অকাজের লোক
বিজন সাহা
জীবনে খুব কম মহিলাকেই দেখেছি যারা স্বামীদের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে খুশি। বাবার কখনই জামা কাপড়ের প্রতি তেমন আকর্ষণ ছিল না, ধূতি আর সাইডে পকেটওয়ালা হাফ শার্ট পরেই সারা জীবন কাটিয়ে দিলেন। আর এ পোশাক কী বাড়িতে, কী ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ গেলে, কী কোলকাতা গেলে। যাকে বলে পার্সোনাল ব্র্যাণ্ড। কিন্তু মাকে দেখেছি সব সময়ই এ নিয়ে কথা বলতে, যদিও মার ট্রাঙ্কে বেনারসি, জামদানি থেকে কোন শাড়ির অভাব ছিল না। সুধীর দাও ঐ রকম, কিছু একটা পরলেই হল। আর এ নিয়ে বৌদির কথা শুনত। তবে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই রতন খুব টিপটপ, জামাকাপড় ম্যাচিং করে পরবে। আমি জামা কাপড়ের ব্যাপারে উদাসীন নই, তবে এ নিয়ে মাথাও ঘামাই না কখনই। রঙটঙ নিয়ে একেবারেই ভাবি না, একটাই দেখি সেটা এই পোশাকটা আমার জন্য কমফোর্টেবল কিনা। অধিকাংশ মানুষ জামাকাপড় পরে অন্যদের জন্যে, মানে অন্যদের চোখে নিজেকে সুন্দর, পরিপাটী দেখাতে। আমি পরি একান্তই নিজের জন্য। কে কী দেখল, কে কী বলল, কে কী ভাবল সেটা একান্তই তাদের সমস্যা।
আমাদের গবেষণা কেন্দ্রে কেউই খুব একটা জামাকাপড় নিয়ে ভাবে না। নিজেদের শিক্ষকদের তেমনটাই দেখেছি। ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন ইতালির ট্রেস্টে আইসিটিপি যাই দু মাসের জন্য, ইউরোপের বিজ্ঞানীদেরও দেখে জামাকাপড়ের প্রতি উদাসীন বলেই মনে হয়েছে। ঐ সময় স্ট্রিং স্কুলে আমেরিকা থেকে জন শোয়ারজ সহ সেই থিওরির কিছু দিকপাল ও উঠতি বিজ্ঞানীরা এসেছিলেন। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখে প্রথম মনে হল বিজ্ঞানী মানেই যেমন তেমন পোশাক নয়, এখানেও ফ্যাশন চলে এসেছে।
আমি প্রায়ই রঙবেরঙের জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াই। অনেকেই তাকায়, কারও মুখে কখনও হাসি ফুটে ওঠে। একদিন গুলিয়া, মানে আমার বউ বলল আমাকে নাকি লাইট পোস্টের মত লাগছে। তাকিয়ে দেখি পায়ে নীল জুতা, পরনে হলুদ প্যান্ট, গায়ে কালো সোয়েটারের উপর লাল জ্যাকেট আর মাথায় সবুজ টুপি।
- হ্যাঁ, তবে সবগুলো লাইট কিন্তু এক সাথেই জ্বলছে।
- মানে?
- মানে চাইলেই গ্রীন সিগন্যাল মনে করে চলে যেতে পার। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে লাল বাতি ছাড়া তুমি আর কিছুই দেখনি, তাই সারা জীবনের জন্য আটকা পড়ে গেছ।
আমি যে জামাকাপড় সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নই, তা কিন্তু নয়। একবার শীতে মস্কো গেছি। পরনে কালো শীতের জুতা, কালো প্যান্ট, কালো ওভার কোট আর কালো টুপি। পাশে এক ছেলে শুনি তার বান্ধবীকে বলছে কালো পোশাকের ভিড়ে মানুষটাকেই দেখা যাচ্ছে না।
আমার ডিএসসি ডিফেন্ডের পরে কি এক কাজে দূতাবাসে গেলাম। সাথে জুনিয়র বন্ধু টিপু।
- বিজন দা, আমরা আগে একটা দোকানে যাব।
- হঠাৎ?
- একটু কাজ আছে।
দোকানে গিয়ে ও আমার জন্য কোট, প্যান্ট, টাই, শার্ট, জুতা এসব কিনল।
- কী ব্যাপার?
- রাষ্ট্রদূত বাবুল ভাই বলেছেন।
কয়েকদিন আগে আমি যখন থিসিস ডিফেণ্ড করি, পরনে ছিল পুরনো জিন্স আর সাধারণ শার্ট আর প্রিয় হাতাবিহীন কিন্তু অনেকগুলো পকেটওয়ালা কোট। এটা নাকি ওনার পছন্দ হয়নি। উনি যদি জানতেন আমি যখন সামারে রাশিয়া বা ইউরোপের কোন দেশে কোন কনফারেন্সে যাই, হাফপ্যান্ট, টিশার্ট আর ক্যামেরা ছাড়া সাথে কিছুই থাকে না। তবে এরপর যখন সামারে সংগঠনের কাজে দূতাবাসে যেতাম, দূতাবাসের দরজায় হাফপ্যান্টের উপর ফুলপ্যান্ট পরে ওনার সাথে দেখা করতে যেতাম।
গুলিয়ার দোকানে যাওয়া মানে লাইব্রেরিতে যাওয়া, কিসের গায়ে কী লেখা সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তারপর কিনবে। তাই আমি যাই পরে, ব্যাগ টানতে। বাসার পাশেই দোকান, তাই সামারে জামাকাপড় না বদলিয়েই যাওয়া যায়
তোমার কী মাথা খারাপ?
মানে?
শার্টটা বদলিয়ে এলে হত না?
শার্টটা আবার কী দোষ করল?
কী বাজে অভ্যেস প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা?
বাজে হবে কেন?
আমার মানসম্মান আর থাকবে না তোমাকে নিয়ে।
আমার মত মানসম্মান ঘরে রেখে এলেই তো ঝামেলা চুকে যায়।
তুমি এসব বুঝবে না। তোমাকে এই পোশাকে দেখলে লোকে আমাকে কি বলবে?
জিজ্ঞেস করলে বলে দিও বাসার কাজের লোক। তাতে বরং ওদের চোখে তোমার প্রেস্টিজ আরও বেড়ে যাবে। এই বাজারে কয় জন কাজের লোক রাখতে পারে?
কথার যা ছিরি?
তুমি কি বলতে চাও আমি কাজ করি না, কাজের লোক নই? অকাজের লোক? ঠিক আছে বলে দিও অকাজের লোক।
দুবনা, ০১ জুলাই ২০২১
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments