জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ফ্রান্স (ইউরোপ)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ফ্রান্স (ইউরোপ)

চিন্ময় দাশ

হংসরাজ

জগতে যে এত রকমের জীব—কে গড়েছে তাদের? বিধাতা পুরুষ। যাকে যেমনটি মনে হয়েছে, গড়েছেন। কেউ দেখতে সুন্দর, আবার কেউ যে মন্দ-- সব তাঁরই কাজ। কারও গলার স্বর মিষ্টি, কারও বা কর্কশ—তাতে কি কারও নিজের কিছু করবার আছে? 
হাঁস দেখতে তো বেশ সুন্দরই। তার গলাটি কিন্তু তেমন সুবিধের নয়। কেমন ফ্যাঁসফেঁসে। তাছাড়া, তার গলার জোরও তেমনি। শুনতে সত্যিই ভালো লাগে না। 

যাকগে, আসল গল্পটা বলি। হয়েছে কী, এক দেশে ছিল একটা হাঁস। দেখতে ভারি সুন্দরই। কিন্তু ঐ যে বললাম, গলা? যেমন মোটা, তেমনি তীক্ষ্ণ। আর, হাঁসটার স্বভাব হোল যখন তখন হাঁক-ডাক করা। 

যারা তার পাড়া-পড়শি, তার ডাকাডাকিতে সকলের কান ঝালাপালা।  প্রাণ ওষ্ঠাগত। কেবল নিজের পাড়া নয়, কালে কালে গোটা দেশশুদ্ধ লোক জেনে গেল হাঁসটার কথা। সব সময় তাকে হাঁক-ডাক করতে শুনে, সবাই বলত—কাণ্ডখানা দেখো না ব্যাটার। একেবারে রাজার মত হাঁক-ডাক। সেই থেকে তার নামই হয়ে গেল—হংসরাজ। 

ইদানিং কেউ কেউ তার সামনে পড়ে গেলে, বিনয়ে একেবারে গদগদ হয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে বলতে লাগল—পেন্নাম হই, রাজামশাই। ভালো আছেন তো? 
এসব যে ভক্তি বা ভালবাসায় নয়, নিপাট টিটকিরি-- হাঁস সেটা ভালোই বোঝে। তবে, সুখের কথা হোল, হাঁসটার স্বভাব হোল লোকের কথায় কান না দেওয়া। যার যেমন স্বভাব, তার আচার-আচরণও তেমনই তো হবে। অন্যের কথায় কান দিয়ে লাভ কী? তুমি থাকো তোমার নিজেকে নিয়ে। এই হোল হাঁসের হিসাব-বিচার।
তবে, হাঁসটার আর একটা স্বভাব হোল, পরিশ্রম আর সঞ্চয় করা। তুমি যতই দেখতে সুন্দর হও, কিংবা গুণবান, টাকা না থাকলে, কেউ মানবে না তোমাকে। টাকা আছে তোমার, তো তখন সব দোষ ঢাকা পড়ে যাবে। তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে সবাই। 
দেখতে দেখতে অনেক ধনের মালিক হয়ে উঠল হাঁস। সবাই জানল বড়লোক হাঁসের কথা। ভারি নামডাক হোল হাঁসের। 

সেদিন এক ঘটনা। হঠাতই বাতাসে খুট-খাট খুট-খাট আওয়াজ। ঘোড়ার পায়ের শব্দ। একটু বাদেই এক ঝলমলে জুড়িগাড়ি এসে দাঁড়াল হাঁসের বাড়ির সামনে। দেশের রাজা নামল গাড়ি থেকে। সবাই আকাশ থেকে পড়ল। হাঁসের বাড়িতে দেশের রাজা! কেন রে, বাপু! ব্যাপারটা কী? 
আসল ব্যাপার হোল, সময়টা ভালো যাচ্ছে না রাজার। কিছুদিন বড় টানাটানি চলছে। কিছু টাকার দরকার পড়েছে। তাই হাঁসের কাছে আসা। 

 সব শুনে বেশ গুমোর হোল হাঁসের। টাকা ধার নিতে হাঁসের বাড়িতে এসেছে দেশের রাজা। গুমোর হবে নাই বা কেন। বেশ দেমাক দেখিয়ে হাঁস বল—দেব টাকা। তবে একটা শর্ত আছে। 

আশপাশে অনেকেই এসেছে ভীড় করে। কেউ রাজাকে দেখছে। কেউ দেখছে রাজার ঝকমকে জুড়িগাড়ি, কোচোয়ান, তেজিয়ান দুখানা ঘোড়া—এইসব। কেউ উঁকিঝুঁকি মারছে  আড়াল থেকে। সামনে আসতে ভরসা পাচ্ছে না। কিন্তু কান সবারই খাড়া। কী কথা হয় শুনতে চায় সকলেই।

হাঁসের গলায় শর্ত চাপানোর কথা কানে যেতেই, পিলে চমকে গেল সকলের। দেশের রাজাকে অনেকেই চোখে দেখেনি এর আগে। তবে শুনেছে সকলেই। ভারি বদমেজাজী। খামখেয়ালি, স্বভাবে উগ্র, অহঙ্কারী—যত বদগুণ সবই আছে রাজার। এতবড় কথা শুনে, নিশ্চয়ই এক কোপে হাঁসের মাথাটাই কেটে নেবে এখুনি। ভয়াণক একটা কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে, এই ভেবে কেউ কেউ সরে পড়তেও চাইল। 
কিন্তু কোথায় কী? কথা কাটাকাটি তো বহু দূরের ব্যাপার, রাগও নাই রাজার গলায়। হাসি মুখ করে বলল— টাকার কথা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

হাঁস মনে করিয়ে দিল রাজাকে—এক বছরের কড়ার কিন্তু। কথাটা মাথায় রাখতে হবে। 
রাজা তখন গাড়ির পাদানিতে। মুখ ফিরিয়ে জবাব দিল—বললাম না, টাকার ভাবনা মাথায় রেখো না।
বলেই রাজা চলে গেল। রাজার গাড়ি চলে গেল টগবগিয়ে। শুধু কি তাই? দিন গেল এক এক করে। মাস গেল। দেখতে দেখতে বছরও গড়িয়ে গেল। কিন্তু টাকা ফেরত দেওয়ার টুঁ শব্দটিও নাই রাজার ঘর থেকে। 
হাঁস ভাবল—রাজা বলে কথা। হাজার কাজ নিয়ে থাকতে হয়। হাজার ভাবনা, হাজার সমস্যা। হয়ত সময় করে উঠতে পারছে না। দেখা যাক আর কিছু দিন। রাজা বলে কথা। শর্ত খেলাপ করবে না নিশ্চয়। মান-সম্মানের ব্যাপার আছে যে। 
কিন্তু হাঁস ভালো করে জানেই না, দেশের রাজাটি কেমন লোক। ভারি দুষ্টু। কারও থেকে হয়তো কিছু নিল। সময়ে ফেরত দেওয়া তো বহু দূরের কথা। দেওয়ার নামটাও করবে না আর।

হাঁসের থেকে এই টাকা ধার নেওয়ার কথাটাই ধরা যাক। কড়ার মতো, এক বছর পূর্ণ হলেই টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা। রাজার সাড়া-শব্দ নাই। 
মন্ত্রীমশাই আছে একজন রাজার। বুড়ো মানুষ। স্বভাবটি বেশ ভালো। একবার মনে করিয়ে দিল রাজাকে—হাঁসের টাকা ফেরতের সময় হয়ে গেছে, রাজামশাই। 
রাজার এক কথা-- ও তোমাকে ভাবতে হবে না।
দেখতে আরও এক বছর পার হোল। মন্ত্রী আবার মনে করিয়ে দিল রাজাকে। রাজাও একই কথা বলে চুপ করিয়ে দিল তাকে।
এইভাবে আর দিন নয়, বছর গড়াতে লাগল। তিন গেল, চার গেল। দেখতে দেখতে পাঁচ বছরও গড়িয়ে গেল যখন, মন্ত্রী বলল—রাজামশাই, পাঁচ বছরও কেটে গেল যে!
এবার রাজা সাথে সাথে কিছু বলল না—শুধু কটমটিয়ে চাইল মন্ত্রীর দিকে। মিষ্টি করে জানতে চাইল—তোমার বুঝি রাজবাড়ির অন্ন আর মুখে রুচছে না? না কি, নিজের মুণ্ডটার উপরেও দরদ নাই? 
ঠিক যেন সাপের ছোবল খেয়েছে, কোন রকমে সরে পড়ল মন্ত্রী। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তার।
এদিকে হাঁস ভাবল—অনেক হয়েছে, আর নয়। টাকা আমার ফেরত চাই-ই চাই। একটা থলে ঘাড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাজার বাড়ি। মুখে ছড়া কাটতে লাগল-- এবার রাজার বাড়ি যাই। টাকা কিন্তু ফেরত চাই।। 
পাড়ার সবাই হাঁ করে দেখতে লাগল হাঁসকে। 

পাড়া ছাড়িয়েছে সবে, একটা বাড়ির দেওয়ালে সিঁড়ি লাগানো ছিল। সিঁড়িটা বলল—ব্যাপার কীগো? হনহনিয়ে চললে কোথায়? 
--আর বলো কেন? এক বছরের কড়ারে নিয়েছে, পাঁচ বছর কেটে গেল। টাকা ফেরত দেওয়ার নামটি নাই রাজার। আদায়ে বেরিয়েছি। হাঁস বলল বটে, দাঁড়াল না। 
সিঁড়ি বলল— বলো কীগো? অবাক কাণ্ড যে। রাজার বাড়ি যাচ্ছো! তা-ও আবার বকেয়া আদায়ে! তা, আমাকে সঙ্গে নেবে?
--নেব না কেন? যদিও ভীড় বাড়ানো ভালো নয়। তবুও, বলছ যখন, চলো তাহলে। প্যাঁক-প্যাঁক করতে লাগল-- সঙ্গী হলেই সই। ঝোলায় রইল মই।।
মইটাকে পিঠের ঝোলায় ঢুকিয়ে চলতে লাগল হাঁস। প্যাঁকপেঁকিয়ে বলতে লাগল— রাজার বাড়ি যাই। টাকা আমার চাই।।
চলতে চলতে গাঁয়ের সীমা শেষ হোল। এবার সামনে পড়ল একটা নদী। নদী বলল—চললে কোথায় সাত সকালে? 
হাঁস বলল—রাজার বাড়ি যাচ্ছি। কবেই সময় পেরিয়ে গেছে। ধার নিয়েও, টাকা ফেরত দেয়নি রাজা। আদায়ে যাচ্ছি। 
শুনে, নদী তো আঁতকে উঠল—অবাক কাণ্ড! সাহস তো কম নয় তোমার। রাজার কাছে টাকা উশুল করতে চলেছ? তা, বলছিলাম কী, আমাকে সঙ্গে নেবে তোমার? 
হাঁসের একই কথা—কারুরই বেশি বন্ধু থাকা ভালো কথা নয়। তা চাইছো যখন, চলো তাহলে।

নদীকেও থলেতে পুরে ফেলল হাঁস। প্যাঁকপ্যাঁক করে বলে চলল— নিজেই বলল যদি। সঙ্গে থাকুক নদী।।
চলতে চলতে একটা বটগাছের তলা দিয়ে যাচ্ছে। গাছের ডালে একটা মৌচাক। সে মাথার উপর থেকে বলল—ঝোলা পিঠে ফেলে কোথায় চলেছ, ভাই?
কে কথা কয়? গলা উঁচিয়ে মৌচাককে দেখল হাঁস। বলল—পাঁচ বছর হয়ে গেল, ধার শোধ করেনি রাজা। এক বছরের কড়ারে নিয়েছিল। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। তাই তো আদায়ে চলেছি। 
আবার প্যাঁকপ্যাঁক-- রাজার কাছে যাই। টাকা আমার চাই।
--কী মারাত্মক কথা! চেনো না তুমি দেশের রাজাকে? একেবারে পাষণ্ড যাকে বলে। প্রাণের ভয় নাই তোমার?
হাঁস বলল—ভয় কীসের? টাকা নিয়েছে, ফেরত দেবে। এর  বেশি আর কীসের কথা?
মৌচাক বলল—বলিহারী যাই তোমার সাহসকে। তা আমাকে সঙ্গে নেবে তোমার? 
--কেন নেব না? অবশ্য, বন্ধু সংখ্যায় বেশি হওয়া ভালো কথা নয়। তবুও চলো সঙ্গে। 
প্যাঁকপ্যাঁক করে  বলতে লাগল—বলছে যখন যাক। থলেয় এবার মৌচাক।। 
বলতে বলতে মৌচাকটাকে থলেয় ভরে ফেলে, আবার শুরু হল হাঁসের পথ চলা। মুখে সেই কথা—যায় না চুপ থাকা। উশুল করব টাকা।
চলতে চলতে রাজধানিতে এসে পৌঁছল হাঁস। আরও খানিক এগিয়ে রাজবাড়ির সদর দেউড়ি। জনা কয়েক সেপাই-শান্ত্রী সেখানে পাহারায়।
হাঁস বলল—রাজামশাইকে খবর দাও গিয়ে। বলবে, হংসরাজ এসেছে টাকা ফেরত নিতে। 
রাজামশাই যে হাঁসের কাছে টাকা ধার করেছে, দেশ শুদ্ধ সবাই জেনে গেছে কথাটা। সে টাকা সোধ দেবার নামটিও করে না রাজামশাই, উলটে মন্ত্রীর মাথা কাটবার ধমক দিয়েছে, সে কথাও জানে রাজবাড়ির সবাই। 

ভয়ে সেপাইরা দোনামনা করতে লাগল। হাঁস বলল—চটজলদি করো। অনেক দূরের পথ। হাতে সময় নিয়ে ফিরতে হবে আমাকে। 
কী আর করে? অগত্যা একজন সেপাই চলল ভেতরে। দরবারে ঢোকার হুকুম নাই তার। সে গিয়ে ভেতরের সেপাইকে জানাল কথাটা—তুমি রাজামশাইকে বলো গিয়ে। আমি চললাম। 

ভেতরের সেপাই বেচারার প্রাণ ধুকপুক। কোন রকমে গিয়ে, কানে কানে জানাল মন্ত্রীকে। 
হাঁস যে একদিন এসে হাজির হবে, মনে মনে জানত মন্ত্রী। কিন্তু কথাটা তাকেই বলতে হবে রাজাকে, ভাবতেই বুক ধড়ফড় বুড়ো মানুষটার। ভেবে পেল না, কী করা যেতে পারে? 
কিছুই করতে হোল না কাউকে। যা করবার, রাজা নিজেই করল। আসলে হয়েছে কী, দেউড়ির সেপাই এসে কানে কানে কিছু বলে গেল দরবারের সেপাইকে। সে আবার এসে বলল মন্ত্রীকে। সবই চোখে পড়েছে রাজার।

মেঘের মত গুরু গম্ভীর গলায় রাজা জানতে চাইল—কীসের গুজুর-গুজুর হচ্ছে মন্ত্রী? ব্যাপারটা কী?
মন্ত্রী দেখল, নিজেকে বাঁচাবার এই সুযোগ। সে মুখ বেঁকিয়ে বলল— কী আস্পদ্দা হতভাগার! সেই হাঁসটা দরবারে এসে হাজির হয়েছে, টাকা ফেরত চাইতে! একটা হাঁসের এত সাহস? বিরক্তি ঝরে ঝরে পড়তে লাগল তার গলা থেকে।
--কী?! 
এই একটি কথাই বলল রাজা। তার ভয়াণক রাগী আর গমগমে গলায়, সারা দরবার ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। মন্ত্রী-সান্ত্রী, পাত্র-অপাত্র ভয়ে কুঁকড়ে গেল সবাই। রা-টিও বেরুল না কারও মুখ দিয়ে। আজ কার মাথা যে ধড় থেকে নামবে, তার নাই ঠিক। ভয়ে কুঁকড়ে গেল সবাই। 

একটু সময় গুম হয়ে রইল রাজাও। খানিক বাদে এক সেপাইকে ডাকল হাত নেড়ে। সে বেচারা কাঁপতে কাঁপতে দু’পা এগিয়েছে সবে, রাজা গমগমে গলায় বলে উঠল—দেউড়িতে যা। হতভাগাটাকে ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে, আমার হাত-মুখ ধোওয়ার চৌবাচ্চাটায় ফেলে দে। পচে পচে মরুক ওখানে। 

সারা দরবার নিথর হয়ে আছে। ধূপের ছাই খসে পড়লে, সে শব্দটিও শোনা যাবে হয়ত।
রাজার গমগমে গলা বেজে উঠল—কী মন্ত্রী, জবাবটা ঠিক দিলাম তো? 
মন্ত্রী তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত কচলাতে কচলাতে বলল—যেমন কর্ম, তেমন ফল। রাজার কাছে এসেছে মহাজনী ফলাতে। যেমনটি হবার, একেবারে ঠিক ঠিক তেমন ফলটিই পেয়েছে হতভাগা। মহারাজ, আপনি বরং …
--আমি কী করব, সে জ্ঞান তোমাকে দিতে হবে না। বুড়ো ইঁদুর কোথাকার। রাজা ধমকে উঠল-- তোমার জন্যই রাজ্যটার এই অবস্থা। ছোট বড় ভেদ মানে না কেউ। আর, আমিই যদি সব করব, তোমাকে খাওয়াচ্ছি কী করতে? 
দরবারে যখন এই সব চলছে, ততক্ষণে বাইরের কাজ সারা হয়ে গিয়েছে। সেপাই গিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে হাঁসটার মাথা। পাঁচিলের গায়ে একটা চৌবাচ্চা মত ছিল। তাতে ছুঁড়ে ফেলে দিল হাঁসকে। 

এক লহমায় ঘটে গেল ব্যাপারটা। হাঁসের কিছু আঁচ করে উঠবার আগেই।
চৌবাচ্চার ভিতরে পড়ে, একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে বেচারা। চারদিকে খাড়া দেওয়াল। খুব যে একটা উঁচু, তা কিন্তু নয়। কিন্তু খাড়া দেওয়াল বেয়ে হাঁস উঠবে কী করে? সে চেঁচাতে লাগল—বাঁচাও আমাকে। এখানে পড়ে পড়ে মরে যাব আমি। কে কোথায় আছো, বাঁচাও।
এমনিতেই হাঁসটা বিখ্যাত তার গলার জন্য। এখন তো মারা পড়বার ভয়ে প্রানভয়ে চেঁচাচ্ছে। চার দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে চেঁচানিটা। শুনছেও সবাই। কিন্তু এগোবে কে? একটার বেশি মাথা আছে কার ঘাড়ে? নিজের মাথা বাঁচাতে চায় না, এমন কেউ আছে না কি দুনিয়ায়? বিশেষত এই দুরাচারী রাজার রাজ্যে!

কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে পড়ে রইল হাঁসটা। নিজের পরিণতি ভালোই দেখতে পাচ্ছে সে। খানিক বাদে মাথার মধ্যে চিড়িক করে উঠল। ঝোলার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে গেল তার। 

অমনি হাঁস বলল—যা করবার, করো তাড়াআতাড়ি। ঝোলা ছেড়ে, বাইরে বেরোও সিঁড়ি।।
চোখের পলকটুকুও পড়ল না। সিঁড়ি বেরোল ঝোলা ঠেকে। তরতর করে মই বেয়ে উপরে উঠে এল হাঁস। 
এবার তার গলার স্বর গেল পালটে। বেশ দেমাকি গলায় বলতে লাগল—কে আছে এই দুনিয়ায়, হাঁসকে দেবে সাজা। টাকা বেড়েছে পাঁচ বছরে, ফেরত দেবে রাজা।।
রাজা অবাক হয়ে বলল—ব্যাপারটা কী? বাইরে এল করে হাঁসটা? ঠিক আছে, দ্যাখাচ্ছি মজা। মন্ত্রী, তুমি নিজে যাও। হতভাগাটাকে একটা বড় হাঁড়িতে ভরে, আগুনে বসিয়ে দাও। জ্বলে-পুড়ে মরুক ব্যাটা। 
মন্ত্রীর হুকুমে পেয়াদা ছুটল। শত শত লোকের রান্না হয় রাজবাড়িতে। কত রকমের সাজসরঞ্জাম, তৈজসপত্র। বড় দেখে একটা হাঁড়ি বয়ে আনা হোল রসুইখানা থেকে। হাঁসটাকে তাতে ভরে বসিয়ে দেওয়া হোল চুল্লিতে। 
হাঁস চেঁচাতে লাগল—বাঁচাও। কে কোথায় আছো? পুড়ে মরতে বসেছি। 

শুনল সবাই। রাজাও শুনল। ভারি পুলক হোল তার। অন্যরা শুনল। কিন্তু রাজার ভয়ে এগোল না কেউ। তখন হাঁসের মনে পড়ল নদীর কথা। বন্ধু হয়ে সেও এসেছে রাজবাড়িতে। 
এবার হাঁস বলতে লাগল-- আগুনে পুড়ে মারছে রাজা, প্রাণ বাঁচাবে যদি। দয়া করে ঝোলা ছেড়ে, বাইরে এসো নদী।
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হুড়মুড়িয়ে নদী বেরিয়ে এল ঝোলা থেকে। অমনি কোথায় আগুন, কোথায় কী! চার দিক জলে থইথই। 

হাঁস এবার দেমাক দেখিয়ে হাঁক পাড়ল—রাজার রেহাই নাই। টাকা আমার চাই।। 
রাজার কানে গেল কথাগুলো। অবাক হয়ে বলল—আরে, হোলটা কী? ব্যাটা বাঁচল কী করে? ঠিক আছে। যা করবার আমাকেই করতে হবে দেখছি। ভেতরে নিয়ে আয় হতভাগাকে। আমি ওর গতি করে দিচ্ছি। টুঁটি ছিঁড়ে দেব ছুঁচোটার। 
দরবারে আনা হচ্ছে হাঁসকে। এবার বুঝতে বাকী রইল না তার। আর রেহাই নাই। আজই জীবনের শেষ দিন। মরীয়া হয়ে চেঁচাতে লাগল সে—বাঁচাও তোমরা। এই নরাধম আজ মেরে ফেলবে আমাকে। সবারই মাথা নীচু। কেউ এগোল না। 

রাজার হাতে পড়বার আগে, মৌচাকের কথা মনে পড়ে গেল হাঁসের—মৌচাক ভাই, বন্ধু আমরা, এই কথাটা মনে রেখে। দেরী কোর না, চটজলদি বেরিয়ে এসো ঝোলা থেকে।।
অমনি দরবার জুড়ে ভীষণ একটা বোঁ-বোঁ আওয়াজ। কানে তালা ধরে যাওয়ার জোগাড়। শ’য়ে-শ’য়ে হাজারে-হাজারে মৌমাছি বেরিয়ে এল ঝোলা থেকে। চারদিক থেকে ছেঁকে ধরল রাজাকে। 

পাহাড়ি মৌমাছি সব। এক কামড়েই পরিত্রাহি অবস্থা হয় মানুষের। রাজার একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। কোন রকমে লাফিয়ে নামল সিংহাসন থেকে। তারপর আলুথালু হয়ে দৌড়। প্রথমে দরবারের বাইরে। তারপর সামনের রাস্তা ধরে, চোঁ-চোঁ দৌড়। লোকজন ভীড় করে দেখছে। দেশের রাজা দৌড়ে পালাচ্ছে। পেছন পেছন এক টুকরো কালো মেঘের মত তাড়া করে চলেছে এক পাল মৌমাছি। 

শেষ পর্যন্ত রাজার কী দশা হয়েছিল, কেউ না কি জানে না। সত্যি কথা বলছি, আমরাও জানি না। তাছাড়া জানবোই বা কী করে? আমরা তো সেদিন রাজার পেছনে দৌড়ইনি। আমরা রয়ে গিয়েছিলাম দেউড়ির সামনে। সেখানে তখন মহা সমারোহ যে!
রাজামশাই পালাবার পরেই, শত শত শাঁখ বেজে উঠল রাজবাড়ি জুড়ে। মেয়েরা উলু দিতে লাগল মহানন্দে। কাড়া-নাকাড়া বেজে উঠল। 

রাজার মালী কাজ করছিল বাগানে সে দৌড়ে এসেছে সেখান থেকে। বসসড় কয়েকটা মালা আর এক ঝুড়ি ফুল এনে ধরিয়ে দিয়েছে মন্ত্রীমশাইকে। তখন সে কী হাসি বুড়োমানুষটার মুখে। 
মন্ত্রী হাঁসকে বলল—আমাদের সবাইকে রেহাই দিয়েছ তুমি। প্রাণে বাঁচিয়েছ—একথাও বলা যেতে পারে। তুমি আমাদের রাজা হবে?
প্রশ্ন নয়, মন্ত্রীর গলায় তখন আসলে অনুনয়-বিনয়। সবাই হই-হই করে উঠল—হ্যাঁ। তুমিই আমাদের রাজা। 
হাঁস উত্তর দিল—ঠিক আছে, বলছো যখন, আমি রাজি। বন্ধু সংখ্যা যত বেশি হয়, ততই তো ভালো।  
এতদিনে ‘হংসরাজ’ নামটা সার্থক হোল হাঁসের। সত্যি সত্যিই আজ দেশেরও রাজা হয়েছে সে। 
আর মুখ পুড়ল তাদের, হাঁসকে টিটকিরি দিত যারা। সত্যি কথা হল, ছোট বলে কাউকে হেয় করতে নাই কখনও। কার কবে সুদিন আসে, কেউ বলতে পারে না।

আরও পড়ুন 
প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় 

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর। এই লৌকিক রূপকথা গুলি সমস্ত বিশ্ব জুড়ে দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে। এই রূপকগল্পে কিছু মোরাল থাকেই আর চরিত্রগুলো জল মাটি থেকে উঠে আসা। খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete