জ্বলদর্চি

মেদিনীপুর জেলার আনাচে কানাচে বসবাসকারী ডোম ও চাঁড়ালরাই বাংলার প্রাচীন ব্রাহ্মণ /দুর্গাপদ ঘাঁটি

মেদিনীপুর জেলার আনাচে কানাচে বসবাসকারী ডোম ও চাঁড়ালরাই বাংলার প্রাচীন ব্রাহ্মণ 



 দুর্গাপদ ঘাঁটি
            
অনেকেই এদেরকে দেখলে ছোট জাত বলে নাক সিটকায় অথবা এদের  বাড়িতে এক গ্লাস জল পর্যন্ত গ্রহণ করতে চান না, ভারত সরকার এদের অনুন্নত জাতি হিসেবে তপসিল ভূক্ত করে সার্টিফিকেট প্রদান করেছে। কখনও কখনও  দলিত বলে উচ্চ বর্গের মানুষ দ্বারা চরম অত্যারিত হতে হয়েছে বহুবার।

    এই ব্রাত্য জাতিদ্বয়ের ইতিহাস জানতে একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। 

   বাংলায় আর্য্যগনের উপনিবেশ প্রথম স্থাপিত হওয়ার পূর্বে এই বাংলার প্রাচীন নাম পুন্ড্রবর্ধন। আর এখানে অন্ধ্র-পুলিন্দ -শবর প্রভৃতি ব্রাত্য বা অন্ত্যজ দস্যু ভূয়িষ্ঠ জাতির মধ্যে পুণ্ড্রেরও নাম রয়েছে। 

বাংলায় আর্য্যেতর জাতির দ্বারা অধ্যুষিত ছিল বলে এদেশে আগমন ও বসতি উত্তর ভারতবাসী গনের পক্ষে বহুদিন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।এ দেশে এলে ফিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত না করলে সমাজে গৃহীত হতো না আর্যদের। যারা এদেশে রয়ে যেতেন তাঁরা ব্রাত্য, নষ্ট বা পতিত  বলে গণ্য হতো। বৈদিক যুগে বাংলায় উপনিবিষ্ট আর্যের অস্তিত্ব থাকলে  তাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প ছিল।হয়তো প্রথম দিকে আগত আর্য জাতি যারা আর ফিরে যেতে পারেনি তাদেরই মধ্যে ডোম ও চাঁড়াল সম্প্রদায় বাংলার প্রাচীন পূজক ব্রাহ্মণ এর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না তাও অনেকের ধারণা।

     আবার অন্য বেশ কিছু তথ্য থেকে জানা যায়- ডোমেরা যদি বাংলার অস্ট্রিক জাতি হিসেবে গণ্য হয় তাহলে সেই বাংলার বর্তমান ডোম বা  "গদরিয়া" বা "মেশপালক" অর্থাৎ পূর্বে পশুপালনই তাদের প্রধান জীবিকা ছিল। বিবর্তনে অথবা সভ্যতা বিকাশে অন্যদের থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কারণে এরা এবং চাঁড়াল সম্প্রদায় একসময় বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে উঠেছিল একথা বোধ করি অনেকেরই অজানা।বাংলার তখন যে কাল্পনিক দেবদেবী ছিল তাদের মধ্যে ধর্ম ঠাকুর হল অন্যতম। প্রাচীন কালে মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনা যখনই ঘটত তার প্রকৃত কারণ মানুষ খুঁজে পায়নি। তাই তারা তখন এক অদৃশ্য শক্তিকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সেই শক্তির প্রতীকস্বরূপ কখনো গাছ, কখন শিলাকে তারা তাদের আরাধ্য দেবতা হিসেবে পূজা করতে শুরু করে। আর এটাই ছিল তাদের কাছে ধর্ম-ঠাকুর। আর এই ধর্ম ঠাকুর- সূর্য,বরুণ,বিষ্ণু,যম ও শিব সন্নিবেশিত রূপ এবং একক প্রতীক হিসাবে ধর্ম ঠাকুরকে তারা মনে করত। আর অন্য মানুষেরা এই দেবতার পূজার  অধিকার পাই নি।  তখন ডোম ও চণ্ডালেরাই তৎকালীন  অগ্রণী সম্প্রদায় হিসেবে এই অধিকার পেয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় ডোম ও চন্ডাল জাতি তৎকালীন বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিল।এই সম্প্রদায়দ্বয়ের বাড়িতে বাড়িতে ধর্ম ঠাকুরের মন্দির ছিল। যা এখনো অনেক ডোম সম্প্রদায়ের বাড়িতে দেখা যায়। 

 এই দুই সম্প্রদায়ই পুরাণের কল্পিত দেবতার  পূজা-অর্চনা করে তাঁদের জীবিকা চালাতেন।
  এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো - দ্বাদশ শতাব্দী এক বৌদ্ধ পণ্ডিতের উক্তি অনুসারে জানা যায় চন্ডাল দের উপবীত সংস্কার ছিল, সঙ্গে ডোমেদেরও। আবার প্রাচীন পণ্ডিতদের মতে এই ডোমরা নাকি আর্যভাষীও ছিল। হয়তো সময় ও কালের বিচারে যদিও এসব বিষয়ে বিতর্ক বা অসংগতি থাকতেই পারে কিন্তু কিছু একটা ঘটনা তো ছিলই যার কিছু  নিশ্চয়ই আনাচে কানাচে পড়ে রয়েছে। তাই এমন সত্যি  উল্লেখ না করলে এই সম্প্রদায়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ রাখা হবে।

    পূর্ব ভারতের অর্থাৎ বাংলার ডোমেদের একটি অংশ এদেশ ছেড়ে প্রথমে ইরানে এবং পরে পরিযায়ের পথ ধরে ইউরোপে পৌঁছান। এদের সেখানে ইংরেজিতে নাম হয় "জিপসি" এবং ডোম রোমে  "ডোম্ব" অপভ্রংশ হয়ে রম্ব এখন রোম। এই সম্প্রদায়ের মেয়েরা ছিল অসম্ভব সৌন্দর্য প্রিয় এবং তারা নৃত্যগীতে পটিয়সি।
   তারপর এদিকে বাংলা ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টে চিরাচরিত এক থেকে আর এক ঘটনার পদার্পণ।

    মৌর্য ও শুঙ্গযুগ মিলে সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫ অব্দ। এই সময়ে বাংলায় মৌর্যশক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরাভবের পর সেখানে আর্য-সংস্কৃতির প্রবেশ ও প্রভাব ধীরে ধীরে শুরু হয়। এই মৌর্য ও শুঙ্গযুগের আর্যীকরণকেই  প্রথম আর্যীকরণ বলা হয় । গুপ্তযুগ ছিল ৩১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।এই সময়ে বাংলায় আর্য সাংস্কৃতির প্রভাবটিকে বলা হয় দ্বিতীয় আর্যীকরণ। ইতিপূর্বে অবশ্য বাংলায় বৌদ্ধ মহাযান মতেও প্রাদুর্ভাব ঘটে।আর গুপ্ত শাসনের সময় থেকেই আর্য ব্রাহ্ম মত বেশি বেশি এই বাংলায় প্রসার লাভ করতে থাকে।অর্থাৎ গুপ্ত যুগের শেষের দিকেই বাংলায় আর্য আগমনের সম্পূর্ণায়ন ঘটে।

  বাংলাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে তখন দুটি স্তর তৈরি হয় - আর্য এবং অনার্য। উভয় স্তরের মধ্যে বৈবাহিক মিলন মিশ্রন এবং আচার বিচার, দান প্রতিদান চলতে থাকলেও সংস্কৃতিতে এবং ভাবধারাতে এই দুই স্তরের মধ্যে পার্থক্য বরাবর বেশ সুস্পষ্ট ছিল। আর্যরা যখন বাংলায় প্রথম উপনিবিষ্ট হয় তখন সংখ্যায় বহু ছিল না। ক্রমশ অনার্যের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে ধীরে  সংখ্যা বহুল হয়ে ওঠে।বর্তমান একটি তথ্য আমাদেরকে বেশ বিস্মিত করেছে। একটা তথ্য নিয়ে আলোচনা করলে সবাইকে বিস্তৃত হতে হবে আশা করছি। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক দল ভারতের কয়েক লক্ষ জনজাতির ডিএনএ টেস্ট করে তথ্য প্রকাশ করেছেন যে- এদেশের হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের যে বহু বিভাজিত সম্প্রদায়ের  জিনগত বৈশিষ্ট্য হুবাহুব এক দেখা গেছ। সেই গবেষক দল সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বহিরাগত আর্যরা এদেশে আসার পর এদেশের দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়,অষ্ট্রিক জাতির সঙ্গে আর্যদের মধ্যে শাসন,সভ্যতা,সংস্কৃতির সংঘর্ষ প্রথম প্রথম হলেও পরে পরে বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে অন্যান্য সম্পর্ক এক সময় দানা বেধেছিল তা উপরোক্ত গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে তা স্পষ্ট। 

      কিন্তু তত্ত্বগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে হয়তো অনার্যরা ছিল আর্য থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক। আর্যরা ছিল মনোধর্মী অর্থাৎ চিন্তাশীল আদর্শবাদী, তত্ত্বানুসন্ধানী,সংযমনিষ্ঠ অধ্যাত্মপরায়ণ। আর অনার্যরা ছিল প্রানধর্মী অর্থাৎ ক্রিয়াশীল,বাস্তববাদী,ভোগলিপ্সু ও দৈব নিষ্ঠ। অনার্যের বিশিষ্ট শিব যখন মনোধর্মী আর্যের দেবতা তখন তিনি যোগীশ্রেষ্ঠ বিয়ে করে হয়েছিল সতীপতি। আর যখন আর্যদের কাছে শিব  প্রানোধর্মী,অনার্যের দেবতা তখন তিনি ভোলানাথ।

 এভাবে হয়তো আর্য অনার্যের মধ্যে বেশ কিছু প্রভেদ রয়েছে কিন্তু কি অদ্ভুত মিলও রয়েছে তা কয়েকটি কথায় ব্যাখ্যা করলে তা পরিষ্কার হবে। ঋগ্বেদকে আমরা যদি পৃথিবীর প্রাচীন গ্রন্থ ধরি যা ভারতের এক সম্পদও বটে- যেখানে ঈশ্বরকে নিরাকার ব্রম্ভ স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ঈশ্বরের কোন লিঙ্গান্তর হয় না।সেখানে তাঁর  নানা নাম উল্লেখ আছে যেমন- বিশ্বকর্মা,  দুর্গা, শিব,গণেশ, কার্তিক, লক্ষী,সরস্বতী।এমন সব নাম হওয়ার কারণ একটা উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। যেমন বিশ্বের সৃষ্টি কর্তার জন্য ঈশ্বরের আরেক নাম বিশ্বকর্মা। এমনকি ভাবে অন্য নাম গুলিও।  যাইহোক ভারতবর্ষে আর্যাগমনের পূর্বে  দ্রাবীড় জাতি দ্বারা সভ্যতা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো প্রাচীন নমুনা শিবলিঙ্গের মতো ধ্যানমগ্ন যোগীপুরুষের অস্তিত্ব আর্যদের দেওয়া তথ্যকে ভেঙে দেয়। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন দ্রাবিড় জাতি ইতিহাস থেকে  দেখা গেছে যে সেখানেও ঋকবেদে বর্ণিত দেব দেবীর মতোই একই নাম বিশেষত শিবের নাম উল্লেখ আছে। আবার আবার আর্য পূর্ব প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মে ব্যবহৃত অনেক শব্দ ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে। 

   তাই ভারতবর্ষের ধর্মের প্রাচীনত্ব নিয়ে যে যাই দাবী করুক কোনটা যে সত্য  তা পুনঃপর্যালোচনার প্রয়োজন।

      যাই হোক ভারতবর্ষের উত্তর পথ ধরে যখন কথিত সবচেয়ে সভ্য জাতি অার্যদের বাংলায় তিনটি পর্যায়ে আগমন সম্পূর্ণায়ন ঘটে  তখনই তাঁদের ধর্মাচরণে উৎকর্ষতার ছাপ পড়ে বাংলার অধিবাসীদের উপর। প্রথমে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ চরমে ওঠে। কিন্তু আর্যদের মন্ত্রের স্পষ্ট উচ্চারণ ভঙ্গি ও আচারে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকায় স্থানীয় তৎকালীন অধিবাসীরা এই আর্য জাতিকেই গ্রহণ করে।পূজাপার্বণ পেশা  হারিয়ে এই ডোম সম্প্রদায় তাঁরা ধীরে ধীরে অন্য জীবিকায় চলে যান এবং রোজগারমুখী তেমন কাজ না মেলায় ডোমেরা তাদের বেশির ভাগই নিম্ন রোজগারের বাঁশ বেতের কাজ, নানা হিন্দু অনুষ্ঠানে ঢাক বাজানো, কেউ কেউ ক্ষেতমজুর কেউ কেউ  কুটির শিল্পের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহন করে।আর চণ্ডালেরাও অন্য পেশায় এবং ধীরে ধীরে হত দারিদ্র্য অবস্থার  পৌঁছায় এঁরা। পাল ও সেন যুগে তৎকালীন নব্য সমাজ প্রভুদের দ্বারা প্রচারিত হতে হতে এঁরা নিম্ন জাতি হিসেবে পরিগণিত  হয়।এমনই ভাবেই দেশে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরি হয়েছে বোধ করি যুগে যুগে।

    যাই হোক, যারা বর্তমান বাংলা তথা ভারতবর্ষের  কথিত উন্নত জাতি বা সম্প্রদায় বলে নিজেদেরকে দাবি  করেন এবং  উন্নত জাতি ভেবে এদেরকে ঘৃণা  ও তাচ্ছিল্য করেন, তখন কিন্তু এই ঘৃনিত সম্প্রদায় বা জাতি এসব মানুষ দ্বারাই পূজিত হত।

   এই ডোম সম্প্রদায়ের দেহে যদি প্রাচীন ব্রাহ্মণের রক্ত ও জিনগত গুন এখনো প্রবাহিত হয় তবে কেন তারাই এত ঘৃণিত বর্তমানে!

   আসলে জাতপাত নামক ছুঁতমার্গ কিছুটা মানসিক বিকারের বহিঃপ্রকাশ। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে পড়তে যুগের করাল গ্রাসে বিকৃত মানব সভ্যতায় হয়তো এই ডোম ও চাঁড়াল  সম্প্রদায়ের বর্তমান এই অবস্থা। এই বর্ণবৈষম্যের যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক কোন অস্তিত্বই নেই সেখানে সরকারের সংরক্ষণ নামক স্ট্যাম্প জাতপাত ব্যবস্থার শেকড়কে আরও গভীরে প্রথিত করে যা দেশের প্রকৃত উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেয়। এখন তা দেশ বিদেশের নানা ঘটনা ও  পরিস্থিতি প্রমাণ করে।

    
তথ্যসূত্র
১.বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস - ডঃ শ্রী সুকুমার সেন
২. What is india's caste system? BBC News
৩. Bengal Districts Gazeteers
৪. পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতি- বিনয় ঘোষ
৫. বীরভূমের লৌকিক দেবদেবী- অজিত কুমার মিত্র.
৬. শিবঃ অনার্য দ্রাবিড় জাতির দেবতা- ইমন জুবায়
৭. তথ্য  সরবরাহ সহযোগিতায় ব্যাকরণবিদ- কালীপদ চৌধুরী।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments