জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প (আফ্রিকা)(শেয়ালের প্রশিক্ষণ পর্ব) /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প (আফ্রিকা)

শেয়ালের প্রশিক্ষণ পর্ব 

চিন্ময় দাশ 

বনের জীবদের ভিতর শেয়াল হোল সবচেয়ে ধুরন্ধর। সেটা জানেও সবাই। আর, জানে বলেই, কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। তাতে শেয়ালের কিছু যায় আসে না। সবাইকেই সে বোকা বানাতে চেষ্টা করে। 

   একদিন শিকারে বেরিয়েছে শেয়াল। যেতে যেতে এক বেড়ালের সাথে দেখা হয়ে গেল। একটা গাছের উপর চড়ে বসেছে বেড়ালটা। দুটো ডালের খাঁজে গা এলিয়ে আয়েশ করে শুয়ে আছে। যেন বনের মহারানীতিনি। চোখে পড়তেই, রাগে গা রি-রি করে উঠল শেয়ালের। 
তবে হ্যাঁ, বেড়ালের উপর রাগ করবার যথেষ্ট কারণ আছে শেয়ালের। বেড়াল কেমন দিব্বি তরতরিয়ে গাছে উঠে যায়। দুনিয়ার বাকি সব বিদ্যা শেয়ালের রপ্ত আছে। এই গাছে চড়াটাই কেবল শেখা হয়ে ওঠেনি। 
বেড়ালকে এভাবে আয়েশ করতে দেখে, দাঁড়িয়ে পড়ল শেয়াল। গলা যতটা সম্ভব মোলায়েম করে বলল-- আচ্ছা মাসী, তুমি গাছে চড়ো কেন বলো তো? 
দূর থেকেই শেয়ালকে দেখেছে বেড়াল। দেখেই চোখ বুজে, মটকা মেরে পড়ে ছিল। এখন আড়মোড়া ভেঙে, মুচকি হেসে বলল-- চড়ি কি আর সাধে, বাছা? হাজারটা সুবিধা আছে গাছে চড়বার। 

  শেয়াল অবাক হওয়া গলায় বলল—সে কী, মাসী! বলো কী! হাজারটা সুবিধা? দুটো-একটা বলো তো, শুনি। 
--তাহলে, বলি শোন। বেড়াল বলতে লাগল-- যেমন প্রথমেই ধর, অনেকটা ওপরে পৌঁছে যাই তো! চারদিকটা কেমন পরিষ্কার করে দেখতে পাই। তাতে সময় ভালো কাটে। তার উপর, বড় কথা হোল, কেউ এলে, আগেভাগেই আমি জানতে পেরে যাই, সে বন্ধু না শত্রু। সাবধান হওয়া যাও আগেভাগে। 

  শেয়াল তারিফ না করে পারল না-- সেটা অবশ্য ঠিকইবলেছ তুমি। সুবিধাই হয় তাতে। 
বেড়াল ধমক দিয়ে বলল—কথার মাঝে কথা বলিস না তো। আরও আছে, বলি শোন। বড় সুবিধা হোল, কুকুরের হাত থেকে বাঁচা। হতচ্ছাড়া কুকুরগুলোকে তো জানিস তুই। বেড়াল দেখলেই তাড়া করতেলেগে যাবে।  কেন রে, বাপু। তোদের কোন পাকা ধানে মই চালিয়ে দিয়েছে বেড়াল? চটপট গাছে উঠে পড়া ছাড়া, অদের হাত থেকে রেহাই পাবার, অন্য কোনও রাস্তানাই। 
শেয়াল বলে বসল—মাসী, কী ভিতু গো তুমি। সাপ, পাখি আর ভীতু ছাড়া, কেউ গাছে চড়ে না কি?
খোঁচাটা খুব গায়ে লাগল বেড়ালের। কিন্তু শেয়াল কত ধূর্ত, সেটা ভালোই জানা আছে তার। শয়তানটাকে চটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। গলা নরম করে খানিকটা তোয়াজের মতো করে বলল—সে তুমি বলতেই পার, বোনপো। তোমার পায়ে কত জোর। কুকুরকে তোয়াক্কাই করো না তুমি। দিব্বি সরে পড়তে পারো। কিন্তু অমন জোর কি আর আমার পায়ে আছে? এদিকে, কুকুর আমাদের চিরকালের শত্রু। সাধ করে কি আর গাছে চড়ি? 

  প্রশংসা শুনে শেয়াল ভারি পুলকিত-- তা যা বলেছ মাসী। দৌড়ে আমার সাথে পারবে না কি কুকুরগুলো? 
বেড়াল বলল—শুধু কি তাই? কত বুদ্ধিও আছে তোমার মগজে।এমনি এমনি কি আর তোমাকে পণ্ডিত বলে মানে সবাই? 
প্রশংসা শুনতে, কার না ভালো লাগে! শেয়ালেরও বেশ হোল শুনে। দেমাকের গলায় বলল—আসুক না ধেড়ে শয়তানগুলো। মওকা পেলে, মজা দেখিয়ে দেব একদিন।

  বেড়াল আস্তে আস্তে ফাঁদ পাতছে শেয়ালের জন্য। পরামর্শ দেবার মত করে বলল—পায়ের জোর আর মগজে বুদ্ধি—দুটই আছে তোমার, আমি সেটা ভালোই জানি। তবু কী জানো, বিপদ কখনও কখনও আচমকা এসে পড়ে। তখন মাথা বলো, কি গায়ের জোর, কিছুই কাজ করে না। শিথিল হয়ে যায় সব। তেমন বিপদের সময়, আমাদের এই গাছে চড়ে পড়াটা কিন্তু খুব কাজ দেয়। প্রাণটা বেঁচেযায়। বেঘোরে মরতে হয় না।

  কথাটা বেশ মনে ধরলো শেয়ালের। উদাস গলায় জবাব দিল—ঠিক কথাই তো বলেছ, মাসি। ভালোও লেগেছে বেশ। খুবই কাজের কথা। কিন্তু আমি তো গাছে চড়তে জানি না। দুনিয়ায় এই শিক্ষাটাই নাই আমার। 
ভারী আনন্দ হোল বেড়ালের মনে। কৌশলটা ঠিক রাস্তা ধরে চলেছে। সে তিরষ্কারের গলায় বলল—জানি না, এটা বলা কোনও কাজের কথা নয়, বাপু। জীবনের ধর্মই হোল শিখে নেওয়া। যত দিন বাঁচি, তত দিন শিখি। আমি বাপু, মোদ্দা এই একটা কথাই মেনে চলি।

শুনে, শেয়াল ভারি পুলকিত। বলল—তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে, মাসি?
তিরস্কার করে শেয়াল বলল—আচ্ছা ছেলে তো তুমি? এদিকে মাসি বলছ, ওদিকে বলছ শিখিয়ে দেবে? কেন দেব না? তুমি কি আমার পর? হোলই বা একটু দূরের সম্পর্ক। বোনপো তো বটে। 


  শেয়ালের তো আনন্দ ধরে না। আহ্লাদে ডগমগ। কিন্তু স্বভাবে সে অতি ধুরন্ধর। একটা পুঁচকে বেড়ালের কাছে উপকারনিচ্ছে, এটা আদৌ সম্মানের কথা নয় তার কাছে। বেড়ালকে বেশি গরজ দেখানো যাবে না। 
খুব হালকা গলায় শেয়াল বলল—ঠিক আছে, তুমি নিজের লোক। তোমার কথা ফেলি কী করে? তাহলে, ঐ কথাই রইল। কবে আসব বলো। কবে শেখাবে? 
বেড়াল ভাবল, এ হতভাগাকে বিশ্বাস নাই কোন। মতিগতি যদি পালটে যায়। এমন মওকা ছাড়া ঠিক হবে না। সে বলল—কবে আসব মানে? এখুনি শুরু করো। জীবনে আর যা-ই করো, শুভকাজে দেরী করবে না কখনো। 

  মনে মনে শেয়াল খুব খুশী। কিন্তু মুখে বলল—ঠিক আছে। তাই হোক। শুরুটা আজই না হয় করা যাক। 
বেড়াল গাছ থেকে নেমে এসে, একেবারে গোড়ার কয়েকটা নিয়ম বাতলে দিতে লাগল—যা করবে, মন থেকে করবে। গাছকে ধরবে বেশ আঁকড়ে। নীচের দিকে তাকাবে না একটি বারও। চোখ আর মন থাকবে উপরের দিকে। কত দূর, আরও কতটা উপরে উঠে যেতে পারি, এই হবে মনে প্রাণে একমাত্র চিন্তা। ঠিক আছে, লেগে পড়। শেয়াল পুলকিত মনে গাছের কাছে এগিয়ে গেল। 

  বিড়াল বলল—আর একটা কথা। আমরা তো ছোটবেলাতেই গাছে চড়বার বিদ্যাটা মায়ের কাছে শিখে নিই। তুমি শিখতে এসেছ মাসির কাছে। তাও আবার এই ধাড়ি বয়সে। সহজেই শেখা হয়ে যাবে, ভেবো না। সময় লাগবে এতে। কষ্টও সইতে হবে একটু। এটা ভুলে গেলে, বিদ্যা রপ্ত করতে পারবে না।

এত কথা শুনে, শেয়াল এবার ভারি বিরক্ত—অনেক হয়েছে। তোমার ভাষণ থামাও। গাছে চড়তে দাও আমাকে। 
বলেই, গাছে ওঠা শুরু করল সে। আসলে হয়েছে কী, ছাত্র হিসাবে শেয়াল মোটেই সরেস নয়। তাছাড়া শেয়ালের থাবাও খুব ভোঁতা। শক্ত করে গাছ আঁকড়ে ধরা সহজ কাজ নয়। পায়ের নখগুলোকেও ব্যবহার করতে হবে, সে কথাটা ইচ্ছে করেই শেয়ালকে বলে দেয় নি বেড়াল। তার তো আসল ফন্দি হতভাগাকে একটু শিক্ষা দেওয়া। তাছাড়া, শেয়াল যদি গাছে চড়তে শিখে যায়, তাতে সবচেয়ে বেশি বিপদ তো বেড়ালেরই। তখন তো আর গাছে চড়েও রেহাই পাওয়া যাবে না শয়তানটার হাত থেকে। 

  শেয়াল খানিকটা না উঠতেই ধপাস করে পড়ে গেল। আবার উঠল, আবার পড়ল। কয়েক বার ধরে, একই অবস্থা। বেড়াল তো বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখছে। এটাই চাইছিল সে। শেয়াল যাতে নাকানি চোবানি খায়। 
মনের ভাব মনে চেপে, বেড়াল বলল—হাল ছেড়ে দিও না, বাছা। কষ্ট একটু হবেই। সে তো আমি আগেই বলেছি। আমাদেরও হোত। কিন্তু সঙ্কটের সময়, প্রাণটা বেঁচে যাবে, এটা ভুলে যেও না। 

-- না না, মাসি। হাল ছাড়বার পাত্র আমি নয়। বলতে বলতে আবার উঠতে লাগল শেয়াল। ঘষটে ঘষটে এবার বেশ খানিকটা উঠে পড়েছে। কিন্তু শুধু থাবার বাঁধনে কি ভারি চেহারা বেঁধে রাখা যায় গাছের গুঁড়িতে? বেড়াল তাকে নখ লাগাতে শিখিয়েই দেয়নি। 
যা হবার, সেটাই হোল।একেবারে চিৎপটাং হয়ে মাটিতে পড়ে গেল বেচারা। শক্ত করে গাছ আঁকড়ে ধরা ছিল। তাতে শুকনো ছালের খোঁচা লেগে, তার বুক আর পেট ছিঁড়ে গিয়েছে। 

  এভাবে আকাশের দিকে চার পা তুলে আছড়ে পড়তে দেখে, নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না বেড়াল। ফিক ফিক করে হেসে উঠল সে। 
তাতে ভয়াণক রাগ চড়ে গেল শেয়ালের মাথায়। আজই শেষ দিন শয়তানির। হয়রানি করবার মজা দেখিয়ে দিচ্ছি এখুনি। আজই তোর শেষ দিন। 

  মাটি থেকে উঠেই এক লাফ। মূহুর্তের মধ্যে ঘটে গেল ব্যাপারটা। বেড়াল বুঝে গিয়েপালাতে চাইল বটে, একটু দেরি হয়ে গিয়েছে তাতে। শেয়াল তার অইছনের একটা পা কামড়ে ধরে ফেলেছে। বেড়ালও বুঝে গিয়েছে, আজই আমার শেষ দিন। ছিঁড়ে ফালাফালা করে দেবে এখুনি। 
কিন্তু যীশু রাখে, তো মারে কে? ঠিক তখনই একপাল কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শোনা গেল। শেয়ালের দিকে দৌড়ে আসছে কুকুরগুলো। শেয়াল চোখে পড়লে, কুকুর কবে আর করে চুপ করে থাকে? 
এদিকে কুকুরের গলা কানে যেতেই, চমকে উঠল শেয়াল। কী সর্বনাশ! এতগুলো সাক্ষাৎ যম হাজির! দাঁত আলগা হয়ে গেল। বেড়ালের পা ছেড়ে, চোঁ-চোঁ করে লম্বা দৌড় লাগাল প্রাণ বাঁচাতে। 
কিন্তু কুকুর হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তারা তাড়া করে যেতে লাগল পিছন পিছন। 
শেয়ালের সেদিন কপাল ভালো বলতে হবে। কুকুরগুলো এসে পড়বার আগেই, সামনে একটা গর্ত চোখে পড়ে গেল। কিসের গর্ত, কারই বা গর্ত,ভাববার সুযোগ কোথায়? সুড়ুৎ করে গর্তটায় ঢুকে পড়তে পারল বেচারা। বেঘোরে মরতে হোল না আজ।

   কী আর করে কুকুরগুলো? খানি ফোঁস ফোঁস করে, ফিরেই যেতে হোল তাদের। গর্তে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে থাকতে, আবার বেড়ালটার কথা মনে পড়ল শেয়ালের। ভালো মতন শিক্ষা দিতেই হবে ওকে। 
গর্ত থেকে একটুখানি মুখবের করে, চার দিক ভালো করে জরীপ করে নিল প্রথমে। কেউ কোথাও নাই। বীরের মত এসে হাজির হোল গাছটার কাছে। 
শেয়াল ফিরে আসবে, বেড়াল জানতো ভাল করে। সে আগেভাগেই মগডালে উঠে বসে আছে। শেয়ালকে দেখেই হি-হি করে হেসে দিল ওপর থেকে।গায়ে জ্বালা ধরে গেল শেয়ালের। কিন্তু করবার কিছু নাই। উল্টে নিজেরই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। 

  বেড়ালই ওপর থেকে বলল—দেখলে তো,বিদ্যেটা কেমন কাজ দেয়। কোন কিছু শিখতে গেলে, অত ভয় পেতে নাই। হাল ছেড়ে দিতে নাই। পণ্ডিত হয়ে, এটুকু বিদ্যাও নাই পেটে। কেন যে সবাই তোমাকে পণ্ডিত বলে, বুঝি না, বাপু। আর হ্যাঁ, গুরুর ওপর রাগও করতে নাই। এটাও মাথায় রেখো। বলেই আবার হি-হি হাসি। 
একে কাটা ঘা, তায় মগডালে বসে নুনের ছিটে দিচ্ছে শয়তানি। গা পুড়ে যাচ্ছে রাগে। ঠিক আছে, আজ পার পেয়ে গেলি। মওকা আমি এক দিন পাবোই। ভাবতে বাবতে চলে গেল শেয়াল। 

   শেয়াল আর বেড়ালের বিবাদ চলছে সেই থেকে। একেবারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক যাকে বলে। কেবল আফ্রিকা দেশে নয়, দুনিয়ারযে কোনও দেশেই এক ব্যাপার। শেয়াল দেখলেই, সামনে যে গাছই চোখে পড়ুক না কেন, তরতরিয়ে উঠে পড়ে বেড়ালেরা। শেয়ালরাওতক্কে তক্কে থাকে, কখন বাগে পেয়ে যাবে বেড়ালকে। নাকানি-চোবানি খাওয়াবার শোধটা তুলতেই হবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব মজা পেলাম গল্পটা পড়ে 😄

    ReplyDelete