জ্বলদর্চি

প্রগতিশীল/সন্দীপ দত্ত

গল্প

প্রগতিশীল

সন্দীপ দত্ত


মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে জটলার মধ্যে গিয়ে গলা বাড়ানোর চেষ্টা করল রাতুল,কিন্তু লোকটাকে দেখতে পেলনা। শরীরটা উপুড় হয়ে আছে। ধূসর রঙের প‍্যান্টের ওপর অনেকগুলো মানুষের রোষমাখা জুতোর দাগে প‍্যান্টের রঙ পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঘিয়ে শার্ট হয়ে গেছে মেটে। রাতুল  ভিড়ের দু'চারজনকে জিজ্ঞেস করতেই ওরা চোখে তাপ নিয়ে বলল,"শালা সরকারি কর্মচারী! দু'হাত ভরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেবে,অথচ কাজের বেলা অষ্টরম্ভা। হাতে স্পীড নেই তো আসিস কেন? বুড়ো হলে তো মানুষ ঘরে থাকে। অফিসেও আসবি আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজও করবি,তা কি হয়? আমাদের সময়ের কোনও দাম নেই? চেয়ারটা ছেড়ে একবার দেখ না,স্পীড কাকে বলে দেখিয়ে দেব। বুড়ো হাত নিয়ে কখনও কম্পিউটারের কাজ হয়? শালা চাকরিও দিবি না,চেয়ারও ছাড়বি না,তাহলে তো মার খেতেই হবে।" বলে লোকটার পাছায় সজোরে আরও ক'খান লাথি পড়ল নিমেষে। কান থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল চশমাটা। পথের ধুলোয় লুটোপুটি খেল কাচদুটো।
     রাতুলের বুকের কথাই বলল ওরা। মনের কথা। সরকারি অফিসগুলোর এই কয়েকটা বুড়ো লোকের জন‍্যই এখনও তারা বেকার। অভিজ্ঞতার দাম রাখতে গিয়ে অবসর হতে হতেও হয়না। নতুন নিয়োগের রাস্তা তাই বন্ধ রাখতে হয়। বুড়ো হাড়ের ভেলকির পরীক্ষা নেয় সরকার। ষাট বছরে এসে তাই শিখতে হয় কম্পিউটার। নতুন লাগে একবারে। এক পা দু পা করে তাই তো এগোনো। তাবলে জেন ওয়াই শুনবে কেন? ওদের কাছে জীবন মানেই গতি। বেঁচে থাকা মানেই দৌড়োনো। অফিসগুলোতে এলেই ধৈর্যচ‍্যুতি ঘটে যায় তাই। আজ যেরকম ঘটেছিল। সেকারণে রাতুলও একখান সুযোগ নিল। লোকটার পিঠের ওপর পা তুলল সে। সজোরে শিরদাঁড়ার ওপর আঘাত করল একটা। তীব্র গোঙানি বেরলো লোকটার মুখ থেকে। ব‍্যথায় কষ্ট পেতে পেতে তার জিভ তখন বেরিয়ে গেছে। সেই জিভে লাগল মাটি।
       আজ ক'দিন ধরেই মন ভাল নেই রাতুলের। এতদিন চিন্টুদার কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে সপ্তাহে দু'দিন সে প্র‍্যাকটিস করত। গত পরশু চিন্টুদা সাফ জানিয়ে দিয়েছে,"একেবারে বিনে পয়সায় তোকে একটা চেয়ার ছাড়তে পারিনা রাতুল। একটা কম্পিউটারকে তুই আগলে রাখবি,তাও একেবারে শুধু শুধু,আমার ফুটো পয়সাও লাভ হবে না,তা তো হয়না! তোর ঐ সিট'টার জন‍্য আমি একজনকে ভর্তি নিতে পারিনা। একগাদা টাকা লোকসান হয় আমার। তুই অন‍্য কোথাও যা রাতুল।" কথাগুলো শুনে চিন্টুদার ওপর খানিক রাগ হয়েছিল  রাতুলের। তবে রাগের পরত'টা বেশি জমেছিল বাবার ওপর। আজ দু'মাস ধরে বাড়িতে একটা কম্পিউটার কেনার কথা বলছে সে। বাবা শুধু বলে,"দেখছি।"
     কম্পিউটারে রাতুল সুদক্ষ হয়ে গেছে অনেকদিন। অনেকগুলোই জমে গেছে সার্টিফিকেট। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। কোথাও চাকরি জোটেনি এখনও। তাই ইচ্ছে বাড়িতে একটা কম্পিউটার কিনে সে ব‍্যবসার হাতেখড়ি'টা করবে প্রথম। একটা থেকে দুটো হবে তারপর। দুটো থেকে  দশটা করবে। চিন্টুদার সেন্টারে পনেরোটা কম্পিউটার। একদিন চিন্টুদাকেও ছাড়িয়ে যাবে সে। কিন্তু বাবা কথা শুনছে না। বাড়ির লোনের টাকাটা এখনও শোধ হয়নি। চাকরি থেকে অবসর নিতে এখনও বছরখানেক। এখনই হাত কাঁপে বাবার। পায়ের পেশিতে টান পড়ে। তার ওপর এই বয়েসে এসে অফিসের বড়বাবুর নির্দেশে কম্পিউটারে কাজ। কত যে আস্তে আস্তে করতে হয়। শেখাই হল না ঠিকমতো। বাড়িতে কম্পিউটার থাকলে রাতুল বাবাকে শিখিয়ে দিত সব। সরকার নামক অদৃশ‍্য প্রশাসকের মুখ'টা মনে পড়তেই মাথাটা আবার গরম হয়ে গেল রাতুলের। যোগ‍্যদের আর কতদিন বসিয়ে রাখবে সরকার? লোকটার উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটাতে আবার একটা লাথি কষালো রাতুল। আবার একবার যন্ত্রণার শব্দ বের হল তার মুখ থেকে।


বন্ধুর বাড়িতে একদিন কাটিয়ে আজ সকালে শহরে ফেরা রাতুল সারাদিনের শেষে সন্ধেবেলা বাড়িতে ঢুকল যখন,দেখল বাবা বিছানায় শয‍্যাশায়ী। পরনে শুধু লুঙ্গি ছাড়া কিছু নেই। উদোম গা। উপুড় হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। সারা পিঠময় জুতোর দাগ। কোথাও কালসিটে,কোথাও রক্ত চুঁইয়ে নামছে। মা সেই দাগগুলোর ওপর পরম যত্নে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। ছেলেকে কাছে পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদল মা। "কতবার বললাম,শরীরটা তোমার অসুস্থ। জ্বর নামলেও দুর্বলতা কাটেনি। আর একটা দিন বিশ্রাম নাও। কিছুতেই শুনল না। আজ মাসের পয়লা। বলল,যাই,বেতনটাও পাবো।.....তুইই বল রাতুল,এ বয়েসে কি কুড়ি বছরের ছেলের মতো কম্পিউটার পারা যায়? সেকেলে মানুষ। কাগজে কলমে কাজ করে সারাজীবনটা কাটল। এখন যদি কেউ বলে,ঝড়ের গতিতে কম্পিউটারে কাজ করতে হবে,পারবে কেন? তাই খুব মেরেছে রে পাবলিক। ওদের হাতে নাকি সময় নেই!"বলতে বলতে দু'চোখ থেকে জল গড়ায় মায়ের।
     নির্বাক রাতুল। নিশ্চুপ। মায়ের চোখের দিকে চোখ তুলে দাঁড়াতে পারছিল না সে। অন্ধকার পরিসরে আস্তে আস্তে সরে সরে যাচ্ছিল তার পা। আপ্রাণ চেষ্টা করল সে পা দুটোকে আলোয় রাখতে। ইচ্ছে করছিল বাবার পিঠের ওপর একটু হাত রাখতে। পারল না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
সংগ্রহ করতে পারেন।

Post a Comment

0 Comments