জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---পর্ব-(২৭)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(২৭)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল


ধর্ম ও দর্শন

Sartre ফরাসি ধনতন্ত্রের অবসান চেয়েছিলেন। ১৯৬৮ খ্রিঃ মে মাসে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা ফলপ্রসূ না হওয়ায় তিনি কমিউনিজমের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। নৈরাজ্যও কোনো না কোনোভাবে এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ সংহতি বা সামঞ্জস্যের আবহ সৃষ্টি করে, যখন রাষ্ট্রশক্তির বিলয় ঘটে। সাধারণভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার জন্য পুলিশ সৈন্য আদালত কর প্রভৃতি প্রয়োজন নেই এবং সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র না থাকলেও সমাজ থাকতে পারে। Sartre-এর প্রতিষ্ঠিত অস্তিত্ববাদের অর্থ মানবতাবাদ বা মানবতাবাদী দর্শন। তার মতে মানুষের সেই শক্তি আছে, যার সাহায্যে যে কল্পনাশ্রয়ী হয়েও তার চারপাশের পরিবেশকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে ও নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তার এই অভূতপূর্ব মানসিক শক্তি ছিল বলেই তিনি "নোবেল পুরস্কার" প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন এবং এ-ও বলেছিলেন, তাকে যদি "লেনিন পুরস্কারে" ভূষিত করা হত, তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করতেন। তার অস্তিত্ববাদী দর্শনে স্বাধীনতা মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ এই স্বাধীনতা মানুষকে অপরিসীম দায়িত্ব পালনের দিকে ঠেলে দেয় এবং সেই মানুষ তখন মনে করে- একমাত্র আমিই লোকহিতের জন্যে সঠিকভাবে দায়বদ্ধ, যার ভিতর দিয়েই মানবতাবাদের জন্মলাভ সম্ভব হবে।

  তিনি যুবশক্তিকে প্রাণিত করে বলেছিলেন- "You are free, therefore choose" বিশ্ব সম্পর্কিত চিন্তায় তার হৃদয় আচ্ছন্ন ছিল বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, মানুষের স্বাধীনতাবোধ থেকেই সে ভয়ংকরভাবে এক অসীম দুঃখের কারাগারে নিজেকে নিক্ষেপ করেছে। মানুষ তো কখনও স্বাধীনতাকে নির্বাচন করে না এবং বেঁচে থাকাকেও সে নির্বাচন করে না। তাকে এই বিশেষের মধ্যে এনে ফেলা হয়েছে, যেখানে তার সৃজন নির্মাণের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। ফলে তাকে সর্বক্ষণ দায়বদ্ধতার জীবনযাপন করতে হয় এবং সেখানেই সে নিজেকে খোঁজে। মুক্ত চিন্তার ভিতর দিয়ে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে বোঝে, সে যা করছে তার বাইরে সে আর কিছুই নয় এবং স্বাধীনতাবোধ ও স্বাধীনতা ভোগের অর্থ বুঝে সে নিজেকে আবিষ্কার করে বলতে পারে,- "We are not free not to be free। এবং নির্দ্বিধ প্রত্যয় নিয়ে এ-ও বলতে পারে "... Humanity makes history and history makes humanity."

  মানুষ যা মনে ইচ্ছা করে, সে তাই-ই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা সে-ই নির্ধারণ করে এবং ঈশ্বর যদি নাও থাকে, তবে কোন এক পরম শক্তিকে সে অনুভুতির ভিতর সন্ধান করতেও পারে। মানুষ যখন নিজেকে গড়ে তোলে, এই গড়ার মধ্যেই সে সমগ্র মানুষকেও গড়ে তুলতে চায় এবং সমগ্র মানবের ধারাকেই যেন দেখতে চায়। সে মানুষের মধ্য দিয়েই দেখতে চায়, সে কি করছে বা করতে চলেছে। এই বোধ থেকেই সে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি অর্জন করে, এবং নিজেকে পরিচালিত করার আগ্রহ লাভ করে। তার অনবদ্য জীবনবোধ তাকে এই প্রশ্নের উজ্জীবিত করে- "Am I really a man who has the right to act in such a manner that humanity regulates itself by what I do?"

  এখানে প্রসঙ্গত রাশিয়ার বিখ্যাত উপন্যাসিকের উক্তিটি স্মরণীয়, ডস্টয়ভস্কি (Dostoyevsky,খ্রিঃ ১৮২১-১৮৮১) মানুষের ধর্মীয় চিন্তা বিশ্বাস, তার জীবনের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট এবং সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনের অর্থ কি ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তার বিশ্বাস- "If God did not exist everything would be permitted"। অস্তিত্ববাদীদের কাছে এই উক্তিটির তাৎপর্য অপরিসীম এবং অস্তিত্ববাদের জন্মই এখানে থেকে শুরু হয়েছে। ঈশ্বর না থাকলে সব কিছুই অবাধ এবং সব কিছুই করা সম্ভব। কারণ কোন কিছু করার পিছনে নিয়ন্ত্রণকর্তার ভয় বা নির্দেশ বলে কিছু নেই। মানুষ যা করেছে তা সে নিজেই করছে, কেউ তাকে করাচ্ছে না। এই ঈশ্বর না থাকার ফলে মানুষের নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি বিষয়ে কোন নির্দেশনামা নেই। সুতরাং "Man is the future of man."

Descartes,Rene (খ্রিঃ ১৫৯৬-১৬৫০) ফরাসি গণিতবিদ। বিজ্ঞানী ও দার্শনিক মানুষের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- "Conquer yourself rather than the world." এই তাত্ত্বিক বাক্যটির অর্থ অবশ্যই এই যে, মানুষ নিজেকে জয় করতে অবিরাম কাজ করে যাবে, তার ফল যাই হোক না কেন। Sartre মানব জীবনকে বিচার করে বললেন- "I cannot base my confidence upon human goodness or upon man's interest in the good of society,seeing that man is free, there is no human nature which I can take as foundational,First I ought to commit myself and then act my commitment according to time honoured formula that one need not hope in order to undertake one's work." মানুষের জগৎই এই বিশ্বজগত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড। এর বাইরে আর কিছু নেই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments