জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা - ৫৮/উৎসব সংখ্যা ৭


সম্পাদকীয়,
উৎসবের আর এক নাম পরব। সাঁওতাল ও মুন্ডা জনজাতির বাঁধনা পরব শুরু হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে। অর্থাৎ আমরা যেদিন কালী পুজোয় মেতে উঠি সেদিন থেকে। পরবটি উপলক্ষ্যে সারপা নাচ হয়। সেই নাচের একটি ছবি উপহার দিয়েছেন, সুদীপ আঙ্কেল। সারা বাংলা জুড়ে এমন কত কত উৎসব সারা বছর ধরে পালিত হয় তার খবর আমরা রাখি না। কিন্তু সেগুলোও কিন্তু আনন্দের উৎসব। এই আজ যেমন শিশুদিবস। শিশুদিবস মানেই বিমলেন্দ্র জেঠুর আঁকা ছবিটার মতো শিশুদের অনেক যে হাত পা গজাবে তা কিন্তু নয়। শিশুদিবসের আরো তাৎপর্য আছে। এই যেমন তোমাদের বন্ধু সুহেনা দুগগার সিংহ কে খুঁজে পাচ্ছে না বলে একটা ছড়া লিখে ফেলল, আর অস্মিতা আশুদাদাকে নিয়ে একটা গল্প, এটাই শিশু দিবসের মজা। মজা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাঁধনা পরবের মজা কোনো কোনো গ্রামে চলে একমাস। তেমন শিশু দিবসে কত কত স্কুলে পাড়ায় ছবি আঁকা উৎসব হয়। আমরাও তোমাদের আঁকা অনেক ছবির ডালি দিয়ে আজকের সংখ্যা সাজিয়েছি। আর সবচেয়ে আনন্দের কথা আজকের শিশুদিবসের মজা বাড়াতে বাসবদত্তা আন্টি তোমাদের নিয়ে যাবে মেঘেদের বাজারে। সেখানে, পাহাড় আছে, আব্বে জলপ্রপাত আছে,...  কি মজা না! এতদিন বাদে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কেমন লাগল জানিও। দেশের মধ্যে বেড়ানোতো হল। এবার জয়া আন্টির মজার অনুবাদ গল্প টা পড়ে নাঈ। তবে বিদেশের এক ছোট্ট বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে। কি খুশি তো? এই খুশিতে চলো পড়ে ফেলি সন্দীপন আঙ্কেল, স্বপ্ননীল আঙ্কেল, গৌতম আঙ্কেল আর মলয় জেঠুর ছড়াগুলো। শিশুদিবসে যেমন নানা মেলা বসে, নাচ গান হয় অনেক জায়গায়, সবই তো জহরলাল নেহেরুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে সেটা জানো তো? আমাদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চাচা নেহেরু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন তাই আমরা তাকে স্মরণ করতে শিশুদিবস পালন করি। জন্মদিনের কথায় মনে পড়ে গেল সুব্রত আঙ্কেলের গল্পে অমল স্যার আর মনোজের আজ জন্মদিন। অমল স্যারের জন্মদিনে তাঁর মা পায়েস রেঁধেছে।  যাবে নাকি খেতে? তাহলে কিন্তু উপহার নিয়ে যেও। কী উপহার? কেন, বই। কোন বই? বলব না। গল্প পড়ে জেনে নাও। আর অদিতি আন্টির গল্পে বুদুলের খুব মন খারাপ। কেন? সেটাও গল্প পড়ে জেনে নাও। ছোটোবন্ধু শ্রীপর্ণা, তুলি, স্নেহা, অনুশ্রুতি, বিশাখা, জয়দীপ, সখী, ঐশিক, যে ছবিগুলো এঁকে পাঠিয়েছে সেগুলো কেমন লাগলো জানাতে ভুলনা, সেটাই হবে শিশুদিবসে ছোটো বন্ধুদের আঁকার পুরস্কার। উৎসব সংখ্যা শেষ হল বলে মন খারাপ হচ্ছে নিশ্চয়ই। আমারতো মনখারাপ হচ্ছে তাদের জন্য যারা পুজোর আগে বন্যায় ঘর জলে ভেসে গেছে বলে নতুন জামা কাপড় পরে ঠাকুর দেখতে যেতে পারেনি। আমি তাদের কথা জানলাম কেমন করে? কেন অমিত আঙ্কেল তার গল্পে গল্পে বলল তো! এসো সেসব জায়গার শিশুদের লজেন্স কেক পাঠানোর ইচ্ছার কথা বলি যে যার নিজেদের জন্মদিনে।  কাকে বলবে? কেন মা-বাবাকে! এমন অনেক অনেক কিছু ইচ্ছা আমরা সারা বছর পালন করে, এসো শিশুদের আনন্দ দিই। তবেই না সারা বছর উৎসবের আনন্দ পাব। এই সাত রঙে রাঙানো উৎসব সংখ্যাগুলি মৃন্ময়ীদিদির আঁকা যে ছবিটির মোড়কে সেজে উঠল সেটি এঁকে পাঠানোর জন্য আমি তোমাদের হয়ে দিদিকে বলে দিচ্ছি, - থ্যাঙ্কু, মৃন্ময়ীদিদি। তবে শুনে রাখো এবার থেকে জ্বলদর্চি ছোটোবেলা তোমাদের জন্য আরো মজার মজার সংখ্যা নিয়ে হাজির হবে।  - মৌসুমী ঘোষ




Clarita se volvió invisible ক্লারিতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল / Graciela Montes গ্রাসিয়েলা মোন্তেস/ স্প্যানিশ থেকে বাংলা অনুবাদ- জয়া চৌধুরী

অনেকদিন আগে একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল, নাম তার ক্লারিতা। একদিন ক্লারিতা তার বাথটাব থেকে বের হয়েছে, বড়সড় তোয়ালে দিয়ে নিজেকে বেশ ভালমত জড়িয়ে নিয়েছিল সে, বলল- আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি!   
বড় তোয়ালেটা সত্যিই বিশাল বড় আকারের ছিল, বিপুল সে আকৃতি, আর খুব মোটা যে ক্লারিতার গলা বড্ড আস্তে শোনা যাচ্ছিল। এত হালকা যেন ভূতের মত সরু। 
আমিইইইইইইইইই  অদৃশ্য হয়ে গেছি!   
আমিইইইইইইইইই  অদৃশ্য হয়ে গেছি!- বলে উঠল ক্লারিতা। বিরাট তোয়ালের নিচে নিজের হাতদুটো একবার উপরে একবার নিচে  এমন করে ঘোরাতে ঘোরাতে কথাটা বলছিল ক্লারিতা। 
আর তারপর ক্লারিতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

আর হবেই বা না কেন? হ্যাঁ এরকমটা হতেই পারে।  আর তা যদি না হয়, তাহলে খামোখা তোয়ালেটা শুধু দেখা যাবে কেন? 
বিরাট তোয়ালেটা দেখতে পায়। হ্যাঁ সে চোখে দেখতে পায়। এমনকি তোয়ালের নিচে যে পা দুটো দেখা যাচ্ছিল সেগুলো ক্লারিতার নয়। 

হ্যাঁ ক্লারিতার পা ও দুটো নয়।  কারণ ক্লারিতা তো অদৃশ্য হয়ে গেছিল। 
তখন কলঘরের মেঝেয় ক্লারিতা তার পরনের তোয়ালেটা ফেলে দিল। ওর ভালুক আঁকা চটিটা পরে কলঘরের বাইরের করিডোরে রাখা আয়নার সামনে দৌড়ে গেল। 
যখন হাঁটছিল তখন আওয়াজ হচ্ছিল 
ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ 

আয়নাটা যেখানে রাখা ছিল ক্লারিতা যখন সেখানে পৌঁছল বেশ ভাল করে তাকাল ওটায়। সে তাকাল কিন্তু দেখতে পেল না। কিন্তু করিডোরের আয়নাটা ফাঁকা ছিল। ও কেবল দেখতে পেল মেঝের ওপর ভালুকের ছবি আঁকা এক জোড়া চপ্পল।  ক্লারিতা যখন নড়াচড়া করছে ও দুটো নড়ছে। 
কিন্তু আয়নায় ক্লারিতার পায়ের পাতা ছিল না, পুরো পা দুটোও ছিল না। ক্লারিতার হাতদুটো ছিল না। এমনকি মুখও নয়। আয়নায় কোন ক্লারিতা ছিলই না। আর ক্লারিতা ওখামে ছিল না কেননা ক্লারিতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। 
ক্লারিতা হেসে উঠল। অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে ক্লারিতার খুব মজা লাগছিল। 
তখন ক্লারিতা দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেল।  
   
ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ 

ক্লারিতা যখন চপ্পল পরে হাঁটছিল তখন ওরকম আওয়াজ হচ্ছিল। 
মা রান্নাঘরে তোরতিইয়া বানাবে বলে ডিম ফেটাচ্ছিলেন। 
ক্লারিতা যেহেতু অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তাই সে যে রান্নাঘরে ঢুকেছে মা তা খেয়ালই করেননি। এমনকি ক্লারিতা যে মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আর নাক মুখ চোখ দিয়ে নানা রকম করে ভেংচি কাটছে সেটাও দেখতে পাননি। 
এটা নিশ্চিত যে মা ক্লারিতাকে দেখতে পাননি। কেননা তিনি যদি ক্লারিতাকে দেখতে পেতেন তাহলে নির্ঘাত বলতেন-
খালি গায়ে ওখানে কী করছিস ক্লারিতা? শিগগির গিয়ে জামা পর, ঠান্ডা লেগে যাবে! 
কিন্তু মা কিচ্ছু বললেন না। কারণ ক্লারিতাকে মা তো দেখেনই নি। আর দেখতে পান নি কেননা ক্লারিতা তো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। 
মা তার দিকে চেয়ে আছেন অথচ তাকে দেখতেই পাচ্ছেন না। ক্লারিতার খুব হাসি পাচ্ছিল।
“মার সঙ্গে একটা মজা করি!” ক্লারিতা ভাবল। 
ক্লারিতার মা যখন দেখলেন ডিমের ট্রে থেকে একখানা ডিম উড়তে শুরু করেছে এবং তারপর সেটা বাতাসেই ভাসতে থাকছে, প্রথমটায় উনি চোখ বড় করে খুলে ফেললেন। তারপর মুখ খুলে ধরলেন বড় করে এবং তারপর বললেন
উউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউই
ওপরে অনেকগুলো উ লেখা হয়েছে কেননা সেটা বেশ জোরালো উই ছিল। 
উই বলে ফেলার পরে ক্লারিতার মা মাথা ঘুরে যাতে না পড়ে যান সে ভয়ে রান্নাঘরে রাখা একটা সবজে রঙের বেঞ্চে বসে পড়লেন। 
তারপর ক্লারিতা ওর ডিমটাকে নামিয়ে আনল। আবার সেটাকে ডিমের ট্রের মধ্যে রেখে দিল। 
হাসতে সাহতে পালাল ক্লারিতা। ও খুব হাসছিল। অদৃশ্য হয়ে আছে বলে ক্লারিতার দারুণ মজা লাগছিল। 
তারপর দৌড়ে শোবার ঘরে গেল। ওখানে ভাই ঘুমোচ্ছিল। 

ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ 

পায়ের চপ্পল থাকার জন্য করিডোরে শব্দ হচ্ছিল ওরকম। 
ক্লারিতার ভাই ছিল ছোট্ট এক শিশু। এইজন্য সে মুখে চুষিকাঠি নিয়ে ঘুমোত। ওর চোখ দুটো বেশ ভালভাবে বোজা ছিল। মুখে ছিল চুষিকাঠি। কাঠিটা হালকা করে নড়ছিল, খুব আস্তে করে। 
ক্লারিতা ধীরে ভাইয়ের কাছে গেল ( ছপ এবং তারপর ফের ছপ আওয়াজ তুলছিল ওর চপ্পল দুটো)। তারপর এক টানে স্যাক! করে চুষিটা টেনে নিল সে। 
চুষিটা আকাশে দুলছিল। কুট্টি ভাইটা কেঁদে উঠল। খুব জোরে কাঁদতে লাগল। মাটিতে তখনও একজোড়া চপ্পল পড়ে ছিল। চপ্পল দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ক্লারিতাকে নয়। কারণ ক্লারিতা অদৃশ্য হয়েছিল। 
ভাইটা খুব জোরে কাঁদছিল। বাচ্চাদের মুখ থেকে স্যাক! করে চুষিকাঠি টেনে নিলে ওরা যেরকম কাঁদে ঠিক সেরকম জোরে কাঁদছিল।  জোরে মানে এতটাই জোরসে যে ক্লারিতা চুষিকাঠিটা বিছানার ওপরে ফেলে রেখে হাত দিয়ে কান চেপে দৌড়ে বাইরে চলে এল। 
দৌড়তে দৌড়তে হাসছিল। কারণ ক্লারিতার খুব মজা লাগছিল। কেননা সে তো অদৃশ্য হয়ে গেছে। 
তার পর থেকে ক্লারিতা এরকম অনেক কাজ করল। অদৃশ্য হয়ে গেলে মানুষ যে যে ধরনের কাজ করে। 
ম্যাওয়ের লেজ ধরে টানল। কিন্তু বিড়ালটা তো ওকে দেখতে পায় নি। স্রেফ ফফফফ করে ফোঁস আওয়াজ করেই থামল। তার লোমগুলো এক্কেবারে খাড়া হয়ে উঠেছিল। 

ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ 

ক্লারিতা পালাচ্ছিল। 
মায়ের পরনের অ্যাপ্রনটার গিঁট খুলে দিল। কিন্তু মা বুঝতেই পারলেন না হঠাত করে অ্যাপ্রনটা খুলে মেঝেয় পড়ে গেল কেন। 

( হাসতে হাসতে পালাচ্ছিল ক্লারিতা। অদৃশ্য মানুষেরা যেভাবে হাসে  ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ )

জানলার দুই পাটিই হাট করে খুলে দিলেন। অমনি দুটো হলদে পাতা পাখির মত ঘরে ঢুকে এল। 
ইস কী ভীষণ হাওয়ার দাপট! মা বললেন। জানলা বন্ধ করতে দৌড়ে গেলেন। 

ক্লারিতা পালাচ্ছিল হাসতে হাসতে ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ।
যতক্ষণ না তোরতিইয়া বানানো শেষ হল মা সবুজ বেঞ্চে বসে রইলেন। তারপর বানানো শেষ হলে মা বললেন-
ক্লারিতা শিগগির চলে এসো এখানে সোনা। আমি তোমায় চুমু খাব!  

ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ 
দৌড়ে বেঞ্চের দিকে ছুটল ক্লারিতা। 
আমি এসে গেছি মাম্মি 
কোথায়? কোথায় গেলে তুমি? তোমায় তো দেখতে পাচ্ছি না? – মা জিজ্ঞেস করলেন।
এই তো মাম্মি। দেখো।
কিন্তু ক্লারিতা, - হাসি চেপে মা বললেন- আমি তো তাকাচ্ছি আর তাকাচ্ছি কিন্তু তোমায় তো দেখতে পাচ্ছি না, একদম দেখতে পাচ্ছি না। 
দেখতে পাচ্ছি! দেখতে পাচ্ছি! – বলল ক্লারিতা। (কারণ ক্লারিতা খেলাধুলো করতে খুব ভালবাসত।)
ঠিক আছে- মা বললেন -  দেখতে পাচ্ছি! দেখতে পাচ্ছি!
কী দেখছ?-  ক্লারিতা জিজ্ঞেস করল। 
একটা ছোট্ট মেয়ে
কোন মেয়ে?
আমার মেয়ে
কী রঙের?
ক্লারিতা রঙের। গোলাপি গাল আর সাতখানা তিল সুদ্ধ সে মেয়ে। 
এই তো আমি!- ক্লারিতা বলে উঠল।

ক্লারিতা আর তত অদৃশ্য নেই।
মা তাকে জাপটে ধরে কাতুকুতু দিতে লাগলেন আর চুমু খেতে লাগলেন। 
ভাগ্যি তোমায় দেখতে পেলাম! দেখতে পেলাম! – মা বললেন- ওই জন্যই তো তোমায় চুমু খেতে পারছি। 

তারপর মা বললেন- এখন ক্লারিতা যাও জামা নিয়ে এসো। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে তো! 
তখন রান্নাঘর থেকে এক ছুটে ক্লারিতা জামা আনতে গেল। পায়ে ওর চপ্পল জোরা ছিল। ছুট ছুট। 

ছপ ছপ ছপ ছপ ছপ 



লেখক পরিচিতি
গ্রাসিয়েলা মোন্তেস
ভারতের স্বাধীনতার সালে মানে ১৯৪৭ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেস শহরে তাঁর জন্ম। অনুবাদক- সাহিত্যিক গ্রাসিয়েলা মোন্তেস আর্জেন্টিনার ফ্লোরিডায় বড় হল। শিশু সাহিত্যিক মন্তেস একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা “লা মাঞ্চা” বা “আবর্জনা” পত্রিকার সপাদনা করছেন দীর্ঘ দিন ধরে। ১৯৮০ সালে লাসারিইও পুরষ্কার পান। হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন পুরষ্কারের জন্য তিনবার মনোনীত হন। শিশু সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে পায়োনীয়র সম্মান পান। এতাবৎ ৭০ টির বেশি বই লিখেছেন ছোটদের জন্য।



আমার খুশি
সন্দীপন রায়

আমার খুশি মাঠ ভরা সাদা কাশে।
আমার খুশি শিউলি ভেজা ভোরে।
নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোয়,
আমার খুশি শারদীয়া রোদ্দুরে।


পুকুর ভরা পদ্মে আমার খুশি।
আমার খুশি আটচালা পুজো ঘরে।
আমার খুশি দুঃখহারিণী মা গো,
তোমার খোঁজে সীমাহীন পথ ধরে।


অতিমারীর এ কালবেলায়
এসো মা দুগ্গা তুমি।
সকল আঁধার কাটিয়ে আবার
খুশিতে রাঙাও ভূমি।


খাড়াপাড়ার ছড়া 
স্বপ্ননীল রুদ্র

জানতুমই না এই শহরে আছে এমন পাড়া
কেউ বসেনা টুলে মোড়ায়, দাঁড়িয়ে থাকে খাড়া
চেয়ারগুলোয় ধুলোবালির সর পড়েছে পুরু
এসব দেখে অবাক আমি, কুঁচকে গেল ভুরু  

রাত্রিবেলায় ঘুমোয় শুধু, সকাল থেকেই আবার
দাঁড়িয়ে পড়ে যে যার মতো, বসেনা কেউ আর—
লেখাপড়া ইস্কুল-কলেজ গান গাওয়া বা আঁকা
খাড়া হয়েই করে সবাই, হয়নাতো কেউ বাঁকা

হাতের ওপর খাতা ধরে একজনেতে দাঁড়ায়
অন্য জনে কলম তুলে লিখতে লিখতে হাঁপায়
রান্না না হয় দাঁড়িয়ে হল, কিন্তু খাওয়ার বেলায়?
সারি সারি দাঁড়িয়ে সবাই সবজি ভাতে মেশায়!

অফিসগুলোয় টেবিল শুধু, চেয়ার নেইতো কোনো—
বড়বাবু দৌড়ে এসে বলেন, ‘সবাই শোনো,
বড়সাহেব আসবে এখন, দেখতে সবার কাজ
দাঁড়িয়ে উনি বাইক চালিয়ে রওনা দিলেন আজ—!’

রাস্তাঘাটে সবাই খাড়া, বাসেও নেই তো সিট
ওই পাড়াতে ঢুকলে পরে হবে যে কেউ ফিট
মাথা ঘুরে আমিও খুঁজি কেবল দাওয়াখানাই
দাঁড় করিয়ে ডাক্তার বলে, ‘খাড়া থাকুন মশাই…!’



ফুলবাড়ি
গৌতম বাড়ই


ফুল বলেছে ঐ বাড়িতে
আমি যাবই যাব রে,
এই বাদলের ঝরনা হয়ে
জিনিয়ার রঙে মাতিয়ে।
সনধে বেলায় মালতী ফুল
কানেতে তার কনক দুল,
কদমতলায় থোকার ফুলে
কাছের নদী ভাসায় জলে।
বৈঠা ঠেলে নৌকা করি
কে এল এই ফুলবাড়ি?




আসছে পুজো
মলয় সরকার

আসছে পুজো   আসছে পুজো
বাজছে ঢাকের বোল,
কাশের বনে  আপন মনে
উঠছে কলরোল।
শিউলি ফুল  ঘুমটি ভেঙে
ভাবছে এবার মনে-
অর্ঘ্য দেব নিজের হাতে  
মায়ের শ্রীচরণে। 

আসছে পুজো  আসছে পুজো
সোনার বরণ রোদ, 
ছুটির মজা নতুন জামা
বুকে খুশীর বোধ,
ঘুরতে যাওয়া খুশীর খাওয়া
আনন্দ হুল্লোড়-
ঠাকুর দেখা আড্ডা দেওয়া
আসছে খুশীর ভোর।

আসছে পুজো  আসছে পুজো
একটি বছর পরে,
বাইরে যারা আছে তারাও
ফিরবে সবাই ঘরে। 
ঢাকের সাথে অঞ্জলিতে
ভরবে সবার মন-
পুজোর শেষে সিঁদুর খেলার
বিশাল আয়োজন। 

আসছে পুজো  আসছে পুজো
মাত্র ক'দিন তরে,
পুজোর শেষে মনটা সবার
বিষাদে যায় ভরে। 
কৈলাসেতে খবর নিয়ে
দৌড়ে যাবে চাস,
অশ্রু ভারে নোয়ায় মাথা
মাঠের ধারে কাশ।



মায়া
অদিতি ঘোষদস্তিদার 

মা সব্বাইকে ভালোবাসে শুধু বুদুলকে ছাড়া। কেন যে সেটা বুদুল এক্কেবারে বোঝে না। 
বাড়ির সবাই মানে ঠামি, ঠাঠু, বাবা, পিমণি বলে, "মায়া নামে যেমন কাজেও, জগতের সবার জন্যে বুকভর্তি মায়া ওর!"
বুদুল তখন ঠোঁট ওল্টায় আড়ালে!
তবে হ্যাঁ, মায়া দয়া আছে মায়ের মনে সেকথা অবশ্য মিথ্যে নয়।  
গত বছর রাস্তায় ছোট্ট ভুলো কুকুরটাকে কে যেন সাইকেলের ধাক্কা মেরে পালিয়ে গেল, কেঁউ কেঁউ করে কী কান্না তার! বুদুল দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখেছিল, বলেও ছিল, "ও ঠামি, ভুলোটা কী কাঁদছে, ওষুধ লাগিয়ে দেব?" 
ঠামি হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন।   
"না গোপাল, একদম নয়। কামড়ে দিলে কী হবে?"
কলেজ থেকে ফেরার সময় মা দেখতে পেয়েছিল কুকুরটা দরজার সামনে বসে কেঁদেই যাচ্ছে আর ব্যথা পাওয়া পাটা সমানে চাটছে। মা তাকে কোলে করে তুলে এনে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে গরম দুধ খাওয়াল। 
তারপর কত চিন্তা।  
"এক্স রে করালে ভালো হত, কে জানে ভাঙল কিনা।"
সবাই প্রথমে হেসে উঠেছিল, কিন্তু পরে মায়ের গম্ভীর মুখ দেখে বাবা কতসব ফোন টোন করে এক ডাক্তারকে নিয়ে এলেন। কী যেন বলে তাঁদের, ও হ্যাঁ ভেট। 
মানে পশুদের ডাক্তার।  
সে এক হই হই রইরই ব্যাপার তখন।  ভুলো অবশ্য ভালো হয়ে গেল। এখন বাবার ভাষায় খেয়ে খেয়ে কেঁদো হয়েছে।
কিন্তু তা বলে কি মা কুকুর পুষতে দেবে বুদুলকে? সে হবার জো নেই। কবে থেকে বুদুলের একটা নধর তুলতুলে কুকুর পোষার শখ। পিমণি বলেও ছিল, জন্মদিনে একটা কুকুর দেবে।
কিন্তু মা এককথায় উড়িয়ে দিল সে কথা। কী ই না, পশুপাখিকে শেকল বেঁধে রাখব না।  
ভুলো রাস্তায় ঘোরে, যখন আসে খেতে দেওয়া হয়! ঐটুকুই। 
ব্যাস! হয়ে গেল! বুদুলের কত্ত কষ্ট হয়েছিল, চোখ উপছে জল বেরিয়ে আসছিল মা কি একটুকুও নজর করেছিল? ও আস্তে আস্তে এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিল, পিমণি দেখতে পেয়ে এসে আদর করেছিল। 
কানে কানে চুপি চুপি বলেছিল, "বড় হয়ে নিজের বাড়ি করবি যখন, তখন আমি কিনে দেব!"
হুঁ! তখন কিনে কী হবে? পাবে কি সময় কুকুরের সঙ্গে খেলার? বাবা কি পায়? পিসের কি খেলার সময় আছে? বুদুলের এখনই চাই। কত খেলত! কিন্তু মা সে কথা বুঝলে তো?
 বুদুল আরো অবাক হয় এবাড়ির বাকি লোকেদের কান্ডকারখানা দেখে।  সবাই কেমন মায়ের কথায় সায় দিয়ে দেয়। ঠামি তো বুদুলসোনা বলতে অজ্ঞান। বুদুল ভেবেছিল ঠামি  হয়ত পিমণির কথায় খুব সায়  দেবে, ও মা কোথায় কী?
কেমন ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলল, "মায়া তো ঠিকই বলছে, এইটুকু জায়গায় বেচারা হাঁফিয়ে উঠবে, আর কেই বা তাকে যত্ন করবে, আমরা সবাই তো ব্যস্ত!"
এইটুকু জায়গা! এত বড় দোতলা বাড়ি তাদের! পেছনে ছোট বাগান! কতবড় ছাদ! বন্ধুদের তো ফ্ল্যাটেও কুকুর আছে! 
তাই তাড়াতাড়ি বুদুল এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বলেছিল, “আমাদের থেকে ছোট বাড়িতেও কুকুর আছে অনেকের, আর আমি যত্ন করব, দেখো তোমরা, খুব যত্ন করব!" 
সবাই তো হেসেই অস্থির। আর মা? কেমন ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, "হুঁ:! ও নেবে যত্ন! ওকে আর ওর জিনিস সামলাতে সামলাতেই লোকে অস্থির! একটা বইখাতা আস্ত নেই, শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে মায়ের হাতে কড়া পড়ে গেল, স্কুলে যায় না কুস্তির আখড়ায় কে জানে?"
ঠামির কাছ থেকে পরে বুদুল জেনেছে কুস্তির আখড়ার মানে কী। বুদুল মোটেই স্কুলে মারামারি করে না। জামার বোতাম বুঝি বড়োদের  ছেঁড়ে না? মাঝে মাঝেই তো বাবা অফিস যাবার আগে গেঞ্জি পরে ঠামির সামনে এসে শার্ট নিয়ে এসে দাঁড়ায়। 
"তাড়াতাড়ি বোতামটা পরিয়ে দাও না মা!"
তার বেলা? কতদিন ঠামিকে ছুঁচে সুতো পরিয়ে দিয়েছে বুদুল। 
আর পাতা উল্টোতে উল্টোতে বইয়ের পাতা কখন যেন ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে যায় -সে কি ইচ্ছে করে করে বুদুল? ব্যাগ থেকে খাতা বের করতে গেলেও মাঝে মাঝে ছেঁড়ে। মায়েরও কি কোনদিন হয়নি?
যাই হোক কুকুর কেনা তো বাদ গেলো। 
কিন্তু সেই থেকে ভুলোটাকে দেখলেই রাগ হয় বুদুলের। কেমন মায়ের আদর খায়।  
এ বাড়িতে সবচেয়ে ভোরে ওঠে মা। মায়ের কলেজটা অনেক দূরে। তাই অনেক সকালে বেরোতে হয়। বুদুলকেও উঠতে হয় সকাল বেলা। সাতটার মধ্যে বাস এসে যায়। মা আগেই বেরিয়ে যায়।  মা সকালে উঠে চা করে  ভুলোকে দেয় মাটির ভাঁড়ে, সঙ্গে দুটো লেড়ো বিস্কুট। বুদুল তখন দুধ সিরিয়াল খায়। ভুলো খুব ল্যাজ নাড়ে, মা ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বুদুলকে তাড়া লাগায় ।
"ওরে, তাড়াতাড়ি খা, বাস মিস করলে কে ছাড়তে যাবে?" 
একটু বুদুলের মাথাতেও তো মা হাত বোলাতে পারে, বুদুল তাহলে চোঁ চোঁ করে খেয়ে নেয়। কোনদিন হয় না। 
তাই ভুলোকে একদিন ঢিল মেরেছিল আড়ালে। কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু ভুলো এমন কেঁউ করে চিৎকার করে উঠেছিল বুদুলের কান্না পেয়ে গেছিল।  
আর কোনদিন করেনি। আসলে রাগটা তো ভুলোর ওপরে নয়, মায়ের ওপর। মা যদি একটু ভালোবাসত।
ঠামিকে একদিন জিজ্ঞেসও করেছিল বুদুল। 
“ও ঠামি, মা আমাকে ভালবাসে না কেন গো? জানো তুমি?”
শুনে ঠামি হেসে অস্থির।
“দূর বোকা ছেলে, মা ভালবাসে না তোকে? তাহলে কলেজ থেকে ফিরেও তোর পছন্দের রান্না রাঁধে কেন শুনি? তোর যত লেগো আর গাড়ি কে কিনে আনে? তোর বাবা রাগ করে তাও! সারাক্ষণ তো তোর জন্যেই চিন্তা! কলেজ থেকেও খোঁজ নেয়, ছেলে খেল কিনা, ঘুমোল কিনা!”
ধুস! ঠামিও কিচ্ছু বোঝে না! 

শুধু কি মানুষ আর ভুলো কুকুর? মায়ের ভালোবাসার জিনিস আরো আছে। ঠাঠুর খুব গাছের শখ, ছাদভর্তি গাছ। কিছু কিছু পেছনের বাগানেও। গাছগুলোও মায়ের ভীষণ আদরের। ঠাঠু তো বলে, "মায়ার গ্রিন থাম্ব। যা বসায়, লাফিয়ে লাফিয়ে  বাড়ে।"
বাবা তখন বলে, "হবে না, মায়ার মিউজিক থেরাপি যে। গাছগুলোর গায়ে হাত বুলোয় আর গান গায়।"
বুদুল চুপি চুপি ঠামিকে বলেছিল," মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে গান করে না কেন গো?"
ঠামি বলেছিল বুদুল যখন ছোট ছিল মা নাকি গান গেয়ে গেয়ে ঘুম পাড়াত।
"এখন কেন করে না?"
ঠামি যেই না মাকে  গিয়ে সেই প্রশ্ন করেছে, মায়ের কী হাসি!
"বুড়ো ছেলের শখ দেখো মা!"
আচ্ছা, বুদুল কি বুড়ো? এই তো সবে ছ বছরের জন্মদিন গেল!
সেই থেকে বুদুলের গাছগুলোর ওপর ভারি রাগ। মাঝে মাঝে দু একটা ফুল ছিঁড়ে দেয়, পাতা কেটে দেয়।  মা অবশ্য বোঝে না। ঠাঠুকে বলে, "বাবা চড়াইগুলো বড্ড ঝামেলা করছে, পাতাগুলো কেমন কেটে দিচ্ছে।” 
ঠাঠু গিয়ে একটা কাকতাড়ুয়া বসিয়ে এসেছে। 
 কয়েক সপ্তা আগে মা আর একটা গাছ এনেছে।  গাছটার নাম নাকি নাইট কুইন। রাতে ফুল ফোটাবে। সেই গাছটাকে মা এখন সবচেয়ে যত্ন করছে। পাতা মুছিয়ে দেয় রোজ, খাবার দেয়। বাবাকে বলে, "ফুল ফুটলে তুমি ভিডিও করবে পুরোটা, কেমন আস্তে আস্তে ফুলটা ফুটছে দেখা যাবে।"
এই গাছটার ওপর বুদুলের এখন সবচেয়ে রাগ। তাই বেশ কদিন হল খাটের তলায় পিচবোর্ডের বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে গাছটাকে। মনে হচ্ছিল ডাস্টবিনেই ফেলে দেয় ,সাহসে কুলোয়নি। সারাক্ষণ ভয়ে অবশ্য বুক ঢিপঢিপ করে। যদি ধরা পড়ে যায়! কিন্তু খাটের তলায় তো অত ঝাড়পোঁছ হয় না সবসময়।  
আর মা নিজে এখন ভীষণ ব্যস্ত। কলেজে পরীক্ষা চলছে। বাড়িতেও খাতার পাহাড়। কোনদিকে তাকাবার সময় নেই। তাও মাঝে একদিন খোঁজ করছিল, গাছটা চোখে পড়ছে না বলে। বাবা এক ধমক দিয়ে উঠেছিল, “নিজের একটু যত্ন নাও তো, কতটুকু ঘুমোও! রোজ এত জার্নি। কোনদিকে মন দিতে হবে না। বাবা তো আছে গাছেদের যত্ন করতে, না কি?"
তাই সে বারের মত কথাটা চাপা পড়ে গেছিল।
তারপর আর খোঁজ হয়নি। 
আজ সন্ধে থেকে মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে বুদুলের। মা খাতা দেখায় ব্যস্ত। ঠামিকে জানাতে ঠামি বলল তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে। 
বুদুল ওর ঘরে একাই শোয়। ঠামি এসে একটু গল্প বলে গেল, তারপর  ঘুমিয়েও পড়েছিল বুদুল । হঠাৎ ভীষণ শীত করতে শুরু হতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বেড সুইচটা সামনেই ছিল। ফ্যানটা নিভিয়ে দিল। 
মাথাটা এখন আরো ব্যথা করছে। আর খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে।  কাউকে কি ডাকবে বুদুল? ফ্যান বন্ধ করে চাদরটা চাপা দিতেই কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে! 
হঠাৎ বুদুলের মনে হল বাক্সের মধ্যে গাছটারও কি এমনিই হচ্ছে? ওরও কি খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে?  কতদিন তো ওকে জল দেওয়া হয়নি।
গলা বুক সব যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। সারা শরীর জুড়ে খুব কষ্ট। তাও বুদুল অনেক কষ্টে বিছানার পাশের টুলে রাখা জলের বোতলটা নিয়ে একটু জল খেল। 
আঃ! কী শান্তি!
নাঃ! গাছটারও নিশ্চয়ই তেষ্টায় খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠামি  বলেছে গাছেরা নাকি সব বুঝতে পারে।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে জলের বোতলটা নিয়ে মাটিতে বসল বুদুল। খাটের তলার বাক্সটা থেকে গাছটা বের করল। 
আহারে! গাছটা একেবারে দুমড়োনো শুকনো! বোতলটা পুরোটা উপুড় করে জল দিল। 
তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়েই  সব যেন অন্ধকার! 

আবছা আবছা কী যেন কানে আসছে, "বুদুল, ও বাবা, বুদুল সোনা, মাণিক আমার! চোখ খোল বাবা! কী হবে! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! ও সোনা!"
মায়ের গলা! মা এতো আদর করে বুদুলকে ডাকছে? বুদুলের চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। 
"শুইয়ে দাও! বিছানায় শুইয়ে দাও!"
"মাথা ধুইয়ে দাও! জ্বর কমার ওষুধ দিতে হবে এক্ষুনি!"
ঘরময় অনেক কথা।  
চোখ বুজেও বুদুল বুঝতে পারছে বাবা শুইয়ে দিল বিছানায়!
মাথাটা মনে হচ্ছে মায়ের কোলে। আস্তে আস্তে চোখ খুলল বুদুল। 
"জল খাব। "
"আহারে! জল খেতে উঠেই বোধহয় জ্বরের ঘোরে পড়ে গেছে মাটিতে। আমি তো আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এসেছি।"
মা বলে যাচ্ছে।  
"এসে দেখি মাটিতে পড়ে। বোতলটা গড়াগড়ি যাচ্ছে। কোলের কাছে নিশিপদ্ম গাছটা! গাছটা এখানে কোথা  থেকে এলো বলতো! আশ্চর্য!" 
"আঃ! ওসব পরে ভেবো তো! ওষুধ খাইয়ে এখন মাথা ধোয়াই আগে। "
বাবা। 
ওষুধ খাইয়ে বাবা মাথা ধুইয়ে দিচ্ছে। ঠামি পা টিপে দিচ্ছে। আর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কত কী বলছে গুন গুন করে,  সব কথা ঠিক মত শুনতে পাচ্ছে না। আড়চোখে একবার গাছটার দিকে তাকিয়ে মায়ের কোলে মাথা গুঁজল বুলাই।   দুচোখ জুড়ে ঘুম আসছে।



জন্মদিনের উপহার 
সুব্রত দেব

 জানলা র পাল্লার ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে শীতের নরম রোদ
 পড়ছে বিছানায়। লাগছে মনোজের চোখেমুখে।
মনোজ পাশ ফিরে শুয়ে গায়ের চাদরটা টেনে নেয়।
--- মন, উঠে পড়। তোর ছাত্ররা এসে গেছে।
মার কথায় মনোজ ধড়ফড় করে উঠে বসে।
--- সাতটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। উঠে মুখ হাত ধুয়ে নে। চা করে আনছি।
- মনোজ দেয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল - সাতটা দশ। সাতটা থেকে পড়াতে বসার কথা। মনোজের এই হয়েছে জ্বালা। সকালে যে একটু শান্তি করে ঘুমোবে তার উপায় নেই। সকাল থেকেই
চাটাই পেতে বসে পড়া। না বসে করবেই বা কি!
মা বেটার পেট তো চালাতে হবে। হায়ার সেকেন্ডারি র
পর দুদিনের জ্বরে বাপ ফুড়ুৎ। কষ্ট করে গ্রাজুয়েশন।
চাকরীর চেষ্টা। কিন্তু চাকরি কোথায় ? এইতো সেদিন কাগজে দেখল মাস্টার ডিগ্রি পিএইচডি ধারীরা
হসপিটালে ডোম পদে প্রার্থী। 
-- মন, পড়ানো হয়ে গেলে কার্তিকদার দোকানে এই ঠোঙা গুলো দিয়ে আসবি আর দুটো দুধের প্যাকেট আনিস।
--- দুধের প্যাকেট কি হবে মা?
- একটু পায়েস করব, আজ তোর জন্মদিন।
-- না না মা, এসবের দরকার নেই।
- আনিস না বাবা দুই প্যাকেট দুধ।
-- ঠিক আছে।
# মনোজ, আশিস  তোরা একটু এদিকে আয়।
মনোজরা স্যারের টেবিলের সামনে এগিয়ে আসে।

একটা ছোট  কাপড়ের ব্যাগে অসংখ্য ছোট ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট। আর তাতে ভরা নানা স্বাদের
রকমারি লজেন্স, চকোলেট।
অমল স্যার ব্যাগটা মনোজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে
ভেতরে ছোট ছোট লজেন্সের প্যাকেট আছে। তুই আর আশিস ক্লাসের সবাইকে দিয়ে দে।
--- স্যার আপনার আজকে জন্মদিন।
মনোজের প্রশ্ন শুনে অমল বাবু মৃদু হেসে বলে -ওই আর কি! মনোজ বলে- স্যার আমারও আজ  জন্মদিন।
-- সেকিরে মনোজ, আজ তো আমারও জন্মদিন।
আশিস প্রায় লাফিয়ে ওঠে
-- বেশ! বেশ! 
স্যার, আমি  ক্লাসের সব বন্ধুদের জন্য আর আপনার জন্য কেক নিয়ে এসেছি, মা দিয়ে পাঠিয়েছে। দেবো সবাইকে।
--- দিবি তো! শোন  আশিস, মনোজ। ক্লাসের সবাই শোন - আজকে আর কিছু পড়াবো না। আজকে তোরা একে একে সামনে এসে যে যা পারিস কর
- গান, কবিতা, ছোট গল্প । 
সকলে দারুণ খুশি। ছোট একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
হয়ে যায়। তারপর আশিসের কেক আর স্যারের 
লজেন্সের প্যাকেট পেয়ে সকলের কি আনন্দ।
আজ মার  কথায় ছেলেবেলা র  সেই জন্মদিনের
স্মৃতি মনে পড়ে মনোজের।
মনে পড়ে, ও তখন ক্লাস সিক্সে। জন্মদিনে বাবা   একটা লাল টুকটুকে জামা কিনে এনে বলল
----  মন দেখতো জামাটা তোর হয় কিনা।
জামাটা দেখে মনোজ লাফিয়ে ওঠেছিল - কী সুন্দর!
 জামাটা অনেক দিন যত্ন করে রেখে দিয়েছিল মনোজ।
পড়াতে মনোজের ভালোই লাগে, তবু সেভাবে টিউশন করতে পারছে কোথায়! সবাইতো ছুটছে
স্কুল টিচার দের কাছে। পড়ানোর পর মনোজের মা বলল - বাবা মনে করে দুধ টা এনে দিস। আর এই নে
-- মনোজ দেখে মা ওর দিকে একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরেছে।
--- এ টাকা কোথায় পেলে মা?
-- শোন না, তোকে বলা হয়নি। কয়দিন আগে পাড়াতে ওই ছেলেটা এসেছিল, আরে কি যেন নাম---
-- কে এসেছিল, কি নাম?
--- আরে সেই যে পুরনো বই খাতা কাগজ নেয়।
-- তাই কি হয়েছে? মনোজ কৌতুহল বাড়তে থাকে।
-- ওকে তোর পুরনো বই খাতা বিক্রি করে এই টাকাটা পেয়েছি।
-- মনোজ চমকে ওঠে। -- করেছো কি! ও ছুটে গিয়ে
পুরনো বইয়ের তাক টা ভালো করে দেখতে থাকে।
--- একি! অমলবাবুর বইটা কোথায়? 
-- মার কাছে ফিরে আসে  মনোজ।

-- মা, ওখানে 'চাঁদের পাহাড়' বইটা ছিল। ওটাও বিক্রি করে দিয়েছ?
-- তা তো ঠিক জানি না, তুই একদিন বলছিলিস
- -- এই বই গুলো রেখে আর কি হবে, এসব পুরোনো 
পাঠ্যবই, এখন আর চলে না, বিক্রি করে দিলেই হয়।
--- তাই শুনে তুমি বিক্রি করে দিলে! মনোজ বেশ
জোরে রাগত স্বরে মাকে কথাগুলো বলে।
--- আসলে আমি ঠিক বুঝিনি।
-- তুমি জানোনা ওই পুরনো বইয়ের মধ্যে আমার  চাঁদের পাহাড় বইটা ছিল। ওই বইটা অমলবাবু আমাকে পুরষ্কার দিয়েছিল। মাধ্যমিকে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায়।
-- সে কিরে?
পাড়ায় পুরনো কাগজ খাতা বই নিতে যে ছেলেটা আসে তাকে মনোজ চেনে। পাড়ার অনেকেই ওকে পুরনো কাগজ বই বিক্রি করে। ছেলেটার নাম
ফিরোজ। একদিন কথায় কথায় শুনেছিল ও উর্দি বাজারে থাকে। কিন্তু এতদিন বাদে ও বইটা কি আর পাওয়া যাবে। তবু দেখা যাক। এই ভেবে মনোজ জামাটা গায়ে চাপিয়ে নেয়।
-- কিরে চললি কোথায়? মনোজ  মার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সাইকেলে
বেশ খানেক ঘোরাঘুরির পর উর্দি বাজারের শেষ মাথায় ফিরোজের বাড়ি খুঁজে পায়।
সব কথা শুনে ফিরোজ বলে যে সে  ওসব বই  পরেরদিনই পুরনো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে।
মনোজ আশেপাশে র  পুরনো বইয়ের দোকানে
বইটার খোঁজ করে। একটা বইয়ের দোকানে
বইটার নাম শুনে বলে --- হ্যাঁ চাঁদের পাহাড় তো,
আছে। দাঁড়ান, খুঁজে দিচ্ছি।
মনোজ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। দোকানদার এরপর খুঁজে পুরনো একটা চাঁদের পাহাড় বই মনোজের হাতে ধরিয়ে দেয়। মনোজ হতাশ হয়ে দেখে সেটা ওর পুরস্কার পাওয়া চাঁদের পাহাড়   বই নয়। মনোজের মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়।-- ওর অমলবাবুর  কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে বইটা হাতে তুলে দিয়ে স্যার বলেছিলেন -- তোর বাংলাটা ভালই, ভবিষ্যতে লেখালেখি নিয়ে থাকলে এগোতে পারবি। মনোজের মনে পড়ে চাঁদের পাহাড় বই টা ও এক রাতে শেষ করেছিল। কি কাহিনী!
অপূর্ব।
এরপর পথের পাঁচালী, আরণ্যক একে একে  বিভূতিভূষণের অনেক উপন্যাস, ছোট গল্প পড়েছে।
কিন্তু প্রথম পড়া সেই চাঁদের পাহাড় আজও ওর
কাছে ছেলেবেলার প্রথম অ্যাডভেঞ্চার।
মনোজ বাংলা নিয়েই  পড়েছে। এখন ও বাংলার ই টিউশন করে। সাহিত্য অন্ত প্রাণ। সারাদিনই পড়া আর লেখালেখি নিয়ে ই মনোজের কেটে যায়।
মন খারাপ করে মনোজ বাড়ি ফিরে আসে।  মন খারাপ করলে  মনোজ অমলবাবুর দেওয়া চাঁদের
পাহাড় বইটা বার করে আনত।বইটা ছুঁলেই ওর
অন্য রকম একটা অনুভূতি হত।মনে পড়ত অমলবাবুর কথা, স্কুলের দিনগুলোর কথা।বইটা না
পাওয়ায় অমল খুব হতাশ হয়ে পড়ে।

# # মা ছেলের সংসার। বিকেল থেকেই রান্নাঘর থেকে সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে।মা পায়েস রাঁধছে।
রাতে লুচি পায়েস।মনোজের খুব প্রিয়। জন্মদিনে
মা যত অসুবিধাই হোক ,এইটুকু করে মনোজকে
দেবেই।মনোজ অনেকবার না করেছে, কিন্তু মা বলেছে -- তোর বাবা থাকলে দেখতিস কত কি করত।
এবারে মনোজের মন একেবারেই ভালো নেই। বইটা   এত খুঁজেও পেল না।
আজ পড়ানো নেই।সন্ধেবেলায় বাড়িতেই ছিল। ঘরে
বসে একটু লেখালেখির চেষ্টা করছিল মনোজ।এমন
সময় দরজায়কড়া নাড়ার শব্দ। 
এ সময় আবার কে এল।আজ তো টিউশন নেই।
ভাবতে ভাবতে মনোজ গিয়ে দরজা খোলে।
-- দরজা খুলতেই অবাক!
-- চিনতে পারছিস?
মনোজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে আশিস না?
-- একেবারে ঠিক ধরেছিস। তা ভেতরে বসাবি না?
-- আয়, আয়।তারপর আজ এত বছরবাদে, কি মনে করে --?
রান্না ঘর থেকে মা জিজ্ঞেস করে -- কে এলরে মনোজ?
-- আমার স্কুলের এক বন্ধু, আশিস।
- তুই তো এখানে থাকিস না?
- না,  এখন দিল্লীতে। ওখান থেকে ফিরেছি দিন সাতেক হল। তা আজ একটা প্রয়োজনে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।তোদের বাড়িটা নজরে এল। ভাবলাম যাই, দেখি যদি তোর দেখা পাই।
বেশ করেছিস, বোস। বলে আশিস ঘর থেকে বেরোয়।
একটু পরেই মনোজের মা গরম গরম লুচি আর
পায়েস নিয়ে আসে।
-- নাও বাবা, একটু খেয়ে নাও।
আশিস প্রায় লাফিয়ে ওঠে -- গ্র্যান্ড!
বেশ পরম তৃপ্তি করে আশিস লুচি  পায়েস খায়।
দুজনে সেই ওদের স্কুল জীবনে ফিরে যায়। গল্প
গুজব করে আশিস বলে -- তাহলে আজ উঠিরে।
উঠতে গিয়েও ফের বসে পড়ে আশিস।কাঁধে ঝোলা ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে একটা প্যাকেট। মনোজের দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে
বলে - এটা রাখ?
মনোজ অবাক হয়ে বলে এটা কি?
-- কিছু না, দুটো গল্পের বই আছে।এটা তোর জন্মদিনের গিফট।
-- তুই কি করে জানলি আজ জন্মদিন?
-- সে কিরে মনোজ তুই ভুলে গেলি তোর আর আমার এক ই দিনে জন্মদিন, সেই স্কুলের দিনগুলো,অমল বাবু --- 
-- কিন্তু আমি তো তোকে ---
জন্মদিনে এত ভালো খাওয়ালি যে --
আসলে মনোজের পুরোনো কথা সব ই মনে ছিল, তবু আশিস কে একটু যাচাই করে নিল।
-- ঠিক আছে, আজ আসিরে।পারলে একদিন আসিস আমাদের বাড়িতে।এখন মাসখানেক থাকব।
-- দেখি।
-- দেখি না, টিউশন  এডজাস্ট করে একদিন  আয়, সারাদিন আড্ডা দেয়া যাবে।
আশিস বেরিয়ে যাবার পর গল্প পাগল মনোজ আর থাকতে পারে না। বইয়ের প্যাকেটটা খুলে ফেলে।
-- উপরের বইটা বনফুলের ছোটগল্প, নিচের বইটা পুরনো।-নাম চাঁদের পাহাড়। অমলবাবুর দেওয়া
সেই পুরস্কার। বই দেখে মনোজ লাফিয়ে উঠে।
বইটা ওল্টাতে ই একটা চিঠি। তাতে লেখা - প্রিয়
মনোজ ,আমি দিন সাতেক আগে দিল্লী থেকে ফিরেছি।দুদিন আগে আমাদের দোকানে ছিলাম।তখন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে,দোকান বন্ধ 
করার তোড়জোড় চলছে।পুরনো  কাগজ বই বিক্রি করে একটা  ছেলে এল অনেকগুলো পুরনো বই
বিক্রি করতে।বইগুলো বস্তা থেকে দোকানের মেঝেতে ঢালতেই ছড়িয়ে পড়ল।তারই মধ্যে হঠাৎ দেখি - চাঁদের পাহাড় বইটি।চাঁদের পাহাড়
আমার খুব প্রিয় বই।তাড়াতাড়ি তুলে পাতা ওল্টাতে 
নজরে পড়ল অমলবাবুর লেখা।তখনই মনে হল হয়তো বা ভুল করে অন্য বইয়ের সাথে চলে এসেছে।
না হলে এ বই তো মনোজের বিক্রি করার কথা নয়।
এই বইটা তোর স্কুল জীবনের স্মৃতি।আর তোর স্মৃতি মানে আমারও। সেই অমল বাবু, জন্মদিন, কবিতা, গল্প --- তাই জন্মদিনে নতুন বইয়ের সাথে এই বইটাও উপহার স্বরূপ দিলাম।
ভালো থাকিস। --- আশিস।
চিঠি টা পড়ে মনোজ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে
তারপর অস্ফুটে বলে আশিস তুই ও খুব ভালো থাকিস।বইয়ের প্রথম পাতাটা খুলে মেলে চোখের
সামনে।তাতে লেখা মাধ্যমিকে বাংলায় সর্বোচ্চ
নম্বর প্রাপককে - নিচে পাশে অমলবাবুর স্বাক্ষর।
অজান্তেই  মনোজ শক্ত করে বইটাকে ধরে রাখে।
ওর একমাত্র স্বীকৃতিকে ও যে আর হারাতে চায় না।


সিংহের খোঁজে
সুহেনা মন্ডল
চতুর্থ শ্রেণী, জি ডি গোয়েঙ্কা পাবলিক স্কুল, দক্ষিণেশ্বর

সিংহ আমার কোথায় গেল
চেঁচিয়ে উঠলো দুর্গা
লক্ষ্মীবাহন সাদা পেঁচার
কাঁটা দিল সারা গা
শিব ও খুব ভয় পেলো
দুর্গা তো আজ আগুন
মুখখানি যা করে রেখেছে
দেখে মনে হয় শকুন
দুর্গার আজকে তান্ডব শুরু
নৃত্যের তালে তালে
ধুক ধুক করে কাঁপছে সবাই
স্বর্গ মর্ত্য পাতালে
লক্ষ্মীবাহন পেঁচা তখন
উড়ে উড়ে মর্ত্য
দেখল সবই ভাঙ্গাচোরা
আর বড় বড় গর্ত
কি জানি সে সিংহ কোথা
কোথায় যে তার মনটি
দুর্গা বাহন হওয়া সত্ত্বেও
খামতি রাখছে না কোনোটি
লক্ষ্মী তখন বের করলো 
অন্নপূর্ণার জাদুয়ী হাঁড়ি
সেখানেতে দেখা গেল
সিংহ গেছে তার মাসির বাড়ি।



আশু দাদার বিপদ
অস্মিতা ঘোষ
দ্বিতীয় শ্রেণী, সেন্ট জেভিয়ার্স, পানিহাটি,আগরপাড়া

আশু দাদা, আশু দাদা জানতো টুকাই, বুবলুর পা মেরে ভেঙে দিয়েছে। ওকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। তুমি তাড়াতাড়ি একবার চল।আশু দাদা বলল-কেন? কি করে হল এসব?
লালু বলে উঠল, বুবলু বেচারা  দেখতে গেছিল টুকাই কি খাচ্ছে। দেখতে না পেয়ে সে টুকাই এর কাঁধে উঠে বসে। টুকাই ভয় পেয়ে কাঁধের ওপর দিল এক চাপর।তুমি তাড়াতাড়ি চল দাদা। 
আশু দাদা তার দলবল নিয়ে বুবলুকে দেখতে চলল।হাসপাতালে গিয়ে দেখে ছেলেটা অসহায় হয়ে পড়ে আছে। নড়াচড়া করতেই পারছে না। আশু দাদা খুব রেগে গেল। এর একটা বিহিত করা দরকার। সবাই মিলে একটা আলোচনা সভা ডাকল। অনেক ভেবে আশু দাদা একটা উপায় বের করল। বলল, টুকাই যখন রাতের বেলায় ঘুমায় তখন আমরা গিয়ে সব নোংরা ওর গায়ে দিয়ে দেব। আর তোমরা  ক'জন ওর গালটা চেটে দেবে। বাকিরা ওর খাবারগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে নোংরা করে দেবে। কিন্তু সাবধান ও যেন টের না পায়।
কথা মতন কাজ শুরু হল। তখন গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। আশু দাদা তার দলবল নিয়ে টুকাই  এর ঘরে হামলা করল। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হল। 
সকালে দেখা গেল টুকাই এর সারা গায়ে মুখে সাদা চাকা চাকা দাগ  আর পেটে ব্যথা ও বমি। মার বুঝতে বাকি রইল না এটা কার কাজ। আশু দাদারা পরেরদিন আসার পরিকল্পনা করেছিল আবার। মাও আরশোলা মারার ওষুধটা ঘরে দিয়ে রেখেছিল। যেই আশু দাদার বাহিনী ঘরে ঢুকল অমনি কিছু জনের ওষুধের গন্ধে  দম বন্ধ হবার অবস্থা হল। প্রসণের দায়ে তারা পালিয়ে বাঁচল। আশু দাদা এই দুষ্টু নিষ্ঠুর মানুষের দেশ ছেড়ে মনের দুঃখে চলে গেল। আর টুকাইও খাবার ফেলে ঘর নোংরা করত না কারণ টুকাইকে ওর মা বুঝিয়েছিল ওর মারের জন্যই বুবলু চিরকালের মতন খোঁড়া হয়ে গেছে।




জলের পোকা জলে যা 
অমিত মজুমদার 

কখনও কখনও আকাশটা বড্ড বেশী রহস্যময় বলে মনে হয় সুমনের। মুহূর্তে মুহূর্তে যেন বদলে যায় সে। এই এখনই যেমন। বর্ষাকাল একদম শেষের দিকে। রোদ উঠেছে। কিন্তু সকালের আলোতে খুব একটা জোর নেই। আবার আকাশের রং শরতের মতো নীলও নয়। মাঝে মাঝে নীল দেখা যাচ্ছে আবার কয়েকদিন টানা মেঘলা। দু'দিন আগেও মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে এখানে। আর বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটায় ঝরে পড়েছে আতঙ্ক। 

        বর্ষার শেষ লগ্নে আতঙ্কটা বেশ জোরালো ভাবে এসে গেলো। গ্রামের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে জলঙ্গী নদী৷ জল প্রতিদিনই একটু একটু বাড়ছিলো কিন্তু কয়েকদিন আগে বৃষ্টির পর হঠাৎই অনেকটা বেড়ে গেছে। এটাই একটা অশনি সংকেত। নদীর জল প্রতি বছর বাড়ে। এই জলের স্তর বেশী বেড়ে গেলেই নদী থেকে যে সমস্ত খাল চাষের জমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে তা ছাপিয়ে যায়। সমস্ত মাঠ তলিয়ে যায় জলের নীচে। এই অঞ্চলে জলঙ্গীর প্রভাব অপরিসীম। মুর্শিদাবাদের একটা থানার নাম জলঙ্গী৷ এই নদী সেই জলঙ্গী থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ দুশো কুড়ি কিমি পথ পেরিয়ে নদিয়ার নবদ্বীপে এসে গঙ্গায় মিশেছে। নদীর নামকরণ হয়েছে উৎসমুখের জায়গার নাম থেকে। যদিও এখন নদীর দৈর্ঘ একশো বাহাত্তর কিলোমিটার। উৎসস্থলের আটচল্লিশ কিলোমিটার পথ এখন চাষের জমি। বাংলার প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক মানচিত্র অঙ্কণকারী রেনেল সাহেবও নবদ্বীপ হয়ে জলঙ্গীতে প্রবেশ করেন। গোটা জলঙ্গী পারি দিয়ে পদ্মা হয়ে ঢাকায় যান৷ বলাই যায় প্রথম মানচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে এই নদীর ভূমিকা ভীষণ ভাবে উল্লেখযোগ্য। 

        এই দীর্ঘ নদীর গতিপথের মধ্য নদিয়া জেলার একটা গ্রামে সুমনদের বাড়ি। গ্রামের নাম নীলকন্ঠপুর। সুমনদের গ্রামের শেষ প্রান্তে। ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা থেকে খানিকটা নীচ থেকে চাষের জমি শুরু। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় ততদূর পর্যন্ত জমি। এই সমস্ত জমি জলের নীচে চলে যাবে জলঙ্গীর আর সামান্য বাড়লেই। জল যদি আরও কিছুটা বাড়ে তবে রাস্তার ওপরে চলে আসবে৷ তারপরেই ভেসে যাবে গোটা গ্রাম। মাঠে জল আসাটা এই গ্রামে নতুন না। প্রায় প্রতি বছরই আসে। তাতে ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা হয় না মানুষের। এই সময়টায় পাট কাটা হয়ে যায়। সাধারণত মাঠে কোনো ফসল থাকে না। এইটুকু বন্যার সঙ্গে গ্রামের মানুষ দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু জল যেভাবে বাড়ছে তাতে রাস্তা ছাপিয়ে জল উঠে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ে যাচ্ছে না কিছুতেই। এই বছর ভালো বৃষ্টি হয়েছে। আর একটা বড় নিম্নচাপ সৃষ্টি হলেই তিন চার দিন বৃষ্টি হবে। তখন বিভিন্ন বাঁধের জল একসাথে ছাড়া হবে। সেই জলের স্রোত সহ্য করতে পারবে না জলঙ্গী। দুই পাড় ছাপিয়ে উঠবে জল। 

        সুমন খুব গভীর ভাবে আকাশ মেঘ আর জমি দেখে চলেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে নির্জন এক বন্দরে গভীর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সে দেখার চেষ্টা করছে কোনো জাহাজের মাস্তুল দেখা যায় কিনা। সুমন এমনিতে খুব সাহসী কিন্তু বন্যা যদি চলেই আসে তবে তার সঙ্গে লড়াই দেবার মতো অবস্থায় এখনও আসেনি। গ্রামে বেশ কিছু পাকা বাড়ি আছে। তাদের ছাদ আছে। হঠাৎ জল চলে আসলে তারা ছাদে উঠে যেতে পারবে। কিন্তু ওদের বাড়িটা কাঁচা। মলিবাঁশের বেড়ার ওপরে টিনের চাল। বাবার কাছে শুনেছে কুড়ি বছর আগে একটা বড় বন্যা এসেছিলো। সেবার প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিলো। টানা দশদিন অবিরাম বৃষ্টির পর রাস্তা ছাপিয়ে গ্রামের মধ্যে জল ঢুকে পড়ে৷ তখন জন্ম হয়নি সুমনের। ওদের বাড়িতে গলা জল। বাবা মা দাদু ঠাকুমা সবাই আশ্রয় নিয়েছিলো ওদের হাইস্কুলের দোতলায়। স্কুলের একতলাতেও কোমর জল। শুধু ওর বাবা মাই নয় গ্রামের প্রচুর মানুষ সেই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলো। কেউ কেউ আবার বাড়ির পোষা ছাগল ভেড়া নিয়ে উঠেছিলো স্কুলে। কিন্তু সেখানে জায়গা সীমিত। স্কুলটা এখনকার মতো এত বড়ও ছিলো না তখন। বহু মানুষের পোষা ছাগল ভেড়া গরু বাছুর চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। সেবার বন্যা এসেছিলো আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজোর ঠিক পঁচিশ দিন আগে। সেই ভয়ংকর বন্যা এই গ্রামের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে গেছে। বেশ কয়েকবছর লেগে গেছিলো সেই ধাক্কা সামলে উঠতে। এগুলো সব গল্প শোনা। দাদু ঠাকুমা এখন বেঁচে নেই। মা বাবা ছাড়াও গ্রামের অনেকের কাছে সেই দিনগুলোর গল্প শুনেছে ওরা। এবার বুঝি নিজের চোখে দেখার পালা এগিয়ে আসছে। ছোটোবেলায় শ্লেট মোছার পর একটা ছড়া বলতো ওরা সবাই। ‘জলের পোকা জলে যা আমার শ্লেট শুকিয়ে যা’। শ্লেট শুকিয়ে যেতো কিছুক্ষণের মধ্যে। সেটা মন্ত্রের গুণে না এখন বোঝে। কিন্তু কিছু কিছু এমন মুহূর্ত আসে যখন মন্ত্রকেও খুব বিশ্বাসী বলে মনে হয়। যেমন মুষলধারে বৃষ্টির সময়, ‘নেবুপাতায় করমচা যা বৃষ্টি ঝরে যা’ আবার ভূতের ভয় পেলে ‘ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে ভূতে করবে কি’। এমন কত সব ছড়া। সেই ছড়াটা যদি শ্লেটের মতো গোটা গ্রাম থেকে বন্যার জল শুকিয়ে দিতে পারতো তাহলে সবাই মিলে বলতো, জলের পোকা জলে যা আমার গ্রাম শুকিয়ে যা৷ 

        সাইকেলের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালো সুমন। গ্রামের বেশীরভাগ রাস্তা পাকা হলেও এই রাস্তাটা পাকা হয়নি। ইঁট ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এই রাস্তায় এত বেশী ট্রাক্টর, গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি যাতায়াত করে যে রাস্তার দফারফা হয়ে গেছে। সাইকেলে করে অনির্বাণ আসছে। ওদের বাড়ি জলঙ্গীর ধারে হাটগোবিন্দপুরে। আগে সুমনদের স্কুলে পড়তো। ভালো ফুটবল খেলে। স্কুল দলের হয়ে নিয়মিত ফরওয়ার্ড খেলতো। এখন পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। অনির্বাণকে দূর থেকে দেখেই সুমন জিজ্ঞাসা করলো, “অনির্বাণদা জলের খবর কী গো ?”

        অনির্বাণ সাইকেল থামালো না। মনে হলো তাড়া আছে। বলল,“খবর ভালো না রে ভাই। আজও জল বেড়েছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে তোদের এখানে চলে আসবে। সাবধানে থাকিস। পারলে বাড়ির জিনিসপত্র একটা উঁচু মাচা করে তার ওপর তুলে দে। পরে হয়তো আর সময় পাবি না।” 

        কথাটা বলতে বলতে অনির্বাণ চলে গেলো। ও টাউনে যাবে। এখান থেকে ছয় কিলোমিটার। যেভাবে বললো তাতে এমনও হতে পারে যে ফেরার সময় নৌকোতে ফিরতে হচ্ছে। জল আর আকাশের ওপর এই মুহূর্তে কোনো ভরসা করা যাচ্ছে না। বাড়িতে অতিথি এলে বলা হয় আসাটা নিজের ইচ্ছায় কিন্তু যাওয়াটা এই বাড়ির ইচ্ছায়। সেই কথাটা এখন দিব্যি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়। যাওয়াটা নিজের ইচ্ছায় কিন্তু আসাটা জলের ইচ্ছায়। 

২ 
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে তানিয়ার। যেকোনো মুহূর্তে বন্যার জল ঢুকে পড়তে পারে গ্রামে এই নিয়ে বেশ আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবও রটছে প্রচুর। যে যার মতো খবর ছড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে অমুক বাঁধের জল ছাড়া হচ্ছে নয়তো তমুক বাঁধ ভেঙে পড়েছে৷ হু হু করে জল ঢুকছে। যে কোনো মুহূর্তে জল গ্রামে ঢুকে যাবে৷ গ্রামের প্রতিটা মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা। 
        তানিয়ার মন অবশ্য এই কারণে খারাপ নয়। বন্যা নিয়ে সে যথেষ্ট উৎসাহিত। বন্যা এসে গেলে তার কি পরিণতি হতে পারে সেটা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তার মন খারাপের কারণ ঋষিতা। ওর কাকাতো বোন। কলকাতায় থাকে। গত বছরও মাঠে জল এসেছিলো। সেই জলে তানিয়ারা কয়েকদিন নৌকো নিয়ে খুব ঘুরেছিলো। সেই সব মজার গল্প শুনে ঋষিতা বলেছিলো পরের বছর এমন জল এলেই সে গ্রামের বাড়িতে আসবে। সবার সঙ্গে নৌকোতে ঘুরবে। ঋষিতার জন্ম এখানেই। জন্মের পর চার বছর বয়স পর্যন্ত সে এই বাড়িতেই ছিলো। তানিয়ার কাকা কর্মসূত্রে কলকাতা থাকতেন। দুই সপ্তাহে একদিন বাড়িতে আসতেন। পরের দিকে তাও পারতেন। এই সমস্যার জন্য একদিন বোন আর কাকিমাকে নিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। এখন তাঁরা ওখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। তানিয়ার থেকে এক বছরের ছোটো বোন ঋষিতা। কলকাতার ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ে। এখন বছরে সাধারণত দুইবার বাড়ি ফেরে। গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটিতে। তাও দুর্গাপুজোতে আসে না। ওরা আসে লক্ষীপুজোতে। গ্রামে প্রতি ঘরে ঘরে লক্ষীপুজো হলেও এই পুজো উপলক্ষে হাইস্কুল মাঠে বিরাট মেলা বসে। প্রচুর দোকানপাট বসে। নাগরদোলা রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে খেলনা, চুরির দোকান, আইসক্রিম, ফুচকা কিছুই বাদ থাকে না। বড় মঞ্চ হয়। কলকাতা থেকে নামি শিল্পীদের আনা হয়। আশেপাশের অনেক গ্রাম থেকে লোকজন আসে। অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান হয়৷ এই গ্রামের মানুষের আনন্দ বলতে এটুকুই। সারা বছরের প্রতীক্ষা থাকে এই মেলা নিয়ে। অনেক আগে যাত্রা হতো দুর্গাপুজোর সময়। কিন্তু সেসব অনেক বছর বন্ধ হয়ে গেছে৷ গ্রামের যারা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন তাঁরা সবাই এই পুজোর সময় বাড়ি ফেরেন। ঋষতারাও বাড়ি ফেরে। পাঁচ দিনের এই মেলার আনন্দ সবাই লুটেপুটে উপভোগ করে। 

        গতকাল তানিয়ার কাকা ফোন করে জানিয়েছেন এই মুহূর্তে বাড়ি আসা সম্ভব নয়। করোনার প্রকোপ এখনো কমেনি। বাস চলাচল শুরু হলেও ট্রেন চালু হয়নি। তার ওপর বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষ বন্যা থেকে সরে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে চলে যায় সেখানে নিরাপদ জায়গা থেকে বন্যার দিকে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং কাকা বলেছে তানিয়াদেরই সবাইকে বন্যার সময় কলকাতায় তাদের ওখানে গিয়ে থাকতে। কিন্তু তারা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। 

        তানিয়ার খুব রাগ হচ্ছে বোনকে বন্যা দেখাতে পারবে না বলে। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো বন্ধুদের সঙ্গে বোনকে নিয়ে নৌকোয় ঘুরবে। শুকনো ডাঙায় সহজে যে সব জায়গায় পৌঁছানো যায় না বন্যার জল এলে সেইসব জায়গায় সহজে পৌঁছানো যায়। জলে গ্রাম ঢেকে গেলে সব বাড়িই এক বলে মনে হয়। সেখানে দূর থেকে সব বাড়ি চেনার মধ্যে একটা এডভেঞ্চারের মজা আছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ঋষিতা আসছে না। অতএব সেই মজাও হচ্ছে না। গতকাল থেকে ভীষণ মন খারাপ তানিয়ার। ভালো করে খায়ওনি। কারো সঙ্গে ভালো করে কথাও বলছে না। 

        এমনিতেই মেজাজ খারাপ ছিলো তার ওপরে এক নাগাড়ে সাইকেলের বেল শুনে আরও বিরক্ত লাগলো তানিয়ার। গ্রামের বাড়িতে সাধারণত প্রাচীর থাকে না। বাড়ির উঠোন ঘিরে ঘরগুলো এমনভাবে তৈরী হয় যাতে রাস্তার আড়াল হয়ে যায় উঠোন। বেল দেবার স্টাইল দেখেই তানিয়া বুঝলো অদিতি এসেছে। এক নাগাড়ে বেল দেয় মেয়েটা। এসেছে তো ভেতরে এলেই হয় বাইরে থেকে বেল দেবার অর্থ কি ? তানিয়া বারান্দা থেকে উঠে পড়লো। বাইরে এসে অদিতিকে বললো, “এত বেল দিচ্ছিস কেনো ? ভেতরে চলে আসতে কষ্ট হচ্ছিলো ?”
        “আমি ভেতরে গেলেই দেরি হয়ে যাবে তাই তোকেই বাইরে নিয়ে এলাম। খবর কিছু শুনেছিস ?” 
        “কিসের খবর ?” 
        “জলের।” 
        “হ্যাঁ শুনছিলাম জল আসছে৷ মাঠে জল এলে গতবারের মতো এবারেও আমরা নৌকো নিয়ে বেড়াতে যাবো।” 
        “এবার আর নৌকো নিয়ে ঘুরতে হবে না৷ নৌকো নিয়ে পালাতে হবে৷ বড় বন্যা আসছে এবার। আমাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে যাবে।”
        “ভালো হবে৷ আমরা সবাই মিলে হাইস্কুলে গিয়ে থাকবো।”
        “তানিয়া ইয়ার্কি নয়। খুব চিন্তার বিষয় এটা।” 
        “এমা ইয়ার্কি কোথায় করলাম ? বাড়ি ডুবে গেলে আমদের তো স্কুলের দোতলায় গিয়েই থাকতে হবে। এখানে তো আর তেমন কোনো জায়গা নেই আশ্রয়ের।” 
        “এমন বলতে নেই। প্রে কর যাতে জল না আসে। জল এলে অন্তত  এক মাসের ওপর ওই স্কুলে লোক থাকবে। নীচু জায়গাগুলো থেকে জল নামতে অনেক সময় লাগে। স্কুলে এত লোক থাকলে এইবছর দুর্গাপুজো হবে না। দুর্গাপুজো তো দূরের কথা লক্ষীপুজোও হবে না। এটা ভেবেছিস ?”
        তানিয়া হাঁ করে অদিতির দিকে তাকালো। বন্যা এলোই না আর সে এতদূর চিন্তা ভাবনা করে ফেলেছে। 

৩ 
গ্রামে বেশ কয়েকটা দুর্গাপুজো হলেও স্কুলপাড়াতে একটাই পুজো হয়৷ সেটাও আবার স্কুলের ভেতরে। এটা কোনো ক্লাবের পুজো নয়। এটা স্কুলপাড়া বারোয়ারি। বহু পুরোনো পুজো। তখন স্কুলটা খুব ছোটো ছিলো। স্কুলের পাশে পুজো হতো৷ স্কুল চত্ত্বরের চারপাশে কোনো প্রাচীর ছিলো না৷ সময়ের সঙ্গে স্কুলের আয়তন বেড়েছে। চারবাশে প্রাচীর হয়েছে। কিন্তু দুর্গাপ্রতিমার বেদী পড়ে গেছে স্কুলের ভেতরেই। তাই পুজোটা আর ওই জায়গা থেকে পরিবর্তন করা হয়নি। স্কুল কতৃপক্ষকে গ্রামের লোকজন অনুরোধ করায় স্কুলও মেনে নিয়েছে বিষয়টা। পুজোটা খুব বেশী বড় হয় না। ছোটোখাটো প্যাণ্ডেল করা হয়। বাজেট কম থাকে কারণ এক সপ্তাহর মধ্যেই লক্ষীপুজোর মেলা৷ গ্রামের মানুষের উৎসবের বাজেট হিসেবে লক্ষীপুজোর খরচ ধরা থাকে। কিন্তু লক্ষীপুজো যত বড়ই হোক না কেনো দুর্গাপুজোর গুরুত্ব চিরকালই আলাদা। গ্রামে এই পুজোকে বড় পুজো বলা হয়৷ 
        এই বছর দুর্গাপুজো হবে কিনা সেই বিষয়ে ভাবনা শুরু হয়ে গেছে৷ এই পুজোর উদ্যোগ নেন গ্রামের বড়রা। তাঁদের একটা প্রাথমিক মিটিং হয়েছে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি না পৌঁছাতে পারলে এই বছর পাকা সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে না। খবরে দেখাচ্ছে অনেক জায়গায় বন্যা হয়েছে। মানুষের খুব দুর্ভোগ চলছে। এখানেও যে এমনটা হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কুড়ি বছর আগে তো অজয় নদীর জলও এত দূর চলে এসেছিলো। সেই অভিজ্ঞতা বড়দের প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে যায়৷ অন্যান্য বছর আবহাওয়া এমনটা বিরূপ থাকে না। এবছর মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। এটাই খুব খারাপ লক্ষ্মণ। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে একটা গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে যাবে৷ 

        স্কুলমাঠে বিকেলের আড্ডা খুব ভালো জমছে না। খেলা একপ্রকার বন্ধ৷ যারা মাঠে আসে তারা এদিক সেদিক বসে আলোচনা করে। সুমনদের আড্ডায় আজ সুদীপ আসেনি। ওদের বাড়ি মণ্ডল পাড়ায়৷ মাঠের মধ্যে খানিকটা গেলে এই পাড়া। এই পাড়াটা যেহেতু মাঠের মধ্যে তাই বেশ নীচু। জল এলেই এই পাড়াগুলো আগে তলিয়ে যেতো। প্রতিটা বাড়িতেই নৌকো আছে এই পাড়াতে। জল আসলে অনেকে নৌকোতে থাকতো। আর অনেকেই স্কুল বাড়িতে আশ্রয় নিতে চলে আসতো। বেশ কয়েক বছর মণ্ডল পাড়ার রাস্তাটা উঁচু হয়েছে। বেশীরভাগ বাড়িও মাটি ফেলে উঁচু করে নিয়েছেন বাসিন্দারা। তবে কিছু কিছু বাড়ি এখনো নীচুই আছে। সুদীপদের বাড়ি তার মধ্যে একটা। এই পাড়াটা অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে। কারো নিজের জমি তাকলেও অনেকের নিজের জমি নেই। সুদীপদের অবশ্য কিছু জমি আছে। কিন্তু বাড়ির অবস্থা ভালো না। সুদীপ ছোটো থেকেই একটু আধটু জল দেখে অভ্যস্ত। ওদের বাড়ির ওখানে প্রতিবছর জল আসে। উঠোনে হাঁটু জল বা ঘরের মধ্যে সামান্য জল ঢুকলেও বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে হয় না তাদের। এই সময় তারা নৌকোতে থাকে। বন্যার জল এলে প্রচুর মাছ আসে। যে সমস্ত পুকুরে মাছ চাষ হয় জল এলেই সেই মাছগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। কোন পুকুরের মাছ যে কোথায় চলে যায় তার হিসেব রাখে না কেউ। ভীষণ আনন্দ নিয়ে মাছ ধরে সবাই। তখন দুই বেলা মাছ দিয়ে ভাত খায় ওরা। সারাবছর ভাত জুটলেও এইসব পরিবারে মাছ সাধারণত নিয়মিত জোটে না। কিন্তু বন্যা এলে চিত্রটা পুরো বদলে যায়। তখন ভাতে টান পড়িলেও মাছের অভাব হয় না। কিন্তু ঘরে চাল কমে গেলে সেই মাছ বড় বিস্বাদ লাগে। 
        “সুদীপ আজ এলো না কেনো রে ?” সুমন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়। 
        “দু’দিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। মনে হয় পাটের কাজ করছে। ওদের পাট কাটা হয়ে গেলেও জাগ দেয়া হয়নি সব পাটে।” রণদেব উত্তর দেয়। 
        পাট কাটার অভিজ্ঞতা ওদের সবার আছে। ক্লাস নাইনে পড়লেও নিজেদের পাট কাটার সময় বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে পাট কাটতে হয় সবাইকেই৷ এতে একটা মুনিশের খরচ বেঁচে যায়। প্রতিদিন একটা করে মুনিশের খরচ বাঁচলে সাতদিনে বেঁচে যাওয়া টাকার পরিমাণটা কম না। সুমন বললো, “এবারেও জল এলে সুদীপদের ঘরে আগে জল আসবে।” 
        “সে তো আসবেই। জল যে পথে আসে সেই পথে প্রথম বাড়ি ওদের। তবে ওদের অভ্যেস আছে। প্রতি বছরের মতো অল্প জল এলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বেশী জল এলে ওদের সঙ্গে আমাদেরও চিন্তা।” দীপ বললো। 

        “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এবছর জল আসবে না।” রণদেব বললো। 
        “কেনো মনে হচ্ছে বল তো ?” 
        “ওই দেখ আকাশ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বর্ষার আকাশে ক্রমেই ফুটে উঠছে বর্ষার নীল ছাপ। সাদা তুলোর মতো মেঘও আকাশে দেখা যাচ্ছে।”
        সবাই আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে নীল রঙের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে সাদা সাদা মেঘ। কয়েক দিন হলো শরৎকাল এসে গেছে। মাঠের ধার দিয়ে কাশফুলও ফুটতে শুরু করেছে। এই সময় বন্যা আসা একেবারেই বেমানান। সবার মুখেই খুশির ঝিলিক খেলে গেলো। এবার জল আস্তে আস্তে কমে যাবে নদীতে। 
        ভাদ্রমাসের অর্ধেক দিন পার হতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। একটা গভীর নিম্নচাপ। চারদিন টানা বৃষ্টি হবার পরই মাঠে হু হু জল ঢুকতে শুরু করলো। 

৪ 
জল এখন খুব ধীরে ধীরে বাড়ছে। আপাতত রাস্তা থেকে এক হাত নীচে এসে থম মেরে আছে। মণ্ডলপাড়ার কয়েকটা বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ির মধ্যে জল ওঠেনি। যে বাড়িগুলোতে জল উঠেছে সেই বাড়ির লোকজন কেউ বাড়ি ছাড়েনি। নৌকো আগে থেকেই সব বাড়িতে ছিলো। অনেকে বাঁশের উঁচু মাচা তৈরী করে নিয়েছিলো৷ ভেসে যাওয়ার মতো খুব দামী জিনিসপত্র কারো বাড়িতেই নেই। ঘরের মধ্যে সব বাড়িতেই উঁচু করে মাচা পাতা আছে। জিনিসপত্র যা ছিলো তা ওর ওপরে তুলে দেয়া হয়েছে। জল আর না বাড়লে সমস্যা নেই কিন্তু আরও বেড়ে গেল স্কুলে আশ্রয় ছাড়া উপায় থাকবে না আর। কোভিড পরিস্থিতিতে স্কুলে ক্লাস অবশ্য বন্ধ। মাসে একবার মিড ডে মিলের চাল ডাল আলু দেয়া হয়। এছাড়াও অন্যান্য কোনো কাজ থাকলে স্কুল খোলে। 

        বৃষ্টি মাঝে মাঝে হচ্ছে তবে বড় ধরণের কোনো নিম্নচাপ আর হয়নি। জল আসার আগে মানুষের মনে যে আতংকটা কাজ করছিলো সেটা এখন আর নেই। করোনার দাপট এখনও কমেনি তবে গ্রামে এই মুহূর্তে  কারো পজিটিভ হবার খবরও নেই। এটা একটা বড় ভালো খবর। জলের সঙ্গে সবাই বেশ মানিয়ে নিয়েছে। সুমনরা মাঝে মাঝেই বিকেলের দিকে নৌকো নিয়ে বেরোচ্ছে। সুদীপও যোগ দিচ্ছে ওদের সঙ্গে। আলোচনা হচ্ছে কে কি মাছ পেয়েছে। বন্যা মানে একটা মাছ ধরার মরশুমও। যে যার মতো জাল কিংবা বরশি দিয়ে এই সময় মাছ ধরে। অনেকে তো দূর থেকেও চলে আসে মাছ ধরতে। 

        ওরা চারজন নৌকো নিয়ে বেড়িয়েছে। সুমন, দীপ,রণদেব আর অপূর্ব। আজ আকাশটা বেশ নীল। যেসব জায়গা দিয়ে ঘুরছে সে সব জায়গায় জল বেশী না। বড় জোর চার থেকে পাঁচ ফুট। এগুলো সব চাষের জমি। কোন জমি কাদের সেটা বোঝার খুব একটা উপায় নেই। যতদূর দেখা যায় শুধু জল আর জল। বাইরের কেউ এসে দেখলে বিশ্বাসই করবে না যে এটা বন্যার জল। জল সরে গেলেই চাষের জমি বেরিয়ে আসবে। তবে অনেক জায়গায় জল এত স্বচ্ছ যে নীচের মাটি, ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়গুলো পরিস্কার দেখা যায়। 
        স্কুলে ক্লাস না হলেও ওদের বাড়ির কাজ দেয়া হয়েছে। এক মাস সময় সেগুলো খাতায় লিখে জমা দিতে হবে। কিন্তু সেই নিয়ে আপাতত তাদের কোনো চিন্তা নেই। তারা চিন্তা করছে দুর্গাপুজো হবে কি হবে কিনা সেই ব্যাপারে। 
        “পুজোর শেষ খবর কি জানা গেলো ?” অপূর্ব জিজ্ঞাসা করলো। 
        “এখনও পর্যন্ত যা খবর তাতে পুজো না হওয়ার চান্স বেশী।”
        “কে বললো তোকে ?” 
        “গতকাল বাবা শুনে এসেছে। সবাই কানাঘুষো করছে।” 
        “জল তো বাড়ছে না এখন আর। দেখিস আর সাত দিনের মধ্যে কনা শুরু হবে৷ তখন বড়রা সিদ্ধান্ত পাল্টাবে।” সুমন বললো। 
        “পুজোর সাত দিন আগে সিদ্ধান্ত পাল্টালে তো হবে না। এই পুজোর প্রস্তুতি অনেক আগে থেকে নিতে হয়। প্রতিমার অর্ডার দিতে হয়৷ এতো সরস্বতী পুজো নয় যে বাজারে গেলাম আর একটা প্রতিমা নিয়ে চলে এলাম৷” দীপ বলে উঠলো। 
        “প্রতিমার বায়না অনেক আগেই করা আছে শুনেছি। তাই সাত দিন সময় পেলেও হয়ে যাবে৷” 
        “মাঝখানে কোনো সাড়া শব্দ না দিলে সাত দিনে তারা মূর্তি করে দিতে পারবে তো ? এমনিতেই গত বছর ধরে তাদের মন্দা যাচ্ছে।” 
        “প্রার্থনা কর যাতে জল আর না বাড়ে। পুজোর বেশ কয়েকদিন আগেই যদি জল কমতে শুরু করে তাহলে পুজো হবে।” 
        নৌকোর প্রতিটা ছেলেই জানে পুজো হলেও বাবা মা তাদের নতুন জামা প্যান্ট কিনে দিতে পারবে না। গত বছরও পারেনি। করোনা পরিস্থিতি আসার পর থেকে গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে অনেকটাই। যারা দিন হিসেবে কাজ করতেন তাদের অনেকের কাজ নেই। ছেলেগুলো পরিস্থিতি বুঝতে শিখে গেছে এখন তাই বাবা মায়ের কাছে নতুন জামা কাপড়ের বায়না করে না আর। তবু দুর্গাপুজোটা তাদের আনন্দ। 
        হঠাৎই প্রসঙ্গ বদলে দীপ বললো, “আচ্ছা হাট গোবিন্দপুর যাবি ? নদীতে নাকি দারুণ মাছ উঠছে। বড় বড় সব রুই। ওখানে আমাদের যে বন্ধুরা আছে তারা ফোনে বলেছে।” 
        “গেলেই হয়। চল না। কাল আমার হবে না। পরশু দিন চল। কিন্তু যাবো কিভাবে ? গ্রামের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটা ওইদিকে গেছে সেটা কয়েক জায়গা ডুবে গেছে। যেতে হলে মাঠের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে নৌকোতে যেতে হবে নয়তো সেই ঘুরে ঘুরে পাকা রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যেতে হবে।” 
        “আমরা সাইকেলেই যাবো। পরশু সকালের দিকে যাবো। স্কুল মাঠে সকাল নটার দিকে সবাই দেখা করবো ঠিক আছে ?” 
        হাটগোবিন্দপুর কারো যাওয়া হলো না। পরেরদিন দুপুরের মধ্যে খবর হয়ে গেলো অল্পবয়সী একটা ছেলে বাইরে থেকে জল দেখতে ওখানে এসেছিলো। মাঝনদীতে নৌকো থেকে পড়ে জলে তলিয়ে গেছে। 

৫ 
খবরটা যেভাবে ছড়িয়েছিলো তা পুরোপুরি সঠিক নয়। ঘটনাটা মোটেও মাঝনদীতে ঘটেনি। এমনকি নদীতেই ঘটেনি। ঘটেছে নদীর থেকে বেরিয়ে আসা খালের মধ্যের ঘটনা। অবশ্য একেবারে নদীর কাছেই। ছেলেটার বাড়ি এখানে নয়। আট কিলোমিটার দূরে টাউনে ওদের বাড়ি। এখানে এক বন্ধুর কাছে জলের খবর শুনে কয়েকজন দল বেঁধে জল দেখতে এসেছিলো। সবাই এই বছর বারো ক্লাস পাশ করেছে। মাঠের মধ্যে নৌকোতে করে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পর খাল দিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছিলো। খাল যেখানে নদীতে মিশেছে সেখানে বেশ স্রোত ছিলো। এত জল দেখার অভ্যেস ছেলেটার নেই। নদী দেখেই নৌকার মধ্যে সবাই একটু অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে ওঠে। কিছুটা ধাক্কাধাক্কিও লেগে যায়। টাল সামলাতে না পেরে হঠাৎই নৌকো থেকে একজন জলে পড়ে গেছে। তবে তলিয়ে যায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। পেটে জল ঢুকেছিলো। সেই জল বের করার পর সে কিছুটা সুস্থ। চোখ মেলেছে কিন্তু দুই চোখ জুড়ে আতঙ্ক। রাস্তায় হঠাৎ দ্রুত গতিতে আসা ট্রাকের সামনে থেকে শেষ মুহূর্তে বেঁচে ফিরলে হৃদপিণ্ড যে গতিতে ধকধক করে এখনও সেই গতিতে ধকধক করছে৷ পালস বেড়ে গেছে। সে যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না যে বেঁচে আছে। তবে এটা ঠিক যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে সে। আর এই ফিরে আসার জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলেকে। তারা সব এইট নাইনে পড়ে। নদীর ধারে যাদের বাড়ি তারা জলকে ভয় করে না। তারা সাঁতারেও পটু হয়। নদী এপার ওপার করেই তারা সাঁতার শেখে। সেই কয়েকজন ছেলে জমিয়ে মাছ ধরছিলো খালের ধারে। তাদের চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটে ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে জাল ফেলে নদীতে ঝাঁপ দেয়৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটাকে তুলে আনতে পারে। আর এইটুকু সময়ের মধ্যেই রটে গেলো জলঙ্গীতে তার তলিয়ে যাবার খবর। সোসাল মিডিয়াতে খবর যেনো বাতাসের থেকেও বেগে ছুটে চলে। এখানেও তাই হলো। 

        তলিয়ে যাবার খবর যত সহজে ছড়িয়েছিলো উদ্ধার হবার খবর তত সহজে ছড়ালো না। সেটা ছড়াতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো৷ উদ্ধার না হলে ভয়াবহ বিপদ হতো। পুলিশ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম চলে আসতো। শুরু হতো জিজ্ঞাসাবাদ। অনেক কিছুই হতো শুধু ছেলেটার প্রাণ ফিরতো না আর৷ এসব কিছু যে হয়নি তারজন্য ওই ছেলেগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। এরাও নীলকণ্ঠপুর হাইস্কুলের ছাত্র। পড়াশোনায় একজনও ভালো না। কিন্তু পড়াশোনার বাইরে অনেক কাজেই ওস্তাদ। এরা এভাবেই বড় হয়েছে। দরিদ্রতা ওদের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছে শুধু পড়াশোনায় মতি ফেরাতে পারেনি। শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকলে আজ জলে ঝাঁপ দিয়ে একজনের প্রাণ বাঁচাতে পারতো না ওরা। 

        এমনই একজনের নাম গোপীনাথ। সেও নাইনে পড়ে। প্রথম জলে ঝাঁপ সেই দিয়েছিলো। তারপর একে একে জলে নেমে যায় আরও তিন চার জন। উদ্ধার মুলত গোপীনাথই করেছে। বাকীরা সঙ্গে ছিলো। ছেলেটাকে টেনে ডাঙায় তুলতে সাহায্য করেছে।  নৌকোতে যারা যারা ছিলো ভয়ে আঁৎকে উঠে তারাও যে সেই মুহূর্তে জলে পড়ে যায়নি সেটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। মজার ব্যাপার হচ্ছে উদ্ধারকার্যের সময়ও কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও তুলতে ব্যস্ত ছিলো। 

        সেই গোপীনাথ এখন হিরো। তাকে সামনে রেখে ফটোশেসন চললো বেশ কিছুক্ষণ। তার ছবিও পোস্ট করা হতে লাগলো। বিষয়টা বেশ ভালোরকম উপভোগ করতে লাগলো সে। একজনের জীবন বাঁচাতে পেরেছে সে। এর থেকে আনন্দের খবর আর কি হতে পারে৷ ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেয়াহয়েছে হাসপাতালে। তার বন্ধুরা যারা এসেছিলো তারা ছেলেটার বাড়িতে খবর দিয়েছে। 

        গ্রামের হিরো হয়ে উঠলো গোপীনাথ। বাকি দিনটা শুধু অভিনন্দন নিতে নিতেই কেটে গেলো। ঠিক সন্ধ্যের আগে তাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো পুলিশ। গোপীনাথ আর তার বাবাকে গাড়িতে বসিয়ে তুলে নিয়ে গেলো। 

৬ 
“এরপর গোপীনাথের কি হলো ?” তানিয়া ফোন করে জানতে চাইলো অদিতির কাছে৷ ওদের কারো নিজের ফোন নেই বাড়ির ফোনে থেকেই কথা বলে প্রয়োজন হলে। আজও ফোন করেছে রাতে খাবার পর। ফোন বলতে ছোটো বোতাম টেপা ফোন। এনড্রয়েড ফোন না। 
        “গোপীনাথ তো এখন হিরো। খবর পেয়ে আমাদের বিডিও সাহেব পুলিশ দিয়ে ওকে আর ওর বাবাকে তুলে নিয়ে গেছিলো। আবার রাতের দিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েও গেছে। খবরের কাগজে ওর কথা বেরোবে৷ মনে হচ্ছে সাহসীকতার জন্য ও কোনো একটা পুরস্কার পাবে।” 
        “বাহ! দারুণ ব্যাপার তো। আমাদের এক বন্ধু এমন একটা কাজ করেছে সেটা ভাবতেই ভালো লাগছে।” 
        “হ্যাঁ সত্যিই তাই।” 
        “আচ্ছা ওর জন্য আমরা একটু কিছু করতে পারি না ?”
        “কি করার কথা বলছিস ?”
        "পুজোর সময় আমরা বন্ধুরা চাঁদা তুলে ওকে একটা উপহার দেবো। আমাদের স্কুলপাড়ার পুজোতে ওকে ডাকবো। সবার সামনে ওর হাতে উপহার তুলে দেবো।” 
        “খুব ভালো হয়। সবাই রাজী হবে। কিন্তু পুজো হবে তো ? এখনও পর্যন্ত কারো পুজো নিয়ে কোনো হেলদোল নেই।” 
        “বাবার কাছে শুনলাম আর এক সপ্তাহ দেখবে। জল যদি না বাড়ে তবে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হবে। এই এক সপ্তাহর ওপর সব নির্ভর করছে। এই সময় যেনো বৃষ্টি না হয়।” 
        “বৃষ্টির ওপর কোনো বিশ্বাস নেই রে। দেখছিস তো কয়েকবছর যাবৎ পুজোর মধ্যেও বৃষ্টি হচ্ছে।” 
        “হ্যাঁ রে সেটাই তো চিন্তার।” 
        “গোপীনাথকে কি দেয়া যায় বল তো ?”
        “কি আবার দেবো ? বই দেবো। বইয়ের থেকে ভালো কিছু আর হয় নাকি বল ?” 
        “আচ্ছা বেশ তাই হোক। কিন্তু ও তো পড়াশোনা করার ছেলে নয়।” 
        “এবার পড়বে। ও এখন সেলিব্রিটি। ওকে বোঝাবো একজন সেলিব্রিটি হয়ে পড়াশোনা না করলে তার মান সম্মান থাকবে না৷ বোঝালে অবশ্যই বুঝবে৷ সেলিব্রিটি হবার আনন্দ যেমন আছে তেমন চাপও আছে৷” দুজনেই হেসে ওঠে এই কথায়। 

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মাঠের সামনে এসে আকাশ দেখতে সুমনের খুব ভালো লাগে৷ আজও উঠে এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আলো ফুটে গেছে। এরপর জলের দিকে তাকিয়েই অসম্ভব চমকে উঠলো সে। একটা জলের পোকা জলের দিকে নেমে যাচ্ছে। তারপরেই তালগাছটার দিকে তাকালো। রাস্তা থেকে কয়েক হাত দূরে মাঠের মধ্যে একটা তালগাছের দিকে তাকিয়ে সে জল মাপতো। কাল যেখানে জলের তল দেখেছিলো আজ জলের তল তার থেকে ইঞ্চিখানেক কম। দুই চোখ রগড়ে আবার দেখলো। না কোনো ভুল নেই। জল নামছে। নিশ্চিত জল নামছে। আনন্দে চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো ওর। দুই হাত মাথার ওপর তুলে আবার আকাশের দিকে তাকালো। নীল আকাশের মাঝে মাঝে তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এই তো শরৎকালের আকাশ। তারমানে এই বছর আর বন্যা হচ্ছে না। তারমানে ছোটো করে হলেও দুর্গাপুজো লক্ষীপুজো সব হচ্ছে। আকাশে মেঘের মধ্যে সে যেনো দেখতে পেলো মা দুর্গার মুখ। আর ঠিক তখনই যেনো দূর থেকে তার কানে ভেসে এলো ঢাকের শব্দ।




মেঘবাজার মন্দালপেটিতে

  বাসবদত্তা কদম

-তোমরা বাজার দেখেছ?
-হ্যাঁ!
-জানি তো। আর মেঘেদের বাজার? 
-একি সবাই চুপ কেন? আচ্ছা আরেকটু পরিষ্কার করে বলি- ঐ যে গো যেখানে মেঘ বিক্রি হয়, থলেতে পুরে পুরে আইসক্রিমের মত মেঘ নিয়ে চলে যাওয়া যায় বাড়িতে। তারপর? তারপর আবার কি? বাড়ীর ফ্রিজে মেঘ রেখে দাও বাক্সে পুরে আর ইচ্ছেমতন টুকরো নিয়ে একটু চিনি ছড়িয়ে টকাস্‌। 
-কি বলছ? বাড়িতে ফ্রিজ নেই। তাতে কি? গালে হাত দিয়ে অমন ভাবনার কি আছে?
এই আমি, যখন ব্যাগভর্তি মেঘ নিয়ে বাড়ি এলাম, ফ্রিজটা খারাপ। আমি কাঁচি আর সেলোটেপ নিয়ে সোজা ছাদে। ব্যাগ থেকে মেঘ বের করে আটকে দিলাম আকাশের নীল বোর্ডে। সে তো বেশ আছে। রোদ্দুরেও গলে না। হাওয়া এলে একটু দুলে ওঠে বটে; হাওয়া কমলে আবার যেকে সেই। 


বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা। মেঘবাজারের গল্প শোনো আর ছবিগুলো নিজের চোখেই দেখে নাও। 
সেবার ঠিক এরকম সময়ে পুজোর আগ দিয়ে আমরা গেলাম মাইসোর। জানি বলবেই তোমরা ওহ! মাইসোর গেছি তো । জানি তো। আরে এটা মাইসোরের কথাই না। এটা হল সেই মেঘবাজারের কথা। মেঘবাজারের রাস্তার ডিরেকশন দিতে মাইসোর টা বলতেই হল। নাহলে তোমরা যেতে গিয়ে খুঁজে না পেয়ে বলবে ‘আমি গুল মেরেছি। মেঘবাজার ঠাজার বলে কিছু হয় না।’ সেটি হচ্ছে না।
রাতের ট্রেন ভোরবেলা মাইসোরে থামতেই, ইয়া মোটা গোঁফ নিয়ে চিরাপ্পন আন্না আমাদের হাইজ্যাক করে তার গাড়ীতে বসিয়ে দৌড় দৌড়। 
আমাদের তখনও ভালো করে ঘুমই ভাঙেনি। আমার তো ভাঙেইনি। সে ঘুম একটু ভাঙতেই দেখি শহর ফুরিয়ে আমরা একটু একটু করে ঢুকে পরছি জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গলে ভয় কার না লাগে বল? জঙ্গলে ভয়ের সঙ্গে একটা অদ্ভুত শিরশিরানি ভালোলাগাও চলতে থাকে কিন্তু। 
হটাৎ একটা অচেনা পাখির শিস্‌। তার পরপরই আমাদের চেনা বুলবুলের শিস্‌। এদের দুটোর  মাঝখানেই, ডেকে ওঠে কোকিল। দক্ষিণ ভারতে শীত কম বলে সেপ্টেম্বর থেকেই কোকিলের কুহুকুহু শুরু হয়ে যায়। সামনে থেকে পিছন থেকে ভেসে আসছে কত যে চেনা অচেনা পাখির ডাক। একটা দুটো যা দেখতে পেলাম, তা একরকমের পায়রা। তবে আমাদের পায়রা বংশের হলেও চেহারায় হাবেভাবে বেশ আলাদা। দক্ষিণ ভারতের ঘন জঙ্গলেই এদের বাস। পিঠের পালক বেশ রংবাহারি। ঘাড়ের কাছে দাবার বোর্ডের মত চক্কর কাটা। এদের নাম Nilgiri wood pigeon 
গাড়ি হটাৎ থেমে যেতে দেখি রাস্তা পার হচ্ছে বেজি পরিবার। এদেরও ঘাড়ে চক্রাবক্রা।  বেজির ইংরেজি Mongoose সে সবাই জানে। এদের নাম Stripe necked mongoose এরা বেশ পরিবার পরিজন সহ রাস্তা পার হয় দেখলাম। মায়ের পিছে পিছে ছানা নম্বর এক, দুই, তিন। অনেকটা হাঁসের ছানাদের পুকুরে নামবার মত। আর পরিবারের কারুর, এতটুকু ভয় নেই কো মনে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে হু হু। 
অবশ্য অযথা ভয় পাবেই বা কেন? ওদের ঠাকুর্দার চোদ্দ যুগ আগেও এটাই ছিল ওদের এলাকা। ওদের ঘর। তার মধ্য দিয়ে রাস্তা বানিয়ে ফেলল, মানুষ। নিজেদের দরকারে। ওরা হাবেভাবে বেশ বুঝিয়ে দেয়, সেই মানুষরাই দেখে চলবে। এটাই স্বাভাবিক। সে দায়িত্বে খেলাপ হলে লজ্জা আমাদের মানুষদের। হক কথা। 
আমাদের চিরাপ্পন দাদা এ ব্যাপারে দেখলাম খুব সতর্ক। 
আমার মনে খুব সাধ, একটিবার যদি দেখা পাই এই এলাকার Malabar trogon এর। এ পাখি থাকে পশ্চিমঘাটে ঘন জঙ্গলে। বুকটা লাল, মাথাটা নীলচে কালো। পশ্চিমঘাটের জঙ্গল অনেক রকমের পাখি, সাপ, বাঘ, হাতি, হরিণ, বেজি, সাপ এদের সবারই বাড়িঘর। কারুর আছে গাছের কোটর। কেউ বা থাকে পাহাড়ের গুহায়। কিংবা গাছের ডালে। এদের মধ্যে অনেককে আমরা চিনি। কেউ কেউ একটু অচেনা। 
যারা বিশেষ সম্ভ্রান্ত তারা হল sloth bears , Indian elephant Asian elephant, Langoor আর আছে আছে Indian pangolin যদিও শেষের জনের দেখা পাওয়া খুব মুশকিল। 
এই Langoor দের রঙ সাদা, কালো দুই-ই হয়। এদের মাথার চারিদিকে টুপির মত ছড়ানো লোম। দাড়ি আর টুপি মিশে গেলে যেমন হবে, অনেকটা ঠিক তেমনি। 
আর Pangolin, পিপীলিকাভুক সে খায় পিঁপড়ে, পিঁপড়ের ডিম আর ছোট ছোট পোকা। 
আর আছে অনেক সাপ। এদের মধ্যে ভয়ংকর হচ্ছে Russell’s Viper অবশ্য চন্দ্রবোড়া বিষ ঢাললে ভয়ংকর তো বটেই। 

জঙ্গলের মধ্যে এক কাঠের বাড়ির সামনে হটাৎ দেখি গাড়ি থেমে গেল। চিরাপ্পন আন্না আমাদের বলল খেয়ে নিতে। কাঠের মেঝে আর তার লাল টুকটুকে ছাদ। সেই ছাদে একটুকরো রোদ্দুর পড়েছে জ্যামিতি বাক্সের চাঁদার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে। আর সেই একফালি রোদ্দুরে খেলা করে বেড়াচ্ছে মা কাঠবিড়ালি আর তার ছানা পোনার দল। মাঝে মাঝেই সুড়ুৎ করে তারা নেমে আসছে বাদাম গাছের নীচ থেকে বাদাম কুড়িয়ে নিতে। বাদাম হাতে নিয়ে ভাঙছে কুড়কুড় মুড়মুড় আর খাচ্ছে কুট্‌কুট্‌ । 
এর মধ্যে আমাদের জন্য এসে গেল গরম, গরম নরম ধোসা আর মাখনের মত নারকেলের চাটনি। সে যে কি টেস্টি কি টেস্টি তা আর কি বলব। কিন্তু চিরাপ্পন দাদা! বসে একটু আঙুল চাটতেও দিলে না গো। তার বেঁকানো গোঁফ কেঁপে উঠতেই আরেক ধমকের আগেই আমরা চারজন গাড়ীতে। গতজন্মে চিরাপ্পন দাদা স্কুলের হেডমাস্টারমশাই ছিল নির্ঘাত। অমন গুঁফো আর রাগী হেডঅফিসের বড়বাবু আর হেডমাস্টারমশাইরা হয় সে আমি খুব জানি।
আবার ছুটলে গাড়ি ভ্যাঁ-পো, ভ্যাঁ-পো করে। 
চাদ্দিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। বসে আছি তো বসেই আছি আর নীল রঙের সবুজ রঙের জঙ্গল দেখেই যাচ্ছি। প্রচুর ইউক্যালিপ্টাস গাছ হয় দক্ষিনভারতের জঙ্গলে। আর তাতেই জঙ্গলের রঙটা জলপাই গাড় সবুজ থেকে হটাত হটাত নীলচে সবুজ হয়ে যায়। 
বেশ চলছিল গাড়ি, ওমা যেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তার উল্টোদিকের জঙ্গলি ফুলের গাছের প্রজাপতিগুলো দেখছি আর গুনছি অমনি আমাকে গাড়ীতে একা ফেলে সব নেমে গেছে। কেউ একবার আমায় কিছু বললে না পর্যন্ত। এমনকি চিরাপ্পন আন্নাও নেই। যাকগে। বয়ে গেছে আমার। আমি আরো মন দিয়ে প্রজাপতি দেখতে ওদের কাছে গেলাম। বললে বিশ্বাস করবেনা কত যে রঙ আর কি তুলতুলে ডানা তাদের। বড় আছে। মেজ ছোট সবাই আছে। নীল সবুজ খয়েরি হলুদ সাদার ওপর ছিটে, সবাই আছে। এর মধ্যে দেখি রাস্তার ওপার থেকে আপ্পু সিং শুঁড় দুলিয়ে আসছে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নীচে অনেক হাতিদের বাস। সেরকমই কোনো বাড়ীর বাচ্চা হবে। বেশ স্মার্ট। একাএকা রাস্তা পেরোচ্ছে। সাথে কেউ নেই। আপ্পুকে দেখেই প্রজাপতিগুলো আমাকে বলে কিনা -যাও যাও তোমার বন্ধু এসে গেছে। 
দেখেছ, এতক্ষন আমি ওদের সঙ্গে খেললাম আর আমাকে আপ্পুর বন্ধু বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা আচ্ছা আমি মোটা সেটাই তো বলছ। এভাবে না বললেও হত। আমার কি মান অপমান বোধ নেই নাকি? -এবাবা রাগ করেনা। তা বলিনি। মোটেও বলিনি। তারা দৌড়ে দৌড়ে আমার দিকে আসতে লাগল। আমিও দিয়েছি এক ছুট। না আর আমি তোমাদের সঙ্গে খেলবনা। আমাকে মোটা দেখে আপ্পুর বন্ধু বলা। আমি কি বুঝিনা।  
যেইনা একটু এগিয়েছি আপ্পুকে আদর করব বলে; গাছে খেলা করছিল মিশমিশে কালো বেশ কয়েকটা বাঁদর। সব কটা নেমে এসে চিঁ চিঁ করে কি সব বলতে শুরু করলে। দক্ষিনভারতের জঙ্গলের গাছগুলোতে ওরা থাকে। ফল থেকে মাংস সবই খায়। আর ওদের লিডার বুড়ো গোদাটা রাস্তা আটকে বলে কিনা -এ রাস্তায় যাওয়া যাবে না। এটা আমাদের রাস্তা। মানুষ বাচ্চাদের জন্য মোটেও নয়। তোমরা মানুষরা যেখানেই যাও বড় নোংরা করো আর গাছ কাটো। বোঝো ঠ্যালা। আমি বলে আপ্পুকে দেখে বন্ধুত্ব করতে যাচ্ছি।খামোখা আমাকে আটকে কতগুলো কথা শোনাচ্ছে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে ভারী অসভ্য তো তোমরা। জানো না শোনো না আমাকে খানিক কথা শোনাচ্ছ কেন? কথা ফুরোতে পেল না গাছ থেকে কুচোগুলো নেমে এসে আমার পিঠে মাথায় চাঁটি ঠাটি মেরে সে এক যা তা কান্ড। মাঝখান থেকে আপ্পুটা রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। যাবার সময় শুঁড় তুলে ফিচিক করে একটু হাসল মনে হল। 
এবার আবার গোদা বাঁদরটা ধাক্কাচ্ছে। 
দেব এক বলে যেই না ঘুরেছি, দেখি কি আমার বোন আমাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে -উফফ্‌ মানুষ এত ঘুমাতেও পারে। 
-আমরা পৌঁছে গেছি? 
-হ্যাঁ গেছি। এবার ওঠো। গাত্রোত্থান করো।   
গাড়ীর চাকা লাল মাটির কাদায় আটকে গেছে। ব্যাগগুলো চিরাপ্পন দাদা আর হোটেলের ছেলেরা হাতে হাতে নিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের আঙ্কেলের হাতেও ব্যাগ।
শুধু আমিই পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিলাম। এ বাবা। এরপর আমায় নিয়ে কত যে হাসাহাসি হবে তার কি ঠিক আছে না ঠিকানা আছে। নামি। 
নামতেই দেখি পিচের রাস্তাটা দুম করে শেষ হয়েছে কাদামাটিতে মিশে। 
ডানদিকে চলে গিয়েছে একখানা শুড়ি পথ। সেই রাস্তায় লম্বা লম্বা সব গাছেরা দিনের আলো আটকে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশের রাস্তাটা ঢুকে গেছে যেখানে আমরা থাকব সেইখানে। ঘরে পৌঁছবার আগে বারান্দায় পৌঁছে দেখি চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। সন্ধে হবার অনেক আগেই শুরু হয়ে গেল ঝিঁঝিঁ ডাক। তার সাথে আরো বেশ কিছু খসখস, ঝুরঝুর, খরখর কত রকমের যে আওয়াজ। সময়টা দুর্গা পুজোর আশপাশ তাই আকাশে বাঁকা একফালি চাঁদ। তারার আলোতে আর ঐ একফালি চাঁদের আলোতে পাশের কফি বাগিচায় ধোঁয়া ধোঁয়া আলো। পরদিন সকালে বারান্দায় এসে দেখি আমাদের দরজার গায়ে বসে আছে কত রকমের মথ। আলো ফুটতে বাগানের হাতায় দেখি উড়ে বেড়াচ্ছে রঙ-বেরঙের কত প্রজাপতি। আমার হাতের পাতার সাইজের মত বড় থেকে একেবারে কুট্টি। আর কি সুন্দর সব কারুকার্য তাদের গায়ে।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা গেলাম আব্বে ওয়াটার ফল দেখতে। 
কর্ণাটকের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা অঞ্চলের কাবেরী নদীর এই জলপ্রপাত। কাবেরী নদী ব্রহ্মগিরির থলকাবেরী থেকে নেমে বহু পথ পেরিয়ে কর্ণাটক তারপর তামিলনাড়ু রাজ্য হয়ে বঙ্গপোসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই যাবার রাস্তায় নিজের উৎপত্তিস্থল থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার গিয়ে পশ্চিমঘাটের এক পাহাড় থেকে সে দিয়েছে এক ঝাঁপ। সেই হল আব্বে জলপ্রপাত। এনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে আব্বের বেশ কাছে চলে যাওয়া যায়। এতটাই কাছে যে গায়ে জলের কণা এসে লাগে। আব্বের ঠিক সামনেই আছে একটা ঝুলন্ত সেতু। সেখান থেকে আব্বে কে দেখতে আরো সুন্দর লাগে। নীচে আমার তোলা আব্বের একটা ছবি দিলাম। 
অনেক আগে ব্রিটিশ ভারতে আব্বের নাম ছিল জার্সি। তখন সেখানে ঘন জঙ্গলে বাঘ ডাকে। তারপর দেশ স্বাধীন হল। তখন এক দক্ষিণ ভারতীয় ঐ অঞ্চলের পাহাড় জমি কিনে নিলেন সরকারের কাছ থেকে। কফি চাষ করবেন বলে। জার্সি ফলসের নাম বদলে তার নাম হয়ে গেল আব্বে। ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা আবার আব্বেকে আদর করে বলেন আবি। একটা জলপ্রপাতের আদরের ডাকনাম কি আগে শুনেছ তোমরা? আমি কিন্তু শুনিনি। 
আশে পাশে ব্রীজের উপরে নীচে ঘুরে, আবিকে দেখে, তার ছবি তুলে যখন হা-ক্লান্ত হয়ে গেছি আমরা; ঠিক তখনই বোঝা গেল আমার একার নয়, সবারই বেজায় খিদে পেয়ে গেছে। 
নীচে তো খাবার নেই। শুধু জল আর কোল্ড ড্রিংকস পাওয়া যায়। 
ওপরে ওঠা শুরু হল। সেই আবার অত্তগুলো সিঁড়ি উঠছি আর উঠছি। তোমরা দৌড়ে উঠে যাবে সে আমি জানি। তারপর তো চা পাঁউরুটি বিস্কুট কেক এসব খেয়ে শরীর আর মন আবার বেশ তাজা হয়ে উঠল। চায়ের দোকানের দাদার সাথে অনেক গল্প হল। তিনিই বললেন -এতদূর থেকে এসেছেন আর মেঘেদের দেশ মন্দালপেটি যাবেন না! 
-মেঘেদের দেশ! 
-হ্যাঁ শোনা যায় সেখানে রাত্রে পরীরা নেমে আসে আর মেঘেদের সাথে খেলে। আকাশ থেকে টুপ্‌ টুপ্‌ করে মিষ্টি জলের কনা ঝরে পরে ঘাসের উপর। নীল ঘাস সবুজ হয়। সবুজ ঘাস নীল। আর পুট্‌পুট্‌ করে ফোটে হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনী ফুল। ভরে যায় প্রান্তর। 
তবে হ্যাঁ রাত্রে সেখানে কেউ যেতে পারে না। যদি যেতে হয় ঘুরে আসতে হবে সন্ধ্যের আগে। খুব সুন্দর জায়গা, ঘুরে আসুন। 
-ও চিরাপ্পন দাদাগো নিয়ে চল না আমাদের সেই মেঘেদের দেশে। 
না চিরাপ্পন দাদার সেখানে যাবার পার্মিশন নেই। চা দাদার সাথে কথা বলতে তিনিই ঠিক করে দিলে আমাদের মেঘবাজারে যাবার রথ। একখানা জিপগাড়ি।   
এতক্ষনে বুঝে গেছ নিশ্চয়ই মন্দালপেটি নামখানার মানে মেঘেদের বাজার। 
জিপগাড়ি ছুটে চলল। তা সেখানে মেঘেরা বাজার করতে আসে না সে বাজারে মেঘ বিক্রি হয় তা আমি বলবনা। কিছু প্রশ্ন মনে থাকা ভাল, যখন যাবে তখন মিলিয়ে নিয়ো। 
দেখলাম একখানা মাত্র রাস্তা এঁকে বেঁকে নিজের খুশিমতন আলপনা দিয়ে গেছে। আর আমাদের জিপগাড়ির চাকা সেই আলপনার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কখনো আস্তে, কখনো কখনো জোরে। রাস্তার দুদিকে কত যে নাম না জানা ফুলেদের জঙ্গল। কিন্তু ফটো তোলার উপায় নেই, গাড়ি থামবে না। একখানা মোটে রাস্তা কিনা তাই একটা গাড়ি এদিক থেকে রওয়ানা হলে ওদিকের গাড়ি থেমেই থাকে যতক্ষণ না এদিকের এই জিপ পৌঁছায়। 
আরে আরে থামান থামান বলতে বলতেও সে জিপ পেরিয়ে যায়। 
হটাত দেখা এক দঙ্গল সূর্যমুখীর সাথে। খয়েরী, হলুদ, সবজেটে হলুদ সবাই তারা বিভিন্ন কোন থেকে আকাশ ভজনা করছে। সূর্যমূখী ফুল সূর্যের আলোর সাথে সাথে ঘোরে এ সবাই জানে। আর তার উল্টোদিকে একখানা বিশাল প্রান্তর। সবুজ ঘাসে ঢাকা। সেখানে ফুটে আছে কত যে ঘাসফুল। কি অপূর্ব সুন্দর তাদের ঝিকিমিকি রূপ। ঠিক যেন আকাশের তারা কেটে কেউ বসিয়েছে ঘাসের উপর। 
রাস্তা ধরে জিপ যেমনি যেমনি এগোচ্ছে মন বলছে সত্যি চলেছি পরীদের দেশে। এক্ষুনি দেখা হবে মেঘকুমার মুহিলন আর মেঘকুমারীর সাথে। সাদা ধপধপে মেগের বেঞ্চে বসে নীল গেলাস থেকে গোলাপী রঙ্গনের মধু খাচ্ছে আর গল্প করছে তারা। 
লাল মাটির রাস্তাখানাও তেমনি স্মার্ট। আমাদের জিপদাদাকে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। হটাত ঝড়াং শব্দ করে জীপগাড়িখানা বন্ধ হল। এই রে গাড়ি খারাপ হয়েছে। 
-না পৌঁছে গেছেন। ঘুরে দেখে নিন। আমি এখানেই আছি। 
এ মনে হচ্ছে চিরাপ্পনের ভাই বেরাদার কেউ হবে। অমনি মোটা গোঁফ আর তেমনি মেঘের মত আওয়াজ।
এসে গেছি। এসে গেছি। দৌড়ে দৌড়ে নেমে পড়লাম আমরা।     
নীল সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। ছোট ছোট দুটো টিলা পাহাড়। আরেকটা রাস্তা নেমে গেছে নীচের মাঠের দিকে। আমাদের রাস্তাটা ত্রিভুজ হয়ে পাহাড়ে চড়েছে। তারপর পাহাড়ের গায়েই আটকে আছে। ছবি দেখে মিলিয়ে নিও। পাহাড়ের খাদের ধারে একলা একখানা গাছ ফুল পাতা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সামনের নীল পাহাড়িকে ডাকছে। তার ছবিও থাকল তোমাদের জন্য।
আরে ধাক্কা মারে কে? ওমা এযে এক কুকুরছানা। না ঠিক ছানা বলা যায় না তাকে, একটু বড়। শোনা গেল আমাদের মত পথিকদের ভরসাতেই সে থাকে। ব্যাগে রাখা বিস্কিট আর কেক খেল পরমানন্দে। জল খাওয়া হলে, আমাদের পিছে পিছে ঘোরে আর লেজ নাড়ে। গাইড হয়ে পাহাড়ে চড়ে। মাঠে হাঁটে। ভৌভৌ করে ঘাসফুলের সাথে আমাদের ভাব করায়। আকাশের মেঘকে ডাকে। অতিথি এসেছে, আলাপ করাই এসোগো তোমরা।
সে নাকি রাতেও থাকে এই প্রান্তরে, যায় না কোথাও। বুঝলাম মেঘ আর পরীদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে এমন গাড় যে এ প্রান্তরের টান কাটিয়ে বাইরে সে যেতেই পারেনা। 
আমরা বলি, বল না আমাদের তোর বন্ধু মেঘ আর পরীদের গল্প। সে বলে কৌকৌভৌ। জিপে ওঠা অবধি সঙ্গে এলে আবার গটগটিয়ে ফিরে গেল তার নিজের এলাকার দিকে। পিছনে পড়ে রইল মন্দালপেটি নামের মেঘবাজার। আমরা চললাম ঘরের পথে।
এর কদিন পর মাইসোর হয়ে ঘরে ফেরার পথে ডুবারের এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে হাতিদের স্নান আর আদর খাওয়া দেখে মাইসোর এলাম। ডুবারের এই ক্যাম্পে মাইসোর রাজার হাতিও আসে আদর খেতে, দশেরার আগে। আমি যা বুঝলাম ওটা হচ্ছে হাতিদের পার্লার। হাত ঘষছে, পা ঘষছে। গায়ে মালিস হচ্ছে। স্নান তো হচ্ছেই। কেউ কেউ নাকি নখও কাটতে আসে এখানে। ভাবো একবার। সেজেগুজে তারা যাবেন মাইসোরের রাজার দসেরার প্রসেসনে। অবশ্য পুজোর প্রসেসনে গেলে কার না একটু সাজুগুজু করতে ইচ্ছা করে? 
দশেরায় মাইসোরের প্রাসাদ জনসাধারনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিশাল বাগানে সেদিন যে খুশি সে যেতে পারে। প্রাসাদেও ঢুকতে পারে। সন্ধেবেলা রাজা বের হন হাতির পিঠে চড়ে। রাজার হাতিরও গয়নায় শুঁড় থেকে পিঠ পুরোটাই ঢাকা থাকে। বেচারা হাতিগুলো লোকে লোকারণ্য রাস্তার মাঝখান দিয়ে প্রসেসন করে যায়। যায় কি আর নিজেদের ইচ্ছায়! ওদেরও যে একটা বন আছে, রাজার হাতি ঘুমিয়ে শুধু স্বপ্নে সেই বন দেখে, আর ভীড়ের রাস্তায় হাঁটে।
সেদিনই রাত্রের ট্রেনে চড়ে আমরা ফিরে এলাম।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন


Post a Comment

0 Comments