জ্বলদর্চি

মেদিনীপুর কলেজ : সার্ধশত বছর/অমর সাহা

মেদিনীপুর কলেজ : সার্ধশত বছর

অমর সাহা


স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় যাঁরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পত্তন করেছিলেন সর্বপ্রথম আমি তাঁদের স্যালুট জানাই৷ গঙ্গার এপারে শ্রীরাম কলেজকে বাদ দিলে আজকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গের একমাত্র কলেজ৷ এই সময়কার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের সশ্রদ্ধ নমস্কার করি৷ আজ কলেজ সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করছে যা ভাবতে আমি আবেগ মথিত হয়ে পড়ছি৷ দীর্ঘ এই কলেজে কিশোরকাল থেকে যৌবনে পদার্পণ করার সময় পাঁচ বছর পড়াশুনো করেছি৷ তখন কলেজে এগারো-বারো ক্লাস হোত৷ আমি যে সময় পড়াশুনো করি (১৯৮৫-১৯৯০) তখন এত কলেবর বৃদ্ধি পাইনি কলেজের৷ কিন্তু সার্ধশতবছরে সে যুবক৷ চব্বিশটি বিষয়ে স্নাতক ও চোদ্দোটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চলছে বর্তমানে৷ তাছাড়া বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে গবেষণা করার স্বীকৃতি লাভ করেছে কলেজ৷ অসংখ্য জ্ঞানীগুণী মানুষ এই কলেজে পদার্পণ করেছে৷ বহু কৃৃৃৃতি পড়ুয়া এখান থেকে পড়াশোনা করে পৃথিবীর বহু প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন৷ 

   মাঝখানে আমার কলেজের সঙ্গে কিছুদিন বিচ্ছেদ ঘটেছিল৷ স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এই বিচ্ছেদ৷ পরে আবার এলাম কলেজে অধ্যাপনা করতে৷ সেও দুই দশকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে৷ মেদিনীপুর কলেজ আজ স্বশাসিত৷ আমি আমার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় এই কলেজে কাটাচ্ছি৷ এ যেন আমার ঘরতুল্য৷ যতই আমরা দেশ বিদেশে ছুটে যাই না কেন যেখানে আমার প্রাণের টান, যেখানে বুকে রক্ত তুফান তোলে, যেখানে দুঃখ আনন্দ ধুলোর সঙ্গে মিশে মিশে আছে তা তো পিতৃতুল্য৷ মাতৃতুল্য ৷ ক্রন্দনরত শিশুকে যেমন পিতামাতা কোলে কাঁখে করে মানুষ করে তোলে, তেমনি করে এই কলেজের অধ্যাপকদের কাছে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠার রসদ লাভ করেছি৷ সমস্ত স্বর্গীয় অধ্যাপকদের আমার প্রণাম৷



   ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর শহরে কলেজটি স্থাপিত হয়৷ গুটি গুটি পায়ে ভাদ্র মাসের ভরা নদীর মতো ছাত্রধারায় কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে মেদিনীপুর কলেজ৷ নাকের (তৃতীয় সারকেল) বিচারে মেদিনীপুর কলেজের গ্রেড পর পর তিনবার A+ যার CGPA - ৩.৬০৷ তৃতীয়বার ৩.৬০ এত সিজিপিএ গ্রেড৷ তার আগে ৩.৫৮ ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম কলেজ নাকের বিচারে প্রথম 'A' গ্রেড প্রথমবার পায়৷ কলেজ ২০১৪ সালে অটোনমাস স্ট্যাটাস পায় এবং ২০১৫ সালে সিপিয়ি স্ট্যাটাস পায়৷ এই কলেজের জন্ম ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এখানে একটি প্রাইভেট স্কুল স্থাপিত হয়৷ ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি জিলা বিদ্যালয় রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলেজটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল৷ ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে মেদিনীপুর কলেজ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে আসে৷ এই কলেজ ছাত্র হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামী দীনেশ গুপ্ত(১৯২৮-১৯২৯), প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য (১৯৩২-১৯৩৩), মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত(১৯৩৩-১৯৩৪), ব্রজকিশোর চক্রবর্তী(১৯৩৩-১৯৩৪) ও নির্মলজীবন ঘোষ(১৯৩৩-১৯৩৪) প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে পেয়েছে৷ সেই হিসেবে কলেজ গর্ব অনুভব করে৷ এখন কলেজে ২৪টি বিষয়ে স্নাতক ও ১৪টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম পড়ানো হয়৷ কলেজ দুটি গবেষণাধর্মী জার্নাল প্রকাশ করে৷ যার একটি হল 'এডভানস জার্নাল অফ হিউম্যানিটিস এন্ড সোশাল সায়ান্সস' এবং 'এডভানস জার্নাল অফ বেসিক সায়ান্সস'৷ কলেজের বার্ষিক পত্রিকা 'প্রাঙ্গণ' নিয়মিত প্রকাশিত হয়৷ এছাড়া প্রাক্তনীদের দ্বারা প্রকাশিত হয় 'মিলিতা'৷ বিভিন্ন বিভাগও নিয়মিত পত্রিকা বের হয়৷ যেমন বাংলা বিভাগের 'অঙ্গন' পত্রিকা৷ এছাড়া প্রত্যেকটি বিভাগের রয়েছে দেওয়াল পত্রিকা যা ইউ.জি-র পড়ুয়ারা প্রকাশ করে৷ যেমন ইংরেজি বিভাগের 'ফিনিকস'৷ এই কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের ব্যবস্থা করা হয়৷ তাছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে কর্মশালার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে৷

   বর্তমানে এই কলেজে কলা ও বিজ্ঞান অনেক ছাত্রছাত্রী গবেষণারত৷ এখানে অনেকগুলি ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্স করা যায়৷ তাছাড়া দূর শিক্ষায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের ব্যবস্থা রয়েছে৷ বহু অধ্যাপক মাইনর ও মেজর গবেষণায় ব্যস্ত৷ বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ফলে অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং ফলাফল ও ছাত্রছাত্রীদের শংসাপত্র সুষ্ঠ ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷

    এই কলেজের গর্বের বিষয় লাইব্রেরি৷ প্রায় ৭৫,০০০ হাজার বই এই লাইব্রেরিতে আছে৷ ভারতের প্রথম কুড়িটি কলেজের মধ্যে স্থান লাভ করবে এই কলেজ৷ প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে যেকোনো পড়ুয়ার কাছেই তা গর্বের৷ পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো কলেজে বোধহয় এখানকার প্রাক্তনীদের মতো সামাজিক কাজকর্ম করার মতাদর্শ আছে কি না আমার জানা নেই৷ এখানকার প্রাক্তনীদের কাজকর্ম নিয়ে আনন্দ উপভোগ করি৷ প্রায় প্রতিটি বিভাগের প্রাক্তনী সম্মীলন হয়৷ কলেজ খেলাধুলোতে পূর্ব ভারতে একটি বিশিষ্ট জায়গা করে নিয়েছে৷

   কলেজের কলেবর বৃদ্ধি পেলেও বর্তমান ইউ.জি.সি বিল্ডিংয়ের সামনে একটি বেদী বাঁধানো নিম গাছ ছিল৷ সেই গাছটি আজ আর নেই৷ প্রায়ই আমার স্মরণ হয় নিম গাছটির কথা৷ এই নিম গাছ কাটা নিয়েও নানারকম অলৌকিক আধিভৌতিক কথা আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল৷ সেই নিম গাছটির কথা মনে পড়লেই সাহিত্যিক বনফুলের 'নিমগাছ' ছোটোগল্পটির কথা মনে হয়৷

    এখন কলেজে ১২০ জন ফুলটাইম অধ্যাপক ও ১০০ জনের বেশি স্টেট এডেড কলেজ টিচার (স্যাকট) শিক্ষাদানে রত৷ শুধু শিক্ষাদান নয়, সেই সঙ্গে শরীরচর্চা, খেলাধুলো ও অন্যান্য নানান কো-কারিকুলাম একটিভিটিজ এবং চাকুরির পরীক্ষার জন্য ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷

  এই কলেজের পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল রয়েছে আলাদা করে৷ স্থায়ী শিক্ষকরাই হোস্টেল সুপার হোন৷ কলেজের সামনে রয়েছে বিশাল খেলার মাঠ৷ সকাল সন্ধে  মানুষজন এই মাঠে প্রাতঃ ও সান্ধ্য ভ্রমণ করতে আসে৷ বর্তমানে প্রাক্তনীদের সাহায্যে ও কলেজের অর্থানুকূল্যে একটি পাঁচতলা বিল্ডিং তৈরির কাজ প্রায় শেষের মুখে৷ আমার পড়ার সময় এত বিল্ডিং, মহিলা হোস্টেল ছিল না৷ বরং ফাঁকা জায়গাতে আমরা গাছ লাগিয়েছিলাম৷ সেগুলি সব ছিল সেগুন গাছ৷ যে গাছগুলির নিদর্শন স্বরূপ কিছু গাছ এখনও রয়ে গেছে৷ এখন লাইব্রেরি ও ইউ.জি বিল্ডিং থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ সেই জায়গায় ভূগোল বিভাগ দখল করেছে৷ ওই বিল্ডিংয়ের জানালার সার্সিগুলি এখনও যেন কথা বলে৷ তখন আমরা ওই বিল্ডিংয়ে বই নিতাম৷ এখন লাইব্রেরি রিডিং রুম বিশাল আকারের প্রায় একটি তলা ঘিরে৷ বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে শ্রেণিকক্ষ ও ইংরেজি বিভাগ৷ প্রথম তলায় লাইব্রেরি, দ্বিতীয় তলায় রিডিং রুম এবং তৃৃৃৃতীয় তলায় পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম হয়৷ পরিবর্তনশীল জগতে কত রকম পরিবর্তন ঘটছে তারই বিবর্তন দেখি মেদিনীপুর কলেজের বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের রূপের গঠনে৷ সবচেয়ে মজার ব্যাপার বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এরফলে পড়ুয়া ও শিক্ষকদের লাইব্রেরি যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে৷ বিবেকানন্দ হলটি আমাদের সময়ও ছিল, তবে এখন তার আধুনিকরণ ঘটানো হয়েছে৷ কলেজের সমস্ত বড় বড় অনুষ্ঠান এখানেই হয়৷ রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের অবস্থান আমাদের সময় যেখানে ছিল এখনও সেখানেই রয়েছে একই রঙে৷ কলেজের শিক্ষকরা নিয়মিত যান আউট রিচ প্রোগ্রামে৷ এ নিয়ে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই৷ আমাদের সময় কলেজে এন.সি.সি ছিল৷ মাঝখানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ এখন আবার চালু করা হয়েছে৷ এখন আবার কলেজে এন.এস.এস চালু হয়েছে৷ কলেজে আমূল পরিবর্তন হয়েছে রাজনীতির৷ যখন আমি পড়েছি তখন কী ভয়ংকর ছিল ছাত্র রাজনীতি৷ আমি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পরও সে ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি৷ তবে স্বশাসিত মর্যাদা পাবার পর এখানে রাজনীতির বাতাবরণে ছেদ পড়েছে৷


    
শুধু প্রাক্তন ছাত্র হিসেবেই নয়, নিজেকে ধন্য মনে করি এই কলেজে শিক্ষাদান করার জন্য৷ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা আমার কাছে মাতৃজঠরতুল্য৷ তারই কোলে লালিত পালিত হয়ে তাকে লালন পালন করাই আমার জীবনের সার্থক তপস্যা হোক৷ আমি যে ঋণ কলেজ থেকে গ্রহণ করেছি তা পরিশোধ না করতে পারলে জীবনের পরপারে ঋণী থেকে যাবো৷
     
     আমার শিক্ষালয় তোমাকে প্রণত
     অনেকে খিস্তিখেউড় করে জানি
     কলিগরা ধোঁকা দেয়, অদ্ভুত রীতি,
     দড়ি টানাটানি করে নিজেরাই গহ্বরে ডুবে৷
     জানি অনেক ঝড় ঝাপটাতেও তুমি
     নত হওনি, আগামী দিনেও
     তোমার আস্য উজ্জ্বলময় হোক৷

লেখক মেদিনীপুর কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments