গল্প।। ঘুঘুর ফাঁদ।। সন্দীপ দত্ত

গল্প।। ঘুঘুর ফাঁদ।। সন্দীপ দত্ত


বিশ্বকর্মার কপালে ভাঁজ দেখে ভুরু কোঁচকালেন ত্রিলোচন।
"কী ব‍্যাপার বিশু,তোমায় আজ ভারি চিন্তিত দেখছি? রাত্তিরে ঘুম হয়নি বুঝি?"
বিশ্বকর্মা সাহস করে ত্রিলোচনের চোখে চোখ রেখে গলার আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে বললেন,"না মহাদেব,ঘুম টুম নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। চিন্তাটা আমার অন‍্য জায়গায়। যদি অভয় দেন তো বলি।"
"বলো বিশু,শুনি কী বলতে চাও।" বলে মহাদেব গাঁজার কলকেটা নামিয়ে রেখে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন বিশ্বকর্মার দিকে।
"নারদ আপনাকে কিছু বলেনি?"
"কই,নাতো!"
"সরস্বতী,লক্ষ্মী,কার্তিক,গনেশ কেউ না?"
"না বিশু,কেউ আমাকে কিচ্ছু বলেনি। কেন,স্বর্গে কোনও বিপদ টিপদ হয়েছে নাকি?"
"না মহাদেব, স্বর্গে নয়,বিপদটা মর্ত‍্যে শুরু হয়েছে। এখন এই বিপদ থেকে মর্ত‍্যবাসীকে উদ্ধার করতে একমাত্র আপনিই পারেন। আদিদেবের কাছে তাই ছুটে আসা।"
"খোলসা না করলে আমি বুঝব কেমন করে? প্লিজ,খুলে বলো বিশু।"
"মর্ত‍্যে এখন করোনার প্রকোপ চলছে আপনি তো জানেন।"

"হ‍্যাঁ.তা জানি। ভয়ানক একটা অসুর! অনেক অসুরের সাথেই লড়াই করেছে পার্বতী। এটাকেই কেবল পারছে না। কোত্থেকে যে এত শক্তি পেয়েছে শরীরে! নাকি আমার পার্বতীরই বয়েস হয়ে গেল,বুঝতে পারছি না। তবে আমি যে শুনেছিলাম বিশু,মর্ত‍্যে করোনাসুরের শক্তি খানিকটা ক্ষয় হয়েছে। খবরটা কি মিথ্যে?"
"না মহাদেব,এক বর্ণও মিথ্যে নয়। দেবী চন্ডী যাওয়ার দিনকয়েক আগে মর্ত‍্যে আমিও তো গিয়েছিলাম। তখন কিন্তু মানুষদের মধ্যে একটা লাগাম দেখেছি। প্রায় সকলের মুখেই মাস্ক, আর সারাক্ষণই স‍্যানিটাইজার নিয়ে ওরা চলছে। বন্ধ কারখানা খুলেছে সব। নিম্নবিত্ত,মধ‍্যবিত্ত মানুষদের হাতে একটু একটু করে টাকাও আসছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মুখে আবার সেই চেনা হাসি। কিন্তু দেবী চন্ডী মর্ত‍্য থেকে ফিরে আসার পর সরস্বতী লক্ষ্মীর মুখে যা শুনলাম......" কথাটা আর শেষ করলেন না বিশ্বকর্মা।

"কী শুনলে বিশু? থামলে কেন? তাড়াতাড়ি বলো। আমার অস্থির লাগছে।" উতলা হলেন ত্রিলোচন।
"শুনলাম একবছর পর দেবী চন্ডীকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মর্ত‍্যের বেশির ভাগ মানুষই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়নি। বেশিরভাগের মুখেই মাস্ক নেই। দূরত্ববিধিও মানেনি।"

"ঘরের মেয়ে উমাকে কাছে পেয়ে মানুষ ওরকম আনন্দে আকুলিবিকুলি করবেই। প্রতি বছরই করে। ওটা এমন কিছু নয়। খুশি আর আনন্দ।"
"না মহাদেব,শুনলে আপনি আশ্চর্য হবেন,মুখে মাস্কহীন মানুষগুলোর বেশিরভাগই সরকারি কর্মচারি আর নেতামন্ত্রী। যাদের অনেক টাকা। যাদের জীবনে কোনওকিছুর অভাব নেই। এত গা ঘেঁষাঘেঁষি আর ভিড় করোনার তৃতীয় ঢেউকে যদি ডেকে আনে,যদি আবার লকডাউন হয়,যাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। মরবে তারাই,যারা দিন আনে দিন খায়। আবার কলকারখানা বন্ধ হবে,ছোট ছোট ব‍্যবসাগুলো যাবে বসে,নিম্নবিত্ত মধ‍্যবিত্ত মানুষগুলোর হাত আবার হয়ে যাবে খালি। কার্তিক বলল,অথচ এই শ্রেণির মানুষগুলোরই মুখে প্রায় প্রত‍্যেকেরই মাস্ক ছিল। মহাদেব আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ,আপনি এর একটা বিহিত করুন। লকডাউন যদি হয়,মর্ত‍্যের ঐ বড়লোকগুলোর জন‍্যই তো হবে। তাই না? আর যারা কোনও দোষই করল না,তারা পাবে শাস্তি। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে অভাবের সাগরে পড়ে যাবে। এটা কি ঠিক?"
বিশ্বকর্মার মুখ থেকে সব শুনে গম্ভীর হলেন মহাদেব। সত্যিই বড় সমস‍্যা।

"এখন আমায় কী করতে বলছ বিশু?"
"বলছিলাম যে মর্ত‍্যের গরীব বড়লোক সকল কর্মচারিই তো আমার সন্তান। তাই কারও যাতে কোনও ক্ষতি না হয়,সেইদিকটা আপনি যদি একটু দেখেন......। মানে সকলের হাতেই যাতে টাকা থাকে,এমন কিছু একটা উপায়......।"
"দেখো বিশু,এ ব‍্যাপারে আমার তো কিছুই করার নেই। লক্ষ্মীর সাথে একবার আলোচনা করে দেখি।"
ত্রিলোচনের কথায় বুকে আশা নিয়ে ফিরে গেলেন বিশ্বকর্মা।


মহাদেব মেয়ের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব জানতে চাওয়ায় বিশদে বলল লক্ষ্মী। সব শুনে লক্ষ্মীর হাতদুটো ধরলেন তিনি। "হ‍্যাঁ রে মা,কিছুই কি করা যায় না সব শ্রেণির মানুষদের অর্থনৈতিক ব‍্যবস্থাটকে সচল রাখার জন‍্য?"
"কী করতে চাও বলো বাবা?" লক্ষ্মী বলল।
"যদি আবার নতুন করে লকডাউন হয়,শুধু সরকারি কর্মচারি নয়,সকলের হাতেই যাতে টাকা থাকে,এমন কিছু।" মহাদেব বললেন।
"বাবা,যদি ব‍্যাপারটা আমি উলটোভাবে করি?" হাসল লক্ষ্মী।
"কী করবি মা?"
"ভাবছি রাজকোষ প্রায় শূন‍্য করে দেবো। মর্ত‍্যে কিছু কিছু সরকারি কর্মচারিদের গত প্রায় দু'বছর ধরে বসিয়ে বসিয়ে পুরো বেতন দিচ্ছে সরকার। ওদেরকে বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না,অভাব কী জিনিস। লকডাউনের যন্ত্রণা। সরকারের অর্থে যদি আমি ভাঁটার সৃষ্টি করি,সব সরকারি কর্মচারির মাসিক বেতনের অংকটাও তাহলে খানিক কমে। সমবন্টন ব‍্যবস্থাটাই মর্ত‍্যের প্রশাসক এখনও করতে পারল না। ভাবছি এবার এই শিক্ষাটাই দেবো ওদের। ওরা রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়। নোংরা রাজনীতি। মর্ত‍্যে আবার নতুন করে যদি লকডাউন হয়,আমি লক্ষ্মী হয়ে এবার বুঝিয়ে দেবো,অর্থাভাবের যন্ত্রণা শুধু একা খেটে খাওয়া কর্মীরাই ভোগ করবে না,বেতনভুক পায়ের ওপর পা তুলে বসা বাবুসমাজও হাড়ে হাড়ে টের পাবে। লক্ষ্মীর রোষ ওরা এখনও দেখেনি।"
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লক্ষ্মী। তারপর বাবার স্নেহ পাবার জন‍্য বাঘছাল পরিহিত ছাইমাখা মহাদেবের বুকে মাথা রাখল সে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Comments

Trending Posts

রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পরিষদ (NAAC) এর মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি: উদ্দেশ্য ও প্রস্তুতি - কলেজ ভিত্তিক অভিজ্ঞতা /সজল কুমার মাইতি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১২৫

শমিত ভঞ্জ (অভিনেতা, তমলুক)/ ভাস্করব্রত পতি

বারুণী স্নান /ভাস্করব্রত পতি

প্রয়াত লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত। শ্রদ্ধা ও স্মরণে কলম ধরলেন লেখক শিল্পীরা।

মেদিনীপুর জেলার আনাচে কানাচে বসবাসকারী ডোম ও চাঁড়ালরাই বাংলার প্রাচীন ব্রাহ্মণ /দুর্গাপদ ঘাঁটি

বিস্মৃতপ্রায় কবি ফণিভূষণ আচার্য /নির্মল বর্মন

গায়ত্রী জানা (ব্রতচারী প্রশিক্ষক, সঙ্গীতজ্ঞ, রাধামনি, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি