জ্বলদর্চি

রসায়নবিদ ড. ফ্রিৎজ হাবার ― ইতিহাসের এক কলঙ্কিত নায়ক /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪৫

রসায়নবিদ ড. ফ্রিৎজ হাবার ― ইতিহাসের এক কলঙ্কিত নায়ক 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


ছয় ইঞ্চির দুটো বুলেট। দু'বার ফায়ারের শব্দ শোনা গেল। একবার শূন্যে। উড়া ফায়ার। দ্বিতীয়বার শরীরে। তারপর সব শেষ। বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে দ্বিতীয় বুলেট। হৃদয়ের বাম পাশে ধারালো গর্ত। গর্ত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ততক্ষণে গুলিবিদ্ধ শরীরটি অন্ধকার বাগানে নির্জন ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়েছে। বুলেটের শব্দ শুনেছিল বছর বারো'র এক বালক। হারমান। মৃতপ্রায় মহিলার একমাত্র সন্তান। বন্দুকের আওয়াজ শোনা মাত্র সে দৌড়ে বাগানে চলে গিয়েছিল। নীলাভ আধো আলোয় গিয়ে সে দেখে― তার গল্প-বলা মা নরম ঘাসের উপর পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে; দক্ষিণ হস্তে সার্ভিস রিভলবার ধরা। রিভলবারটি তার বাবার। সে আরও দেখে যে, গুলিবিদ্ধ তার মা ক্লারা তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলবার চেষ্টা করছে! কথাগুলি অস্পষ্ট। অক্ষরগুলি জড়িয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে বের হচ্ছে গ্যাজলা। বালকটি সম্পূর্ণ থ বনে যায়; মুখ থেকে রা বের হয় না। অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে জোরের উপর চিৎকার করে ওঠে সে―
'মা-আ-আ'!
ছুটে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মায়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয় সযত্নে। তখনও মৃদু হৃদস্পন্দন অব্যাহত। বড্ড বেশি দেরী হয়ে গেল বোধহয়। শরীর থেকে ধীরে ধীরে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যেতে থাকে। অন্তিম সময় আসন্ন। বারো বছরের হারমান-এর কোলে মাথা রেখে আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তার দুঃখিনী মা। চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ল। এক মূহুর্তে হারমান-এর আকাশটা যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তার দুহাতে রক্তের দাগ। অনবরত কেঁদে চলেছে সে। বাঁধ-ভাঙা কান্না! অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে দু'গাল বেয়ে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারার মতো। মনের অবস্থা তথৈবচ। অন্ধকার সে-নিশুতি রাতে হারমান-এর বুকফাটা কান্নায় সম্বিৎ ফেরে বাড়ির মধ্যে পার্টি-করা লোকজনের। ছেলের চিৎকারে ততক্ষণে ছুটে বাগানে এসে হাজির হয়েছে তার বাবা আর বাবার সকল বন্ধুবান্ধব। জড়ো হয়েছে ঘটনাস্থলে। আকাশে তখন মেঘে-ঢাকা-চাঁদ। তামাটে। ক্ষয়াটে। রাতের তারা'রা ইতস্ততঃ মিটিমিটি আলো জ্বেলে শোক প্রকাশ করছে। সে এক দুঃস্বপ্নের গভীর রাত। ছোট্ট ছেলেটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও জানা নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় অতিথির দল কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হতবাক!

   সে দিনটা ছিল ১৯১৫ সালের পয়লা মে। সন্ধ্যায় জমকালো এক পার্টির আয়োজন করেছিল বাড়ির কর্তা ফ্রিৎজ হাবার। ক'টা দিন আগের কথা। জার্মান সরকার 'ক্যাপ্টেন' উপাধি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছে। দারুণ খুশির খবর। আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই। সে-আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পার্টি রাখা হয়েছে বাড়ির সুসজ্জিত বলরুমে। খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন। সন্ধ্যার আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে গেষ্টরা সব জোড়ায় জোড়ায় হাজির। সকলেই প্রায় বন্ধুবান্ধবের দল। হইহুল্লোড়ে ব্যস্ত। সুরা পাত্র হাতে নিয়ে ছোটখাটো জটলা। মদিরা পান করে কারও কারও শরীরের নিচের অংশ দোদুল্যমান দুলছে। অতিথি অভ্যাগতদের আদর আপ্যায়নে কোনও রকম ত্রুটি নেই। বাড়ির মালকিন মিসেস ক্লারা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু তদারকি করছেন। তাঁর তীক্ষ্ণ নজর সবদিকে ব্যস্ত। সন্ধ্যে পেরিয়ে কখন যে রাত হয়ে গেছে, সে-খেয়াল কারও নেই। রাত একটু গভীর হতে না-হতেই ঘর ছেড়ে সটান বেরিয়ে গেলেন মিসেস ক্লারা। সোজা গিয়ে ঢুকলেন স্বামীর বেডরুমে। হাবার তখন পার্টিতে আনন্দে মত্ত। ড্রয়ার খুলে হাবার-এর সার্ভিস রিভলভারটি হাতে তুলে ধরলেন শ্রীমতী ক্লারা। ক্ষণিকের অন্যমনস্কতা। তারপর সোজা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। বাড়ির পেছনে রয়েছে বিশাল বাগান। বাগানে পৌঁছে আকাশের তারা দেখেন। তারা দেখতে দেখতে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তাঁর। মৃদু নক্ষত্রালোকে কখন যে তাঁর সুন্দর চাঁদপানা মুখখানি ঘিরে আক্রোশের কালো ছায়া ঢেকে দিল, কেউ টের পেল না। রাগ। হ্যাঁ হ্যাঁ চরম রাগ! নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তাঁর। ঘন আঁধারেও তাঁর চোখ থেকে যেন ঠিকরে বের হচ্ছে ক্রোধের আগুন। অবিশ্বাসের চোরা স্রোত। ভুল লোকের সংসারে যেন তাঁর অকস্মাৎ আগমন। লোকটা একটা পিশাচ! রক্ত-খেকো ড্রাকুলা! নরাধম। বদ-স্বভাব কোনও দিন শোধরানোর নয়। আজ নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তাঁর। বিবেকের দংশন কুরে কুরে খায় প্রতিনিয়ত। অথচ দোষ যে করল, সে দিব্যি নিরুত্তাপ। আর দোষ যে সয়, বিবেকের তাড়নায় ছটফট করে মরে সে। এমনই অবস্থা মিসেস ক্লারা হাবার-এর। আর নয়, অনেক হয়েছে সাপ-লুডোর খেলা। এইবার সে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।
      
  এমন সময় সাত পাঁচ না-ভেবে অন্ধকার আকাশের দিকে তাক করে ধরে বন্দুকের নল। প্রথম গুলিটি শূন্যে নিক্ষেপ করল সে। তারপর দ্বিতীয় গুলিটি নিজের বুকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিমেষে ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ল মিসেস ক্লারা। ওই আনন্দসন্ধ্যায় মিসেস হাবার-এর জীবনদীপ চিরকালের মত নিভে যায়। বছর বারোর হারমান অবশ্য বিপদের আঁচ সামান্য আন্দাজ করেছিল। সেজন্য মায়ের পিছু নেয় সে। গুলির শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া মায়ের মাথা নিজের কোলে তুলে ধরে একলা। ততক্ষণে সব আশা প্রায় শেষ। ছেলের কোলে মাথা রেখে চিরনিদ্রায় চলে গেল মিসেস হাবার। ক্লাইম্যাক্স অন্য দিকে মোড় নিল ঘটনার তিন দশক পরে। আরও দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ঘটল ড. হাবার-এর জীবনে। যা বলতে ভালো লাগে না, তা হল যে ওই ছেলেও ১৯৪৬ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।


   প্রশ্ন উঠেছিল― শ্রীমতী ক্লারা কেন আত্মহত্যা করলেন? কী কারণে তাঁদের অল্প বয়সি ছেলেটা নিজে একসময় চরম পথ বেছে নিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করল না? কতটা মানসিক চাপে জর্জরিত হলে দু-দু'টো ফুলের মতো নিষ্পাপ জীবন এমন অকালে ঝরে পড়ল? কী এমন ঘটল যে নষ্ট হয়ে গেল একটা দুজনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ? নিছক রাগ-অভিমান-শোক, নাকি, অন্য কোনও কারণ! সে-শোক-সম্পৃক্ত কাহিনী আজ শোনাব, প্রিয় পাঠক।


   রাষ্ট্রনীতি কী? কে বা কারা স্থির করে একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ? রাষ্ট্রের দুই হেভিওয়েট মাথা― ডিপ্লোম্যাট আর রাষ্ট্রনায়ক। বিশেষ রাষ্ট্রের রীতিনীতি, ভবিষ্যৎ কর্মসূচী অনেকাংশে কূটনৈতিক মতাদর্শের কুক্ষিগত। বিশ শতকে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছিল, ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে কোনটি বেশি ভয়ঙ্কর প্রতিপন্ন হয়, হে পাঠক? বিভৎসতার নিরিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার আগের মহাযুদ্ধকে টেক্কা দেবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তা বলে কি প্রথম মহাযুদ্ধ ধোয়া তুলসী পাতা? ঘরবাড়ি-লোকজন-সম্পদ নষ্ট হয়নি একফোঁটা? বাস্তবে তা নয়। সকল যুদ্ধই কম-বেশি বিয়োগান্তক! শোক-দুঃখ-লোকসান ব্যতীত কোনও যুদ্ধ সম্পূর্ণ হয় না। এতই যদি শোক-হাহাকার-স্বজন হারানোর ব্যথা, তাহলে দেশে-দেশে, দেশের ভেতরে-বাইরে এত যুদ্ধ বাঁধে কেন? এত সব যুদ্ধের জন্য কে দায়ী? দেশের কূটনীতি আর রাষ্ট্রনায়কদের স্বেচ্ছাচারিতা-ই একমাত্র কারণ নয়। যুদ্ধের জয়-পরাজয়ে বিজ্ঞান একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার একটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম। যে-রাষ্ট্রের বিজ্ঞান যত উন্নত, তাদের যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনাও অনেক বেশি। এমন ধারণার হাতে গরম উদাহরণ― দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমার ব্যবহার। যদিও বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করে উর্বর কূটনৈতিক মস্তিষ্ক। কূটনীতিক সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানের নাক গলানোর জায়গা খুব কম। অর্থাৎ, বিজ্ঞান কূটনীতির দাস বনে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। আমেরিকা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলঙ্ক পরমাণু বোমা আবিষ্কার করল পণ্ডিত বৈজ্ঞানিকের দল আর ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহারের সম্মতি দিয়ে দিল ডিপ্লোম্যাটিক কর্তাব্যক্তিরা, বিজ্ঞানীদের হাজার বারণ সত্বেও। পৃথিবীতে প্রথম পরমাণু বোমা প্রয়োগ করে ইতিহাস কলঙ্কিত করেছে আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ আমেরিকার কলঙ্ক। আর সেই কলঙ্কের ভার কিছুটা হলেও বিজ্ঞানীদের ঘাড়ে এসে পড়ে বইকি। খুব জানতে ইচ্ছা করে―দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়-পরাজয়ে যে-বিজ্ঞানের এত ভূমিকা, প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফলে তার কি ছিঁটেফোঁটা প্রভাব ছিল না! চল্লিশের দশকে, পরমাণু বোমার প্রয়োজনে ও বিরোধীতায় বিজ্ঞানীদের তৎপরতা যতটা নজরে পড়ে; প্রথম মহাযুদ্ধে তাদের ভূমিকা, সে অর্থে, কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়। তবে কি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বিজ্ঞান হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ ঠাণ্ডা ঘরে বসে যুদ্ধের তামাশা দেখছিল? ব্লাডি যুদ্ধক্ষেত্রে বিজ্ঞান অবতীর্ণ হয়নি! অবশ্যই কূটনৈতিক ছলচাতুরি বিজ্ঞানকে ল্যাবরেটরিতে দিন রাত ব্যস্ত রেখেছে যুদ্ধের খাতিরে। বিজ্ঞানের সে আবিষ্কারগুলি কতটা ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছিল যুদ্ধ জয়ে, তার ইতিবৃত্তের দলিল বেশ লম্বা। সমালোচনা আর ধিক্কার-ধ্বনি তাদের কর্ণমূল বধির করে রেখেছে। কেউ কেউ অবশ্য 'বিজ্ঞান বিজ্ঞানের জায়গায় সঠিক, কূটনীতি তার কাজ করে। বিজ্ঞান সেখানে হস্তক্ষেপ করবে কেন...' বলে নিজের দোষ এড়িয়ে যান। কিন্তু ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না, ক্ষমা করেনি। বিজ্ঞান ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে তাদের নাম ধিক্কারের সঙ্গে চিরদিন উচ্চারিত হবে।
       

   প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এমনই এক কলঙ্কিত নায়ক ড. ফ্রিৎজ হাবার। রসায়নবিদ। নোবেল লর‍্যিয়েট। আগাগোড়া অত্যন্ত মেধাবী। গবেষণার জগতেও বেশ নামডাক। তবে, দাঁতের ফাঁকে সিগার চেপে একদল তরুণ বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে গবেষণাগারে দিনরাত যে বিষয়ে গবেষণা করতেন হাবার, তা শুনলে শান্তিপ্রিয় মানুষের চোখ সত্যিই কপালে উঠবে সন্দেহ নেই।

   প্রুসিয়া'র অন্তর্গত ব্রেসলে (অধুনা পোল্যান্ডের রকলে)-র এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে এ হেন ফ্রিৎজ হাবার-এর জন্ম ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের নয় তারিখে। তার প্রপিতামহ পোল্যান্ডের কেমপেন-এ একজন প্রসিদ্ধ উলের ডিলার ছিলেন। বাবা সেগফ্রেড হাবার ছিলেন শহরের একজন নামজাদা ব্যবসায়ী। 'ডাই' রঞ্জক পদার্থ, বিভিন্ন রঙ আর ফার্মাসিউটিক্যালস সামগ্রীর ব্যবসা তাঁর। বাড়ির সম্পূর্ণ অমতে সেগফ্রেড নিজের খুড়তুতো বোন পলা হাবার'কে বিয়ে করে ফেলেন। পলা'র গর্ভে জন্ম হয় ফ্রিৎজ হাবার-এর। জন্মের তিন সপ্তাহের মাথায় মা পলা'কে হারায় ছোট্ট শিশু। যখন ফ্রিৎজ-এর বয়েস মাত্র ছ'বছর, বাবা পুনরায় বিয়ে করে। অবশ্য বাবার সঙ্গে কোনও কালে বনিবনা হয়নি তার। ছোটবেলা থেকেই পিতা-পুত্রের জটিল সাংসারিক সম্পর্ক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার সঙ্গে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ে। সে তুলনায় সৎমা হেডিগ হামবার্গার আর তিন সৎবোন এলসা, হেলেন ও ফ্রিডা'র সঙ্গে ভালো সময় কাটে তার।

   ইতিমধ্যে অভিজাত জার্মান সোসাইটির পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়েন সিনিয়র হাবার। নাম, খ্যাতি, যশ বাড়ে। ছোট্ট ফ্রিৎজ জার্মান পরিমণ্ডলে বড় হতে থাকে। জোহান্নেম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় তার। এসব স্কুল ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট আর জিউস― সকল স্টুডেন্টের জন্য দরাজ হস্ত। পড়াশুনার দরজা সব সময় খোলা। কোনও বিধি নিষেধ নেই। প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে এগারো বছর বয়সে ব্রেসলে'র সেন্ট এলিজাবেথ ক্লাসিক্যাল বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায় ফ্রিৎজ। কৃতিত্বের ছাপ রেখে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১৮৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। স্কুলের পাঠ চুকলে'পর বাবার ইচ্ছা পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিক ছেলে। 'ডাই' রঞ্জক পদার্থের ব্যবসায় অ্যাপ্রেনটিস হিসাবে কাজে যোগ দেওয়ার সবরকম ব্যবস্থা পাকা ছিল। বাদ সাধল ছেলে। তার ভাবনা অন্য রকম। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা আপাতত তার লক্ষ্য। সভয়ে বাবা'কে জানাল সে-কথা। মিলে গেল সম্মতি। বার্লিনের ফ্রেডরিখ উইলহেল্ম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেল সে। এখানে ভর্তি হয়ে খুশি নয় ফ্রিৎজ। মনের মত পরিবেশ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শীতকালীন সেমিস্টার (১৮৮৬―১৮৮৭) টেনেটুনে উতরে গেল। ফলাফল হতাশাজনক। ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারে হেডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে; প্রফেসর রবার্ট বুনসেন-এর আয়ত্তে। সেখান থেকে অধুনা বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। ১৮৮৯ সালের গ্রীষ্মে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দেন। এক বছরের জন্য সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে বাধ্যতামূলক যোগ দেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পুনরায় টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে তাঁর ঠিকানা। অধ্যাপক কার্ল লিবারম্যান-এর প্রিয় ছাত্র বনে যায় সে। খুব সুন্দর অরগানিক কেমিস্ট্রি পড়ান লিবারম্যান স্যার। প্রিয় প্রফেসরের ইচ্ছায় ১৮৯১ সালে গবেষণা শুরু করেন। রিসার্চের বিষয় হেলিওট্রপিন, যার অপর নাম পিপারোন্যাল, একটি জৈব যৌগ (C8-H6-O3)। যৌগটি রঙিন গন্ধ পদার্থের একটি উপাদান। এ হেন যৌগ পদার্থের সঙ্গে কার্যকর বিক্রিয়াসমূহ ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। ১৮৯১ সালের মে মাসে ফ্রেডরিখ উইলহেল্ম ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

   ডক্টরেট হয়ে আবার ব্রেসলে'তে ফেরা। বাড়ি ফিরে বাবার ব্যবসায় যোগদান। বাবার পরিচিতির সূত্রে নামকরা রাসায়নিক কোম্পানিগুলি থেকে অ্যাপ্রেনটিসশিপ কাজের অফার আসে। সব অফার ফিরিয়ে দেয়। উল্টে মনস্থির করে আরও কিছু দিন জুরিখের পলিটেকনিক কলেজে কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিছু দিন জুরিখে কাটিয়ে ব্রেসলে ফিরে এসে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেয়। কিন্তু বাবার সঙ্গে বনিবনা হয়ে ওঠে না। শেষমেশ দুজনে বসে ঠিক করে― যৌথভাবে কোনও কাজ করবে না তারা। এবার ফ্রিৎজ যেন মুক্ত বিহঙ্গ। প্রথম পছন্দ শিক্ষকতা। গন্তব্য ইউনিভার্সিটি অব জেনা। প্রফেসর লুডিগ নর-এর স্বাধীন সহকারী হয়ে একাডেমিক পদে যোগ দিলেন তিনি। সেখান থেকে কেমিস্ট্রি প্রফেসর কার্ল এঙ্গলার-এর হাত ঘুরে প্রফেসর হান্স বান্টে'র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে ইউনিভার্সিটি অব কার্লসরুহ-এ যোগদান ১৮৯৪ সালে। এখানে তাপের সাহায্যে হাইড্রোকার্বন (হাইড্রোজেন ও কার্বনের সমন্বয়ে তৈরি জৈব যৌগ) ভাঙার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
       
   ১৮৯৪ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত কাল তিনি অতিবাহিত করেন কার্লসরুহ ইউনিভার্সিটিতে। ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে উচ্চ চাপ আর তাপে হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মিলন ঘটিয়ে অ্যামোনিয়া প্রস্তুত করেন। পরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে বৃহৎ মাত্রায় অ্যামোনিয়া উৎপাদনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। শুধু অ্যামোনিয়া নয়, ল্যাবে আরও অনেক নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগ পদার্থ উৎপাদন করেন, যা সার হিসাবে জমিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। কার্লসরুহ ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে ১৯১১ সালে বার্লিনের ডালহেম ইন্সট্যুট-এ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ও ইলেকট্রো-কেমিস্ট্রি বিভাগে গবেষণার কাজে যুক্ত হন। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন তিনি।

   ইতিপূর্বে বিশ্বের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেছে। ১৮৯৯ আর ১৯০৭ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন বসে। সেখানে গোটা বিশ্বের যুদ্ধনীতি স্থির করা হয়। যুদ্ধে মারণ গ্যাস ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে পণ্ডিতগণ। পরবর্তী সময়ে জার্মানি সেই হেগ-চুক্তি লঙ্ঘন করে আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা করেছে। আর তাতে আগুনে ঘি ঢালার মতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ইতিমধ্যে ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই তারিখে অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরিয়ান মিলিটারী সেনা সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড-এ বোমা বর্ষণ শুরু করলে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সেবছর পয়লা আগস্ট জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে বসে। পুরোদস্তুর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দুটো দেশ। সেই শুরু! তারপর আর থামানো যায়নি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মহাযুদ্ধ।

   এ হেন প্রেক্ষাপটে গোপনে ক্লোরিন গ্যাসের বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে দিয়েছেন ড. হাবার। শুধু ক্লোরিন গ্যাস উৎপাদন করেই হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকেননি তিনি; ভবিষ্যতের কথা ভেবে তৈরি করেছেন তরল ক্লোরিন গ্যাস ভর্তি পাঁচ হাজার সাতশো তিরিশটি গ্যাস সিলিন্ডার। একেকটা সিলিন্ডারের ওজন দু'শত পাউন্ড। এতে অবশ্য খুব লাভবান হল জার্মানি। শত্রু শিবিরে ক্লোরিন গ্যাস প্রয়োগের নেশা পেয়ে বসল জার্মানিকে। কারণ, ক্লোরিন হল সেই বিষাক্ত গ্যাস যা আমাদের নাক মুখ ঠোঁটের কোমল ত্বক নিমেষে পুড়িয়ে দেয়। শ্বাসরোধ করে মারে। চোখের দৃষ্টি চিরদিনের মত নষ্ট করে দেয়। তা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মারণ গ্যাস উৎপাদন করার নেশায় মেতে উঠলেন হাবার। গবেষণাগারে কী কাজ করতেন তিনি? সাদা পৃষ্ঠায় আঁকচিরা কাটতেন দিনরাত। লেখচিত্র আঁকতেন। নতুন নতুন সমীকরণ নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন। কত কম সময়ে বেশি লোক মারা যাবে তার হিসেব লিখে রাখতেন খাতায়। যদি মনে হত যে কম লোক মারা পড়বে; মন খুব খারাপ লাগত তাঁর। উল্টোদিকে, বেশি লোকের জীবননাশের সম্ভাবনা থাকলে আবিষ্কারের আনন্দে যারপরনাই খুশি হতেন।

   বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জোরকদমে মারণ গ্যাস তৈরির গবেষণা চলছিল। দিনরাত খেটে বিজ্ঞানীদের তৈরি করা মারণ গ্যাসের ক্ষমতা যুদ্ধক্ষেত্রে যাচাই করছেন সেনানায়করা। গোলাবারুদ বন্দুকে সুসজ্জিত মিলিটারি সৈন্যসামন্ত এখন আর একা নয়। পিছনে থেকে বিজ্ঞানীরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। 

   সময় বিকেল পাঁচটা। ২২শে এপ্রিল ২০১৫। জার্মানি চলেছে ফরাসি সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। জার্মানির সৈন্যদলের পিছু পিছু যুদ্ধক্ষেত্রে চলেছেন ফ্রিৎজ হাবার আর তাঁর অনুগামী বৈজ্ঞানিকের দল। তাদের সঙ্গে রয়েছে তরল ক্লোরিন গ্যাস ভর্তি কয়েক হাজার গ্যাস-সিলিন্ডার। সম্মুখ সমর শুরু হওয়ার অব্যাহতি পরে জার্মান সেনানায়ক নির্দেশ দিলেন― মুখোশ-পরা সৈন্যরা গ্যাস-সিলিন্ডারের ভালভ খুলে দিক। বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। পরিখার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ফরাসি সেনারা তাদের অস্ত্রসস্ত্র-গোলাবারুদ ফেলে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে শুরু করে। ঠিক সেই সময় জার্মান সেনাবাহিনী ফরাসি পরিখার দখল নিয়ে নেয়। ওইদিন প্রায় পাঁচ হাজার শত্রুসেনা মারা যায়। দশ হাজারেরও বেশি শত্রুসেনা ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতে সন্তুষ্ট নন ফ্রিৎজ হাবার। এত কম ক্ষয়ক্ষতি তাঁর না-পসন্দ। তিনি না-কি আরও বেশি গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। হাবার বলেছিলেন― তাঁর কথা শুনলে সেদিনই হয়তো জার্মানি যুদ্ধে জয়ী হয়ে হত। 

   এ কেমন মানসিকতা! এতটুকু অনুশোচনা নেই। মনখারাপের বালাই নেই! তার বদলে ক্লোরিনের চাইতে আরও ভয়ংকর গ্যাস আবিষ্কারে আগ্রহী হন ফ্রিৎজ হাবার। তাঁর আপাতত লক্ষ্য আরও বিষাক্ত ফসজিন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস তৈরি। ফসজিনের মারণক্ষমতা হাইড্রোজেন সায়ানাইডের চাইতেও মারাত্মক। ১৯১৫ সালের বারোই জুন জার্মান সেনাদল রাশিয়ার রেড-আর্মি বাহিনীকে ফসজিন আর ক্লোরিনের মিশ্রণ দিয়ে আক্রমণ করে। ফসজিন একবার শুঁকেই যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে মারা যায় শত্রু শিবিরের শত শত সেনা। কেবল মানুষ নয়; গাছের মগডালে বসে যে সব পাখি মনের আনন্দে গান গাইছিল, ধপ ধপ মাটিতে পড়ে তারাও সব মারা পড়ল। মেঠো ইঁদুরগুলো আলের পাশে কিংবা মাটির গর্তে মরে পড়ে রইল। সে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি! এমন দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। এ হেন মারণগ্যাস প্রয়োগ কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করে না। যুদ্ধে জয়লাভই বড় কথা, একমাত্র লক্ষ্য! 

   ফসজিনের মারণ ক্ষমতা দেখে খুব খুশি হয়েছেন ফ্রিৎজ হাবার। যুদ্ধ জয়ে হাবার-এর এই অবদানে জার্মান সরকারও গর্বিত। রাষ্ট্র থেকে তাঁকে 'ক্যাপ্টেন' উপাধি দেওয়া হল। বিশ্বের কোনও বৈজ্ঞানিক এর আগে এমন সামরিক উপাধি অর্জন করেননি। বার্লিনে ফিরে এসে হাবার তাঁর বাড়িতে এক জমকালো পার্টির আয়োজন করলেন। বন্ধুবান্ধবদের ডাকলেন। গভীর রাত পর্যন্ত চলল পার্টি। তারপর ঘটে গেল অ্যাক্সিডেন্ট। হাবারপত্নী ক্লারা সুইসাইড করলেন। আনন্দসন্ধ্যা নিমেষে অভিশপ্ত রাত্রি বনে গেল ফ্রিৎজ হাবার-এর জীবনে। কেন আত্মহত্যা করেছিলেন মিসেস হাবার? 

   ক্লারা হাবার ছিলেন বিজ্ঞানের তুখোড় ছাত্রী। ইউনিভার্সিটি অব ব্রেসলে'র প্রথম মহিলা ডক্টরেট তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কেমিস্ট, যার নিজের একটি সুগার ফ্যাক্টরি ছিল। মহিলাদের অধিকার সংরক্ষণে সারা জীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন ক্লারা। তিনি খুব বুদ্ধিদ্বীপ্ত এবং আদ্যোপান্ত নিখুঁত মহিলা ছিলেন। সেই তিনিই বিয়ের পর থেকে ক্রমবর্ধমান ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করলেন। আসলে স্বপ্ন দেখতেন তিনি, বড়মাপের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছে। তাঁর সুপ্ত বাসনা― বিজ্ঞানী হাবার মানুষের কল্যাণে গবেষণা করুন। যখন জানতে পারলেন ড. হাবার বিষাক্ত মারণগ্যাস নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত, তিনি বারণ করেছিলেন। হাবার শোনেননি পত্নীর আপত্তির কথা। বারেবারে তর্কে জড়িয়েছেন দুজনে। গৃহস্থ অশান্তি চরমে ওঠে সামরিক 'ক্যাপ্টেন' উপাধি প্রাপ্তির সংবাদে। হাবারকে ভিন্ন গবেষণায় ফিরিয়ে আনার হাজার চেষ্টা করেও তিনি পারেননি। এ যন্ত্রণা নিয়ে বেশি দিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব হল না ক্লারা হাবার-এর। নিজেকে নিজে শেষ করে দিলেন তিনি। 

   প্রিয় পাঠক, আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করে― স্ত্রীর মৃত্যুর পর হাবার-এর মনের অবস্থা কেমন ছিল? এত বড় দুর্ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? হাবার-এর এক জীবনীকার লিখেছেন― হাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা ইস্টার্ন ফ্রন্টের যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা হয়ে যান। রাশিয়ান সেনার বিরুদ্ধে তিনি মারণগ্যাস ফসজিন আর ক্লোরিনের মিশ্রণ ব্যবহার করবেন। হাবারকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের বয়ান অনুযায়ী― মারণগ্যাস গবেষণায় তিনি দিনের পর দিন ডুবে ছিলেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে। 

   ১১ই নভেম্বর ১৯১৮। যুদ্ধ শেষ হল। জার্মানি পরাজিত। বৈজ্ঞানিক হাবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে শত্রুপক্ষ। তাঁর মাথায় একজন প্রধান যুদ্ধাপরাধীর তকমা। আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁর বিচার হবে। কাঠগড়ায় তোলা হবে তাঁকে। কোথায় তিনি? যে করে হোক তাঁকে ধরতে হবে। হাবারকে খুঁজে বের করতে শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। তাঁর বাড়ির চতুর্দিকে গোয়েন্দারা চব্বিশ ঘণ্টা নজর রেখে চলেছেন। অথচ তাঁর পাত্তা নেই। ওদিকে প্রাণে বাঁচতে ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন ফ্রিৎজ হাবার। মুখভর্তি সাদাপাকা দাড়ি। দূর থেকে দেখলে বোঝা দায়, তিনি ফ্রিৎজ হাবার! ঘর ছেড়ে গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে যত্রতত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। একসময় তাঁর মনে হল, এভাবে বেশি দিন ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। যে কোনও দিন ধরা পড়ে যেতে পারেন। সুতরাং দেশান্তরী হতে হবে। সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে সাময়িক প্রাণে বাঁচলেন তিনি। এদিকে জার্মানির তাঁকে খুব দরকার। দেশ গড়তে হবে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে শিল্প ও বিজ্ঞান পরিকাঠামো নতুন করে আবার গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য ড. হাবারকে প্রয়োজন। তিনি সর্বপ্রথম অ্যামোনিয়ার সফল শিল্পোৎপাদন করেছিলেন ল্যাবরেটরিতে। সার হিসাবে অ্যামোনিয়ার বেশ নামডাক। পরে অ্যামোনিয়া থেকে বিভিন্ন নাইট্রোজেন ঘটিত সার তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এ হেন অ্যামোনিয়া তৈরির সহজ পন্থা আবিষ্কার করে বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে তিনি দারুণ আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেন। আর এই কাজের জন্য রসায়নে ১৯১৮ সালের নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পরের বছর, ১৯১৯-এ তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং, তাঁকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নতি অসম্ভব। জার্মানির সাবেক উন্নয়নে ফ্রিৎজ হাবারকে বেশি করে দরকার।



   প্রবাদ আছে, স্বভাব যায় না ম'লে। তেমনই দশা ফ্রিৎজ হাবার-এর। সুইজারল্যান্ড থেকে জার্মানি ফিরে পুনরায় মারণগ্যাসের গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন বৈজ্ঞানিক। তাঁর খ্যাতি যখন পড়তির দিকে, হল্যান্ডে আশ্রিত কাইজার প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক হাবার-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সচেষ্ট হন। কাইজার-এর গোপন ইচ্ছা― হাবার-এর আবিষ্কৃত নিত্য নতুন মারণগ্যাসের সাহায্যে শত্রুদের পরাস্ত করে যুদ্ধে জিতবেন। অর্থাৎ, কিছু মানুষের কাছে হাবার-এর যথেষ্ট সমাদর তখনও অবশিষ্ট ছিল। অথচ যুদ্ধের বিরুদ্ধে, যুদ্ধে বিজ্ঞানের কার্যকারিতা নিয়ে আজীবন শান্তিপ্রিয় আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে বারবার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন যুদ্ধবাজ হাবার। তবুও নিজের নীতি থেকে একচুল সরে দাঁড়াননি দ্বিতীয়জন। 
    

  বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ফরাসি যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে গেলেন তিনজন পণ্ডিত মানুষ―আইনস্টাইন, সলোভিন আর লাঁজভাঁ। সেখানে তাঁরা দেখলেন, অরণ্যের সৌন্দর্য ধুলোয় মিশে গেছে। বড় বড় সব গাছ ভেঙে পড়ে রয়েছে। একসময় সমাধিস্থলে এসে হাজির হলেন তাঁরা তিনজন। ফরাসি আর জার্মান সেনাদের সমাধি রয়েছে পাশাপাশি। চোখে জল এসে গেল তিনজনের। এ এমন এক জায়গা যেখানে দেশ-কাল-সীমানা-কাঁটাতার মিলে মিশে একাকার। বিষন্ন আইনস্টাইন উচ্চারণ করলেন―
'সকল জার্মান ছাত্রদের একবার এনে এই সমাধিস্থল ঘুরে দেখানো উচিৎ। তাহলে হয়তো তাদের যুদ্ধের মোহ কেটে যাবে। যুদ্ধের বিভৎসতা ওরা বুঝতে পারবে।'

  জার্মানদের উদ্দেশ্যে আইনস্টাইনের এই মানবিক আবেদন কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছিল, প্রিয় পাঠক? একফোঁটা না। কারণ, ভার্সাইল চুক্তির কারণে জার্মানিকে যে প্রচুর সম্পদ হারাতে হয়েছে, অধিকাংশ জার্মান নাগরিক তা সহজে মেনে নিতে পারেনি। সেজন্য, শেষ বিচারে জার্মানির বিপুল পরিমাণ সম্পদ অপহরণের পর্বতপ্রমাণ ক্ষোভের উপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে কোনও শিক্ষা নেয়নি জার্মানরা। তাদের অন্ধ জাত্যাভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। উগ্র দেশপ্রেম আর তিরিশের দশকে স্বৈরাচারী হিটলারের উত্থান তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। যার অবশ্যম্ভাবী পরিনতি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।

  হাবার তখন দেশ গড়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে রয়েছেন। জরিমানা স্বরূপ বিশাল এক সোনার ভাণ্ডার হারাতে হয়েছে তাঁর দেশ জার্মানিকে। সেজন্য তিনি স্বপ্ন দেখতেন সমুদ্রের নোনতা জল থেকে সোনা বানানোর। আধুনিক অ্যালকেমি! সমুদ্রের জলে রয়েছে প্রচুর সোনার ভাণ্ডার। এমন এক উপায় উদ্ভাবন করবেন তিনি, যাতে সমুদ্র জল থেকে সহজে সোনা পাওয়া যায়। বাজার দরের চেয়েও সস্তায়। তাঁর সে-প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কেননা, টন টন সামুদ্রিক জল থেকে সোনা পাওয়া গেল সাকুল্যে মাত্র এক মিলিগ্রাম। তাতে খরচা উসুল হওয়ার নয়। অগত্যা, এ হেন কাজে ইতি টানতে বাধ্য হন তিনি।

  ইতিমধ্যে জার্মানিতে পালাবদলের জোর হাওয়া বইছে। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় বসলেন। শুরু হল ইহুদি নিধন ও বিতাড়ন। যে-জার্মানিকে নিজের প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবাসতেন হাবার, সেই দেশবাসীর চোখে তিনি একজন ইহুদি ছাড়া আর কিছু নন। রাতারাতি তিনি হয়ে গেলেন দেশের শত্রু। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখলেন হাবার। নিজের ইহুদি সত্তা বিসর্জন দিয়ে প্রকাশ্যে নিজেকে খ্রিস্টান ঘোষণা করেছিলেন। তাতেও চিড়ে ভিজল না। নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হল তাঁকে। চলে যেতে যেতে জীবন সায়াহ্নে এক বন্ধুকে নিজের অনুশোচনা ব্যক্ত করে লিখেছিলেন চিঠি―
'এখন মনে হয় সারা জীবন ধরে শুধু ভুল করে গিয়েছি।'
    
  জার্মানি ছেড়ে কেমব্রিজ গিয়েছিলেন হাবার। সেখানে উইলিয়াম পোপ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। পোপ নিজেও একজন মারণগ্যাস বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ প্যালেস্টাইন থেকে কাজের ডাক আসে। যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি তাঁর। অকস্মাৎ ১৯৩৪ সালের ২৯শে জানুয়ারি পঁয়ষট্টি বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ড. ফ্রিৎজ হাবার।

  সবশেষে, প্রথম পরমাণু বোমা যেমন আমেরিকাকে কলঙ্কিত করেছে, তেমনি প্রথম মারণগ্যাস প্রয়োগের কলঙ্ক বইতে হয় জার্মানিকে। এই দুই ঘটনা থেকে আগামী দিনে শিক্ষা নেবে কি কাঁটাতারের বেড়াজালে-আটকে-পড়া বিশ্ব? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

তথ্যসূত্র :
●যে কাজ বিজ্ঞানীদের মানায় না ― শ্যামল চক্রবর্তী
●'মাই লাইফ' ― অটো হান
●Fritz Haber : Biography & Facts ― Britannica
●Fritz Haber's Experiments in life and Death ― History
●The Tragedy of Fritz Haber : The Monster Who Fed the World ― Medium
●Fritz Haber : German Chemist ― Wikipedia, Encyclopedia


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments