‘নতুন সে রাস্তাটায়
আঁধার নামলে হাঁটতে পারিস যদি...

তোকে দেব একখানা পাকা কামরাঙা 
আধখানা দেব কঁয়েতবেলের ভাগ...
দিতেও তো পারি একখানা টোপা কুল!’
হেসে বললাম, ‘দেখবি  আমার রাগ?

এক ঝাঁক্কাড়ে বেলপাহাড়ির গ্রাম
পরের তম্বি দেখতে পাবি না চোখে--
পালাবি যখন পাগল-টাগল ভেবে
থামতে বলবে তেপান্তরের লোকে।

তখনো ছুটলে হঠাৎ দেখবি চেয়ে
চাঁদ উঠে একা হেসে বলে, ‘আজ যাই?’
হঠাৎ দেখবি হোঁচট খাচ্ছে দূরে
ব্যাকরণদের সন্ধি-সমাস ভাই!

অনলস্যারের ক্লাস বুঝি এর পরে?
মনে পড়তেই আর কি সেখানে থাকি—
হঠাৎ দেখি কি বাড়ির উঠোনো আমি
চিলচিৎকারে ‘মা মা’ বলে শুধু ডাকি!


পলাতক আমি                    


একখানা ঢিলে ভেঙেছি চাঁদের বাড়ি
পাঁচখানা ঢিলে পেড়েছি সন্ধ্যাতারা
তিনখানা ঢিলে ভেঙেছি তিনটে মাথা
ক্লাস কেটে গিয়ে লিচু পাড়ছিল যারা।

একখানা ঢিলে নিধুদাদুদের গাছে
পেড়েছি দু’খানা লাল টুকটুকে আম
একখানা আমি খেয়েছি নদীর ধারে
বোনের জন্যে একখানা রাখলাম।

দুপুরে যখন ঘোর লেগে আছে মেঘে
চারখানা ঢিলে পেড়েছি একটা আতা
তিনখানা ঢিল উড়ে গিয়েছিল দূরে
ফুটো করে দিল ত্রিদিবদাদুর ছাতা।

শাস্তি হঠাৎ জারি হয়ে গেল স্কুলে
তারপরে সে কী হুলুস্থুলুস গ্রামে
পলাতক আমি খুঁজছি সারাটাদিন
এত কাণ্ড কে করল আমার নামে?
             
               
দয়ালমাঝির নৌকো                                                

চণ্ডীতলায় বাতাবি গাছের নীচে
সন্ধেবেলায় বসে জোনাকির মেলা!
আমরা ওদিকে তাকাইনি চোখ তুলে
বাতাসে তখন বোঁ-বোঁ করে কেউ যেন
শুরু করে দেয় ডানপিটে এক খেলা।

সে খেলার মানে বুঝতে বুঝতে দেখি
রাত এসে জোরে গুঁতো মারে আন্ধারে!
একলা পড়ছি তেরোর নামতাখানি
হঠাৎ কখন সাহস নামল এসে
আমাকে তখন ভয় কে দেখাতে পারে?

হঠাৎ দেখি কী তিনখানা কালো দিঘি
হুসহাস করে হয়ে গেল একখানা!
আমি এসবের মানেটানে বুঝি না তো
তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?
কারা হেসে-হেসে বলল, ‘এসব জানা!’

অমনি তখন আমি আর থাকি নাকি?
দে ছুট দে ছুট ধরণী দাসের বাড়ি!
দম নিয়ে আমি বুক ভরে শ্বাস ফেলি
কুলকুল করে ঘেমে নেয়ে চুপ্পুস
চারপাশে দেখি ছায়াদের মুখ হাঁড়ি!

একখানা ছায়া দু’হাত বাড়াল এসে
‘আয় আয়, ওরে কাছে আয়! কাছে আয়!’
কোন দিকে বাড়ি কিচ্ছু কি মনে আছে?
শুধু চেয়ে দেখি দিগন্তে ভেসে থাকা
দয়ালমাঝির নৌকোটা দাঁড় বায়!
             

নবনীল ক্লাসে সেরা                                          

আলেখ্যমিস ডেকে বললেন ক্লাসে
‘হাত তোলো তাড়াতাড়ি 
আঁকার ক্লাসেই মেঘে মেঘে বলো কারা
এঁকেছিলে ঘরবাড়ি?’
হাত তুলে বলে অনুশা দত্ত সেন, 
‘এঁকেছি ভোরের পাখি!
রংটং আমি করে ফেললাম যেই
করছিল ডাকাডাকি!’
অলয় এঁকেছে জল টলমল দিঘি
নদীনালা পথঘাট,
শ্রেয়ান এঁকেছে আকাশপারের ছবি
তেপান্তরের মাঠ!
নবনীল দাস বলল ‘শুনুন মিস,
ঘরবাড়ি, পাখি, নদী—
আঁকার সময় প্যালেটের রংটংগুলো 
শেষ হয়ে যায় যদি?
তাই তো এঁকেছি ভারতমাতার মুখ
গেরুয়া-সবুজ-সাদা
তাঁর পাশে ওই দু’হাত নমস্কারে
দাঁড়িয়ে রয়েছে দাদা!’
আলেখ্যমিস বললেন, ‘মেঘেদের 
সময় হয়েছে ফেরার
সকলে এঁকেছ সুন্দর তবু আজ
নবনীল ক্লাসে সেরা।’


ডাহুক পুকুর                                              

এতদিন ধরে স্কুলটুল ছুটি আছে
পড়া ভুলে যাওয়া হয়েছে নতুন জ্বালা 
অঙ্কে পেতাম পঁচিশের বেশি তাও
কবে যে ভুলেছি সাতের প্রশ্নমালা।

এমন কাণ্ড কখনো হয়নি আগে
তমালকে বলি, ‘বাড়ি এসে বলে যাস!’
পড়ার ঘরেই ভুলের বাড়ির কে যে
দেয়ালে-দেয়ালে লিখছে ভুলের মাস!’

একটা অঙ্ক সাতখানা উত্তর
কী করে এমন ঘটছে বল না তুই?
ঢেঁড়সের গাছে আমলকী ফলে আছে?
খড়ের গাদায় ফুটেছে কেন যে জুঁই!

একখানা কথা তোকেই বলছি শুধু--
সাঁতারাতে যাবি? দমটম হবে ফাঁকা!
ডাহুক পুকুরে খলবল করে ওঠে
দু’হাত ভরতি সোনার রুপোর টাকা!



স্কুল নেই, মজা নেই

পীযূষ প্রতিহার

স্কুল নেই,
ক্লাস নেই,
পড়া নেই,
ভাবি বুঝি মজা এই!

মা-বাবার তাড়া নেই,
স্যারেদের বকা নেই,
পালানোর মজা নেই,
ভাবি বুঝি মজা এই!

টিফিনের খাওয়া নেই,
গল্প-গুজবও নেই,
ছুটির ঘন্টা নেই,
ভাবি বুঝি মজা এই!

না, না, এসবে তো মজা নেই-
অভ্যাস ভুলে গেলে হৃদয়ের মজা নেই,
ছুটি, শুধু ছুটি হলে ছুটিটার মজা নেই,
তোমরা ভাবছো বুঝি আমাদের মজা এই!

একদম ভুল কথা, আমরাও ভালো নেই,
চারিদিকে হা-হুতাশ, আশারও তো আলো নেই,
এসেছে মারণ ব্যধি, ওষুধও জানা নেই।
একদিন আলো হবে, কোথাও আঁধার নেই।



প্রীতি  জ‍্যোতি
অষ্টম  শ্রেণি
কোমধাড়া মথুরকুড় উচ্চ বিদ‍্যালয়
হুগলি

 দুর্গা.......মা

টিভি খুললেই পুজোর স্পেশাল বিজ্ঞাপন। দেখলেই মনে আনন্দের কম্পন জেগে ওঠে। এবারে পুজোর কেনাকাটা অন্য বছরের তুলনায় একটু আগেই হয়ে গেছে। সযত্নে সেগুলো তুলে রাখা হয়েছে আলমারিতে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে আলমারি খুলে নতুন জামার গন্ধ শুঁকি। নতুন জামার গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে। তাই আমি সেন্ট দিয়ে চাপা দিই না। এরই মধ্যে চার-পাঁচ বার সব ড্রেস গুলো পরা হয়ে গেছে। মা রেগে বলে -"পুজোয় ময়লা জামা পরে অঞ্জলি দিবি"। যাইহোক, আপাতত আমার চারটে জামা হয়েছে। এখনো আমার পাওনা আছে। দিদার দেওয়া হয়ে গেছে বাকি  আছে জেঠু, পিসি আর মাসি।
কাল রাখীদিদির কাছে অঙ্ক পরীক্ষা আছে। এবারেও ভালো নম্বর না পেলে আবার মা কে ফোন করে অভিযোগ। না....! সময় নষ্ট না করে অঙ্ক করতে বসলাম। মিনিট পনের অঙ্ক করার পর চোখের  পাতা যেন আঠার মতো জুড়ে যেতে লাগল তাই ভাবলাম স্নান করে ঠাণ্ডা মাথায় অঙ্ক গুলো করব। তাই স্নান করতে চলে গেলাম। তারপর খিদেও পেয়েছে, মাকে খেতে দিতে বললাম।দেখলাম মেঘ না চাইতেন জল...বায়না করে যা পাওয়া যায় না....! তা আজ কি মনে করে! আজ তাহলে মায়ের মুড ভালো আছে। পেটভরে খেলাম আমার ফেবারিট মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল আর বেগুনি। আরও হয়েছে সে গুলোর দিকে ফিরে তাকায় নি।
  স্নান - খাওয়া সেরে আবার মনোযোগ দিয়ে অঙ্ক করতে বসলাম। আবারও কিছুক্ষণ পরে সেই এক রোগ, আমি এটাকে রোগ...ই বলব। কেন যে এমন হয় জানি না।

রনিতা, দোলা, দিক্ষ্মিতা আমায় চিৎকার করে বলল 'বৃষ্টি ঐদিকে যাসনা বহুরূপীর দল এই দিকে আসছে।' আমি গ্রাহ‍্য না করে ঐদিকে ই গেলাম। দেখলাম সত্যি! কেউ দুর্গা,  কেউ শিব, কেউ গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী সেজে আসছে। আমার পাশ দিয়ে সবাই চলে গেল। কেউ- ই আমার দিকে তাকাল না। তবে ওরা এমন ভাবে বারণ করল যেন আমাকে ধরে বহুরূপী সাজিয়ে দেবে।

গন্ধ পেলাম ঘিয়ে ভাজা লুচির। দৌড়ে রান্না ঘরে গেলাম। ও- মা এ আবার কে? দশভুজা মা দুর্গা! ভালো করে দেখি হ‍্যাঁ.... ঐ বহুরূপী। তখন তো দশটা হাত ছিল না কিন্তু এখন দশটা হাত কি করে  হল, ঠিক মানুষের হাতের মতো, কাঠের বা থার্মোকলের নয় তো...! এক হাতে ছাঁনচা আর এক হাতে গামলা বাকি হাত গুলো লুচি বেলছে কাটছে আরও কতকি। এক অদ্ভুত দৃশ্য একটা হাত রাবারের মতো লম্বা হয়ে বাসনের সেল্ফে লণ্ডভণ্ড করছে। আমি বললাম  কি খুঁজছো ঐভাবে মা বকাবকি করবে। কোনো কথা বলল না। যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি।

সবকাণ্ড দেখে আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমি বৃষ্টি তো! হাতে নিজেই চিমটি কাটলাম জোর লাগল। রণিতা দোলা  দিক্ষ্মিতা সবাই সেজেছে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক। আমি বললাম তোরা কেন সেজেছিস? আর গণেশ কোথায়? আমাকেই গণেশ সাজা আমি সাজব। কেউ কিছুই কথা বলে না। ওরা সবাই লাইন দিয়ে বসে ঘিয়ে ভাজা লুচি আর আলুভাজা খাচ্ছে। যেন সেই পুজোর প্রসাদ। আমিও লোভ সামলাতে না পেরে ওদের পাশে বসে পরলাম। বসবো না কেন আমি তো আগে বসবো এটা তো আমাদের ই বাড়ি। বসে বললাম "দুর্গা  মা আমাকেও দাও।" না....! চাওয়া সত্বেও দিল না। শুধু কপালের তিন নম্বর চোখ টা কটকট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে চুপ রইলাম।

লালপাড় শাড়ি পরে একহাত ঘোমটা দিয়ে কলাবউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘোমটা তুলতেই বলে উঠল "না - না আমায় দেখ না উনি রাগ করবেন।"
শুধু কলাবউ আমার সাথে কথা বলল। ভাবলাম এর সাথেই গল্প করা যাক। বললাম আচ্ছা কলাবউ দোকানে কত সুন্দর সুন্দর পুজোর শাড়ি কিনতে পাওয়া যায়, তুমি এখনো বুড়ি দের মতো শাড়ি পরে আছ। আমার মায়ের অনেক শাড়ি আছে আলমারিতে। একটা দেব পরবে? শুনে কলাবউ তাড়াতাড়ি লালপাড় শাড়ি খুলে ফেলল। আমার কেমন যেন লজ্জা লাগল।

একি! ও পাড়ার পাঁচুডাক্তার আমাদের বাড়ি, বসে খবরের কাগজ পড়ছে! মাথায় দুটো শিং! হা- হা করে হাসলাম। বললাল গোরুর ডাক্তার বলে দুটো শিং লাগাতে হবে? তোমাকে তো সবাই চেনে তুমি গোরুর ডাক্তার আর আমাদের তো গোরু নেই, আছে তো জেঠু দের তা তো তুমি জানো। পরশু দিন তো এলে গোরুর ইনজেকশন দিতে। ছোটবেলায় তোমায় ভয় পেতাম এত্তবড়ো ইনজেকশন দেখে।

সব গোলমাল দৃশ্য দেখে সন্দেহ হল একি মহিষাশূর! ভয় হল পাঁচুডাক্তার মারা যাবে, একে বাঁচাতেই হবে! সবাই যা করছে করুক। সময় নষ্ট না করে খুঁজতে লাগলাম ত্রিশুল। বাড়ির সব জায়গা খুঁজতে লাগলাম। কোত্থাও পেলাম না।

এদিকে রাস্তা দিয়ে কে যেন হাঁক দেয় ত্রিশুল  নেবে গো..... ত্রিশুল.....। আমি দৌড়ে রাস্তায় গেলাম দেখলাম আমার বাপি সাইকেলে অনেক গুলো ত্রিশুল বেঁধে বিক্রি করতে বেরিয়েছে।

আমি চিৎকার করে বললাম বাপি তুমি চলে যাও এখান থেকে আর এসো না।আমাকে দেখে বাপি এগিয়ে আসতে লাগল। যত সামনে আসতে লাগল ততই বুক ঢিবঢিব করতে লাগল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

শঙ্খের আওয়াজ পেতেই আমি ঝিটপিটিয়ে উঠে বসে পরলাম, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লাম, দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
মা বুঝে গিয়েছিল আমি ভয় পেয়েছি, তাই এক গ্লাস  জল খাইয়ে বলল" কখন থেকে তোকে ডাকছি -- বৃষ্টি  ওঠ সন্ধ‍্যা হয়ে গেল, সন্ধ‍্যাবেলায় শুয়ে থাকতে নেই ।"
  'আমি জড়িয়ে ধরে বললাম মা তোমাকে অনেকক্ষণ থেকে দেখতে পায়নি।'



নিবন্ধ
তালেবান প্রসঙ্গ

সুপ্রিয় দাস 
দ্বাদশ শ্রেণি 
অশোকনগর বয়েজ সেকেন্ডারী স্কুল (উ.মা.) 



ইতিহাস আবার শেখাল , ইতিহাস থেকে আমরা কিছুই শিখি না। বর্তমানে আফগানিস্তানের কথা বললে "তালিবান" কথাটি আসবে। যা সারা বিশ্ব কে আতঙ্কিত ও চিন্তিত  করছে। কারণ তারা আফগানিস্তানের নানা প্রদেশসহ রাজধানী কাবুল দখল করেছে। বর্তমান আফগানিস্তান সরকারের পতন ঘটিয়ে সেখানে বিরাজ করছে তালিবানরা, নিজেরা নতুন করে সরকার গঠন করছে।
         
       কিন্তু এই তালেবানরা কারা , এদের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত। "তালেবান" কথাটি এসেছে আরবী "তালিব" শব্দ  থেকে। যার অর্থ হল "ছাত্র"। আরবী তালিব শব্দের সাথে ফারসী ভাষার বহুবাচনিক  উপসর্গ  আন/আঁ  যুক্ত হয়ে হয়েছে "তালিবান" বা "তালেবান" অথবা "তালেবাঁ"।  ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার পর্যায় ক্রমিক আক্রমনণে আফগানিস্তান থেকে বহু ছাত্র পালিয়ে যায়, তারা আশ্রয় নেয় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেছিল। এদের সাথে তাজিক এবং উজবেক ছাত্ররাও যোগদান করে। তখনও তালিবানের  কোনও অস্তিত্ব নেই। ১৯৯০-এর দশকে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে এই ছাত্ররা অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৪ সালে এই তালিবান গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ ওমর এবং আবদুল গনি বরাদার। মোহাম্মদ ওমর এই তালিবান গোষ্ঠীর মুখ্য প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭৯ সাল থেকে রাশিয়ার যে আক্রমণ আফগানিস্তানে চলে, সেই আন্দোলনে এই মোল্লা ওমর জেহাদি অংশ নেয়। এটি উপজাতি ভিত্তিক আন্দোলন ছিল।  এই আন্দোলনের বেশিরভাগ সদস্যই কোনও না কোনও উপজাতির। যেমন মোল্লা ওমর ছিলেন "হোটাক"  উপজাতির "টোমজি" গোষ্ঠীর সদস্য। মোল্লা ওমরের জন্ম হয়েছিল কান্দাহার প্রভিন্সের "চাহ-এ-হিম্মত" নামে একটি গ্রামে রুক্ষ আবহাওয়া,কঠিন জীবন যাপন এই এলাকার বৈশিষ্ট্য। 

           ১৯৯৬ সালে মোল্লা ওমর তালিবানের সুপ্রিম লিডার ঘোষিত হন। এরপর আফগানিস্তানে ১৯৯৬ সালে প্রথম তালিবান সরকার গঠন হয়। তালিবানরা  আফগানিস্তান সরকার গঠন-এর পরই কাবুল থেকে কান্দাহার-এ রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। আফগান গৃহযুদ্ধের সময় তালেবানরা শুধুমাত্র সাদা পতাকা ব্যবহার করতো। ১৯৯৬ সালে কাবুলের  ওপর  নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে ও আফগানিস্তানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। সাদা পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে চিহ্নিত  করে। ১৯৯৭ সালের পর ঐ পতাকায় শাহাদাহ চিহ্ন যুক্ত করা হয়। ২০০১ সালে এই তালিবান সরকার-এর পতন হয়। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে তালিবান শাসন চলে আফগানিস্তানে। এই কালিমা লিপ্ত ৫ বছর আফগানিস্তানের ইতিহাস কে কলুষিত করেছে , তালিবানরা আফগান দের উপর অন্যায় অত্যাচার করেছে। নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী আফগানিস্তানের সাধারণ নাগরিক দের হত্যা করেছে। বিশেষ করে মেয়েদের উপর অত্যাচারের সীমা চরম পর্যায়ে ছিল।  সেই সময় তালেবানরা আফগান নারীদের উপর একাধিক ফতোয়া জারি করে। সেই সকল ফতোয়া নারীদের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি কেড়ে  নিয়েছিল, এক কথায় নারীদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেই সকল ফতোয়া গুলির মধ্যে অন্যতম কিছু হল - মেয়েদের স্কুল কলেজ ছাড়তে বাধ্য করা হয়, কোন মহিলা বাড়ি থেকে একা বেড়াতে পারবে না আর যদি বেড়ায় সঙ্গে একজন পুরুষ আত্মীয় থাকা বাধ্যতামূলক, ঘর থেকে বেড়াবার  সময় মুসলিম মহিলা দের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক এবং মহিলাদের শরীরের কোনও অংশ এমন কী পায়ের পাতাও যেনো না দেখা যায়। কোনও মহিলা যেন কর্মসংস্থানে না যায় তা বাধ্যতামূলক করা হয় এবং আফগানিস্তানে প্রত্যেকটি পরিবারের একটি মেয়ের সাথে একটি করে তালেবান যোদ্ধার বিবাহ দেবার ঘোষণা করা হয়।  তালিবানরা অমুসলিমদের উপরও বেশ কিছু আইন এনেছিল: অমুসলিমদের উপাসনালয় নির্মান করতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। কিন্ত তাদেরকে বিদ্যমান পবিত্র স্থানে পূজা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এমন কি হলুদ কাপড় লাগিয়ে তাদের বাড়ি গুলি চিহ্নিত করা হয়! এই নিষেধাজ্ঞা মূলত দেওয়া অমুসলিমরা যেন মুসলমানদের সাথে একই সঙ্গে বসবাস না করতে পারে, এবং অমুসলিম মহিলাদের একটি বিশেষ চিহ্ন দিয়ে হলুদ পোশাক পড়তে বলা হয় যাতে মুসলমানরা তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারে। তালেবানরা তাদের শাসন কালে পোলিও টিকা নিষিদ্ধ করে। কারণ তাদের ধারনা টিকা কর্মীরা গুপ্তচর এবং খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করে। তালেবানরা একাধিক স্কুল ধ্বংস করে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দের হত্যা করে। ১১ আগষ্ট ১৯৯৮ তালেবান "পুলি খুমরি পাবলিক লাইব্রেরি" ধ্বংস করে। লাইব্রেরিতে প্রায় ৫৫,০০০- এর ও বেশি বই ছিল। ১৯৯৬-২০০১ -এর তালেবান শাসন কালে তারা ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানো এবং দাবা সহ অনেক বিনোদন মূলক কাজকর্ম এবং খেলা নিষিদ্ধ করেছিল। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, গান এবং স্যাটেলাইট বিনোদনও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।  এই সকল ফতোয়া গুলি অমান্য করলে চরম থেকে অতি চরম হত এমনকি মৃত্যু দণ্ড  দেওয়া হত। ২০০১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের হস্তক্ষেপে এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে তালিবানরা পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়। ২০০১ সালে আমেরিকার সেনাবাহিনী তালিবান শাসনের অবসান ঘটায়। এবং আফগানিস্তানেই আমেরিকার সেনাবাহিনী তালিবান শাসনের অবসান ঘটায়। এবং আফগানিস্তানেই আমেরিকার সেনাবাহিনী মোতায়ন রাখা হয়, শান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্য। 

      ২০০৪ সালে ২৬ জানুয়ারি আফগানিস্তান ইসলাম প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। এবং এই সরকার পুনরায় কাবুল কে আফগানিস্তানের রাজধানী ঘোষিত করে। বর্তমানে আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী দীর্ঘ ২০-২১ বছর ধরে আফগানিস্তানের থাকার পর তারা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে থাকে। আর এই দিকে তালেবানদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা নেতৃত্বে। এই হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা ২০১৬ সালে তালিবান দের প্রধান নেতা হিসেবে ঘোষিত হন এবং বর্তমানে তার নেতৃত্বে তালেবানরা পুনরায় কাবুল সহ আফগানিস্তান দখল নেন। এবং তালেবান দের তরফ একটি বিবৃতি তে জানানো হয় -"তারা পুনরায় আফগানিস্তানে সরকার গঠন করবে। তারা আর কোনো যুদ্ধ চায় না তারা আফগানিস্তানে শান্তি সৃষ্টি করবে"। তারা এও বলেন "তারা আগেকার তালেবান দের মতো নয়। তারা আধুনিক তালেবান "। আর এই দিকে তালেবান রা কাবুল দখল করার পরই আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট আসরফ গনি পদত্যাগ করে পালিয়ে যান। তিনি এখন বর্তমানে কোথায় আছেন তা কেউ জানে না। রাশিয়ার দূতাবাসের দাবি আসরফ গনি পালিয়ে যাবার সময়, কম করে চারটে গাড়ি এবং টাকা-পয়সা ভর্তি একটি হেলিকপ্টার সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এমন কি তিনি নাকি আরো টাকা পয়সা নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন,  কিন্ত জায়গার অভাবে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য রাশিয়ার দূতাবাসের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার পর আসরফ গনির সম্পর্কে নিন্দার ঝড় উঠেছে চারিদিকে। আফগানিস্তানের উপ-রাষ্ট্রপতি অমরুল্লাহ সালেহ নিজেকে আফগানিস্তানের সংরক্ষক রাষ্ট্রপতি দাবি করেছেন। কারণ আফগানিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির  অনুপস্থিতি, দেশ ছেড়ে যাওয়া, ইস্তফা, অথবা মৃত্যুর পর উপ-রাষ্ট্রপতি কার্যবাহী রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। 

         আফগানিস্তানের বসবাস কারী বিভিন্ন দেশের নাগরিক যারা বিভিন্ন প্রয়োজনে আফগানিস্তানে বসবাস করছেন,তাদেরকে নিজ নিজ দেশ, নিজ নিজ নাগরিক দের ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। এর মধ্যে একাধিক দেশ, তাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছে। সেই সকল নাগরিকদের মধ্যে থেকে একজন নাগরিক সংবাদপত্রে বলেছেন -" তালিবানরা ভয়ঙ্কর থেকে অতি ভয়ঙ্কর,  তারা মুখে বলে এক আর কাজে করে আর এক, এখনকার তালিবান আর আগে কার তালেবান দের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই "।

         কিন্ত সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল আফগানিস্তানের মধ্যে অবস্থিত পাঞ্জশির উপত্যকা এখনও দখল করতে পারেনি তালেবানরা। সেই প্রদেশকে রক্ষা করতে আহমদ মাসউদের নেতৃত্বে একটি বাহিনী গঠিত হয়েছে। যা তালিবান দের হাত থেকে পঞ্জশির প্রদেশকে রক্ষা করে চলেছে। আর তালিবান রাও পঞ্জশির প্রদেশ দখল করতে মরিয়া। শেষমেষ আফগানিস্তান ও আফগানদের অবস্থা কী হয় আপাতত সেই দিকে তাকিয়ে সারা বিশ্ব। 
                     

সূত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইট 
               


টিটো ও ডাইনোসর

বিশ্বদীপ দে

একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল টিটোর। গল্পটা একদম এখান থেকেই শুরু হোক। যদিও তোমরা হয়তো ভাবছ স্বপ্ন দিয়েই তো দিব্যি গল্পটা শুরু করা যেত। কিন্তু তাহলে যে গল্পটা জমত না। কেন? বলছি, বলছি। আগে গল্পটা তো শুরু হোক।
ঘুম ভেঙে টিটো দেখতে পেল বাইরে বেশ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাদা আলোয় ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ। মা পাশে ঘুমিয়ে কাদা। বাবা অফিসে। নাইট শিফট। ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে। এখন ক’টা বাজে? টিটো ঘড়ি দেখতে শেখেনি এখনও। এই নিয়ে বাবা অন‌েক বকাবকিও করে। ক্লাস টু-তে নাকি বাবা ঘড়ি দেখতে জানত। টিটোও ভেবেছে শিখে নেবে। শেখা হয়নি এখনও। ঘর অন্ধকার। কিন্তু বাইরে থেকে ঘরে যে আলো আসছে তাতেই দিব্যি দেখা যাচ্ছে ঘড়িটা। ছোট কাঁটাটা তিনের আশপাশে। তার মানে তিনটে বেজে গেছে বা এইবার বাজবে। 
হঠাৎই কেমন ভয় করতে শুরু করল টিটোর। এত রাতে কখনও এর আগে তার ঘুম ভাঙেনি। বাবা থাকলে তাও মাঝখানে থাকা যেত। কিন্তু বাবা অফিসে থাকায় সে এখন জানলার ধারে। চুপি চুপি বিছানায় উঠে বসল টিটো। জলতেষ্টা পাচ্ছে। মাকে না জাগিয়ে সাবধানে সে খাট থেকে নেমে ডাইনিংয়ে এসে ছোট বোতলটা থেকে ঢকঢক করে জল খেল। আর তারপরই মনে পড়ল জলের বোতল তো খাটেই ছি‌ল। মা তার বালিশের পাশে ছোট্ট একটা বোতল রেখে দেয়। খামোখা তাকে নামতে হল। টিটো তাড়াতাড়ি বেডরুমের দিকে এগোল। এমনিতে সারাক্ষণই মনে হচ্ছে কে যেন তাকে দেখছে। অথচ দেওয়ালে একটা টিকটিকি ছাড়া কেউ নেই। 
ঠিক সেই সময় বাড়িটা যেন কেঁপে উঠল গমগম শব্দে! টিটো একছুটে দৌড়ে মশারি তুলে ফের খাটে উঠে পড়ল। আর তারপর জানলার বাইরে তাকাতেই... ম্যাজিক! এ তারা কোথায় চলে এসেছে? বাড়িটার কি তলায় চাকা লাগানো? গড়াতে গড়াতে কোনও জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে! বাইরের গাছগুলোও তার চেনা গাছ নয়! যেন কবেকার পুরনো গাছপালা। 
ফের কাঁপছে বাড়িটা। ভ্যাবাচ্যাকা টিটো বুঝতে পারছে, বাড়ি নয়, কাঁপছে মাটি। দুম দুম দুম দুম! জানলার বাইরে লম্বা কালো কালো থাম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক পিছনেই একটা লম্বা কালো পাইপ। কেমন হেলতে দুলতে সেগুলো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে! বিদ্যুৎ চমকাতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। চোখ গোল গোল টিটো আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল, ‘ডা-ই-নো-স-র!’
হ্যাঁ, ডাইনোসর। জানলার বাইরে একটু দূরে যে লম্বা ডাইনোসরটা গাছের ডালে মুখ দিচ্ছে সেটার নাম ব্রন্টনোসরাস। টিটো সবার নাম জানে। টিটোর আঁকার খাতায় সব ছবি আঁকা আছে। তাদের বাড়িটা ডাইনোসরদের দুনিয়ায় চলে এসেছে! ডিপ্লোডকাস, ট্রাইসেরাটপস, স্টেগাসরাস, জলের বাসিন্দা বিরাট চেহারার মোজাসরাস আর... আর...
এরপর যার নাম টিটোর মনে পড়ল তাকেই ঠিক তক্ষুনি দেখা গেল। টিরানোসরাস রেক্স। রেক্স মানে রাজা। বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ডাইনো রাজা সোজা গিয়ে কামড়ে ধরেছে ব্রন্টনোসরাসকে। ঠিক যেমন জুরাসিক পার্কের সিনেমাগুলোয় দেখা যায়। ঝটাপটি চলছে চরমে। অন্ধকার জঙ্গলে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। টিটো হাঁ করে দেখছে। 
খানিক পরে সব শব্দ থেমে গেল। এমন উত্তেজনার মধ্যেও টিটোর ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। সে মায়ের দিকে তাকাল। মা কিছুই জানে না। কেমন আরামে ঘুমোচ্ছে। টিটো চুপ করে শুয়ে পড়ল। আর তখনই ঝড় শুরু হল। এর মধ্যে আবার ঝড় শুরু হল কেন? ভাবতেই টিটোর নাকে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ ভেসে আসতে লাগল। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। সে জানলার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে তার খুব কাছেই আরেকজন কেউ আছে। কে আছে সেটা আন্দাজ করেই টিটো ঘাড় ঘোরানোর সাহস পেল না। 
কিন্তু বেশিক্ষণ না তাকিয়েও থাকতে পারল না। ঘাড়টা ঘোরাতেই পরিষ্কার বুঝতে পারল তাদের জানলার একদম ধারে এসে গেছে টিরানোসরাসটা! তার প্রকাণ্ড মুখের কেবল একটা অংশই এই জানলার সমান। সে চোখটা তাক করে বোঝার চেষ্টা করছে ঘরের ভিতরে কারা আছে। তার নিঃশ্বাসের বিশ্রী গন্ধে গা আনচান করছে টিটোর। ব্রন্টনোসরাসটাকে খেয়েও ওর খিদে মেটেনি। অন্ধকারের মধ্যেও টিটো পরিষ্কার দেখল টিরানোসরাসের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। দুটো নয় একটা। একটাই এপাশে। আরেকটা তো ওপাশে। ওই একটা চোখ দিয়েই টিরানোসরাস তাকে দেখছে। বাবা ভূতের গল্প বলার সময় বলে, ভূতের চোখ ভাঁটার মতো জ্বলে। ভাঁটা ঠিক কী ব্যাপার জানে না টিটো। কিন্তু তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না ডাইনোটাও ওই রকম চোখেই তাকে দেখছে। আচ্ছা, ওরা কি রাতে দেখতে পায়? টিটো নিজের মনে প্রশ্ন করল। কেউ উত্তর দিল না। কেই বা দেবে?    
ঠিক তখনই মা ধড়মড় করে উঠে বসল খাটে, ‘‘এ কী রে! তুই উঠে বসে কী দেখছিস? শুয়ে পড়, ঘুমা।’’ ঘুম জড়ানো মায়ের গলায় রাগের আভাস। দিনের বেলা হলে ধমকটা আরও জোরে পড়ত। কিন্তু এখন তো মা পুরোপুরি জেগে নেই। ঘুমের মধ্যেই আছে। টিটো আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে মা’কে জড়িয়ে ধরল। 
মা’কে জড়ালে মা খুব খুশি হয়। জানে টিটো। তার নিজেরও তো সব ভয় কেটে যায়। টিটো মা’কে জড়িয়ে ধরতেই ঘুমটা যেন মা’র কাছ থেকে গড়িয়ে এসে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। টিটো জানে জানলার বাইরে আর কোনও ভাঁটার মতো চোখ জ্বলছে না। গোটা জঙ্গলটাই মিলিয়ে গিয়ে ফের গজিয়ে উঠেছে চেনা রাস্তা, চেনা বাড়িগুলো। এমনকী গাছপালা, গলির ভেলো কুকুরটাও ফিরে এসেছে। ব্যাটা এতক্ষণ নির্ঘাত টিরানোসরাসের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে ছিল। 
তখনই টিটোর আবার মনে পড়ল স্বপ্নটার কথা। স্বপ্নেও তো সে ডাইনোসরদেরই দেখছিল। তাই ঘুম ভেঙে নিজের বাড়ির পাশেই ওদের পেয়ে গেছিল। শুরুতে সেকথা তোমাদের বলা হয়নি। তাহলে যে তোমরা ধরতেই পেরে যেতে সবটা। তখন তো আর গল্পটা হত না। হারিয়ে যেত। কিন্তু তা কী হয়? গল্পকে তো হারাতে দেওয়া যায় না কোনওভাবেই। 
যাই হোক, টিটো ঘুমিয়ে পড়ছে। গল্পটাও তাই এবার শেষ হয়ে যাবে। জানলার বাইরে বিদ্যুতের ঝিলিক। সেই বিদ্যুৎই টিটোর বুকের মধ্যে কবেকার আলো হয়ে স্বপ্ন ছড়াতে শুরু করেছে। সেই আলোয় ডাইনোসর দেখা দেবে নাকি অন্য কেউ, সেটা টিটো ঘুম থেকে উঠলে না হয় জেনে নেব আমরা। কী বলো?

তাতান ও বুলবুলি পাখি

বিপ্লব চক্রবর্তী

জ্যেতু! ঐ পাখি তা আমাকে ধরে দাওনা.." তাতান আঙুল তুলে বুলবুলি পাখি দুটোকে দেখালো। আঙুল পাখিটার দিকে রেখে, চোখে কাতর অনুনয় নিয়ে রঞ্জনের দিকে চেয়ে রইল।
   বাড়ির চারদিকে বর্ষার জল পেয়ে জংলা গাছের এতটাই বাড়বাড়ন্ত যে, দৈনিক মজুরিতে রঞ্জনকে কাজে লাগিয়েছে অরিত্র।
রঞ্জন কাজ করবে কি, অরিত্রর তিন বছরের মেয়ে তাতান, মায়ের চোখ এড়িয়ে উঠোনে নেমে বুলবুলি পাখির পেছনে ছুটছে।
তাতানের বুলবুলির  পেছনে ছোটা দেখে রঞ্জনও মজা পেয়ে গেছে।
--- উই যে, উই যে জ্যাতু , ধর ধর!
রঞ্জনও ঘাস আগাছা তোলার ফাঁকে তাতানকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে।
পাখিদুটো তাড়া খেয়ে কামিনি ফুলগাছ থেকে রঙ্গন গাছে , সেখান থেকে তাড়া খেয়ে বড় টগর গাছটায় বসতেই তাতান  আরো মজা পেয়ে যায়।খিলখিল করে হেসে ওঠে। উঠোন জুড়ে ওর হাসিটা  সাবুদানার মতো ছড়িয়ে পড়তেই, রঞ্জনও মজা পেয়ে তাতানের সঙ্গে হাসতে থাকে।
দুজনের মিলিত হাসির ফোয়ারায়, বুলবুলি পাখি দুটো ভীষণই ভয় পায়। নিরাপদ ভেবে বর্ষায় নতুন পাতা মেলা উঁচু শিউলি গাছের ডালে উড়ে গিয়ে বসে পড়ে। সেটা দেখেই,
তাতানের হাসিটা মিলিয়ে গেল। পরিবর্তে অভিমানী গলায়  বুলবুলি দুটোকে   কচি কচি হাত দুটো তুলে ডাকতে লাগলো, " আয় আয়! বকব লা! আয়!  ধোলবো না, আয় আয় "!
বারবার ডাকার পরেও যখন পাখি দুটো নামছে না, কান্না জুড়ে দিল তাতান। জ্যেঠুকে নালিশ করতে লাগলো, " ও জ্যেতু, জ্যেতু, ওদের বলো না নেমে আসতে!  " কাঁদতে কাঁদতে এবার  রঞ্জনের কাঁধ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নালিশ করতে লাগলো।
রঞ্জনও এতক্ষণ তাতানের সঙ্গে মজা নিচ্ছিল।এবার আর মজা রইলো না। তাতান কাঁদছে। পাখিটাকে ধরে দিতে হবে রঞ্জনকে, যা একদমই অসম্ভব।তাতানের কান্না আর কাঁধ ঝাঁকানি বেড়ে যেতেই রঞ্জন হাতের খুরপিটা রেখে ,তাতানকে কোলে তুলে নিল।কোলে নিয়েই  শিউলি গাছটার সামনে এসে বুলবুলি দুটোকে দেখতে লাগলো।
বুলবুলি দুটো এতই দুষ্টু যে, মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাতানকে দেখেই চলল।আর তাতান রঞ্জনের কোলে বসে কান্না ভেজা চোখে কাতর অনুনয় করে চলল," আয় আয় বকবো লা, বকবো লা!' পাখি দুটো  তাতানের ডাক আর হাত নাড়ানোর তালে তাল রেখে মাথা দোলাতে দোলাতে  ওদের ভাষায় মজা করতে থাকলো।


চং
শ্যামলী আচার্য

“হ্যাঁ রে, তোদের চা খাওয়া হয়ে গেল?” 
তিস্তু চমকে ওঠে। একতলার জানালার সামনে বসে কলেজের প্রোজেক্টের কাজ সামলাচ্ছে সে। সকাল ন’টা। কলেজের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। এখন যেহেতু সব অনলাইন, তিস্তুরও সব ফ্রম হোম। কম্পিউটার চালু করে গোমড়ামুখে পাসওয়ার্ড টাইপ করছে। পাশে এক মগ ঘন দুধ। তার ওপরে পুরু মোটা সর। বাঁহাত দিয়ে দুধের ওপর থেকে মশা-মাছি-পোকামাকড় তাড়াতে তাড়াতে তিস্তু বাইরের দিকে তাকায়। ভুরু কুঁচকে দেখে নেয় একবার। নাঃ। কেউ তো নেই কোথাও। সামনের বাগানে গন্ধরাজ ফুলের গাছে একটা মৌমাছি বোঁ করে পাক খাচ্ছে। উল্টোদিকের বাড়িতে বাবাইয়ের বাবা তাকে জোরে জোরে ইংরেজি গ্রামার পড়াচ্ছেন। আর তো লোকজন কেউ নেই। তাহলে কে বলল কথাটা? 
এতক্ষণে কম্পিউটার চালু হল। উফ! এবার হাজিরার পালা। ভিডিও অন করতে হবে। বাঁহাত দিয়ে অগোছালো চুলটা একবার পাট করে নেয় তিস্তু। ঠিক সেই সময় জানলা দিয়ে আবার হাঁক পাড়ল কেউ, “বলি চা কি আর আছে?”
ব্যাপারটা কী? জানলার বাইরে একফালি বাগান, তারপরে বড় গেট। গেটের বাইরের গলি বেশ নির্জন। অন্তত এই সকালে লকডাউনের মধ্যে খুব জরুরি দরকার ছাড়া কেউ বেরোবেন না। তাহলে? চা চাইছে কে?
“অমন উদোর মতো এদিক ওদিক দেখিস কেন? পাঁচিলের দিকে তাকা না একবার...”
রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে তিস্তু ডানদিকে তাকায়। জানলার বাইরে নিচু পাঁচিলের ওপর বসে আছে চং। 
অত্যন্ত রেগে যায় তিস্তু। “এটা কি একটা চা চাইবার সময় হল? দেখছিস না, হিস্ট্রি ক্লাসে ঢুকছি? আশ্চর্য!”
আর বলতে বলতেই চমকে গিয়ে হাঁ করে তাকায় তিস্তু। আরে! চং কথা বলছে?
চং। পাঁচিলের ওপর আয়েস করে বসে ল্যাজ দোলাচ্ছিল। সে এই পাড়াতেই থাকে। নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। সকালে জন্টির মা দুধ-পাঁউরুটি দেন, বেলার দিকে বাবাই মাছের তেল, কাঁটা, আঁশ খেতে ডাকে, দুপুরে লাঞ্চ টাইমে তিস্তু আর গোল্লু মাছের ঝোল-ভাত মেখে জোর করে তাকে ঠুসে খাওয়ায়। ঠুসে খাওয়ানোর কারণ হল, ওই সময় চং একা আসে না, তার দুটি হুলো বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। তাদের তিস্তু আর গোল্লুর একদম পছন্দ নয়। ফলে ওরা দুই বন্ধুকে সরিয়ে আগে চংকে পেট ভরে খাইয়ে নেয়। 
চং যে এপাড়ার একটি অতি বিচ্ছু বেড়াল, সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না। কিন্তু চংকে বিচ্ছু, বদমাইশ তো দূরস্থান, সামান্য দুষ্টু বললেও তিস্তু আর গোল্লু হাঁ হাঁ করে তেড়ে তার চুল ছিঁড়ে মাথায় টাক বানিয়ে তাতে পারমানেন্ট মার্কার পেন দিয়ে হাবিজাবি লিখে ছেড়ে দেবে। উফ! চংএর নামে গোল্লু বা তিস্তুকে একবার কেউ কিছু বলে দেখুক।  
কিন্তু চং সাতসকালে এসে পাঁচিলে বসে বিশুদ্ধ বাংলায় চা খেতে চাইছে, এই ব্যাপারটা হজম করতে তিস্তুর বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। ছেলেবেলা তিস্তু গ্রুপ থিয়েটারের নাটকে অভিনয় করত। অনেকদিন অবধি সে ছিল হযবরল-এর হিজিবিজবিজ। তখন ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সব প্রাণীরাই কথা বলে, বলতে পারে। বোকা বাপ-মায়েরা তাদের ভাষা বোঝে না। এই ধারণা তার বড়বেলাতেও আছে। তিস্তুর ছোট বোন গোল্লু এইসব আলোচনায় তার সমঝদার পার্টনার। বেশ বোঝে ব্যাপারগুলো। 
এই তো কালই গোল্লু এসে বলল, জারুলফুলের গাছের পাশে একটা শালিখ খুঁটে খুঁটে পোকা খাচ্ছিল। গোল্লুকে বাড়ির গেট থেকে বেরোতে দেখেই তার মুখখানা কেমন কালচে হয়ে গেল। সে গোল্লুর দিকে একবার তাকিয়েই শোঁ করে উড়ে চলে গেল কেল্টুর চায়ের দোকানের ওপরে। সেখানে ওর মা বসে থাকে। 
তিস্তু একবার জিগ্যেস করল, “তুই কি করে জানলি ওটা ওর মা?”
গোল্লু বলল, “আমি ঠিক জানি। ও ওখানে গিয়ে ওর মা’কে বলল, আজকেও আমি সক্কালবেলা গোল্লুকে দেখে ফেলেছি। আজ আর একটাও ভালো পোকা আমি খেতে পাব না। গোল্লুটা যা অপয়া।” 
“হুম। ঠিকই বলেছিস। হতেও পারে। একটা শালিখ দেখলে স্কুলে আমাদের পরীক্ষা খারাপ হয়, খেতে বসে মায়ের বকুনি খেতে হয়, বিকেলে ফুচকাওলা আসে না, খেলার সময় বৃষ্টি নামে... ওরও তোকে বা আমাকে একলা দেখলে নির্ঘাত কোনও ঝামেলা হয়। হতেই পারে। শালিখের কাছে একলা বাচ্চাও অপয়া হওয়া উচিত।”      
চং বেশ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। না, তিস্তুর দিকে নয়। পাশের মাধবীলতার ঝাড় সোজা লতিয়ে উঠেছে দোতলার বারান্দায়। তার ফুলগুলো হাওয়ায় দোলে। সেইদিকে দেখছে চং। তিস্তু বুঝতে পারে না ক্লাসের সময়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে মন দিয়ে স্যারের লেকচার শুনবে, না চং সত্যিই চা খেতে চেয়েছিল কিনা তার অনুসন্ধান করবে। চংকে আড়চোখে দেখে নিয়ে মোবাইলে মেসেজ করে গোল্লুকে। সে ব্যাটা আবার যা কুঁড়ে। ঘুম থেকে উঠলে হয়।    
টুক করে একটা সংক্ষিপ্ত মেসেজ করেই স্ক্রিনের দিকে তাকায় তিস্তু। স্যার সকলকে ভিডিও অন করতে বলছেন। সেরেছে! আজ আবার অ্যানশিয়েন্ট হিস্ট্রি। প্রাচীন যুগ। অসহ্য ঘুম পায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাচীন সেই আদ্যিকালের কথা কার শুনতে ভাল্লাগে? মুখ গোঁজ করে ভিডিও অন করে তিস্তু। আরে! একি কাণ্ড! স্যারের মুখটা আজ কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে না? গোঁফগুলো খোঁচা খোঁচা হয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে গেছে অনেকটা... চশমার ফ্রেমের কিনারে কালো ছোপ, কাচের আড়ালে চোখের মণিদুটো একেবারে কটা... নাকটা যেন একটু বেশিই চ্যাপটা লাগছে আজ... নাকের ফুটো দুটো বেশ বড় বড়। আর কানদুটো এমনভাবে বাইরে দিকে খাড়া হয়ে উঁচিয়ে আছে...। চোখ কচলে ভালো করে তাকায় তিস্তু। একে একে সকলে ভিডিও অন করছে। অভিষিক্তা, রঞ্জাবতী, কথাকলি, রূপকথা, অয়ন্তিকা, ইন্দ্রায়ুধ... আরে এসব হচ্ছেটা কী? প্রত্যেকের চোখের মণির রঙ পাটকিলে বা ধূসর। কপালের কাছের চুলে কারও যেন হাইলাইট করে ছাই রঙ করা হয়েছে। কেউ আবার একদম ফ্যাকাশে চুল। বয়কাট খোঁচা চুল খাড়া হয়ে রয়েছে কারও কারও। হাসিমুখের পাশ দিয়ে ধারালো শ্বাদন্ত বেশ স্পষ্ট। খাড়া কান। কী আশ্চর্য! হঠাৎ দেখলে যে কেউ ভাববে এ যেন বেড়ালদের ক্লাসরুম। স্যার মিহিগলায় বললেন, “মিঁয়াও। ম্যাঁ... গড়ড়ড়ড়... ঘঁ ম্যাঁ”। তিস্তু স্পষ্ট এইরকমই শুনল। এই ভাষা ও জানে না। কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। রঞ্জাবতী হাত তুলে বলছে, “ম্যাঁও ঘঁঘঁ মিঁইইইইয়াও।” এসব হচ্ছেটা কী? 
তিস্তু হাঁ করে বলতে যায়, “স্যার...”, কিন্তু ওর গলা দিয়ে বেরোয় “মেঁইয়াও...”। কী সর্বনেশে কাণ্ড! ওরা কি তবে সবাই... ঘামতে শুরু করল তিস্তু। ও যে এখনও কারও ভাষা বুঝতেই পারছে না! কী হবে? 
টুং করে মেসেজ এল একটা। 
ও মা! গোল্লুর ডিপিতে একটা বেড়ালছানার ছবি। গোল্লু তিস্তুর মেসেজের উত্তরে লিখেছে, “মিঁইয়ামিঁ”। মানে কী এর? সঙ্গে ভয়েস মেসেজ। সেটা খোলা মাত্র ‘গররর ফোঁসঃ মিঁইয়াওঁ ম্যাঁ’ বলে গোল্লু কীসব যেন বলে গেল! 
তিস্তুর কী যেন মনে হয়। দৌড়ে যায় জানলার দিকে। চং এখনও পাঁচিলে। গুনগুন করে কী যেন সুর করে বলছে। কান পেতে তিস্তু স্পষ্ট শুনল চং গান গাইছে! হে মাধবী দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি, দ্বিধা কেন...। 
“অ্যাই চং” তিস্তু খুব জোরে চিৎকার করতে যায়, ওর গলা দিয়ে বেরোয় “গরররর ফ্যাঁশ”...
চং ভুরু কুঁচকে তাকাল একবার।
“রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাঝখানে খামোখা চেঁচালি কেন? একটা সেন্স নেই তোর? হোপলেস! যা গিয়ে তোর হিস্ট্রি ক্লাসে বেড়ালের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পড়। সকালে একটু চা পর্যন্ত খাওয়ালি না... গানের মেজাজটাও দিলি চটকে... দূর দূর।” 
পাঁচিলের ওপর দিয়ে গদাইলশকরি চালে হেঁটে দু’পা এগিয়ে পেছন ফিরে তাকায় চং।
“মানুষ তো আর হতে পারব না এই জীবনে, সামান্য একটু পালটাপালটি করে দেখি কেমন লাগে... তোরাও দেখ না বাপু... বেড়াল-জীবন।”  
এক মুহূর্তে তিস্তুর চোখের চারপাশটা কেমন সাদা-কালো ঝাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া লাগতে থাকল। ধেবড়ে যাওয়া আবছা পাঁচিলে একটা চারপেয়ে কে যেন হেঁটে গেল। চেনা চেনা লাগছে। 
তিস্তু গম্ভীর হয়ে বলল, “মিঁইয়াওওওঁ।”


শিশু ও হরিণ ছানা    
অভিজিৎ  চৌধুরী

ওকে আমি খুব ভালোবাসতাম। বয়স তখন কতো ছিল ২ বছরের বেশী নয়। হাসলে শুধু মাড়ি দেখা যেতো, দাঁত তখনও ওঠেনি। বা একটা ছোট্ট দাঁত দেখা যেতো।
আমার বাংলোটা ঢোকার মুখে দুটো ময়ূর ছিল। মাটির। রং করে দেওয়াতে একদম মনে হতো জীবন্ত।
এই বাংলোটা ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য তৈরি হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের এক প্রান্তে। 
ক্লাইভ সিরাজকে সিংহাসন চ্যুত করে এবং স্বদেশীয়দের হাত দিয়ে হত্যা করিয়ে মুর্শিদাবাদ শহর থেকে একটু একটু করে মুছে দিচ্ছিলেন নবাবী-স্মৃতি।
তবুও হাজার দুয়ারি নতুন করে ব্রিটিশ স্থাপত্যের মোঘল কারুকাজের মিশ্রন ঘটিয়ে সাময়িক বিচার-ব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছিল। 
নবাব মীরজাফর যে প্রতীক নবাবই ছিলেন এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। মীরকাশিমকে বাদ দিলে আর সমস্ত উত্তরাধিকারীরা ছিলেন মোটেই স্বাধীনচেতা নন, বরং পুতুল নবাব বললেও কিছুই বলা হয় না।
কলকাতা রাজধানী হওয়ার পর মুর্শিদাবাদ তার যাবতীয় গৌরব হারালেও ভূমি-রাজস্বের আদায়ের কারণে এখানে একজন সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের প্রয়োজন ছিল। তারই কারণে এই অপূর্ব বাংলো কিছুটা লোকচক্ষুর অন্তরালে কিন্তু গঙ্গা নদীর প্রায় তীরে নির্মিত হয়। 
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর কোন সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এই বাংলোয় থাকেননি। অবশ্য তাঁরা সব বাদামি চামড়ার সাহেব ছিলেন।
সচরাচর এই সব বাংলোয় থাকেন বা বরাদ্দ হয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্ট যা কিনা বর্তমানে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারদের জন্য।
অথচ এই বাংলোয় গত ৫০-৬০ বছর কেউ না থাকায় প্রায় ভূতুড়ে বাংলো হয়ে উঠেছিল।
বায়সদ্বীপ থেকে লট-বহর নিয়ে আমি যখন প্রশাসক হিসেবে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এলাম, আমার খুব পছন্দ হয়ে গেছিল এই পরিত্যক্ত বাংলো।
হেরিটেজ বিল্ডিং মুর্শিদাবাদে কম নেই। সব যে খুব চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত এমনটা বলা যাবে না। 
এটিকে অবশ্যই হেরিটেজ বিল্ডিং বলা যাবে না। বায়স-দ্বীপ থেকে আমার সঙ্গে একটি হরিণ ছানাও এসেছে, তবে জ্যান্ত নয়, পশমের তৈরি। স্বয়ংবর গোষ্ঠীর মেয়েরা আমায় বিদায় দেওয়ার সময় উপহার দেয়।
দামী পেন, সুগন্ধি আতর আর কিছু বইয়ের সঙ্গে এই হরিণ শিশুও আমার পড়ার টেবিলে শোভিত হতে থাকলো।
তার আগে এই পরিত্যক্ত বাংলো পুরোপুরি সংস্কার করে বাসযোগ্য করতে বেশ সময় লেগেছিল । 
ভয় ছিল সাপেরও। কার্বোলিক অ্যাসিড ছড়ানোর পরও প্রচুর সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখতাম।
ঘরগুলির কার্নিসে লতাগুল্মও বেরিয়ে থাকত। সবটা নিকেশ করা যায়নি।
ভূত বাংলো নিয়ে যে সব কথার চর্চা হয় এই বাংলো নিয়েও হতো। আপনা থেকেই শাওয়ারে জল চালু হয়ে যায়। দরজা হুট করে খুলে যায়। ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায়, এমনকি কখনও কখনও ব্যালে নৃত্য ও পাশ্চাত্য মিউজিকও শোনা যায়। 
সেকালের বিখ্যাত নর্তকী হিকিও নাকি এই বাংলোতে এসেছিলেন। সেকালের সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে ডুয়েল লড়ার রেওয়াজও ছিল। এসবও নাকি শোনা যেতে পারে বা অনেকেই এক বা দু রাত থাকতে গিয়ে শুনেছেন বলে আর থাকেননি।
বাংলোটির বিভিন্ন ঘরে অনেকগুলি পেইন্টিংও ছিল। দুটি ছিল ওয়াটার কালারের। আর বাকীগুলিতে রং-এর ব্যবহার বেশ চোখে লাগার মতোন। 
অবশ্য প্রত্যেকটা পেন্টিংই বিবর্ণ হয়ে গেছিল। আমাকে শিল্পী ডাকিয়ে রঙের পোচ দিতে হয় নতুন করে। আর প্রচুর মাকড়সার জালও বিছানায় প্রায়ই পড়ে থাকত। সাবধানে দেখে নিতে হত। বহুদিন মানুষ থাকেনি বলে কেয়ারি করা ফুলের বাগানটিরও মৃত্যু হয়েছিল আর ফোয়ারাও কালো জলের আধার হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। 
ফুলের বাগান করালাম। শীতকালে এসেছিলাম বলে সবজিও লাগালাম প্রচুর। পরিত্যক্ত বাংলোটা দেশীয় সিভিল সার্ভেন্টের আগমনে নতুন করে সেজেগুজে উঠল।
আমার ড্রাইভার নীলুর একদম পছন্দ ছিল না এই বাংলো। সে প্রায়ই বলতো – অশুভ। ওর মেয়েকে আমি আদর করতাম গাড়িতে বসে। বেশী বিরক্ত করলে সে ডাকতো – বাওয়া, বাওয়া। অর্থাৎ ওর বাবার কাছে নালিশ করত আমার নামে।
নীলু কিছুতেই বাংলোতে আসতে চাইত না। সে আমাকে দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে যেতো। 
আমি চাইলে একজন বডি গার্ড নিতে পারতাম কিন্তু আমি তো এসেছি শহরের উন্নয়ণ করতে, নিজের সুরক্ষা দিয়ে কি হবে!
রান্না করত পার্বতী বিবি। তার মেয়েকে এই বাংলোতে কাজ নেওয়ার কয়েকদিন পরে ভূতে ধরে। স্বাভাবিক ভাবে বিশ্বাস করিনি। সে আমাকে ভূতে পাওয়া তার মেয়ের দাঁতে করে বালতি-ভর্তি জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য কাহিনি বলেছে। বলেছিল ওঝা, ঝাড়ফুঁকের কথা।
আর টেবিলে বই, লেখার কাগজ-পত্তর গুছোনোর সময় সে প্রায়ই বলতো হরিণছানাটা, কেমন জানি।
আমি বলতাম – সুন্দর তো!
সে বলতো – মনে হয় এই হরিণের মধ্যে জিন রয়েছে।
আমি তখন কথা ঘুরিয়ে দিতাম। বলতাম – তুমি কতোদূর পড়েছ!
পার্বতী ক্লাস ট্যু অবধি পড়েছে। সে একে চন্দ্র দুইয়ে পক্ষ জানে। এমনিতে সে খুব ভালো মেয়ে। কখনও কখনও রাতে আমাকে বিরিয়ানি রান্নাও করে দেয়। খুব সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না করে পার্বতী। তবে হরিণছানাটা তার একদম পছন্দের নয়। 


২ 
এই বাংলোর প্রতি নীলুর ইদানিং মন খানিকটা নরম হয়েছে । দিনের রোদ থাকতে থাকতে সে মেয়েকে নিয়ে আসে। ইদানিং তার আমার সঙ্গে ভাব হয়েছে । মাঝে মাঝে কোলে উঠে আমার খোঁচা বের করা দাড়িতে তার কচি আঙুল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করে – তি , তি!
একদিন সে এলো ন্যাড়া হয়ে। তার মা নাপিতকে দিয়ে অমন সুন্দর চুলগুলি কাটিয়ে দিয়েছিল।
তাকে যখন আমি জিজ্জেস করলাম – তোমার চুলগুলি গেলো কোথায়! 
সে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে বলত – মা, মা।
অর্থাৎ চুলগুলি না থাকাতে তার বেশ শোক। 
একদিন আমার খুব পীড়াপীড়িতে ছুটির দিনে নীলু তার মেয়েকে নিয়ে সন্ধেবেলায় এসেছে।
ছোট্ট মাম্‌-কে আমি বসিয়েছি পড়ার টেবিলের লাগোয়া রিভলভিং চেয়ারে। চেয়ারটা ঘুরে গেলে সে খুব খিলখিল করে হেসে উঠছে। 
নীলুর গাড়ির লগ বই সই করছি। হালকা আলো জ্বালানো রয়েছে। একই ঘরে সামান্য দূরে মাম্‌ বসে রয়েছে।
কিলোমিটারের হিসেব মিলিয়ে দিচ্ছে নীলু, আমি সই করে চলেছি। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট আমরা খুব কম আলো পড়া রিভলভিং চেয়ারটা দিকে তাকাইনি, সেখানে মাম্‌ বসে রয়েছে। 
কাজ শেষ হলে নীলু ডাকল – মাম্‌, মাম্‌ – বাড়ি যাবে তো! চলো মা। 
চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে দেখি মাম্‌ নেই। এমনকি টেবিলের হরিণ ছানার পশমের মূর্তিটাও নেই।
খিলখিল করে হাসির শব্দ পেলাম শিশুর। আর কোন হরিণছানার ছুটোছুটির।
শব্দ লক্ষ করে আমরা দুজনে ঘরময় খুঁজছি। শব্দের উৎস-টা যেন আমাদের ধোঁকা  দিচ্ছে। আমরা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না মাম্‌কে। আর সেই খেলনা হরিণ-ছানাকেও। 
নীলু পাগলের মতোন বাইরে গেলো। ফোয়ারা থেকে জল পড়তে শুরু করে ফোয়ারার আধারটা জলে টই-টম্বুর হয়ে উঠেছে।
আর নীলুর মেয়ে, মাম্‌ সেই জলাধারের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুর দিকে তাকিয়ে সে তার ছোট্ট হাত-দুটো দিয়ে হাততালি দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। দৃশ্যটা দেখে আমারও বুক কেঁপে উঠল। 
আর একটা হরিণছানা ফোয়ারার চারপাশের চাতালে ছায়ার অস্পষ্টতা নিয়ে দৌড়ে চলেছে। 
নীলু দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিলো।
সেই রাতে আমিও বাংলোতে থাকতে পারলাম না। সার্কিট হাউসে গিয়ে উঠেছিলাম।
পরদিন সকালে গিয়ে দেখি পশমের হরিণ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। 
মামের অবশ্য কিছু হয়নি। নীলু বলল – সে ভালো আছে।   

সার্কিট হাউসে এসে উঠলাম। কয়েকদিন ছিলাম সেখানে। তারপর জেলা শাসকের কাছে আর্জি জানাতে সরকারি আবাসন পাওয়া গেলো। 
আবাসনে প্রচুর লোকজন, যা আবার আমার তেমন পছন্দ নয়। ছেলেবেলা থেকে নির্জনতা আমাকে টানে। ক্লাব, শখের থিয়েটার এসব আমি কখনও করিনি। বলা যায় শখের লেখক, সুযোগ পেলে লিখি।
সেই বাংলোতে চমৎকার একটা টেবিল আর রিভলভিং চেয়ার ছিল ল। জানলা খুলে দিলেই ছিল গঙ্গা অর্থাৎ ভাগীরথি নদী। দুপুর বেলা ছুটির দিনের অলস অবসরে পাল-তোলা নৌকা দেখা যেত। গঙ্গা পার করলেই সিরাজের কবর। 
লুৎফুন্নিসা যতোদিন বেঁচে ছিলেন, ফুল দিতেন – এমনই লোকশ্রুতি ছিল। 
হাউজিং ছিল বাজারের কাছাকাছি। সরকারী কর্মচারীদের পক্ষে বেশ সুবিধে।
নির্জনতা আমায় ডাকছিল , হয়তো সেই বাংলোও।
নাজির বাবুর কাছ থেকে এক রোববার চাবি নিলাম। নীলুও এলো আমার সঙ্গে।
মাম্‌ এখনও সেই ছোটই আছে। কয়েক মাসে কি খুব বড় হয়ে যেতে পারে। ন্যাড়া মাথায় চুল গজিয়েছে। আরো ফর্সা হয়েছে মুখটা। চোখ দুটো গোল গোল, সামান্য চ্যাপ্টা নাক, ভারী মিষ্টি। দুনিয়ার সকলের সঙ্গে ভাব হলেও আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব কিছুতেই তেমন জমছে না। 
পার্বতী বিবি হাউজিং-এ আসে। হরিণটা নেই দেখে সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছে। আর কোন জিন আমায় কাবু করতে পারবে না।
নীলু এমনিতে খুব সাহসী। তাছাড়াও আমরা বেলা থাকতে থাকতেই গেলাম। 
বাংলোতে যতোদিন ছিলাম, বাইবেটা নিয়ে যতোখানি ভেবেছি, এক শোওয়ার ঘর, বাথরুম আর পড়ার ঘর ছাড়া অন্য ঘরগুলি খুলেই দেখা হয়নি। 
এবার দেখলাম। পশ্চিম দিকের প্রান্তে একটা ঘরে কখনই যাওয়া হয়নি। এবার এলাম, খড়খড়ি খুলে দিতেই নদী গঙ্গা যেন আরো কাছে চলে এলো।
এখানেও অনেকগুলি পেইন্টিং দেওয়ালে ছিল, খুব বিবর্ণ হয়ে গেলেও যতোটুকু বোঝা যাচ্ছে – বেশ টানছিল শিল্পীর মুন্সিয়ানা।
কোন ঘুঙুর, ড্যুয়েটের তরোয়ালের শব্দ পেলাম না। সবটাই স্বাভাবিক শুধু গুমোট ঘরের গন্ধ ছাড়া।
এবার এলাম পড়ার টেবিলের কাছে। কিছু বই-পত্তর ফেলে গেছিলাম। কিছু লেখা , পেন – সবই অবিকৃত রয়েছে।
কিন্তু আমার জন্য চমক অপেক্ষা করছিল। অনেক কিছুর মতোন অবিকৃত রয়েছে সেই হরিণ-ছানা। পশমের তৈরি, কালো ছোট্ট শিং দুটো আরো যেন চকচক করছে। 
চোখের মণিগুলিও যেন ঠিকরে বেরিয়ে এসে আমায় দেখছে।
ঠাণ্ডা স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল যেন। নীলু বলল – চলুন স্যার , হরিণ-ছানাটা থাকুক। 
আমিও ওকে স্পর্শ করতে সাহস পেলাম না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments