সময়াদকীয়,
‘মোরা ছুটব, মোরা খেলব, বসে কুঁড়ে হয়ে থাকব না। ছাতি ফাটবে, মাথা ভাঙবে, তবু খেলা ছেড়ে উঠব না!’ কে লিখেছেন জানো? গুরুসদয় দত্ত। উনি ছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের সময় স্কুলে স্কুলে ব্রতচারী ছিল। তাই তো, তোমরা স্কুল না গেলে কেমন করেই বা জানবে এসব কথা। তবে, এসব প্রয়োজনীয় জানা অজানা কথা উপন্যাসের মধ্যে অপূর্ব ভাবে বলে রতনতনু জ্যেঠু ফুলকুসুমপুর খুব কাছে লিখছেন। আমিও তোমাদের মতো কতো ভুলে যাওয়া জানা কথাগুলো মনে করে নিচ্ছি। আবার বলি, কুঁড়েদের কথা। কুঁড়েরা কেমন হয় জানো? ঐযে পি পু ফি সু র মতো। সেটা একদম ঠিক বলেছে মৌসুমী মাসি তার গল্পে। ঋভুর কথা মতো তোমরা কুঁড়েমি না করে রোজ প্রাণায়াম করবে কেমন? নাহলে ভানুপ্রিয়া দিদির ঘোষ স্যারের মতো মট্টু হয়ে যাবে। কখন প্রাণায়াম করবে? আরে পলাশ জ্যেঠু ছড়ায় যেমন লিখেছেন, রোজ ভোরে সূর্য যখন লাল টুকটুকে গাল নিয়ে ওঠে ঠিক তখন। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি। শীতের সকালে তোমাদের ঘুম থেকে উঠতে বলছি বলে তোমরা রেগে গেছো আমার ওপর। আর যদি বলি, শীতকাল এসে গেলো, চলো কোথাও ঘুরে আসি। তাহলে নিশ্চয়ই আনন্দে লাফিয়ে উঠবে? হ্যাঁ, তোমাদের আনন্দ দিতে এবার থেকে প্রতি রবিবার বাসবদত্তা আন্টি বলবে ভ্রমণের গল্প। শুধু বেড়াতে গেলেই কিন্তু হবে না। ছবি তোলা চাই। দেখছ না অপু দাদা কত সুন্দর একটা নদীর ছবি তুলে উপহার দিয়েছে আমাদের। শেষ করার আগে আরো একটা কথা মনে করিয়ে দিই, ৩ রা ডিসেম্বর ছিল ক্ষুদিরামের জন্মদিন। বাকিটা বলবেন পীযূষ আঙ্কেল। এবার তোমরা চটপট লিখে ফেলো অসিতাভ, অনুশ্রুতি, পৃথা আর তুলিকার আঁকা তোমাদের কেমন লাগলো। - মৌসুমী ঘোষ।
ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ২৬
রতনতনু ঘাটী
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমে পড়ল ফুলকুসুমপুর গ্রামে। যদিও ফুলকুসুমপুরের রাস্তায় ইলেক্ট্রিকের আলো আছে, তবু সন্ধে নামলে কেমন এক আশ্চর্য আলো-আঁধারি খেলা করতে থাকে গাছে-পালায়। যে কুঁড়ির রাতে ফুল হয়ে ফুটে ওঠার কথা, সেও সন্ধেবেলাতেই আনমনা হতে শুরু করে। আর যে ভোরের ফুল নিয়ে কবিরা কবিতা লেখেন, সেই ভোরের ফুল কখন যে রাত থাকতে-থাকতেই ফুটে উঠেছে, সে নিজে টেরই পায় না।
অনিচ্ছে ঠাকুরমা যে কথাটা দাদুকে বলতে সাহস পেলেন না, সে কথাই ছোট্ট বুম্বাকে বলার জন্যে ডাকলেন, ‘হ্যাঁ রে বুম্বা, বিলম্ব তো এখনও এল না? ও তো সন্ধের পর ভূতের ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে সব সময়। ও একটা কী করে বাড়ি ফিরবে বল তো?’
বুম্বা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল খানিক। ঠাকুরমা গলাটা নিচু করে বললেন, ‘ওর আসার পথের দিকে তোতে-আমাতে খানিক এগিয়ে যাবি নাকি?’
বুম্বা বলল, ‘ঠাকুরমা, দাদু দেখতে পেলে আর রক্ষে থাকবে না! এখনই পড়ার ঘরে সকলকে যেতে বলেছেন। আজ নাকি কবিতা আবৃত্তির ক্লাস নেবেন ইচ্ছেদাদু।’
ঠাকুরমা চোখ দুটো ভুরুর দিকে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাই নাকি?’
বুম্বাও তেমনই চোখ দুটো বড়-বড় করে বলল, ‘ও মা, তোমার মনে নেই ঠাকুরমা, আজ সকালে আমাদের গান্ধী আশ্রমে যাওয়ার কথা ছিল বলে ফোন করে বিপদভঞ্জনস্যারকে দাদু সকালে আসতে না বলে দিয়েছিলেন। আমাদের ক্লাস গোটা একটা দিন বন্ধ থাকবে তা তো হয় না। তাই দাদু সন্ধেবেলা আবৃত্তির ক্লাস নেবেন!’
‘তবে শুনেছি,’ অনিচ্ছে ঠাকুরমা বলতে লাগলেন, ‘তোর ইচ্ছেদাদু যখন স্কুলে পড়তেন, তখন ফুলকুসুমপুরে কোনও স্কুলই ছিল না। দাদুকে পড়তে যেতে হত অনেকটা দূরের মোহিনীমোহন হাই স্কুলে। ভাল আবৃত্তির জন্যে তোর দাদুর খুব নাম ছিলা! উনি তখন গুরুসদয় দত্তর দেশাত্মবোধক কবিতাই বেশি আবৃত্তি করতেন। সে ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের কথা! সেই যে কবিতাটা---‘মোরা ছুটব, মোরা খেলব, বসে কুঁড়ে হয়ে থাকব না। ছাতি ফাটবে, মাথা ভাঙবে, তবু খেলা ছেড়ে উঠব না!’
বুম্বা গালে হাত দিয়ে বলল, ‘এ কী গো ঠাকুরমা? এ কবিতায় খেলা ছেড়ে ওঠার কথাই নেই। তা হলে পড়াশোনা হবে কখন?’
ঠাকুরমা বললেন, ‘খেলাধুলোতে শরীর গঠন হয়। পড়াশোনা তো থাকবেই।’
এমন সময় নীচে বিলম্বদাদুর গলা পাওয়া গেল। তা শুনে দাদু গম্ভীর গলায় দোতলা থেকে হুঙ্কার দিলেন, ‘বিলম্ব, এই কি তোর বাড়ি ফেরার সময় হল রে, হনুমান কোথাকার! তোকে এবার তোর মতো করে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে হবে!’
ততক্ষণে বিলম্বদাদু দোতলায় উঠে এসেছে। অনিচ্ছে ঠাকুরমাকে সামনে দেখতে পেয়ে বলে উঠল, ‘আপনি বলেন তো বড়মা, বড়বাবুর এ কী কথার ধরন হল? সব সময় এ বাড়িতে থাকা নিয়ে ঠেস দিয়ে কথা বললে কার আর এ বাড়িতে থাকতে ভাল লাগে বলুন? আমি এ বাড়িতে পড়ে আছি শুধু ছেলেমেয়ে ক’টার জন্যে! এদের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারছি না তো! তা যদি পারতাম, তা হলে কবেই কেটে পড়তাম!’
এবার অনিচ্ছে ঠাকুরমার গলায় দুঃখ ঝরে পড়ল, ‘সে কী রে বিলম্ব? আমার জন্যে তোর একটুও মায়া-মমতা নেই?’
নিজের ভুল শুধরে নিল সঙ্গে-সঙ্গে বিলম্বদাদু, ‘এ কি অলক্ষুনে কথা গো বড়মা! আপনের জন্যে মায়া-মমতা হবে না, এ কী হয়? এ কি গলা বড় করে বলার অপেক্ষা রাখে নাকি? আপনি ভালবাসেন বলেই না এ বাড়িতে আমি পড়ে আছি! না হলে কবেই তেমোহানি সাঁতরে নিজের দেশে চলে যেতাম।’
বুম্বা ফুট করে কথা ছুড়ে দিল, ‘ওই নদীর নামটা তো সকলে জানে। কিন্তু তোমার দেশটার নাম কেউ কখনও শুনেছে বলে তো মনে হয় না।’
বিলম্বদাদু গলায় কান্না ঝরিয়ে বলল, ‘তুমিও আমাকে দাগা দিয়ে কথা বলবে বুম্বাদা? নাঃ! কাল সকালেই আমাকে আমার পথ দেখে নিতে হবে!’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘নাঃ! ঠিক কালই বা কেন বড়মা? সরস্বতী প্রতিমা বায়না করেই এসেছি যখন, তখন এবারের সরস্বতী পুজোটা ভালয়-ভালয় মিটে যাক। তাপরের দিনই যেদিকে দু’ চোখ যায়...’
বুম্বা হাসতে হাসতে বলল, ‘ততদিনে তোমার রাগ জল হয়ে যাবে! এ বাড়ি ছেড়ে আর তুমি যেতে পারবেই না!’
অনিচ্ছেঠাকুরমা বললেন, ‘ততদিনে তোর দাদুরও রাগ আর থাকবে না। বিলম্বকে এক পলক দেখতে না পেলে যিনি অস্থির হয়ে ওঠেন, অতদিন কি আর তিনি রাগ ধরে রাখতে পারবেন? মনে তো হয় না!’
বিলম্বদাদু অকারণে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলল, ‘তবে বড়মা, বড়বাবু কিন্তু মানুষটি বড় ভাল! মনে কখনও রাগ পুষে রাখতে পারেন না।’ তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, ‘না হলে কি আর মানুষ এমনি এমনি অত বড় হয় গো?’
বুম্বা বিলম্বদাদুর এই গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার মানে বুঝতে বাকি রইল না। এ আসলে বুম্বাকে খুশি করার জন্যে এক রকমের ঘুষ দেওয়া ছাড়া আর কী?
এমন সময় ইচ্ছেদাদুর গলা ভেসে এল, ‘বুম্বা, তুমি এখনও আসতে পারলে না আবৃত্তির ক্লাসে? যে মানুষটা সারা জীবন সব কাজে দেরি করে বলে তার নাম ‘বিলম্ব’ ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে? তুমি ওর সঙ্গে থেকে বিলম্বের গুণটাই রপ্ত করতে চাইছ নাকি?’
বুম্বা দৌড় শুরু করার আগে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি এক্ষুনি আসছি দাদু! এক্ষুনি!’
আবৃত্তির ক্লাসে পৌঁছতেই দাদু ঘোষণা করলেন, ‘আজ ক্লাসের প্রথম কবিতা আবৃত্তি করবে বুম্বা!’
বুম্বা আবৃত্তি করার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বার কয়েক ঢোক গিলল। তারপর অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘খুকু ও খোকা’ কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করল:
‘তেলের শিশি ভাঙল ব’লে
খুকুর ’পরে রাগ করো।
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো!
তার বেলা?’
আরও খানিকটা আবৃত্তির পর দাদু হাত তুলে বুম্বাকে থামিয়ে দিয়ে ভরাট গলায় বললেন, ‘শাবাশ, বুম্বা! আমি জানতাম, তুই এই কবিতাটাই নির্বাচন করবি!’
ইচ্ছেদাদুর সামনে কবিতা নির্বাচনের কৌশলটা শুধু বুম্বা একাই নয়, আজকের আবৃত্তির ক্লাসের সক্কলেই জানে। সে কৌশলটা আর কিছুই নয়। দাদুর সবচেয়ে পছন্দ হল দেশাত্মবোধের কবিতা। দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি করলেই দাদুর মন জয় করা কুব সহজ।
এর পর দাদু তিন্নির দিকে তাকিয়ে হাত তুলে শুরু করতে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এবার তিন্নি!’
তিন্নি গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে শুরু করল—‘আমি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর একটা কবিতা বলছি। বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলোক-বলা কাজলাদিদি কই?/ পুকুর ধারে লেবুর তলে,/থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে/ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই,/মাগো আমার কোলের কাছে কাজলাদিদি কই?’
দাদু উদাস ভঙ্গিতে শুনছিলেন তিন্নির আবৃত্তি। বললেন, ‘আঃ! মনটা ভরে গেল রে!’ তারপর একটু থেমে থেকে বললেন, ‘তিন্নি তুই শুরর সময় ‘একটা কবিতা’ বললি কেন? ‘একটি’ কবিতা বলতে শিখিসনি? ‘একটা’ বললে কীরকম একটা তুচ্ছতার রেশ জড়িয়ে যায় না? এর পর থেকে ‘একটি’ বলবি, কেমন?’
দাদুর কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিল তিন্নি। দাদুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এবার দাদু বললেন, ‘শুরু কর বিন্নি, কোন কবিতা তোর নির্বাচনে?’
বিন্নি বলল, ‘দাদু আমি একটি ছোট্ট কবিতা বলব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা ‘স্বাধীনতা’---‘শর ভাবে, ছুটে চলি, আমি তো স্বাধীন!/ ধনুকটা একঠাঁই বদ্ধ চিরদিন।/ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা--/আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা।’
ইচ্ছেদাদু হাততালি দিয়ে উঠলেন, ‘আঃ! কী সুন্দর! তুই কবিতাটি বললিও চমৎকার!’
এমন সময় অনিচ্ছে ঠাকুরমা এসে ঢুকলেন আবৃত্তির ক্লাসে। হাসতে হাসতে দাদুকে বললেন, ‘ছোটরা কবিতা আবৃত্তি করল, তুমিও একটি কবিতা শোনাও না!’
দাদু বললেন, ‘তুমি কী যে বলো অনিচ্ছে, এই বুড়ো বয়সে কবিতা বলব?’
ঠাকুরমা বললেন, ‘কবিতা বলার আবার বয়স লাগে নাকি? তুমি যেসব দেশপ্রেমের কবিতা বলে ছেলেবেলায় পুরস্কার পেতে, তার থেকে একটি কবিতা শোনাও। ওরা কখনও তো তোমার আবৃত্তি শোনেনি?’
ইচ্ছেদাদু হাসতে-হাসতে বললেন, ‘এখন আর অত স্মৃতিশক্তির জোর নেই, বুঝলে অনিচ্ছে।’
বুম্বা অনুরোধের গলায় বলল, ‘দাদু, তোমার কবিতা শুনবই। কবিতা বলো!’
অগত্যা ইচ্ছেদাদু শুরু করলেন, ‘কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি বলার চেষ্টা করছি। জানি না সবটা মনে পড়বে কিনা। আটকে গেলে তোরা হাসিস না যেন?’
এই কথাতেই সকলে হি-হি করে হেসে উঠল। এর পর ইচ্ছেদাদু শুরু করলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?/মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন/মানুষ হইতে হবে এই যার পণ/ বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান/ নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ/ হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?’---এই পর্যন্ত বলে দাদু আটকে গেলেন। লাজুক মুখ করে বললেন, ‘এই যাঃ! আর তো মনে পড়ছে না!’
অনিচ্ছে ঠাকুরমা এর পরের লাইনটা বলে দিলেন, ‘চেতনা রয়েছে যার সে কি পড়ে রয়?’
সঙ্গে-সঙ্গে ইচ্ছেদাদু উঠে পড়লেন, ‘আজ এবার আবৃত্তির ক্লাস বন্ধ হোক। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে!’ বলে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক পাড়লেন, ‘কই গো মাধুরী, খেতে দাও! সেই কখন গান্ধী আশ্রমে দু’ মুঠো ভাত খেয়েছি।’
অনিচ্ছে ঠাকুরমাও উঠে পড়লেন, ‘চলো!’
সকলে চলল খাওয়ার টেবিলের দিকে। পরিপালনকাকু চিড়িয়াখানার মেম্বারদের খাইয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাবেন বলে দাদুর কাছে অনুমতির ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি আজ আসি বড়বাবু?’
ইচ্ছেদাদু পরিপালনকাকুকে বললেন, ‘যাবে তো যাও! তবে একটা কথা শুনে যাও, আমাদের ফুলকুসুমপুর স্কুলমাঠের পাশে এবার গ্রামীণ কৃষিমেলা বসছে, শুনেছ তো? টানা তিন বছর এই মেলা বন্ধ ছিল। তা এবার তিনদিনের সেই মেলায় আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বারদের নিয়ে একটা স্টল দেওয়া হবে। আমি অহেতুকপুর পঞ্চায়েত প্রধানকে ফোন করে বলেছি, একটা স্টলের জন্যে। গল্পকাকা তো ওই পঞ্চায়েত অফিসেই কাজ করে। ও স্টল পাওয়ার জন্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। শুধু ওকে মাঝে-মাঝে মনে করিয়ে দিতে হবে, এটাই তোমার কাজ। গল্পকাকার যা ভুলো মন!’
একটু থেমে দাদু বললেন, ‘তা ছাড়া, পরিপালন, তুই তো আমাকে বলেছিলি ‘বড়বাবু, আমার খুব ইচ্ছে, আমাদের অহেতুকপুর অঞ্চলে যখন কৃষিমেলা আর পুষ্প প্রদর্শনী বসবে, তখন আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার জন্যে শুধুকাকাকে দিয়ে একটা স্টল নেবেন। আমাদের রাধাগোবিন্দ, মিঁউ, বিংগো আর কুমিকে নিয়ে যাব স্টলে। স্টলটার ভিতরে একসঙ্গে ওরা ছাড়াই থাকবে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে ঝগড়া বা মারামারি করবে না, একসঙ্গে মিলমিশ করে থাকবে, খুনসুটি করবে বটে। তবে তা দর্শকদের কাছে ভারী মজার ব্যাপার হবে। তখন দেখবেন, মেলার সব লোকই এসে ভিড় করবে আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার স্টলের সামনে। চারদিকে আমাদের চিড়িয়াখানার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।’
পরিপালনকাকা ঘাড় নেড়ে সায় বললেন, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম তো!।’
গল্পকাকা দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবা, আমি মনে করে স্টলের বুকিং করেই ফেলেছি। এখন স্টল কেমন করে সাজানো হবে, সে তুমি আর পরিপালন মিলে ঠিক করো! পারলে শুধুকাকাকেও সঙ্গে নিও। আমি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে জানানোর ব্যবস্থা করছি।’
মিডিয়ার কথা শুনে বুম্বা বিন্নিদির মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা ইঙ্গিত করল। বিন্নি কোনও উত্তর দিচ্ছে না দেখে বুম্বা গল্পকাকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মিডিয়া মানে কি টিভির লোকজনও আসবে?’
গল্পকাকা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘চেষ্টা তো করব ওদের আনতে!’
দাদু বললেন, ‘খামোখা মিডিয়া-টিডিয়াকে বলতে যাবি কেন? এ তো আমাদের ত্রিপাঠী বাড়ির নিজেদের ব্যাপার? ওসব ঝামেলায় গিয়ে কাজ কী?’
ততক্ষণে বড়বাবু আর শুধুকাকা কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। সামনে গল্পকাকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ রে গল্প, আমরা নাকি এবার গ্রামীণ কৃষিমেলায় স্টল নিচ্ছি? লোহাপুলের ওদিকে লোকজনের মুখে কানাঘুষো শুনে এলাম?’
‘হ্যাঁ, নিচ্ছিই তো। বাবা বলেছেন। আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বাররা এত ভাল, সকলে এমন মিলমিশ করে ছাড়া হয়ে থাকে বাড়িতে, এটা লোকে শুনলে বিশ্বাস করতে চায় না। এ কি আমরা বানিয়ে-বানিয়ে বলি নাকি? আজই গান্ধী আশ্রমে নিজের কানেই তো শুনলে, অনন্ত দণ্ডপাট এ নিয়ে কত প্রশংসা করলেন।’
শুধুকাকা বললেন, ‘আমাকে এ ব্যাপারে কিছু কাজ তো করতে দাও দাদা! আমি তা হলে খবরের কাগজকে ডাকার দায়িত্বটা নিচ্ছি? আমার স্কুলের বন্ধু দীপজয়ের দাদা এখন বড় খবরের কাগজের নিউজ এডিটর। আমি দীপজয়কে দিয়ে বলাব। তখন নিশ্চয়ই ওরা আমাদের নিউঝটা কভার করতে রিপোর্টার পাঠাবে।’
ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন গল্পকাকা। ঠাকুরমা বললেন, ‘তোরা সব খাওয়ার টেবিলে চলে আয়। তোর বাবার খুব খিদে পেয়েছে!’
ইচ্ছেদাদু বিরক্ত মুখে বললেন, ‘অনিচ্ছে, তুমি সব সময় যে-কোনও জরুরি কাজে বাগড়া দাও কেন বলো তো? এখন একটা জরুরি বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে। খাওয়াটা কি বড় হয়ে গেল?’
ঠাকুরমা মিচকে হাসি চেপে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। এবার দাদু বললেন, ‘চল, আমরা সকলে না হয় খেতে-খেতে এ নিয়ে একটা প্ল্যান রেডি করে ফেলি? ছোটরা সকলে চলো!’
অনেক কথার পর ঠিক হল, হযবরল চিড়িয়াখানা এবার যেন অহেতুকপুর গ্রামীণ কৃষিমেলায় একটা মস্ত হইচই ফেলে দিতে পারে। সেইমতো সকলকে উদ্যোগ নিতে হবে।
হঠাৎ বিন্নি গল্পকাকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের বাড়ির নাম গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইতে উঠবে না? তুমি যে মাকে একবার একবার বলেছিলে?’
ইচ্ছেদাদু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সে চেষ্টাটাও তো করতে হবে রে! আমি একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম! ভাগ্যিস বিন্নিটা ঠিক সময়ে মনে করিয়ে দিল!’
বুম্বা চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘আমাদের বাড়ির নাম গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইতে উঠবে? সত্যি বলো না গল্পকাকা!’
কী মনে হল বুম্বার কে জানে? সে দাদুর এ কথার উত্তরে এঁটো হাতে চিৎকার করে উঠল, ‘বিন্নিদি, হিপ হিপ হুররে!’
তিন্নি, বিন্নি আর বুম্বা ঘুমোতে গিয়ে তাদের বড় খাটের এদিক থেকে ওদিকে গড়াগড়ি খেতে লাগল আনন্দে! অনিচ্ছে ঠাকুরমার রাধাগোবিন্দ কী বুঝল কে জানে! এদের হট্টগোলে তার হয়তো ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে বারান্দার সিলিং ফ্যানের ব্লেডের উপর বসে ঢুলছিল। এবার আনন্দে ‘ট্যাঁ-ট্যাঁ’ করে ডেকে উঠল।
বুম্বা তিন্নিকে বলল, ‘কী যে মজা হবে রে তিন্নিদি, আমার এখন থেকে ভেবে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে রে!’
তিন্নির কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না। বুন্বা ভাবল, তিন্নিদি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এরকম রোমাঞ্চকর ঘটনা আলোচনার সময় কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে? এ কথা ভাবতে-ভাবতে একটু পরে বুম্বাও ঘুমিয়ে পড়ল!
0 Comments