জ্বলদর্চি

বিজ্ঞান-সাধিকা ফিজিসিস্ট ড. মারিয়াতা ব্লা ― 'A Dark Star of Disintegration on Earth' /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪৩


বিজ্ঞান-সাধিকা ফিজিসিস্ট ড. মারিয়াতা ব্লা ― 'A Dark Star of Disintegration on Earth' 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


বিশ শতকের গোড়ার কথা। পরমাণুর সংসারে ভাঙন। ভেঙে গেছে দীর্ঘ সময়ের মিথ― 'পরমাণু অবিভাজ্য'। ভেঙে পড়ছে নিউক্লিয়াসের গোছানো সংসারও। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইলেকট্রন, ১৯১৯-এ প্রোটন আর ১৯৩২-এ নিউট্রন আবিষ্কার হয়েছে। একে একে যখন পরমাণু-নিউক্লিয়াসের সাজানো সংসার ভাঙছে, বিজ্ঞানীদের তখন দিশেহারা অবস্থা। নাজেহাল দশা। ভেঙে যাওয়ার আগে পরমাণুর ফ্যামিলিটা তাহলে কেমন ছিল? কীভাবে মৌলিক কণাগুলি তার মধ্যে একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকত? নিউক্লিয়াসের ভেতরের ছবি নিশ্চয়ই আরও রহস্যময়, অস্পষ্ট! তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা তো বলেই খালাস। ব্যবহারিক ল্যাবরেটরিতে হাতে কলমে প্রমাণ করার হাজারো ঝক্কি!

  নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের রহস্য বোঝা দায়! আসল যন্ত্রপাতি এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে পরমাণুর ভেতরকার প্রকৃত গঠন জানা সত্যিই দুষ্কর। তখন পণ্ডিতদের হাতের মুঠোয় অল্প কিছু যন্ত্র। সাকুল্যে দুটি কার্যকরী যন্ত্র― আহিত কণা শনাক্ত করার 'গাইগার কাউন্টার' (Geiger Counter)। আর, কণার যাতায়াতের পথ চিনবার 'উইলসন ক্লাউড চেম্বার' (Wilson Cloud Chamber)। ওই সব যন্ত্রের সঙ্গে একজন সফল পদার্থবিজ্ঞানী অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ল্যাবরেটরিতে পড়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাইক্রোস্কোপের লেন্সে চোখ রেখে নিরন্তর অপেক্ষা― তড়িদাহিত কণিকার সরু আলোকবর্তিকা কখন ধাক্কা মারে ফসফরাসেন্ট উপাদানে। যে-মূহুর্তে সংঘর্ষ বাধবে, উঠে আসবে একগুচ্ছ তথ্য। এদিকে, তথ্য রেকর্ড করার ব্যাপারে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর সাধ্য-ক্ষমতা ভীষণ কম। অথচ, এর চাইতে আরও উৎকৃষ্ট উপায় ছিল, কিন্তু কারও জানা নেই। কারণটা, সম্ভবত ফিজিক্স আর ফটোগ্রাফির মধ্যে যোগসাজশের তীব্র অভাব। এক্ষেত্রে সেতু স্থাপনের নেপথ্য কারিগর একজন মহিলা ফিজিসিস্ট। অস্ট্রিয়াজাত মারিয়াতা ব্লা। এ হেন রমণী সেদিন অসাধ্য সাধন ঘটিয়েছিলেন ফিজিক্স আর ফটোগ্রাফি'তে। 

  মারিয়াতা ব্লা'র জন্ম ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের উনত্রিশে এপ্রিল; ভিয়েনার এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে। বাবা মেয়ার মারকুস ব্লা কোর্টের উকিল। ওকালতি ছাড়াও নেশা মিউজিক প্রকাশনা। মা ফ্লোরেনটিন গোল্ডজুইগ। একটি গার্লস হাইস্কুলে ছোট্ট মারিয়াতা'র পড়াশুনায় হাতেখড়ি। হাইস্কুলটি চালায় মহিলাদের শিক্ষা সম্পর্কিত একটি সংগঠন। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান আর গণিতে তুখোড় জ্ঞানী সে। ১৯১৯ সালে, যখন তার বয়েস মাত্র চব্বিশ বছর, ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পেল। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়েই ডাইরেক্ট চাকুরিতে যোগদান। ইন্ডাস্ট্রিয়াল চাকুরী। স্বল্প সময়ের জন্য ইন্ডাস্ট্রি'তে হাত পাকিয়ে জার্মানি পাড়ি দিলেন মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের রেডিওলজি পড়াতে। ১৯২৩ সালে দেশে ফিরলেন। মা গুরুতর অসুস্থ। সেবা শুশ্রূষার দরকার। সেজন্যই তাঁর অস্ট্রিয়া ফেরা। ফিরে এসে অব্দি একেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থা তাঁর। হাত প্রায় খালি। পকেট শূন্য। রোজগারপাতি নেই বললেই চলে। যৎসামান্য পারিবারিক অর্থের জোগান, সাময়িক অনুদান আর পরামর্শ দাতা হিসাবে প্রাপ্ত টাকাকড়িই সম্বল তাঁর। এদিকে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন― ভিয়েনায় থেকে কাজ করবেন। ভিয়েনার রেডিয়াম ইন্সট্যুট-এ বিনা বেতনে কাজে যোগ দিলেন তিনি। বিশেষ ভাবে তৈরি ফটোগ্রাফিক ইমালসন কীভাবে ফিল্মের উপর ছড়িয়ে পড়ে এবং গতীয় সাব-অ্যাটমিক কণাসমূহের পথের তথ্য ও নথিপত্র কীভাবে ফটোগ্রাফিক প্লেটে আবদ্ধ করা যায়― এ বিষয়ে তাঁর ক্ষুরধার গবেষণা চলতে থাকে। ইমালসন হল পদার্থের একপ্রকার না-তরল, না-কঠিন দশা। একবিংশ শতাব্দীর আগে, যত দিন পর্যন্ত না মাইক্রো-চিপ বানিজ্যিকভাবে বাজারে ছেয়ে গেল, ফটোগ্রাফি ছিল দারুণ চর্চার বিষয়। ফটোগ্রাফিক প্লেট, চলতি বাংলায় যা ক্যামেরার 'রিল' নামে বেশি পরিচিত, তৈরি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মুনাফা লুটল কোম্পানিগুলো। এ হেন ফটোগ্রাফিক প্লেট তৈরি করা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। নিঁখুত সূক্ষ্ম হাতের কেরামতি। কাঁচ কিংবা প্লাস্টিকের খুব পাতলা পাতের উপর সাবধানে রাসায়নিক উপাদান ইমালসন-এর আস্তরণ দেওয়া ছিল পাকা হাতের কাজ। এভাবে তৈরি প্লেটের রাসায়নিক উপাদানের উপর আলো পড়লে চকিতে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। বিক্রিয়ায় তিন মাত্রার বস্তুর দ্বি-মাত্রিক ছবি ধরা থাকে ফটোগ্রাফিক প্লেটের কোণায় কোণায়। তা, এমন প্লেট কী কাজে লাগে? ল্যাবরেটরিতে এর ব্যবহার কেমন?
      
 সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম কণিকা― যেমন প্রোটন কণা, যা খালি চোখে অদৃশ্য, তার উপস্থিতি টের পাওয়ার আশায় ফটোগ্রাফিক প্লেটের উদ্ভাবন। সম্ভাব্য যে পথ বরাবর প্রোটনের যাতায়াত, সে-পথে আড়াআড়িভাবে ফটোগ্রাফিক প্লেট তুলে ধরা হয়। প্লেটে বিক্রিয়ার মাত্রা দেখে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা যাচাই করে আহিত কণার ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানা যায়। ঠিক যেমন, ঊর্ধ্বাকাশে দ্রুতগামী জেট প্লেন ক্ষণিকের মধ্যে পর্যবেক্ষকের দৃশ্যমান পথ থেকে অন্তর্লীন হয়ে গেলে তার অস্তিত্ব বুঝব কীভাবে? নীল আকাশে প্লেন থেকে নির্গত ঘন সাদা পুঞ্জীভূত বাষ্পের সারি দেখে। তা, আহিত কণার শনাক্তকরণ করতে তেমন-ই একটি শক্তিশালী প্লেট তৈরির নেশা পেয়ে বসল কুমারী ব্লা'কে। কণিকার ওজন, গতি আর আধান বিভিন্ন মাত্রায় প্লেটের ইমালসনের মাইক্রোস্কোপিক দানাগুলোকে প্রভাবিত করে তোলে। ফলে প্লেটে বিভিন্ন প্রকার পথের উজ্জ্বল ছায়া পড়ে। 

  রেডিয়াম ইন্সট্যুট-এ নিউক্লিয়ার ইমালসন ফিল্ম তৈরির লক্ষ্যে তাঁর কাজ শুরু হল। হাতে-নাতে মিলল সাফল্য। ফিল্মের রকম-ফের, রাসায়নিক সূত্রাবলি আর আলাদা আলাদা ডেভলপমেন্ট প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেন তিনি। তাঁর তৈরি ফিল্ম কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ ফিজিসিস্ট আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও অন্যান্য পণ্ডিতগণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ফলাফল পেল। আগফা আর আইফোর্ড-এর মতো ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে জুড়ে কাজও শুরু করলেন মিস মারিয়াতা। তাঁর হাত ধরে উঠে এল নিত্য নূতন উন্নত টেকনিক। 

  ইতিমধ্যে, ১৯১২ সালের ৭ আগস্ট বিশ্বের এক ভয়ংকর সমস্যার কথা জানা গেছে। বহির্জগৎ থেকে একধরনের শক্তিশালী কণিকা অনবরত পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। সে-কণা একবার ভূপৃষ্ঠে পৌঁছলে তছনছ করে দেবে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব। অদ্ভুতুড়ে সে-কণার স্রোত যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অহর্নিশ ধাক্কা মারছিল, এতদিনে তার সন্ধান জানা গেছে বৈজ্ঞানিক ভিক্টর হেস-এর গবেষণায়। বৈজ্ঞানিক হেস-এর কথায়, অতীব শক্তিশালী সে-কণার স্রোত আসলে 'কসমিক রশ্মি'। মহাজাগতিক রশ্মি। মেরু অঞ্চলে যে মেরু-জ্যোতি দেখা যায়, তার কারণ এই কসমিক রশ্মি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আয়নমণ্ডল তৈরির জন্যও দায়ী সে। নামে রশ্মি হলেও এটি মূলত উচ্চ শক্তির প্রোটন কণা (৯২%)-র স্রোত। প্রোটন বাদে ৭% হিলিয়াম ও ১% ভারী মৌলের পরমাণু দিয়ে তৈরি। এ হেন কণাকে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছনো থেকে বিরত রাখে পৃথিবীর চুম্বকত্ব। কসমিক রশ্মির আবিষ্কারে বিশ্বে শোরগোল পড়ে যায়। তিরিশের দশকে কসমিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা ব্যাপক হারে বাড়ে। দিনকে দিন নিত্য নতুন কণা আবিষ্কার হয়। মিস মারিয়াতা ব্লা'র আবিষ্কৃত নিউক্লিয়ার ইমালসন টেকনিক এ হেন কণিকা শনাক্তকরণে দারুণ কাজে দেয়। এতেই থেমে না থেকে মিস ব্লা মহাজাগতিক রশ্মির নতুন গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠল পারটিক্যাল ফিজিক্স। বিজ্ঞানের এই শাখায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অবশ্য কসমিক পারটিক্যাল গবেষণায় বিস্তর অসুবিধা।
     

  প্রথম যে সমস্যা দেখা গেল তা এইরূপ― পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কসমিক পারটিক্যালগুলো বিক্ষিপ্তভাবে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে আর যত পৃথিবীপৃষ্ঠ অভিমুখে অগ্রসর হয়, তত তাদের তীব্রতা দ্রুতহারে কমতে থাকে। ফলে ভূপৃষ্ঠে উচ্চ শক্তির কসমিক পারটিক্যাল সচরাচর দেখা যায় না। সেজন্য তাদের ডিটেক্ট করা প্রায় অসম্ভব। শনাক্ত করতে গেলে হাই-অলটিচিউড-এ যেতে হয়। তার জন্য আদর্শ জায়গা পাহাড় চূড়া আর গ্যাসভর্তি বেলুন। ১৯৩২ সালের শুরুতে মিস ব্লা এবং তাঁর প্রধান সহকারী হার্থা ওয়েমবচার অস্ট্রিয়ার ইনসবার্গের কাছে পাহাড়ে ছুটলেন‌। এই পাহাড়ে রয়েছে হেস হাফেলেকার অবজারভেটরি। সমুদ্র তল থেকে ৭৫০০ ফুট উঁচুতে অবজারভেটরি সেন্টার। সেখানেই দারুণ সব রেজাল্ট লক্ষ্য করলেন তাঁরা দুজনে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রচুর কসমিক পারটিক্যাল ― মূলত প্রোটন কণা-র ট্র্যাক পরিলক্ষিত হল। ১৯৩৭ সালে এল নজর কাড়া সাফল্য। এক বিশেষ ধরনের রেডিয়েশন শনাক্ত করে খোঁজ মিলল এক নতুন তারা'র সন্ধান। নাম দিলেন 'ডিসইন্টিগ্রেশন স্টারস' (Disintegration Stars)। যার আশায় পণ্ডিতরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন, অবশেষে মিস ব্লা এবং তাঁর সহকারীর চেষ্টায় তার হদিস মিলল। ডিসইন্টিগ্রেশন স্টারস কী? সিলভার কিংবা ব্রোমিনের মতো ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙনে উৎপন্ন অবিশ্বাস্য বিকিরণ। এক্ষেত্রে কসমিক রশ্মির মধ্যে প্রভূত শক্তি (গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)-সম্পন্ন যে প্রোটন কণিকা বর্তমান, তার সরাসরি আঘাতে ভারী নিউক্লিয়াসের ফর্দাফাই অবস্থা। ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তাঁদের এই আবিষ্কার পারটিক্যাল ফিজিক্সের নতুন ফিল্ডের পথ প্রসস্থ করল। এ সময় প্রিয় বৈজ্ঞানিকের সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার কেবল উড়ানের অপেক্ষায় দিনক্ষণ গণনায় ব্যস্ত। গ্যাস বেলুন দিয়ে আর বিভিন্ন পর্বতশৃঙ্গে গবেষণার প্রস্তুতি চালাচ্ছেন তিনি। ঠিক সেই সময় তাঁর সাফল্যের বিমান মাটিতে আছড়ে পড়ে। কারণ বহুবিধ। নাৎসি জার্মানির উত্থান সরাসরি ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পথ অবরুদ্ধ করল। আরও বড় দুটো কারণ রয়েছে। তাঁর সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে। প্রথমত, টাকাপয়সার অভাব। যথেষ্ট পরিমাণ ফান্ড জোগাড়ের চিরকালীন অপ্রতুলতা একটা বড় কারণ। রেডিয়াম ইন্সট্যুট-এ থাকাকালীন গবেষণার এত গভীরে ডুবে থাকতেন সারাদিন যে অনুদান জোগাড় করার প্রয়োজনীয়তা কখনও মনে হয়নি। আজ যখন নিজভূমি থেকে উৎখাতের সময় সমাগত; অর্থ-ই মস্ত বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠল তাঁর কাছে। দ্বিতীয় সমস্যা আরও মারাত্মক। রেডিয়াম ইন্সট্যুট-এ তাঁর স্থায়ী একাডেমিক পদ ছিল না। এতদিন অবৈতনিক অস্থায়ী পদে রিসার্চ করে গেছেন। যে সময় হিটলারের জার্মানি অস্ট্রিয়া দখল করে ১৯৩৮-এ, রেডিয়াম ইন্সট্যুট-এ তাঁর থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ে। যদিও সমস্যা আরও গভীরে গ্রথিত। এসময় বারেবারে তিনি যখন কর্তৃপক্ষকে নিজের প্রোমোশনের আর্জি জানান, তাঁকে বার বার একটাই বাক্য হজম করতে হয়―
'একে মহিলা, তায় আবার ইহুদি! এটাই যথেষ্ট বিরক্তিকর!'

  শুধু অপমান করে ক্ষান্ত থাকল না অস্ট্রিয়াজাত নাৎসি মনোভাবাপন্ন কর্তৃপক্ষ। তারা আরও বড়সড় ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লাগল। তাঁর সমস্ত কাজ ও কৃতিত্ব তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলার চক্রান্ত করা হল। কুমারী ব্লা নিয়তির ইশারা বুঝে গেলেন। অর্থাৎ তাঁর দেশত্যাগের সময় হয়েছে। নাৎসি অত্যাচারে ভীত দেশীয় বৈজ্ঞানিকগণ প্রমাদ গুনল। তারাও সবাই পিছিয়ে গেল। দেশের দরজা, তাঁর জন্য, আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। এসময় দেশের বাইরে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কতিপয় বন্ধু এগিয়ে আসে সাহায্যের বাসনা নিয়ে। অসলো ইউনিভার্সিটির জনৈক কেমিসিস্ট অসলোতে আমন্ত্রণ জানান তাঁকে। ওদিকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন ডেকে পাঠালেন আমেরিকায়। যাবেন কোথায়? শেষমেশ, বর্ষীয়ান তাত্ত্বিক ফিজিসিস্টের আহ্বানে সাড়া দেওয়া যৌক্তিক মনে হল তাঁর। তবে ইউ. এস. এ.'তে মিলল না চাকুরী। মেক্সিকো সিটি'তে একটি স্থায়ী কাজের বন্দোবস্ত করতে সমর্থ হলেন আইনস্টাইন। ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে মেক্সিকো রওনা হলেন কুমারী মারিয়াতা এবং তাঁর মা। সেখানকার ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইন্সট্যুট-এ কাজে যোগ দিলেন। সে-বসন্তে অস্ট্রিয়া দখল করে জার্মানি। চিঠিতে এক বন্ধুকে তিনি লিখলেন― 'আমি সম্ভবত ভাগ্যবতী শেষ অস্ট্রিয়ান নাগরিক যে জার্মান বর্ডার অতিক্রম করতে সমর্থ হয়।'
     
  মেক্সিকো'তে সব আছে, তবুও যেন কিছু নেই। কিছুতেই মন বসছে না। কি পেশাগত, কিংবা ব্যক্তিগত― দেশের মতো টান-অনুভূতি কিছুই নেই। গোদের উপর বিষফোঁড়া― ফিনান্সিয়াল আর সায়েন্টিফিক উপাদানের বড্ড আকাল মেক্সিকো'তে। সংকট এতটাই প্রকট যে রিসার্চ চালু রাখা দায়। অগত্যা, স্নাতক স্তরে ফিজিক্স পড়িয়ে এবং কিছু রুটিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজ করে গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছে। অন্যদিকে, তাঁর রিসার্চের উপর ভিত্তি করে অস্ট্রিয়ায় তাঁর এককালের সহকর্মী ওয়েমবচার ও অন্যান্য নাৎসি কলিগরা নিয়মিত দারুণ সব কাজ করে যাচ্ছেন। আর তিনি, মিস মারিয়াতা দূর থেকে নীরবে সব প্রত্যক্ষ করছেন। মেক্সিকোয় তাঁর সমস্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এখানে তাঁর থাকা, না-থাকা দুই-ই সমান। মনস্থির করলেন আমেরিকা পাড়ি দেবেন। ১৯৪৪ সালে আমেরিকা পৌঁছলেন তিনি। নিউইয়র্কে বিভিন্ন কোম্পানির ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করলেন। অল্প সময়ের জন্য উইলকিনসন শহরে বাস করেছিলেন। তারপর পুনরায় ১৯৪৮ সালে নিউইয়র্ক শহর-ই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। এখানকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক পদে যোগ দিলেন। দু'বছর ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি'র পরমাণু শক্তি কমিশনে অন্তর্ভুক্ত হলেন। দীর্ঘ টালবাহানার শেষে তিনি আপাতত গবেষণার জগতে ফিরলেন। বেশ একটু তাঁর স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। এখানে তাঁর ফটোগ্রাফিক মেথড কাজে লাগিয়ে সাইক্লোট্রন আর বিভিন্ন পারটিক্যাল অ্যাক্সিলেটরে নিজের যোগ্যতার দৃঢ় স্বাক্ষর রাখলেন তিনি।

  সময়টা ১৯৫০ সাল। অস্ট্রিয়াজাত নোবেল ফিজিসিস্ট ড. আরউইন শ্রোডিংগার সেবছর ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কারের জন্য ড. মারিয়াতা ব্লা ও তাঁর সহকর্মী ওয়েমবচার-এর নাম প্রস্তাব করলেন নোবেল কমিটির কাছে। বিশেষত কসমিক রশ্মি ও নিউক্লিয়ার ইমালসন টেকনিক উন্নতিকরণে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি হিসাবে। কিন্তু, নাহ! তিনি পেলেন না নোবেল প্রাইজ। বদলে তাঁর কাজের উপর ভর করে গবেষণা চালানো ব্রিটিশ সায়েন্টিস্ট সেসিল এফ. পাওয়েল নোবেল পুরস্কার জিতলেন। সন্দেহ জাগে― কেন মারিয়াতা ব্লা'কে নোবেল দেওয়া হল না? দীর্ঘদিন গবেষণা থেকে বিরত থাকাই কি এর কারণ? না-কি, অন্য কিছু! প্রিয় পাঠক, বিচার করুন। নোবেল কমিটি কুমারী মারিয়াতা'র দীর্ঘ কাল গবেষণা না-করার দুঃখ, ভেতরের অস্থিরতা-ছটপটানি ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির করুণ অবস্থা বুঝল না! তাঁর কঠোর শ্রম, ইহুদি মহিলা হিসাবে হাজারটা বাধার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে লড়াই, তাঁর উদ্ভাবনী দক্ষতা, অস্ট্রিয়ায় রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হওয়ার রোমহর্ষক কাহিনী যেমন মুছে ফেলা যাবে না, তেমনই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না বিজ্ঞানে তাঁর অবদান। 
      
  
  দেশ ছাড়ার বাইশ বছর পর, ১৯৬০ সালে, ভিয়েনায় পা রাখলেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে উন্নত দেশ গড়ার খেলা। কিন্তু মানসিকতার বদল হয়নি একফোঁটা। না-হলে তাঁকে আবার বিনা বেতনের চাকুরী নিতে হয় পুরনো প্রতিষ্ঠান― রেডিয়াম ইন্সট্যুট-এ! চেয়ে চিন্তে সংসার চলে! সম্বল বলতে আমেরিকায় কাজের পেনসন আর জ্ঞাতি মানুষজনের আর্থিক সহযোগিতা। আর্থিকভাবে তিনি এতটাই দুর্বল ছিলেন যে, ন্যূনতম একটা স্বাস্থ্য বিমা করার মতো বিলাসিতা তিনি দেখাতে পারেননি। স্বদেশী বৈজ্ঞানিক শ্রোডিংগার পুনরায় তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করলেন। রেজাল্ট পূর্বের ন্যায়― 'Rejected'। 

  ১৯৬৪ সালে সার্ন (SERN)-এর ল্যাবরেটরিতে পারটিক্যাল-ট্র্যাকের ফটোগ্রাফ সংক্রান্ত তথ্য-বিশ্লেষণ বিভাগের প্রধান পদ অলংকৃত করেন তিনি। ইতিপূর্বে, ১৯৬২ সালে অস্ট্রিয়ার একাডেমি অফ সায়েন্স থেকে 'আরউইন শ্রোডিংগার প্রাইজ' সম্মানে পুরস্কৃত হন।

  মাথার মধ্যে হাজার একটা চাপ। চাপ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? ধূমপান। হ্যাঁ, নিয়মিত ভারী ধূমপান করতেন তিনি। এর সঙ্গে জুড়ল শক্তিশালী বিকিরণ উৎসের সংস্পর্শে নিরন্তর গবেষণায় এঁটে থাকা। অবধারিত ফল শরীরে দানা বাঁধল মারণ রোগ ক্যানসার। এর সঙ্গে জুড়ল হার্টের অসুখ। এ দুয়ের জোড়া ফলায় বিধ্বস্ত তিনি, মারিয়াতা ব্লা। ১৯৭০ সালের ২৭ জানুয়ারি চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন। তাঁর মহানিস্ক্রমণের সময়েও ওয়ার্ল্ড সায়েন্টিফিক কম্যুনিটি নিরুত্তর রইল অদ্ভুতভাবে। মৃত্যুর পরে সিমি রুথ লিউইন-এর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি―
'Her brief shot at glory and scientific immortality gone, an aging Blau spent the rest of her life in the shadows, steadily declining in health and energy'।

  তথ্যসূত্র :
●Timeline of Women in Science
●Marietta Blau ― History of Scientific Women
●The Dark Stars of Marietta Blau ― Science History Institute
●Marietta Blau in the History of Cosmic Ray ― Sime Ruth Mesin, Physics Today (2012)
●উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 


Post a Comment

0 Comments