ভগবান
তড়িৎ ভট্টাচার্য
ভগবান কে ? তিনি কোথায় থাকেন? কেমন তাকে দেখতে ? এ সব কথা বলার জন্য অন্য মানুষ আছেন আমার কি ক্ষমতা যে আমি ভগবান সম্বন্ধে আপনাদের অবহিত করবো। আসলে যে বিষয়টা ভেবে একটু লেখার ইচ্ছে আছে তা হলো সবাই তো দেখি ভগবানকে চেনেন একমাত্র আমাকে বাদ দিয়ে। সারা দেশের প্রায় সব বাড়িতেই এই ভগবান সম্বন্ধে নানান উক্তি আমরা শুনি যেমন ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য কথাটি বলেই মাথায় হাত ঠেকান আকাশের দিকে চেয়ে অর্থাৎ ঐ মহাশূন্যে কোথাও তিনি আছেন সেই উদ্দেশ্যে প্রণামটা পাঠানো। অবশ্যই তাঁর বা তাঁদের ভগবানের সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয় আছে। তা না হলে এতো নিশ্চিন্তভাবে প্রণামটাকে কি করে পাঠান। এ ছাড়া যেমন ছেলের ও মেয়ের পরীক্ষা আসছে যথারীতি পড়তে নিয়ে যাওয়া থেকে তাকে নিয়ে বসা, পেছনে লেগে থাকা এবং তার সঙ্গে ভগবানকে উদ্দেশ্য করে ভগবান দেখো একটু ছেলেটা বা মেয়েটা যেন পাশ করে যায়। মা সরস্বতীর কাছে নিবেদন নয় যিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী একেবারে সোজা ভগবানকে। কি দারুণ যোগাযোগ। সংসারে অশান্তি হলো সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো সেই কথা- ভগবান এর বিচার করবেন। এতো বড়ো কথা আমায় বলা এবং তারপর কান্নাকাটি ইত্যাদি। বিচারক ভগবান কি করবেন সেটা সে জানতে পারলো কিনা জানতে ইচ্ছে হয়। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে তারপর নাকে মুখে গুঁজে অফিস যাওয়ার সময় মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলা ভগবান দেখো আজ যেন Absent না হয়ে যাই। Office এর হাজিরা খাতা ভগবানকে Control করতে হবে। বাড়িতে কেউ অসুস্থ ছুটোছুটি হচ্ছে তার জন্য বার বার প্রার্থনা ভগবান মুখ রেখো, দেখো যেন কিছু না হয়, মানুষটা যেন বাড়িতে ফেরে। কোর্টের রায় আজ বেরোবে, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় উকিল বাবুর ভগবানকে বলা রায় যেন তার দিকে হয়। খুনি আসামীর হয়ে উনি লড়ছেন। ভগবানের কি অবস্থা বুঝুন। আরো আছে স্ত্রী স্বামীকে আশ্বাস দিয়েছে, অভাবের সংসার ভগবান একদিন নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন, ভগবান মুখ তুলে চাইলেই তার অভাব দূর হবে। ভগবান মুখ নিচু করে আছেন সেটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। কি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। বন্ধুর কাছে থেকে টাকা ধার করে রেসের মাঠে গিয়েছেন রেস খেলতে। টিকিট কেটেই মাথা ঠেকিয়ে ভগবানকে নিবেদন, দেখো ভগবান আমার ঘোড়াটাই যেন জেতে। তারপর হেরে গিয়ে নেশার ঘোরে উক্তি অমুকের বাচ্ছা ভগবান যদি একটু দেখতেন তা হলে নিশ্চয়ই আমার ঘোড়াটাই জিতত। আরো কতো আছে, যে কটা মনে এলো বললাম। ও হ্যাঁ আর একটা মনে পড়ে গেল ভগবানের দিব্যি আমি এ কাজ করিনি। অর্থাৎ আমাদের বিপদ, আপদ, চিন্তা ভাবনা মানে রেসের ঘোড়া Control করা কিংবা Office Attendance এর ওপর কর্তৃত্ব সব ভগবানের আয়ত্তে । ওষুধ দেওয়ার পর ডাক্তার মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলছে আমি যা করবার করলাম, এখন ভগবানের হাত ৷ ভগবানকে ডাকুন, ডাক্তারকে দেখানোর অর্থ অঙ্ক বেশ বড় মাপের। এই যে মহাশূন্যে বিরাজমান ভগবান যার সঙ্গে এদের সবাইকার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, কি বিরাট ব্যাপার? বছরের পর বছর সাধনা করে থাকে সাধু সন্ন্যাসীরা। পান না তার সঙ্গে এমন Direct যোগাযোগ, আর শুধু যোগাযোগই নয় বিশ্বাস, মাতাল, জুয়াড়ী থেকে সংসারের অভাবগ্রস্ত মানুষ তাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। কাল্পনিক ব্যাপার কাল্পনিক হলে এতো বিশ্বাস এতোজনের এত বছর ধরে কি করে হয়। কিছু একটা ব্যাপার তো আছে। নাকি বংশ পরম্পরায় কিংবা লোক পরম্পরায় চলে আসছে এই আবেগ, কে কতোটা ভগবানের কাছের থেকে সাহায্য পেয়েছেন জানি না। বরং উল্টে গালাগাল খেতে হয়েছে। আর যদি কুসংস্কার হয়ে থাকে তা হলে তো কিছুই বলার নেই কারণ যে এই ব্যাপারটা কখন বলেননি তা হতে পারে না তবুও এটা চলছে। আসলে মেরুদন্ড ভাঙ্গা, মাতাল, নেশাখোর এবং অসহায় সমাজ ব্যবস্থা এই ভাবেই চলে আসছে। ভগবান একজন কেউ আছেন নিশ্চয়ই তা না হলে তিন যুগ ধরে এই নামটা কেন চলে আসবে। সব চেয়ে খারাপ লাগে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের কেন্দ্রবিন্দু যিনি তাকে নিয়ে এই ছেলে খেলা, এ মেনে নেওয়া যায় না।
আসলে ভগবান কে বা কি, ঈশ্বর কে তা অনেক মহাপুরুষ তাদের সারা জীবনের সাধনার মধ্যে দিয়ে বলে গেছেন। শঙ্করাচার্য্য থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত এই পথ চলা। আর এদের মাঝে আছেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ বা অদ্বৈতবাদ সমাজে তার সহজ সরল ব্যাখ্যা অতো কঠিন বিষয়টাকে একেবারে প্রাঞ্জল করে দিয়েছে। এর মাঝে আবার শ্রী শ্রী মায়ের ছোট্ট ছোট্ট কথার মধ্যে দিয়ে বা উপদেশের মধ্যে দিয়ে তা আরও জীবন্ত। যাঁদের কথা বললাম এঁরা তো পৃথিবীতে এসেছেন এবং কার্যকারণের মধ্য দিয়ে নিজেরাই ভগবান হয়ে গিয়েছেন। এরা কেউ কাল্পনিক চরিত্র নয়। আমি অধ্যাত্মবাদ নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাবো না কারণ আমার সে অধিকার আছে কিনা সেটা আরো বিবেচ্য। শুধু রামকৃষ্ণদেব, বিবেকানন্দ যে কথা বলেছিলেন সেটাই উল্লেখ করবো। ভগবান আছেন কিনা জানতে চাওয়াতে ঠাকুর বিবেকানন্দকে (তখন তিনি নরেন) বলেছিলেন নিজের শরীর দেখিয়ে এর ভেতর যিনি আছেন, তিনি তোর ভিতরেও আছেন, তিনিই মা ভবতারিণী তিনিই ভগবান। অর্থাৎ আমিই সেই ভগবান। এই উপলব্ধি তো এতো সহজে হয় না। এর জন্যই সাধন ভজন, এর জন্যই সব কিছু ত্যাগ করে তাকে জানার চেষ্টা অর্থাৎ নিজেকে জানার চেষ্টা, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এক জায়গায়, তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি, আবার বলেছেন ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে তোমায় পাইনি। বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাহিনি।' তাই এতো বড় বিষয় নিয়ে এমন ধ্যাষ্টামো মানা যায় না। অধ্যাত্ম ভূমি ভারতবর্ষ। যা যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীর মানুষকে পথ দেখিয়েছে অদ্বৈতবাদ বা বেদান্তের সেই দেশের মানুষ করছে এই ছেলেখেলা। এ সব শুধু নিজেকেই ঠকান নয় আমাদের ধর্মকে অপমান করা। আর ছোঁয়াচে রোগের মতো এ বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। অবিলম্বে এই কপট ভক্তি বন্ধ হোক এই প্রার্থনাই করি। শুরুর চেয়ে শেষেরটা একটু গুরুগম্ভীর হয়ে গেল। কিন্তু না লিখে পারলাম না। আমি অপারগ।
তড়িৎ ভট্টাচার্য
১৯৪১ সালে ৮ই জুলাই জন্ম। ন’জন ভাইবোনের মধ্যে সপ্তমজন হিসাবে জন্মগ্রহণ। বাবা বিষ্ণুপদ ভট্টাচাৰ্য্য উচ্চ শিক্ষিত এবং অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। ভাই বোনেরা সবাই সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন। তড়িৎ ভট্টাচার্য্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ছিল। স্নাতক হওয়ার পর পরই পিতৃবিয়োগ হওয়াতে তাকে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে হয়। ইচ্ছা ছিল বিভূতিভূষণের ওপর গবেষণা করে বাংলায় অধ্যাপনা করার কিন্তু তা হয়নি। তবু লেখার অভ্যেসটা তারই হাত ধরে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে স্ত্রী বিয়োগের পর। পুত্র, পুত্রবধু এবং নাতনী নিয়ে এখন বাকি পথ চলা। সর্বক্ষণের সাথী লেখা। দিনের অনেকটা সময় কাটে লেখা নিয়ে এবং মনের মতো মানুষ পেলে তার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ আহরণ করতে।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments