জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-(২৫)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --
পর্ব-২৫

সন্দীপ কাঞ্জিলাল



ধর্ম ও দর্শন 

St Anselm of Canterbury-র মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও তার করুণাময় প্রকাশ যে সর্বত্র যুক্তি দিয়ে তা প্রমাণ করা যায়।সত্ত্বাতাত্ত্বিক Ontological বিতর্ক উস্কে দিতে তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থটি Proslogium লেখেন এবং প্রমাণ করেন ঈশ্বর আছেন। তিনি রাজা William II এর সঙ্গে চার্চের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় কোন বিষয়ে চার্চের পোপের কাছে জানাবার অধিকার পাওয়ার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই কারণে তাকে নির্বাসিত করা হয়। রাজা প্রথম হেনরি তাকে এই দণ্ড থেকে মুক্ত করে ফিরিয়ে আনলে তিনি পুনরায় ঘটা করে পদবী প্রদান অনুষ্ঠান বা অভিষেক উৎসব বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম হেনরি এই  Investiture বিরোধী ছিলেন। ১০৯৯ খ্রিঃ তিনি Cur Deus Homo (Why Did God Become Man?) গ্রন্থটি লেখা শেষ করেন এবং এই গ্রন্থের দ্বারা যীশুর পুনরুত্থান ও মানব জাতির মুক্তি প্রভৃতির সারবত্তা প্রমাণ করেন যীশুর মানবতার দিকগুলি উপরে গুরুত্ব দেন। খ্রিঃ ১৭২০ তাকে Doctor Of Church উপাধি দান করা হয়। St Augustine (খ্রিঃ ৩৫৪-৪৩০) এই একই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি নিওপ্লেটোনিজম এর প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর রচিত দুই প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল  Confessions এবং City of God ।মানুষের প্রকৃতিগত দিকটিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং খ্রিস্টধর্মকে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা দিতে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। 

Cathari or Albigensians নামে চার্চ বিরোধী খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছিল পশ্চিম ইউরোপে। দ্বৈতবাদী এই সম্প্রদায় প্রচার করলো- বস্তুজগৎ দুঃখময় এবং মানুষ সর্বত্র অশুভ ও পাপকাজে লিপ্ত। এই কারণেই মানুষকে আসক্তিহীন হয়ে স্বাধীন চিন্তায় ও শুভ কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে এবং ভগবানের উপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যেতে হবে। এই ভগবান হলেন যীশু, ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ, দেবদূত যার মনুষ্যজন্মের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট আঘাত এবং পরিশেষে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ সবই মায়ায় আচ্ছন্ন। এই সম্প্রদায় পরবর্তীকালে দু'ভাগে বিভক্ত হয়। একদল অত্যন্ত নিষ্ঠাপূর্ণ নৈতিক জীবন যাপনের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দেয়; অপরদল 'বিশ্বাসী' হিসেবেই স্বধর্ম পালন করে চলে। খ্রিঃ ১৫ শতকে এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিলোপ ঘটে। বিশপ বার্কলে জর্জ(Berkely George,খ্রিঃ ১৬৮৫-১৭৫৩) জাতিতে আইরিশ ছিলেন। দার্শনিক ও সমাজসেবী এই ব্যাক্তি বললেন মানুষের মনই সব; মনের বাইরে কোনো কিছুরই বাস্তবতা নেই। বস্তুময়তায় যা কিছু পরিদৃশ্যমান তার সবই মনেরই বহিঃপ্রকাশ। মন আছে বলেই দৃশ্যমানতা আছে, যা উপলব্ধিজাত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা মানলেই বস্তুর উপলব্ধি অনুভূত হয় মনে। বস্তুময় যা কিছু দৃষ্টির অন্তর্গত তা অনুভবের আলোকে আনলেই বোঝা যাবে এই সব কিছুর মধ্যেই অবস্থান করছেন বা পিছনে রয়েছেন ঈশ্বর। আমেরিকার Berkeley শহর তার নামে পরিচিত। 

  বার্কলে, (John Locke) জন লকি, (David Hume) ডেভিড ইউম এর অভিজ্ঞতাবাদের ( Empiricism) অনুগামী ছিলেন। ফরাসি গণিতবিদ দার্শনিক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি Pascal Blaise-র (খ্রিঃ ১৬২৩-১৬৬২) মত হল, খ্রিস্টধর্মে 'বিশ্বাসী' হওয়ার মধ্যে অকাট্য যুক্তি বর্তমান। খ্রিস্টানদের ঈশ্বর বলে যদি কিছু না থাকে, তবে অজ্ঞেয়বাদীদের (Agnostics) হারাবার বা পাওয়ার কিছুই নেই, কারণ তারা খ্রিস্টানদের পরম্পরাগত ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণায় বিশ্বাসী নন। অজ্ঞেয়বাদীদের যুক্তি হল, সুপ্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত জ্ঞেয়বাদ (Gnostic) কে বিশ্বাস করা অসম্ভব। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব ব্যাপারে যুক্তিনির্ভর হয়েই ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ে মতবাদের উপর নির্ভর করা উচিত। 

পাসকাল Cornelius Jansen,(খ্রিঃ ১৫৮৫-১৬৩৮) র ধর্মীয় সংস্কারবাদের অনুগামী ছিলেন। তার ধর্মীয় দর্শনকে সমর্থন ও মান্যতা দিয়েই যা Pascal's Wager নামে পরিচিত। খ্রিঃ ১৬৫৭-৫৮ অব্দে রচিত Pense'es গ্রন্থে তিনি লিখলেন যদি খ্রিস্টানদের ঈশ্বর থাকেন তবেই অজ্ঞেয়বাদীগণ জীবনের চিরন্তনতা উপলব্ধি করতে পারবেন, না মানলে তারা পরম শুভশক্তির আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবেন। এই মতামতের বিরুদ্ধে William James বিতর্ক উঠিয়ে বললেন, পরজন্মে বিশ্বাসী ধর্মকে মান্যতা দেয়া অসম্ভব। এই মতকে সমর্থন করে তার অনুগামীরা বললেন, এ বিষয়ে বিচারশীল থাকাই শ্রেষ্ঠ পথ। চার্লস স্যান্ডার্স পিয়ার্স (Charles Sanders Peirce) ও উইলিয়াম জেমসের মতবাদকে নবরুপ দিলেন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক জন ডিউই (John Dewey- খ্রিঃ ১৮৫৯-১৯৫২)। তার প্রয়োগবাদ (Pragmatism) দর্শনে অদৃষ্ট অনির্দিষ্ট, অনুমান বা বিশ্বাসের বিষয় কিছু নেই। বাস্তববাদের অনুপন্থী এই দার্শনিক পরীক্ষিত জীবনের মধ্য দিয়েই সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে; চিরন্তনত্ব বলে কিছু নেই বা হয় না, কারণ সত্যের কোন ধ্রুবত্ব জ্ঞান অসম্ভব বিষয়; কার্যকারণের ভিতর দিয়েই সত্যের উপলব্ধি ঘটবে বলে মত দিলেন। 

 এই দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যবাদ (Coherentism) দর্শনের প্রভূত মিল পাওয়া যায়। সত্যের দর্শন বিষয়ের সত্যতা নির্ভর, যার সঙ্গে অন্যান্য বিশ্বাসের সংহতি বা সংগতি বর্তমান থাকে। প্রতিটি বিষয়ের সত্যতা যাচাই করার মধ্য দিয়েই এই সামঞ্জস্যবাদের দর্শন নির্ভরশীল; যা অন্যদিক দিয়ে বিচার করলে প্রয়োগবাদেরও বিচার্য বিষয়। জ্ঞানতত্ত্বর(Epistemology) বিচারে সামঞ্জস্যবাদের সঙ্গে ফাউন্ডেশনালিজম(Foundationlisam)এর তফাৎ হলো এই তত্ত্ব ইন্দ্রিয় নির্ভর প্রত্যক্ষ অনুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব; অনুমান বা অন্যান্য বিশ্বাসপ্রসূত দর্শন নয়। প্রাচীন গ্রিসে এই তত্ত্বের মূল পাওয়া যায়। এই দর্শনে দীক্ষিতগণ  অন্য কোনও মত বা দর্শনে আগ্রহী নন। সামঞ্জস্যবাদের সঙ্গে ভাববাদী(Idealism) দর্শনের মিল হল- অস্তিত্ব সত্য ও জ্ঞানের প্রকৃতি বিষয়ক দর্শনের বিচারে(Metaphysics) বাস্তব যা, তা দাঁড়িয়ে আছে মানুষ ও মানুষের মনের বিচার ক্ষমতার উপরে। তার সঙ্গেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক বিচার ও নির্ভরশীল। অলৌকিকত্বের অনুভূতি মানুষের মনের সম্পদ। আবার লৌকিকত্বের বিচারও মনের সম্পদ।

  সুতরাং একটি দার্শনিক মতবাদ অন্য দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক সত্য। 
ভাববাদীগণ বলেন, এই জগতপ্রপঞ্চ চৈতন্যের গভীরে এক পরম শক্তি হিসেবে স্থিত; জড়বাদ বা বস্তুবাদের নিরিখে একে বিচার করা চলে না। দার্শনিক George Berkeley (খ্রিঃ ১৬৫৮-১৭৫৩) এই দর্শনই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। অভিজ্ঞতাবাদও(Empiricism) এই  একই মতবাদ যার প্রবক্তাগণ হলেন জন লকিং, জর্জ বার্কলে, ডেভিড হিউম এবং ফ্রান্সিস বেকন- যা আগেই আলোচিত হয়েছে। জার্মান দার্শনিক Feuerbach, Ludwig (Andresa) (খ্রিঃ১৮০৮-১৮৭২) বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক Hegel, George William Frederick (খ্রিঃ ১৭৩৮-১৮২০) এর ছাত্র ছিলেন। শিক্ষাগুরুর ঐশ্বরিক কল্পনাকে নস্যাৎ করে লিখলেন, "It is a question today you say, no longer of the existence or the non-existence of God but of the existence or the non-existence of man;not whether God is a creature whose nature is the same as ours but whether we human beings are to be equal among ourselves;not whether and how we can partake of the Lord by eating bread but whether we have enough bread for our own bodies;not whether we are Christians or heathens, thesists or atheists, but whether we are or can become men, healthy in soul and body, free, active, and fully of viability... I deny God. But that means for me that I deny the negation of man." তিনি এই যুগান্তকারী কথাগুলো উচ্চারণ করে নিজেকে মানুষের জয়যাত্রার পথে সামিল করলেন। 
ধর্ম সম্পর্কে তাঁর অন্য বক্তব্য হল, "Religion is the dream of human mind. But even in dreams we do not find ourselves in emptiness or in heaven, but on earth, in the realm of reality; We only see real things in the entrancing splendour of imagination and Caprice, instead of in the simple daylight of reality and necessity." ফোয়েরবাখ এই ভাবেই হেগেলের দর্শনকে খণ্ডন করেছিলেন। সম্ভবত এই জন্যই গুরু-শিষ্যের দার্শনিক সম্পর্ককে বলা হয়েছে- "Feuerbach belongs to Hegel as much as the beaker of hemlock to Socrates." ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments