জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত/পর্ব-১/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত     

পর্ব-১

সুদর্শন নন্দী

 কথায় বলে ‘উপমা কালিদাসস্য’৷ সাহিত্যজগতের বহুশ্রুত এটি প্রবাদবাক্য। উপমাই কবির ভাষাকে বাঙ্ময় করে তোলে, সঞ্চার করে  ব্যঞ্জনা৷ পাঠকের হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে যায় কবির ভাবনা। যা সরাসরি পাঠকের কাছে পৌছতে পারে না, উপমা তা সহজেই পৌছে দিতে পারে বক্তব্যের মূলকেন্দ্রে। সর্বধর্ম সমন্বয়ের কারিগর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও উপমা আর উদাহরণ দিতেন কথায় কথায়। তাই বলা হয় “উপমা রামকৃষ্ণস্য”। কালিদাসের  পরে ঠাকুর সেই প্রবাদে স্থান পেয়ে হলেন উপমা রামকৃষ্ণস্য। ঠাকুরের উপমার তুলনা নেই। সব ধর্মগুরু উপমা বা গল্পের মাধ্যমে বাণী প্রচার করলেও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেন সকলের মধ্যে বিশেষ।  মধ্যমণি। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘কথামৃতের উপমা, সে এক আশ্চর্য জিনিস। আমি উপমার গদির মালিকের (রবীন্দ্রনাথের) কাছে বছরের পর বছর কাটিয়েছি। উপমার ঐশ্বর্য কাকে বলে জানি,,,,, কিন্তু কথামৃতের উপমা আমাকে চমকে দেয়-এ কী কান্ড তিনি করে গেছেন! আগে জেনেছি, উপমা কালিদাসস্য, পরে বলেছি, উপমা রবীন্দ্রনাথস্য, এখন বলছি, উপমা রামকৃষ্ণস্য’।

ঠাকুর ভক্তদের সাথে ভগবানের যে কথা বলতেন তার পরতে পরতে জুড়ে থাকত উপমা।ঠাকুর বলতেন জীবনের উদ্দেশ্য হল ঈশ্বর লাভ। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁকে লাভ করা যায়।সেই ইশ্বরের দোরগড়ায় পৌছে দিতে তিনি ভক্তদের সাথে ঈশ্বরীয় কথা বলতেন। আর তা সহজে যাতে বোধগম্য হয়, ভক্তদের হৃদয়ে যাতে গেঁথে যায় সেজন্য কথার ফাঁকে ফাঁকে দিতেন উপমা, শোনাতেন লৌকিক  কাহিনী। আমরা সেসবের বর্ণনা পাই কথামৃতে। তার সেই মূল্যবান উপমাগুলি নিয়েই এই উপমামৃত কথন।  আসি কথামৃত থেকে তাঁর উপমা বর্ণনায়।    
১৮৮১, ৩রা ডিসেম্বর। শ্রীযুক্ত মনোমোহনের  বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ বেলা আন্দাজ ৪টা সময় শুভাগমন করেছেন। বাড়িটি ছোট — দ্বিতল — ছোট উঠান। ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে উপবিষ্ট। একতলা ঘর — গলির উপরেই ঘরটি।
ভবানীপুরের ঈশান মুখুয্যের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ কথা  বলছেন।
ঈশান কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলেন, ঠাকুর সংসারত্যাগ করলেন কেন? শাস্ত্রে সংসার আশ্রমকে শ্রেষ্ঠ বলেছে। আর সবাই যদি সংসারত্যাগ করে, তাহলে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ করা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ তা শুনে বললেন, কি ভাল কি মন্দ অত জানি না; তিনি যা করান তাই করি, যা বলান তাই বলি।  এবার উপমা সহকারে কথায় কথায় বললেন-
“তাঁর কি ইচ্ছা মায়াতে জানতে দেয় না। তাঁর মায়াতে অনিত্যকে নিত্য বোধ হয়, আবার নিত্যকে অনিত্য বোধ হয়। সংসার অনিত্য — এই আছে এই নাই কিন্তু তাঁর মায়াতে বোধ হয়, এই ঠিক। তাঁর মায়াতেই আমি কর্তা বোধ হয়; আর আমার এই সব স্ত্রী-পুত্র, ভাই-ভগিনী, বাপ-মা, বাড়ি-ঘর — এই সব আমার বোধ হয়।......সংসার আশ্রম ভোগের আশ্রম। আর কামিনী-কাঞ্চন ভোগ কি আর করবে? সন্দেশ গলা থেকে নেমে গেলে টক কি মিষ্টি মনে থাকে না।
এখানে উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য হবে, তবুও বলি, ঠাকুর উপমা দিয়ে কথাটি বর্ণনা করায় তা সহজেই ভক্তদের হৃদয় গভীরে গেঁথে যায়। আর এখানেই ঠাকুরের উপমার বিশেষ মাহাত্ম্য বা গুরুত্ব।
একই দিনের কথা। ১৮৮১, ৩রা ডিসেম্বর l 

মনোমোহন মন্দিরে ব্রাহ্মভক্তসব, সঙ্গে কেশব এসেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বসে আছেন প্রাঙ্গণে। ভাগবত পাঠ হতে লাগল। পাঠান্তে ঠাকুর কথা বলছেন। প্রাঙ্গণের চারদিকে গৃহস্থ ভক্তরা বসে আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের উপমা সহকারে বলছেন — সংসারের কর্ম বড় কঠিন; বনবন করে ঘুরলে মাথা ঘুরে যেমন অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তবে খুঁটি ধরে ঘুরলে আর ভয় নাই। কর্ম কর কিন্তু ঈশ্বরকে ভুল না। যদি বল, উপায় কি?
ঠাকুর বললেন, “উপায় অভ্যাসযোগ। ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা দেখছি, তারা একদিকে চিঁড়ে কুটছে, ঢেঁকি পড়বার ভয় আছে হাতে; আবার ছেলেকে মাই দিচ্ছে; আবার খরিদ্দারদের সঙ্গে কতা কইছে; বলছে — তোমার যা পাওনা আছে দিয়ে যেও।
উপমা দিয়ে ঠাকুর সরস ভাবে বোঝালেন ভক্তদের।
এরকম ঠাকুরের সব কথাবার্তা উপদেশে দেখি ভুরি ভুরি উপমা। আর এই সরস উপমাই ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে যেত। 

আবার ভক্তদের বললেন, “তবে এটুকু হবার জন্য একটু সাধন চাই। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। ভক্তিলাভ করে কর্ম করা যায়। শুধু হাতে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আঠা লাগবে — হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আর আঠা লাগবে না।”
সোজাসাপটা কাঁঠাল ভাঙার উপমা দিয়ে তিনি বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন ভক্তদের।
ঠাকুর আনন্দে নাচছেন। সঙ্গে সঙ্গে কেশব ও ভক্তরাও নাচছেন। শীতকাল, ঠাকুরের গায়ে ঘাম দেখা দিচ্ছে। ঠাকুর খেলেন এবার। তারপর সংসারে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করছেন।  
শ্রীরামকৃষ্ণ — যারা সংসারে তাঁকে ডাকতে পারে, তারা বীরভক্ত। মাথায় বিশ মন বোঝা, তবু ঈশ্বরকে পাবার চেষ্টা করছে। এরই নাম বীরভক্ত।
যদি বল এটি অতি কঠিন। কঠিন হলেও ভগবানের কৃপায় কিনা হয়। অসম্ভবও সম্ভব হয়।
এবার উপমা দিয়ে বললেন, হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি আলো আসে, সে কি একটু একটু করে আসবে? একবারে ঘর আলোকিত হবে।
এই সব আশার কথা শুনে কেশব ও গৃহস্থ ভক্তরা আনন্দে মশগুল হয়ে পড়লেন।
এবার ঠাকুরকে উপরে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তিনি সেবা করে দক্ষিণেশ্বর যাত্রা করলেন।  
১৮৮১, ১০ই ডিসেম্বর l 
শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র গোস্বামী বাড়ির উঠোনে ভাগবত পাঠ করছেন ঠাকুর। অনেক ভক্ত হাজির। সংসার নিয়ে কথা হচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ পুলের উপমা দিয়ে বললেন — সংসারে হবে না কেন? তবে বড় কঠিন। আজ বাগবাজারের পুল হয়ে এলাম। কত বন্ধনেই বেঁধেছে। একটা বন্ধন ছিঁড়লে পুলের কিছু হবে না। আরও অনেক শিকল দিয়ে বাঁধা আছে — তারা টেনে রাখবে। তেমনি সংসারীদের অনেক বন্ধন। ভগবানের কৃপা ব্যতিরেকে সে বন্ধন যাবার উপায় নাই।
“তাঁকে দর্শন করলে আর ভয় নাই; তাঁর মায়ার ভিতর বিদ্যা-অবিদ্যা দুই আছে; — দর্শনের পর নির্লিপ্ত হতে পারে। পরমহংস অবস্থায় ঠিক বোধ হয়। দুধে জলে আছে, হাঁসে যেমন দুধ নিয়ে জল ত্যাগ করে। হাঁস পারে কিন্তু শালিক পারে না।”
একজন ভক্ত জানতে চাইলেন — তবে সংসারীর উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — গুরুবাক্যে বিশ্বাস। তাঁর বাক্য অবলম্বন; তাঁর বাক্যরূপ খুঁটি ধরে ঘোরো, সংসারের কাজ করো। গুরুকে মানুষবুদ্ধি করতে নাই। সচ্চিদানন্দই গুরুরূপে আসেন। গুরুর কৃপায় ইষ্টকে দর্শন হয়, তখন গুরু ইষ্টতে লীন হয়ে যান।
এবার উপমা দিয়ে ঠাকুর ভক্তদের বিস্তারিত বলছেন-
সরল বিশ্বাসে কি না হয়। গুরুপুত্রের অন্নপ্রাশনে — শিষ্যেরা যে যেমন পারে, উৎসবের আয়োজন করছে। একটি গরীব বিধবা সেও শিষ্যা। তার একটি গরু আছে, সে একঘটি দুধ এনেছে। গুরু মনে করছিলেন যে দুধের ভার ওই মেয়েটি লবে। বিরক্ত হয়ে সে যা এনেছিল ফেলে দিলে আর বললে — তুই জলে ডুবে মরতে পারিস নি? মেয়েটি এই গুরুর আজ্ঞা মনে করে নদীর ধারে ডুবতে গেল। তখন নারায়ণ দর্শন দিলেন; আর প্রসন্ন হয়ে বললেন — এই পাত্রটিতে দধি আছে, যতই ঢালবে ততই বেরুবে, গুরু সন্তুষ্ট হবেন। এবং সেই পাত্রটি দেওয়া হলে গুরু অবাক্‌। আর সমস্ত বিবরণ শুনে নদীর ধারে এসে মেয়েটিকে বললেন — নারায়ণকে যদি আমাকে দর্শন না করাও তবে আমি এই জলেতে প্রাণত্যাগ করব। নারায়ণ দর্শন দিলেন, কিন্তু গুরু দেখতে পেলেন না। মেয়েটি তখন বললে, প্রভু গুরুদেবকে যদি দর্শন না দেন  আর তাঁর শরীর যদি যায় তো আমিও শরীরত্যাগ করব; তখন নারায়ণ একবার গুরুকে দেখা দিলেন।
দেখ গুরুভক্তি থাকলে নিজেরও দর্শন হল আবার গুরুদেবেরও হল।
তাই বলি — যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ীবাড়ি যায়,
 তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
সকলেই গুরু হতে চায়, শিষ্য হতে বড় কেহ চায় না। কিন্তু দেখ উঁচু জমিতে বৃষ্টির জল জমে না। নিচু জমিতে — খাল জমিতে জমে।

আরেকটি উপমা দিয়ে বললেন- যে শামুকের ভেতর মুক্তা তয়ের হয়, এমনি আছে, সেই শামুক স্বাতী-নক্ষত্রের বৃষ্টির জলের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। সেই জল পড়লে একেবারে অতল জলে ডুবে চলে যায়, যতদিন না মুক্তা হয়।    
(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments