জ্বলদর্চি

শিক্ষায় দায়িত্ব এড়ানো ও ছাত্র স্বার্থ/সজল কুমার মাইতি

শিক্ষায় দায়িত্ব এড়ানো ও ছাত্র স্বার্থ

সজল কুমার মাইতি

গত ১৬ ই নভেম্বর, ২০২১ আমাদের রাজ্যে সব স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে অফলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। রাজ্য সরকারের শিক্ষা বিভাগের এক নির্দেশনামার বলে এই ক্লাস শুরু হয়েছে। অফলাইন ক্লাস অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা তাদের নিজের নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে  আগের মতো ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করা সুযোগ পাচ্ছে। ক্লাস ও করছে। শিক্ষকরা আগের মতো 'চক টক' এর মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন। মুখ না দেখে পড়ানোর অবশেষে অবসান হল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাকলিতে ভরে উঠেছে। 

  যতই আগের মতো বলিনা কেন, আসলে আগের থেকে অনেকটাই দূরে। অফলাইন ক্লাস হচ্ছে, ' চক টক ' ও হচ্ছে। কিন্তু, ছাত্র ছাত্রীরা মাস্ক পরিহিত। শিক্ষক ও মাস্ক পরে আছেন। সেই অবস্থায় শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চলছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়াস চলছে। ছাত্র শিক্ষক উভয়ই আপাত খুশি। তবে কতদিন এই ব্যবস্থা চলবে বলা কঠিন। 

  রাজ্য সরকারের শিক্ষা বিভাগের নির্দেশিকায় ১৬ ই নভেম্বর অফলাইন ক্লাস শুরুর কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমন কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হয়েছে। এমনকি ছাত্র অসুস্থ বোধ করলে প্রাথমিকভাবে তার আইসোলেশনের ব্যবস্থার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট জায়গা না থাকলে নিকটবর্তী হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ। তাও বাধ্যতামূলক। ক্লাসরুম, টয়লেট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ নিত্যদিন স্যানিটাইজেশন করা ও পরিষ্কার রাখা অবশ্যকরণীয়। ছাত্র সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কোভিড বিধি সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তার নজরদারি। এইসব কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবশ্যকরণীয়। শিক্ষা বিভাগ নির্দেশিকা দিয়ে নিজ দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। পালনের দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব। বহুদিন  স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ক্লাসরুম, বেঞ্চ, চেয়ার ও ক্যাম্পাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে নিত্যদিন। এবং তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজের দায়িত্ব। খরচ ও তাদের নিজস্ব উৎস থেকে জোগাড় করতে হবে। সরকারি সাহায্য কিছু নেই। স্কুলের ক্ষেত্রে কিছু আর্থিক সাহায্য মিললে ও তা পর্যাপ্ত নয়। এবং এই সাহায্য যথেষ্ট আগে না আসায় মেরামতির কাজ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় নি, সম্ভব ও নয়।

  স্কুলের ক্ষেত্রে ক্লাস কিভাবে হবে তার একটি নির্দেশিকা বেরুলে ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কোনও নির্দেশকা বের হয় নি। এও দায়িত্ব এড়ানোর এক নজির। শুধু সরকার তার দায়িত্ব এড়িয়েছে বললে ঠিক বলা হবে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ও নিজ নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। কোনো একক নির্দেশিকার অভাবে কলেজগুলির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হতে দেখা যাচ্ছে। এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে ও ভিন্ন ভিন্ন নীতি অনুসৃত হতে দেখা যাচ্ছে। এও আদৌ কাম্য ছিল না। দায়িত্ব এড়ানোর এই খেলায় একই বা একধরনের নীতির অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরফলে সবচেয়ে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ছাত্র স্বার্থ। কিছু কিছু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা মিশ্র পদ্ধতিতে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ কিছু সেমিস্টারের ক্লাস অফলাইনে হচ্ছে। বাকিদের অনলাইনে হচ্ছে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে অপ্রয়োজনীয় ভিড় এড়ানো কিছুটা হলেও সম্ভব হচ্ছে। আবার যাদের অফলাইনে অর্থাৎ ক্যাম্পাসে ক্লাস হচ্ছে তাদের প্রত্যেকদিন ক্লাস হচ্ছে না। সপ্তাহে হয়তো দুদিন অফলাইনে ক্লাস হচ্ছে, বাকি দিনগুলিতে অনলাইনে হচ্ছে। সপ্তাহের অন্যদিনগুলিতে বাকি সেমিস্টারের অফলাইন ক্লাস হচ্ছে, অন্যদের অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। 

  এইভাবে পালা করে নিউনর্ম্যাল থেকে নর্মালে বা স্বাভাবিক প্রথাগত ব্যবস্থায় ফেরার এক প্রয়াস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চালিয়ে যাচ্ছে বা যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই মিশ্র পদ্ধতিতে অনলাইন ও অফলাইন ক্লাস যে নিয়মিতভাবে হতে পারছে তা নিশ্চিতরূপে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তার মূল কারণ, অনেক শিক্ষককে বহুদূর থেকে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস করে পরেরদিন আবার অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হয়তো সবক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। এতদিন পরে যাতায়াতের অনভ্যাস ও অতিমারির জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা। তার জন্য বাড়ি ফিরে শারীরিকভাবে পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনে নিয়মিত একাধিকবার স্নান বা অনুরূপ ব্যবস্থার জন্য শারীরিক অসুস্থতা নিয়মিত ক্লাসের পথে অনেক সময় বাধার সৃষ্টি করছে। এছাড়া, কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেবল অফলাইন ক্লাস চালু করেছে। সেইসব ক্ষেত্রে কোনরূপ অনলাইন ক্লাস হচ্ছে না। কারণ, শিক্ষকেরা সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে এসে ক্লাস নেওয়ার কারনেই তাদের পক্ষে আলাদাভাবে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সপ্তাহে দুদিন করে একটি সেমিস্টার অফলাইন ক্লাস করার ফলে বাকিদিনগুলিতে এইসব সেমিস্টারের কোন ক্লাস হচ্ছে না। সেটা ও এক সমস্যার সৃষ্টি করছে। এইভাবে কি করে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব তা কারুর জানা নেই। 

  আর যেহেতু শিক্ষকেরা নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে ক্লাস নিচ্ছেন, তাদের বাড়ি ফিরে আবার অনলাইন ক্লাস নেওয়ার কথা ও বলা যাচ্ছে না। এরফলে, একইসময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে শিক্ষাদান পদ্ধতিতে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একনীতি প্রয়োগ করা সম্ভব হতো যদি ইউনিভার্সিটিগুলি একত্রে বসে এক অভিন্ন নীতিমালা বা নির্দেশিকা চালু করতো। অথবা, সরকার বা শিক্ষা বিভাগ এক অভিন্ন নির্দেশিকা প্রকাশ করতো। শিক্ষাদানে একটি সামঞ্জস্য বা সমতার নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব হতো। দায়িত্ব এড়ানোর এই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হল ছাত্র স্বার্থ। তার ওপর শিক্ষাদানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে এই বিভিন্নতা একান্তই কাম্য নয়। প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র কোন পক্ষের ক্ষেত্রে এটি শুভ নয়, এথেকে শিক্ষার উন্নয়নমূলক কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয় না। এ যেন ' ধরি মাছ না ছুঁই পানি ' গোছের। অর্থাৎ সরকারি নির্দেশকার পালন ও হলো অফলাইন ক্লাসের মাধ্যমে, অথচ সম্পূর্ণ শিক্ষাদান, সিলেবাসের সম্পূর্ণ কভারেজের দায়িত্ব এড়ানো সবই হল। হয়তো সবপক্ষই এতে খুশি। ক্ষতি যদি কারুর হয় তা শিক্ষার ও ছাত্রের। এই অসম্পূর্ণ সিলেবাস, শিক্ষাদানে ঘাটতি,  এই ভবিষ্যত প্রজন্মকে জ্ঞানার্জনে পঙ্গুত্ব প্রদান প্রায় নিশ্চিত করবে। হয়তো ছাত্ররা ও সেইভাবে নিয়মিত অফলাইন ক্লাস করতে তত উৎসাহী নয়, শিক্ষকেরা ও অনেকেই এই বিষয়ে তত উৎসাহী নয়। শিক্ষা প্রশাসকদের ও সমস্যা আছে। ক্যাম্পাস ও ক্লাসরুম নিয়মিত পরিষ্কার ও স্যানিটাইজ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

  বাস্তবিক কারণ, সকাল সন্ধ্যা নিয়মিত ক্লাস হলে পরিষ্কার ও স্যানিটাইজ করার সময় মিলবে কখন? আর নিয়মিত স্যানিটাইজেশনের খরচ জোগাবে কে? প্রতিষ্ঠানের বিল্ডিং রিপেয়ারের কোন অর্থ বরাদ্দ নেই, তার ওপর নিয়মিত স্যানিটাইজেশনের খরচ! সরকার হাত তুলে দিয়েছেন। কলেজগুলির ভাঁড়ার ও শূন্য। এই অতিমারিতে অন্য কোন আয়ের দিশা নাই। এর ওপর স্বাস্থ্যবিধি প্রায় শিকেয় উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। প্রত্যেকেই ভয়ে ভয়ে আছেন কবে কে কোথায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সে ছাত্র বা শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী যে কেউ  হোন। তখন হৈচৈ শুরু হয়ে যাবে। তাকে  সামাল দেওয়ার ক্ষমতা কারুর নেই। সেই কারণে এই দায়িত্ব এড়ানোর এই প্রতিযোগিতা। কিন্তু, এই যুদ্ধে আসল ' বলি ' তো হচ্ছে শিক্ষা ও ছাত্র স্বার্থ।
...........
সজল কুমার মাইতি।
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, হুগলী মহসীন কলেজ। পূর্বতন অধ্যাপক, গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন, কলকাতা। চৌত্রিশ বছরের অধিক কাল ইউ জি ও পি জি শিক্ষা দানের অভিজ্ঞতা। বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের বানিজ্য বিষয়ে সিনিয়র সার্ভিসের একমাত্র অধ্যাপক।



জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments